#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
আয়েন্দ্রির বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ।সবুজ রঙের ডিম লাইটের ক্ষীণ আলোতে আয়েন্দ্রির ওয়াল পেইন্টিং এ নিরবধি চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ।সেদিকেই চোখ রেখে কাতর গলায় বললো—
“জানিস ধ্রুবতারা,এই দুই বছর তোকে কত মিস করেছি আমি।একটা দিনের জন্যও তোকে আমি ভুলে থাকতে পারিনি।”
আয়েন্দ্রি কোনো জবাব দিলো না।সিলিং এর বন্ধ ইলেক্ট্রনিক পাখার দিয়ে তাকিয়ে রইলো।এসির হাওয়ায় শীতলতা বিরাজ করছে বিশাল বেডরুমে।
আয়েন্দ্রির বুক থেকে মাথা তোলে নিষ্প্রাণ।তার মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে অসহিষ্ণু গলায় বললো—
“এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
আয়েন্দ্রি মৃদু গলায় বললো—
“তুই সত্যিই হসপিটালে ছিলি?
আয়েন্দ্রির কপালের উপর কপাল রাখে নিষ্প্রাণ।নাকে নাক ঘঁষে বললো—
“তাহলে চল হসপিটালে।ওদেরকেই জিঙ্গেস করবি আমি সেখানে ছিলাম কিনা।”
আয়েন্দ্রি উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো।ক্লান্ত গলায় বললো —
“তোর কথা বলা শেষ?
আমি ঘুমাবো।”
আয়েন্দ্রিকে ছেড়ে বিছানার এইপাশে এসে শুয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ।পাশে থাকা সাইড টেবিলে দন্ডায়মান ল্যাম্পশেডটা জ্বালিয়ে মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে।কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে আসে নিষ্প্রাণের অক্ষিপুট।আয়েন্দ্রির চোখে ঘুম নেই।তার মানসপটে ভেসে উঠছে সেই দিনের ছবি।দুই বছর আগে যেদিন নিষ্প্রাণকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সেদিন নিষ্প্রাণ একটা কথাও বলেনি।শুধু বদ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো আয়েন্দ্রির দিকে।সেদিন প্রথমবার নিষ্প্রাণের গায়ে হাত তোলে আয়েন্দ্রি।গুনে গুনে ছয়টা থাপ্পড় মারে নিষ্প্রাণের দুই গালে।নিষ্প্রাণ কোনো প্রতিবাদ করেনি।পালিয়ে যাওয়ার তাগিদও তার ছিলো না।হাঁটু ভাঁজ করে আয়েন্দ্রির সামনে মাথা নিচু করে বসে রইলো।আয়েন্দ্রির বাবা আলফাজ সাহেব পুলিশ ডাকলেন,বাড়িতে হট্টগোল হলো কিন্তু নিষ্প্রাণ!সে নিষ্প্রাণ হয়েই থাকলো।পুলিশ যখন নিষ্প্রাণকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখনও নিষ্প্রাণ অনিমেষ ব্যথাতুর চোখে আয়েন্দ্রির দিকেই চেয়ে রইলো।সে চাহনি নিশ্চল,স্থির।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রির বুক চিরে।
পাশ ফিরতেই দেখে ল্যাম্পশেড জ্বলছে।একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে বসে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই মনে হলো সে তন্দ্রাচ্ছন্ন।আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের কাছে এগিয়ে আসে।সংকোচ নিয়ে তার উপরে ঝুঁকে ল্যাম্পশেড অফ করে।ছেলেটা আসলেই পাগল।ডিম লাইট জ্বলছে সেখানে আবার ল্যাম্পশেড লাগে!
নিষ্প্রাণের একদম কাছেই বসে আছে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের ঘুমন্ত মুখটা কী নিষ্পাপ!যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে হয়তো ততক্ষণই শান্ত।উঠলেই অশান্ত।আয়েন্দ্রি গাঢ় দৃষ্টিতে দেখে নিষ্প্রাণকে।এতোটা কাছে আসলেও রাগে,ক্ষোভে,বিতৃষ্ণায় নিষ্প্রাণের চেহারাটা ভালো করে দেখা হয়নি তার।নিষ্প্রাণ আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে।চাপা চোয়ালটা আগের চেয়ে ভরাট।পাতলা দুই ঠোঁটের রঙও আগের মতো।নিষ্প্রাণ তার চুলের যত্ন করতো অনেক।কারণ তার এই ঝাঁকড়া চুল তার ধ্রুবতারার খুব পছন্দ।প্রায় প্রতিদিনই একবার হলেও নিষ্প্রাণের চুলে আঙুল গলাতো আয়েন্দ্রি।আজও তেমনটা ইচ্ছে হলো আয়েন্দ্রির।ফিকে আলোতেও একটুও উজ্জ্বলতা কমেনি নিষ্প্রাণের।আচমকা বলে উঠে নিষ্প্রাণ—
“এমন করে কী দেখছিস?
হকচকিয়ে যায় আয়েন্দ্রি।চোখের পল্লব মেলে ধরে মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ।উঠে বসে।চট করে বললো–
“ঘুমাস নি যে?
আয়েন্দ্রি অপ্রস্তুত হয়।তার এই অবস্থা দেখে আলতো হাসে নিষ্প্রাণ।টুপ করে আয়েন্দ্রির ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো—
“ঘুম পাচ্ছে না।তাই তো?
আমার কাছে আয়।”
আয়েন্দ্রি দৃঢ় হয়ে রইলো।নিষ্প্রাণ নিজেই আয়েন্দ্রিকে কাছে টেনে নেয়।নিষ্প্রাণে বক্ষস্থলে আয়েন্দ্রির পিঠ ঠেকিয়ে বলয় আকৃতি করে আঁকড়ে ধরে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রির খোলা চুলে নাক ঠেকিয়ে বললো—
“তোর এখনো আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না?
আয়েন্দ্রি নির্বিকার।আয়েন্দ্রির কাঁধে চিবুক রাখে নিষ্প্রাণ।মায়ময় গলায় বললো—
“ওরা সবাই কেমন আছে রে?
আয়েন্দ্রি ফ্যাকাশে গলায় বললো–
“কারা?
আয়েন্দ্রির গলার দিকে অধর ছুঁইয়ে নরম গলায় বললো নিষ্প্রাণ—
“তৃণা,কুসুম,সীমান্ত,প্রাবিশ আর শ্রেয়া?
আয়েন্দ্রি সহজ গলায় বললো—-
“ভালো
“কোথায় আছে এখন ওরা?
“তৃণা মাস্টার্স করছে।কুসুম অনার্স শেষ করে গ্রামে চলে গেছে।একবার কথা হয়েছে।বলেছে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জব করে।প্রাবিশ নরওয়ে থাকে।সীমান্ত বাবার ব্যবসায়ে হাত দিয়েছে।আর শ্রেয়ার খবর তোর রাখার কথা।”
শেষের কথায় খলখল করে হেসে উঠে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের বুক থেকে সরে বসে।নিষ্প্রাণ প্রশ্নবিদ্ব চোখে বললো—
“উঠলি কেন?
“ঘুমাবো আমি।”
“ওকে।”
আয়েন্দ্রি শুয়ে পড়ে বিছানার এইপাশটায়।নিষ্প্রাণের স্পর্শে কেমন দূর্বলতা অনুভব করছে আয়েন্দ্রি।ভয়ংকর এই মানুষটাকে নিয়ে ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আয়েন্দ্রির।কিন্তু নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন সত্যিই আয়েন্দ্রিকে বিগলিত করছে।এই যে নিষ্প্রাণের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো।নিষ্প্রাণ তাকে প্রগাঢ় মায়ায় জড়িয়ে ধরলো।অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো আয়েন্দ্রি স্থির শরীরে।যেনো ভেতরে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে নিষ্প্রাণে স্পর্শ,তার তপ্ত নিঃশ্বাস,তার মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ।ভাবতে ভাবতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে আয়েন্দ্রি।
,
,
,
কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে টিপিক্যাল বাঙালি গৃহিণীর মতো রান্না করছে আয়েন্দ্রি।অবশ্য আয়েন্দ্রি যা রান্না করবে গোগ্রাসে তা গিলে নিবে নিষ্প্রাণ।তবুও দু’বছরে রান্নার হাত চেঞ্জ হয়েছে আয়েন্দ্রির।বেশ ভালো না হলেও ভালো বলা চলে।দুপুর রোদের তীক্ষ্ম ফলা কিচেন রুমের জানালা ভেদ করে ঢুকেছে।ও বাড়িতে তেমন রান্না করা হতো না আয়েন্দ্রির।ঝুমা বেগম নিজ হাতেই সব করতেন।
আয়েন্দ্রির শুভ্র, নগ্ন কোমরে হাত রাখতেই চমকে উঠে সে।অতর্কিত ছোঁয়ায় কেঁপে উঠে আয়েন্দ্রির মস্তিষ্ককোণ।পরক্ষণেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।ততক্ষণে আয়েন্দ্রি পাখির ছানার মতো গুঁজে গেছে নিষ্প্রাণের বক্ষস্থলে।নিষ্প্রাণ অতলান্তিক মায়ায় তার উষ্ণ ছোঁয়ায় ব্যস্ত করে তোলে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রি কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে সরল চোখে তাকিয়ে অপ্রতিভ গলায় বললো—
“রান্না শেষ আমার।তুই খেতে বস।আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।”
নিষ্প্রাণ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে আয়েন্দ্রির দিকে তাকালো।আয়েন্দ্রির নাকের নিচের খাঁজটায় মুক্তোর মতো ঘাম জমেছে।সাথে নাকের ঢগা আর চিবুকের গাঁথুনিতে।আয়েন্দ্রিকে ধরে রাখা বন্ধন আরো দৃঢ় করতে আয়েন্দ্রির নিঃশ্বাসও যেনো মিশে যাচ্ছে নিষ্প্রাণের নিঃশ্বাসের সাথে।আয়েন্দ্রি চোখ তুলে অক্ষিপুট প্রশ্বস্ত করে নিষ্প্রাণের চোরা হাসির মুখটার দিকে তাকায়।ভালো করে তাকাতেই আয়েন্দ্রির মনে হলো কিছু একটি মিসিং নিষ্প্রাণের ফর্সা,টলটলে চেহারাটায়।আয়েন্দ্রির এরূপ চাহনিতেই ফিক করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ।কপাল টানটান করে বললো—
“গ্লাস মিসিং।এই যে দেখ চোখে লেন্স লাগিয়েছি।রোমান্সে নো বাঁধা।”
বলেই দীর্ঘ চুমু খায় আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।নিষ্প্রাণের বুকে আঁকড়ে ধরা দুই হাতের মুঠ শক্ত করতেই হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ।চটপটে গলায় বললো—
“মেরে ফেলবি নাকি?
আয়েন্দ্রি অদ্ভুত স্বরে বললো—
“তা সম্ভব হলে অনেক আগেই করতাম।”
আয়েন্দ্রির কথায় থমথমে হয়ে যায়য় নিষ্প্রাণের মুখটা।তাকে ঘুরিয়ে পিঠ ঠেকায় নিজের বুকে।নিষ্প্রাণের হাত তখন আয়েন্দ্রির উদরের উপর চেপে রেখেছে।আহ্লাদী গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—-
“তোর ঘ্রাণ একদম বেলী ফুলের মতো।ইচ্ছে করে সবটা নিংড়ে নেই।তোর মনে আছে?প্রাবিশের বার্থডের দিন প্রথমবার বিয়ার খেয়ে তোর অবস্থা কী হয়েছিলো!বেহুশ হয়ে সারারাত আমার বুকের উপর পড়ে রইলি।বিশ্বাস কর,জীবনের প্রথমবার সেদিন নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে আমার।সারারাত চোখ বন্ধ করতে পারিনি আমি।তোর শরীরের উষ্ণতা,সৌরভ,তোর হৃদস্পন্দন যেনো আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছিলো।নিজেকে কী করে সামলেছি সেদিন আমি বলতে পারবো না তোকে।”
আয়েন্দ্রি ব্যঙ্গাত্মক গলায় বললো—-
“এখন তো তার প্রয়োজন নেই।তোর যা ইচ্ছে করতে পারিস।”
“রাগ করে আছিস এখনো?
“ছাড় আমায়।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
“ওকে।”
আয়েন্দ্রি সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমে চলে যায়।খাবার টেবিলে অপেক্ষারত নিষ্প্রাণ।দরজার বাইরে থেকে অ্যালার্ম আসতেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।আধুনিক সকল প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে নিষ্প্রাণ তার প্রাণস্পন্দনকে নিজের করে রাখতে।দরজা পাশেই লাগানো বোর্ডে কতগুলো ডিজিট লেখা।সেখানে থেকে কিছু ডিজিট চাপতেই দরজার মাঝখানের ছোট জানালার মতো খুপরিটা খুলতেই বাইরে থাকা সিকিউরিটি গার্ড একটা খাম ধরিয়ে দেয় নিষ্প্রাণের হাতে।এই দরজাটা নিজে অর্ডার করে বানিয়েছে নিষ্প্রাণ।বেশ পুরু এই দরজার বাইরে কাঠ হলেও ভেতরে ধাতব পদার্থ।আর রয়েছে ইলেকট্রিক তারের সন্নিবেশন।
খামটা নিয়ে আলতো হাতে খুলে নিষ্প্রাণ।শাওয়ার সেরে একটা নীল রঙের জুম শাড়ি পড়েছে আয়েন্দ্রি।সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“কীসের কাগজ ওইটা?
নিষ্প্রাণ গম্ভীর গলায় বললো—
“ইনভাইটেশন কার্ড।”
টেবিলে গিয়ে খাবার বাড়তে থাকে আয়েন্দ্রি।বিছিয়ে থাকা আঁচলটা এক ঝটকায় কাঁধে তুলে নেয়।হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে এসেছে।নিষ্প্রাণকে কার্ডের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে উৎসুক গলায় বললো—
“কীসের ইনভাইটেশন?
নিষ্প্রাণ কোনো ভনিতা ছাড়াই সহজ গলায় বললো—
“দাদু যে কোম্পানিটা টেক ওভার করেছে তার মালিক নতুন একটা কোম্পানি শুরু কিনেছে।সে উপলক্ষ্যে একটা পার্টি অর্গানাইজ করেছে।তার বিজন্যাস পার্টনার,ইনভেস্টর,ওয়েল উইশার সকলকে আমন্ত্রণ করেছে।একা নয় স্পাউজসহ।”
মুহুর্তেই ঘনকালো মেঘে ছেঁয়ে যায় আয়েন্দ্রির মুখ।নিষ্প্রাণের পাগলামি যদি সত্যিই ভালো না হয় তাহলে ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলবে সে আবার।
চলবে,,,