প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৫৫

0
3056

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রাজন শিকদারের পায়ের সাথে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে আয়েন্দ্রি। তার শান্ত দুই চোখের পক্ষ্মচ্ছায়া সিক্ত হয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ, শীতল নহর। রাজন শিকদার নির্বিকার। তার টলটলে দুই আঁখিযুগলে হাজারো অব্যক্ত কথার ছড়াছড়ি। কিন্তু স্বরনালি সায় দিচ্ছে না। আয়েন্দ্রি মাথাটা উঠিয়ে ভেজা গলায় বলল —

“আপনিই বলুন না দাদু, কী করে থাকব এমন একটা মানুষের সাথে আমি? বলুন না দাদু।”

রাজন শিকদার পলক ঝাঁকালেন। আয়েন্দ্রির অসহায় কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য বিদীর্ণ করে দিচ্ছে রাজন শিকদারকে।
আয়েন্দ্রির চোখের জলে সয়লাব তার কপোল, চিবুক। নাকের ডগায় জমেছে শ্বাস। নাক টেনে টেনে, ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বলল—

“ও তারাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। ওর মন, মস্তিষ্কে তারা এমনভাবে গেঁথে আছে তার সামনে ও কিছুই অনুভব করতে পারে না। আর এ সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। আমার ওর জীবনে আসা উচিত হয়নি।”

আয়েন্দ্রি ঝমঝমিয়ে কাঁদে। তার কান্নায় ভেসে যায় বুকের পাটা। রাজন শিকদার তার স্থির নয়নযুগলের জলে প্লাবিত করলেন তার সুশ্রী আনন। আয়েন্দ্রি কেঁপে ওঠে। কম্পিত গলায় বিড়বিড় করে বলল—

“আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি দাদু। আমার সব কিছু উজাড় করে ওকে ভালোবেসেছি। ওর সন্তানকে আমার গর্ভে ধারণ করেছি। কিন্তু ওকে আমার ভয় হয়। যে সন্তানের জন্য ও আজ মরিয়া হয়ে উঠছে, ওর রাগ সে সন্তানকেও বাঁচতে দেবে না। প্রাণ রাগলে কী করে তা ও নিজেও জানে না। এমন পরিবেশে আমি কী করে আমার সন্তানকে জন্ম দেই?”

আয়েন্দ্রি বাতাস কাঁপিয়ে বিলাপ করে। চাপা চিৎকারে তার কণ্ঠনালী ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। গরগর করে বলল—

“ওর কোনো ক্ষতি আমি চাই না দাদু। কিন্তু ওর সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবে বাঁচা যায় না দাদু। আমি থাকতে পারব না ওর সাথে। আমি থাকলে প্রাণ কখনো সুস্থ হবে না। কখনো না।”
,
,
,
নিষ্কম্প আয়েন্দ্রি গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। কাপড়-চোপড় এক হাতেই গুঁছিয়ে নিয়েছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি সরল গলায় বলল—

” আমরা ঢাকা কবে যাব?”

“কাল।”

আয়েন্দ্রি আর কথা বলল না। খোলস আবৃত কচ্ছপের ন্যায় বসে রইল। নিষ্প্রাণ কাপড়ের ব্যাগগুলো একপাশে রেখে শাওয়ারে ঢোকে। কিছুসময় পর বের হয়ে দেখে আয়েন্দ্রি এখনো আগের জায়গায় নীরব হয়ে বসে আছে। ভেজা চুলের পানি মুছে নিল নিষ্প্রাণ। হলুদ রঙের টিশার্টটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে। আয়েন্দ্রি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে নিষ্প্রাণের প্রতিটি অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করছে। এক ভয়ংকর, প্রকুপিত মানুষকে এখন শান্ত আর স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে। নিষ্প্রাণ ফাইলটা নিয়ে কক্ষ থেকে বের হতেই তড়িঘড়ি করে নড়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। শশব্যস্ত হয়ে ড্রয়ার হাতড়ে খাতা-কলম বের করে। দ্রুতহস্তে কিছু একটা লিখে পাতাটি মুড়ে ফেলে। পরপর আরও কয়েকটা খাতার পাতা ছিড়ে লেখা ওয়ালা পাতাটা তার মধ্যে দিয়ে বল আকৃতির সৃষ্টি করে।
,
,
,
রাজন শিকদার হুইল চেয়ারে বসে আছেন। হাসমুল তার বিছানা ঠিক করছে। নিষ্প্রাণ কক্ষে ঢুকেই দৃঢ় গলায় বলল—

“বাইরে যাও হাসমুল।”

হাসমুল দ্বিরূক্তি করল না। সে চটপট বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। নিষ্প্রাণ ধীর পায়ে এসে এক হাঁটু ভেঙে রাজন শিকদারের সামনে বসল। রাজন শিকদার ভরাট চোখে চাইল। নিষ্প্রাণের অধরে সোনাগলা হাসি। রাজন শিকদারের প্রাণ আন্দোলিত হয়। বিভীষিকাময় অতীত তার সবকিছু কেড়ে নিল। ছোট্ট নিষ্প্রাণ ভয়ংকর পুরুষে পরিণত হলো। রাজন শিকদারের মনষ্কোণে এখনো প্রশ্নেরা উঁকিঝুঁকি মারে, ” নিষ্প্রাণ সত্যিই প্রাণহীন?”

নিষ্প্রাণ তার হাতের ফাইলটা খুলে একের পর একের টিপসই নিতে লাগল। রাজন শিকদার কিছুই বুঝতে পারলেন না। হতভম্ব তিনি। ঠাস করে ফাইলটা বন্ধ করে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকাল। ক্রুর হেসে বলল—

“আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না আমি। কে জানে, আপনারা ছেলেরা কোথায় কী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। কখন আবার আমার উপর এসে তেড়ে বসে। তাই এই ব্যবস্থা। আর এমনিতেও এসব আমারই। গোবরে পদ্মফুল বলে কথা! কাজের মেয়ের গর্ভে আমার জন্ম হলেও রক্ত তো আপনাদের মতো উঁচু অবস্থানের মানুষের।
আমি বাবা হবো। শুনেছেন নিশ্চয়ই? আমার ধ্রুবতারা মা হবে। আমার সন্তানের মা। চিন্তা করবেন না। ওকে আমি আমার মতো বানাব না। কারণ, এমন কোনো পরিস্থিতি আমি ওর সামনে আসতেই দেবো না। সেই খুশিতে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। আজ থেকে আপনি মুক্ত। হয়তো এটাই আপনার আর আমার শেষ দেখা। আমি আর কখনো এখানে আসব না। এই বাড়িতে এসে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। ধ্রুবতারার গায়ে হাত তুলতে হয়েছে আমার। তারা চলে গেছে। তবে এ সবকিছুর মাঝে আমি আমার সন্তানকে পেয়েছি। তাই ওদেরকেও আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তা নাহলে ওই সারক আর মিশকাত যা শুরু করেছে, আই এম ফেডআপ ইয়ার! আসলে এরা কেউ আমাকে শান্ত থাকতে দিতেই চায় না। এখানে আমার কী দোষ বলুন? যাক গে সে কথা। ওদের সাথে এখনো অনেক হিসেব বাকি আমার। ওটা আমি ডিল করে নেবো। আসি দাদু। ভালো থাকবেন।”

রাজন শিকদারের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মৃত্যুর আগে আর হয়তো সে নিষ্প্রাণকে দেখতে পাবে না। এই ছেলে যা বলেছে তাই ই করবে। ছোট্ট নিষ্প্রাণকে রোজ নিজের সাথে মসজিদে নিয়ে যেতেন রাজন শিকদার, রোজ তাকে নিয়ে আকাশ দেখতেন। তিনি চাইতেন যেন নিষ্প্রাণের জীবনটাও ওই নীলাভ, স্বচ্ছ, নির্মেঘ আকাশের মতো হয়। কিন্তু হয়েছে তার উলটো। সেই আকাশ ঢেকে গেছে কালো কাদম্বিনীর দোলাচলে, চলে মেঘে মেঘে ঘনঘটা। হঠাৎ বর্ষণে প্লাবিত হয় সব, অকস্মাৎ থেমে গিয়ে ঝলসে দেয় প্রখর সূর্যের তেজস্বী।

নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। ঝুঁকে গিয়ে রাজন শিকদারে কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল—

“চিন্তা করবেন না দাদু। আপনার কবরে মাটি দিতে আমি অবশ্যই আসব। আমার ছেলের জন্য দোআ করবেন। আমার ছেলেই হবে। তারা বলেছে। আর তারা কখনো মিথ্যে বলে না।”

নিষ্প্রাণ চোখে হাসল। রাজন শিকদারের শ্বাস আটকে আসলো সেই হাসিতে।
,
,
,
নিষ্প্রাণ নিজের কক্ষে এসে আয়েন্দ্রিকে দেখল না। তার সতেজ চোখে অশিথিল ভাবনার উদয় হলো। বিছানায় পড়ে আছে একটা কলম। তৎক্ষণাৎ কক্ষে প্রবেশ করে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ কপাল কুঁচকে বলল—

“কোথায় গিয়েছিলি?”

আয়েন্দ্রি ছোট্ট দম ফেলে মিইয়ে গলায় বলল—

“নিইইচে গেছিলাম। জগের পানি শেষ।”

আয়েন্দ্রির দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি হাতে থাকা পানির জগ বেডসাইড টেবিলে রাখতেই বিছানায় পড়ে থাকা কলমটা পকেটে ঢুকিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। হাতের ফাইলটা ড্রয়ার বন্ধি করে চাবি নিয়ে নিল পকেটে। আয়েন্দ্রি সপ্রতিভ হাসে।

মধ্য দুপুর। একটু পরেই খাওয়ার অধিবেশন শুরু হবে। আয়েন্দ্রি শাওয়ারের উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে ঢোকে। নিষ্প্রাণ বাইরে এসে করিডোরে দাঁড়ায়। নির্মল বাতাস বইছে। তাতে প্রাণ জুড়ানো শীতলতা। একটা অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ! প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপ্রতিবন্ধ বিচরণ। সূর্যের প্রখর রোদেও ঠাঁয় চেয়ে আছে মহীরুহ ওই আকাশ পানে। নিষ্প্রাণ রাশেদকে কল করল। তাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলতে শুরু করে—

“আপনাকে কী বলেছি মনে আছে? কালকেই ঢাকা ফিরছি আমি। সকল প্রপার্টির পেপার চাই আমার। আপনি আমার সাথে অতি সত্বর দেখা করবেন।”

রাশেদ ব্যস্ত গলায় বলল—

“জি, জি স্যার।”

“এখন থেকে সপ্তাহে দু’দিন এসে দাদুকে দেখে যাবেন। আর আমাকে ইনফ্রম করবেন।”

“জি স্যার।”

“রাখি।”

“জি।”

নিষ্প্রাণ ক্লান্ত শ্বাস ফেলে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। শিমুলকে একটা মেসেজ করে কক্ষে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। তার সদ্যস্নাত দেহে মুক্তোর মতো পানির ফোঁটা। চুল মোছা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে ভেজা চুলগুলো একপাশে নিয়ে আসে। চুলের ডগা বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। নিষ্প্রাণ বিমোহিত চিত্তে চেয়ে আছে। আয়েন্দ্রির মায়াভরা কণ্ঠে ধ্যাণ ছুটে নিষ্প্রাণের।

“মোবাইলটা একটু দিবি? মায়ের সাথে কথা বলব।”

“হুম।”

কুণ্ঠিত হলো না নিষ্প্রাণ। জানালার দ্বার ঘেঁষে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। হেসে হেসে কথা বলছে সে। নিষ্প্রাণ প্রশস্ত চোখে চেয়ে আছে। স্বগতোক্তি করে বলল,” তুই যা করছিস ঠিক করছিস না ধ্রুবতারা। আমি তোকে কোথাও যেতে দেবো না। কোথাও না।”
,
,
,
ক্লান্ত বিকেল। প্রভাকরের দীপ্ততা লুকিয়েছে মেঘের ভাঁজে। বিটপীর পল্লব দুলছে আপন ভঙ্গিতে। পশ্চিমাদেশের ধূসর আকাশ নিমগ্ন হচ্ছে রঞ্জিত আভায়। একটু পরেই মিলিয়ে যাবে সূর্য। তমসার রহস্যে হারিয়ে যাবে ধরিত্রী।

রোজকার মতো আজও ব্যবহার্য জিনিসের উচ্ছিষ্টাংশ বাড়ির পেছনে ফেলেছে তালাব। অরণ্যে হরিণ খোঁজার মতো সেসব হাতড়ে যাচ্ছে মিশকাত। আয়েন্দ্রির সেই মোড়ানো কাগজ হাত লাগে মিশকাতের। ধীরেসুস্থে তা খুলে মেজাজ চড়া হয় তার। দাঁত-মুখ খিঁচে বলল,” আহ্ শিট! নিজেকে এখন পুলিশ নয়, উবারের ড্রাইভার মনে হচ্ছে!”
,
,
,
এক ঘনালো তিমির নক্তের শেষে জেগে উঠেছে বসুমতি। কুঞ্জন উঠেছে পবনে। মিলিছে আঁধার দিনের রোশনাইতে। পত্রীরা গাইছে গান নির্মল, সিক্ত, আচ্ছন্ন প্রকৃতিতে।

উবু হয়ে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ। জানালার গ্রিল গলিয়ে মিষ্টি নরম রোদের সাথে ফিনফিনে বাতাস। নড়ে ওঠে নিষ্প্রাণ। এলোথেলো বিছানা হাতড়াতে আয়েন্দ্রির নাগাল পেল না সে। চকিতে ওঠে বসে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মুহূর্তেই তড়াক করে ওঠে। নিষ্প্রাণ তটস্থ পায়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। ব্যগ্র হয়ে সমস্ত ঘরে চোখ বোলায়। কোথাও আয়েন্দ্রি নেই। নিষ্প্রাণ হলরুমে আসে। তালাব ভয়চকিত চোখে চেয়ে আছে। ফোঁস ফোঁস করছে নিষ্প্রাণ। তার শ্বাসের সাথে বুকে উথালপাথাল ঢেউ। সারা বাড়ির কোথাও আয়েন্দ্রির অস্তিত্ব নেই।

নিষ্প্রাণ নিজের কক্ষে ফিরে আসে। তার মোবাইল খুঁজতে থাকে। কিন্তু পেল না। আয়েন্দ্রির সেটাও সাথে করে নিয়ে গেছে। ফুঁসে ওঠে নিষ্প্রাণ। প্রকুপিত গলায় বলল—

“তুই ঠিক করিসনি ধ্রুবতারা, একদম ঠিক করিসনি।”

রাজন শিকদার শুয়ে আছেন বিছানায়। মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তিনি। হাসমুল দৌড়ে এসে তার কানের কাছে অনর্গল বলতে থাকে—

“ছোডো সাহেব চ্যাতছে! আইজ খবর আছে। নয়া বউ পালাইছে বাড়িত তে। আল্লাই জানে, এহন কি হইবো!”

রাজন শিকদারের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। তারপর চোখ দুটো বুজে নিলেন তিনি। তার চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল দীর্ঘসময় আটকে রাখা স্বস্তির জলস্রোত।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here