#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
একটা জাম রঙা শাড়ি পরেছে আয়েন্দ্রি ফুলস্লিভ কালো ব্লাউজের সাথে।আয়েন্দ্রির চুল ততটা লম্বা নয়।পিঠের দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত দীর্ঘ চুল বেশ ঘন আর সিল্কি।এক পাশে একটা সিঁথি করে ছেড়ে রেখেছে চুল।দেশী-বিদেশী প্রসাধনীর ব্যবহারও তার চোখে,মুখে।ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি রঙের লিপস্টিক।আইলেস লাগানো চোখগুলো ভাসা ভাসা।পার্টিতে সমাবেশিত শ’খানেক মানুষের মধ্যে কেমন অস্বস্তি লাগছে আয়েন্দ্রির।যদিও তার আসতে একদম ইচ্ছে করেনি কিন্তু নিষ্প্রাণের না শোনার ধৈর্য্য এখন শূন্যের কোঠায়।
নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে বটবৃক্ষের মতো আয়েন্দ্রির পাশে।সাদা শার্টের সাথে কালো ব্লেজার।বরাবরই কালো রঙ পছন্দ নিষ্প্রাণের।নিজেকে লুকানোর সবচেয়ে যুতসই রঙ।
একটা রিসোর্টে আয়োজিত এই পার্টিতে অনেক নামিদামী ব্যবসায়ীর আগমন।পায়ের নিচে দুমড়ে চলছে সবুজ ঘাস।নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর অন্তর রয়েছে ঝাউগাছ যাতে করা হয়েছে সাদা রঙের লাইটিং।এছাড়াও রয়েছে ঝাউগাছের প্রান্ত ঘেঁষে অতিথিদের জন্য গোল টেবিল।বুফের ব্যবস্থা করাও হয়েছে।নির্দিষ্ট পোশাকে রয়েছে সার্ভিস বয়।তারা সার্ভ করছে স্কচ,ওয়াইন আর সফট ড্রিংকস।
নিষ্প্রাণ তার কিছু পরিচিত লোকের সাথে আয়েন্দ্রিকে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং হঠাৎ বিয়ে নিয়ে ঠাট্টা মশকরাও করে।অত্যন্ত চতুরতার সাথেই সবটা সামলে নেয় নিষ্প্রাণ।
আয়েন্দ্রিকে দাঁড় করিয়ে ওয়াশরুমে যায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি গুটিসুটি মেরে স্থির হয়ে আছে।চকিতেই তার পেছন থেকে কেউ একজন আসতেই ধাক্কা লাগে আয়েন্দ্রির গায়ে।আয়েন্দ্রির হাতে থাকা সফট ড্রিংক তার শাড়িতে পড়ে যায়।অপরিচিত লোকটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঝাড়া মেরে আয়েন্দ্রির শাড়ি থেকে কোল্ড ড্রিংকসের ভেজা আবরণ সরাতে চায়।দূর থেকে তা দাঁড়িয়ে দেখছে নিষ্প্রাণ।ক্রমশ তার শিড়দাঁড়া শক্ত হতে থাকে।চোয়ালে দেখা দেয় অশিথিলতা।দাঁতে দাঁত চেপে হাতের মুষ্ঠি করতেই হাতের শিরা ফুলে উঠে।
অপরিচিত লোকটি সাহায্য করার আড়ালে আয়েন্দ্রির কোমর ছুঁইয়ে দিচ্ছে।অপ্রস্তত আয়েন্দ্রি ব্যক্তিটির নোংরা অভিপ্রায় ধরতে পারলো না।তবুও নিষ্প্রাণের কথা ভেবে নিজেকে সরিয়ে বারবার বলছে সে ঠিক করে নিবে।ব্যক্তিটি তবুও অপরাধবোধ এড়াতে এই কাজ করতে লাগলো।হঠাৎ নিষ্প্রাণের দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় আয়েন্দ্রি।ব্যক্তিটিকে একরকম ঝাঁড়া মেরেই ওঠে।সটকে পড়ে ব্যক্তিটি।আয়েন্দ্রির কাছে এসে মুখভর্তি হাসে নিষ্প্রাণ।মিষ্টি গলায় বললো—
“কী হয়েছে?
আয়েন্দ্রি ভীষণ অবাক হলো নিষ্প্রাণের গলার স্বরে।সাবলীল উত্তর দিলো—
“কিছু না।ড্রিংস পড়ে গিয়েছিলো আমার গায়ে।”
নিষ্প্রাণ একটা লোককে ডাক দেয়।কয়েকটা টিস্যু পেপার নিয়ে শাড়ির এপাশ ওপাশ চেপে ধরে বললো—
“খেয়াল করে হাঁটবি তো।এখানে তো আর আমরা একা না।অনেক মানুষ।”
নিষ্প্রাণের ব্যবহারে যারপরনাই বিস্মিত হলো আয়েন্দ্রি।কতটা সহজ ব্যবহার।আয়েন্দ্রির বিশ্বাস হতে লাগলো নিষ্প্রাণ সত্যিই ঠিক হয়ে গেছে।অদ্ভুত ভালোলাগা শুরু হলো আয়েন্দ্রির।আয়েন্দ্রিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো—
“চিন্তা করিস না।এই শাড়ি আর পরতে হবে না তোকে।এই রঙের নতুন শাড়ি কিনে দিবো।”
আয়েন্দ্রি নীরস হাসলো।নিষ্প্রাণ মুচকি হেসে বললো—
“মাই হার্টবিট।”
যে লোকটার আয়েন্দ্রির সাথে ধাক্কা লেগেছিলো চল্লিশ বছর হওয়ার পরও এখনো ব্যাচেলর সে।তাই এইধরণের গর্হিত কাজ সে প্রায়ই করে।স্কচে চুমুক দিয়ে বিশ্রিভাবে হেসে বললো–
“নতুন বিয়ে তো তাই অনেক শাই।”
পাশে দাঁড়ানো অন্য একজন রেড ওয়াইনে তৃপ্তিকর চুমুক দিয়ে বললো—
“ভাই,বয়স তো কম হলো না।বিয়েটা করে নিলেও তো পারেন।তাহলে আর এদিক ওদিক হাত নাড়তে হয় না।”
জাফর বিশ্রি হাসলো।বললো—
“না,না।ওসব বিয়ে টিয়ে তে আমার পোষবে না।নিত্য নতুন ডিশ পছন্দ আমার।বিয়ের পর ভালো না লাগলেও রোজ সেই ডাল,ভাত।জমে না আমার।”
কথা শেষ করেই চুমুক স্কচের প্রশ্বস্ত গ্লাসে।তার পেছনে দাঁড়িয়ে সবটা উৎকর্ণ হয়ে শুনছিলো নিষ্প্রাণ।চকিতে একটা লোকের সাথে ধাক্কা লাগে জাফরের।লোকটা ছিলো সার্ভিস বয়।শহরের উঁচু তলার মানুষ আবার গরীব লোকদের মানুষ মনে করে না।হাতাপায়ির এক পর্যায়ে জাফরের মোবাইল পড়ে যায় হাত থেকে।জটলার মধ্যে থেকে তা তুলে নেয় নিষ্প্রাণ।দ্রুতহাতে একটা নম্বরে ডায়াল করে যা নিষ্প্রাণের আরেক হাতে।রিসিভ করে সেই মোবাইলটা একটা ঝাউগাছের তলায় রেখে দেয়।আর অতি সন্তর্পনে ঝগড়া মিটে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে।আয়েন্দ্রিকে বুফের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।হাত ভর্তি খাবারের থালা দেখে বিহ্বল আয়েন্দ্রি।অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু একটু করে খেয়ে চলছে আর নিষ্প্রাণকে খুঁজে চলছে।বুফের সামনেই একটা পর্দা টানানো।তাই এইপাশের কিছুই দেখতে পারছে না আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের আদেশ অমান্য করে সেখান থেকে নড়তেও পারছে না।
জাফর ছেলেটাকে এমনভাবে মারলো যে সে নিজেই ঘেমে নেয়ে একাকার।তার হাজার টাকার জুতো নষ্ট করে ফেলেছে ছেলেটি খাবার ফেলে।ততক্ষণে নিষ্প্রাণ তার কাজ করে ফেলেছে।জাফরের মোবাইল থেকে ডায়ালকৃত কল কেটে মোবাইলটা তার পকেটে ঢুকিয়ে দেয়।নিজেকে একটু পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে ঢুকে জাফর।তলপেটে চাপ দিতেই কাজ শেষ করে
হাত ধুয়ে সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকাতেই চোখ পিটপিট করে জাফর।তার পেছনে হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে নিষ্প্রাণ।উৎসুকতা নিয়ে পেছন ফিরতেই জাফরের মুখে একটা চার ইঞ্চির তীক্ষ্ম চাকু ঢুকিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ।চাকুটা বিনা বাঁধায় জাফরের মুখের ভেতরের কন্ঠনালীর একটু সামনের দিকের উপরে গেঁথে যায়।জাফর হতবিহ্বল হয়ে দুই হাতে নিষ্প্রাণের হাত চেপে ধরে।চোখ দিয়ে উপচে পড়ছে পানি জাফরের।মরণ যন্ত্রণায়ও অস্ফুট আওয়াজ তার।নিষ্প্রাণের চোখ দিয়ে আগুনের কুন্ডলী বের হচ্ছে যেনো।দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে নাকের পাটা ফুলিয়ে ডান হাত দিয়ে জাফরের এক হাত ছাড়িয়ে নেয়।জাফর অনবরত থরথরিয়ে কাঁপছে।প্রাণসঞ্জিবনী ফুরিয়ে আসছে তার।মুখ দিয়ে গলগলিয়ে লহুর শ্লথ ধারা বের হচ্ছে।নিষ্প্রাণ জাফরের ডানহাতের আঙুল একটা একটা করে ভেঙে দেয়।তরপাতে থাকে জাফর।গলার নিচ থেকে বুক পর্যন্ত রক্তে জবজবে।গলা কাটা মাছের মতো কিছুক্ষণ শনশনিয়ে বেরিয়ে যায় জাফরের আত্মারাম।হাত সরিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ।গড়িয়ে পড়ে জাফরের নিথর দেহ মেঝেতে।নিষ্প্রাণ হাতে থাকা ওয়ান টাইম গ্লাভস খুলে ফ্ল্যাশ করে।জাফরের ভাঙা হাতের উপর পা মাড়িয়ে ধরে নিষ্প্রাণ।ক্রোশ মিটিয়ে পুরো থেতলে দেয় সেই হাতের পাঞ্জা।রাগে ফুঁসে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ।
নিজেকে ধাতস্থ করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে সে।সিসিটিভি ফুটেজে নিষ্প্রাণের অস্তিত্ব নেই।কারণ সিসিটিভির ডাইরেকশন আগেই চেঞ্জ করেছে নিষ্প্রাণ।সহজ ভঙিতে বাইরে বেরিয়ে আসে সে।অনেকটা দূরে এসে জুতোতে লাগানো এক্সট্রা প্লাষ্টিকের পেপারটা খুলে নেয় নিষ্প্রাণ।ফেললো না তা।একটা কাগজে মুড়ে প্যান্টের পকেটে পুরে নিলো। গাড়ির ভেতরে বসতেই কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—
“কোথায় গিয়েছিলি?
নিষ্প্রাণ সরল গলায় প্রত্যুক্তি করে—
“একজন ইনভেস্টরের সাথে কথা বলতে।জানিস তো আমাদের কোম্পানি ডাউন।সেখানে নিজ থেকে ওই লোক ইনভেস্ট করেছে।আমি তো আর অফিস যাবো না।দেখা হয়ে গেলো তাই কথা বলে নিলাম।তোর কিছু লাগবে?
“উঁহু।”
নিষ্প্রাণের মুখটা প্রাণোচ্ছল,স্বাভাবিক,হাস্যোজ্জ্বল।আয়েন্দ্রির ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে খুশির হাসি।যেনো সবকিছু সুস্থ হতে চললো।
চলবে,,,