প্রিয়কাহন পাঠ-১৬

#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব – |১৬|

এক সুদর্শন যুবকের বাইকে ওঠার অভিজ্ঞতা প্রিয়তার এই প্রথম। আর এই যুবকটিও নাকি তার হবু বর। অভী যখন নির্বিকারে বললো, ‘বাইকে উঠো প্রিয়তা!’, মৃদু ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিলো প্রিয়তার দুর্বল হৃদয়। কোণঠাসা হয়ে উঠলো মন। একমুহূর্তে ইচ্ছে করেছিলো সমস্ত রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ ভেঙ্গে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু কেন করবে সে এমন? এইযে দু তিনদিন কেটে গেলো অভী কি একবারও প্রিয়তাকে সরি বলেছে? একবারও দুঃখ পেয়েছে মনে মনে? সরি তো দূরের কথা, প্রিয়তার ধারনা এই মানুষটা হয়তো অনুতপ্তও হয়নি৷ অথচ শুধু অভীই জানে প্রিয়তাকে নিয়ে সেদিনকার নিষিদ্ধ কল্পনার জন্য সেই খারাপ ব্যবহার কতটা তাকে বিদ্ধ করেছিলো।

অনিচ্ছা সত্বেও বাইকে উঠে বসলো প্রিয়তা। অন্যমনষ্কতার জন্য ওঠার সময় চেপে ধরলো অভীর কাঁধ। অভী হাসলো অগোচরে। বাইক স্টার্ট দিলো। প্রিয়তা মাঝখানে রেখেছে চীনের মহাপ্রাচীরের মতো দুরত্ব। অনায়াসে এখানে একটা নাদুসনুদুস মানব বসতে পারবে। অভী ভ্রু কুঁচকালো। পিছে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ মাঝখানে চীনের মহাপ্রাচীরের মতো বাংলাদেশ মহাপ্রাচীর স্থাপন করার পরিকল্পনা আছে? থাকলে বলো! প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে অধিবেশন করার জন্য আহ্বান জানাবো তাইলে।’

অভীর সুক্ষ্ম অপমানটা গায়ে গরম তেলের মতো ফটফট শব্দে ফুটে উঠলো প্রিয়তার৷ বিরাগ্য অনুভূতি বিদ্ধ করলো তাকে। চোখ ছোট ছোট করে বললো,

‘ ফালতু কথা বন্ধ করে বাইক স্টার্ট করুন!’

‘ ভেবে দেখো, এর আগেও পড়ে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ডিপার্টমেন্ট একাকার করেছো। আবার পড়ে হাত পা ভাঙলে এখানেই এতিম শিশুর মতো ফেলে চলে যাবো।’

রি রি করে উঠলো প্রিয়তার আত্মসম্মানে টুইটুম্বুর মন। নিজের কথা বজায় রাখার জন্য একচুলও অভীর কাছে ঘেঁষে বসলো না। অভী হতাশ হলো। এই মেয়েকে বশে আনতে বেগ পেতে হবে। অদ্রি থেকে ভালোই মিলিটারি ট্রেনিং নিয়েছে। অভীর মাঝে মাঝে রাগ হয় অদ্রির প্রতি৷ অসহ্য ধরনের রাগ৷ গল্প উপন্যাসের শালী সাহেবার মতো এই মানবীর মোটেও দুলাভাই ভক্তের অস্তিত্ব নেই। একে যে বিয়ে করবে, তার জীবন খণ্ডযুদ্ধে জর্জরিত থাকবে এটা নিশ্চিত।

প্রিয়তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইক চালানোতে মগ্ন হলো অভী। প্রিয়তা হাফ ছাড়লো। অভী বিনাবাক্যে মেনে নেবে তা ভাবতে পারেনি। চট্টগ্রামের এলোমেলো পথ ধরে ছুটে চলছে বাইকটি। পথের বাঁকে বাঁকে চোখে পড়ছে ভুতূরে ধরনের পুরনো সেই ঐতিহ্যবাহী তরুগুলো। প্রিয়তার খেয়াল হলো পথটা একটু বেশিই আকাঁবাকা, বারবার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, দ্রুত যাচ্ছে বাইক। প্রিয়তার নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেতে হলো। এভাবে থাকলে নির্ঘাত সে পড়ে যাবে পেছন দিয়ে। অভীকে ধরার চিন্তা এলেও তা দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। আচমকা রাস্তার মাঝে ব্রেক আসতেই প্রিয়তা সাথে সাথে ধাক্কা খেলো অভীর পিঠের সাথে। ভয়ে খামচে ধরলো কাঁধ। অভী তারপর বললো,

‘ আগেই বলেছিলাম! এবার বুঝলে তো!’

__________________

পুলকের ধারনা আসলেই সঠিক ছিলো। সে যে একেবারে বউ নিয়ে হাজির হবে এটা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াই করে নি তেমন কেউ। যেন সবাই আগেভাগেই জানতো পুলকের দ্বারা সব সম্ভব। সাখাওয়াত ভিলাতে যখন সে ঢুকলো প্রথমেই মুখোমুখি হলো মানিকের মার। তাকে দেখিয়ে হাসিমুখে বললো,

‘ মানিকের মা! এই দেখো আমার সুন্দরী গিন্নিসাহেবা!’

তখনই হাতে থাকা থালা বাংলা ছায়াছবির মতো ঝনঝন শব্দ করে পড়ে গেলো নিচে। কাকের গলা হিসেবে এই লেনে মানিকের মার মতো ছুটা কাজের বুয়ার বেশ সম্ভ্রম আছে৷ সে আহাজারি কন্ঠে বললো,

‘ হায় হায়, ভাবিরা কই গো আফনারা? ও খালাম্মা- দেহেন আইপনার ভাইগ্না বিয়া কইরা বউ লইয়া আইসে!’

মানিকের মার ধারনা ছিলো অন্য চারপাঁচটা পরিবারের মতো বজ্রপাত পড়বে সাখাওয়াত ভিলাতে এবার। সবাই মিলে খুবই গম্ভীর সমাবেশ করবে একটা৷ বিচারে আসবে। তবে সে ভুলে গিয়েছিলো এ বাড়িতে এমন কিছু কখনোই হয়না। কারন নাটক এখন এখানকার নিত্যদিনের রুটিন।।প্রিয়তার দাদী যখন দেখলো তখন ছোট্ট করে ‘ওহ’ প্রতিউত্তর করে বিরক্তি সুরে বলেছিলো,

‘ বউ লইয়া খাম্বার মতো দাঁড়ায় আছোস ক্যান ব্যাটা? ভিতরে বয়।’

ঘটনা প্রিয়তা আর রুদ্র অদ্রির বাবার অফিসের ফোন পর্যন্তও গড়ালো। তবে তারাও এতটা হতভম্ব হলো না যতটা প্রিয়তা অদ্রি আর রুদ্র হয়েছিলো। রুদ্রর বাবা শুধু থমথমে গলায় বলেছিলো,

‘ বেকার থেকে বিয়ে করার খুব শখ হয়েছিলো মশায়ের তাই না? আমিও দেখবো কতদিন পা তুলে আরামে বসে খায়।’

অপমানটা হজম করে নিলো পুলক। খালার এই বড় ছেলের কাছ থেকে এমন শাসানো কথা শোনাটাই স্বাভাবিক। বরং স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেই অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াতো।

প্রিয়তা বসে আছে সোফার এককোণে। কিছুক্ষণ আগেই অভীর সাথে ফিরে এসেছে বাড়িতে। বউ – আদর করা হচ্ছে এখন তিথীকে। প্রিয়তা মা আর চাচী মিলে তিথীর সাথে শুরু করেছে রাজ্যের আলাপ। মানিকের মার মুখ ভার। আসন্ন ঝগড়াঝাঁটির কথা ভেবে মনে মনে পুষে রাখা নিষিদ্ধ আনন্দটা চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় মুখ পুদিনাপাতার মতো চুপসানো।
প্রিয়তা ডানদিকে তাকালো। অভী বসে আছে অরিনের পাশে। কি নিয়ে কথা বলছে বোধগম্য হলো না। অরিন প্রিয়তার ছোট বোন হলেও প্রিয়তার মতো না, পড়াশোনায় ভালো তবে কথা জমাতে বেশি ভালোবাসে। এখন অভীর সাথে এই তরুনি কি বিষয়ে আলাপ করছে কে জানে?

দাদী তখন বললো,

‘ এই প্রিয়তা অভীর জন্য শরবত নিয়া আয়? নাতজামাইটা কখন থেকে এভাবে বইসা আছে৷’

প্রিয়তা অপ্রস্তুত হলো। দাদীর অভীকে ‘ নাতজামাই’ বলাতে নিজের কাছেই অন্যরকম ঠেকালো। তাকালো সে অভীর দিকে। চমক খেলো। অভী তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। ঠোঁটে চাপা হাসি। চোখে কাজ করছে কৌতুক। প্রিয়তা বুঝতে পারলে না অভীর এই আমূল পরিবর্তনের কারন। নতজানু হয়ে সে শরবত বানিয়ে নিয়ে এলো। এগিয়ে দিলো অভীকে। বললো,

‘ এই নিন!’

অভী নিলো। এক ঢোক গিলার পর সপ্রশ্নে তাকালো প্রিয়তার দিকে। ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘ শরবতে লবণ দেওয়া হয় জানতাম না তো?’

নয়ন জোড়া বিস্ফোরণে ফেটে পড়লো প্রিয়তার। লবণ মানে? অভীর ব্যবহারে অন্যমনষ্ক হয়ে শরবত বানানোর সময় সে কি সত্যি সত্যিই চিনির বদলে লবণ দিয়ে দিয়েছে? প্রিয়তার চাচী শুনে ফেললো এ কথা। প্রিয়তাকে চোখে পাকিয়ে বললো,

‘ শরবত বানানোর সময় মন কি চান্দে তুলে রেখেছিলি প্রিয়তা? ’

সে শরবতের গ্লাস নিয়ে নিলো অভী থেকে। সলজ্জ হয়ে বললো,

‘ একটু অপেক্ষা করো অভী বাবা! ও হয়তো খেয়াল করে নি৷ আমি বানিয়ে আনছি।’

‘ প্রয়োজন নেই আন্টি। আপনি শুধু এক গ্লাস পানি দিন। আমাকে যেতে হবে একটু দ্রুত।’

অগত্যাই প্রিয়তাকে দিয়ে পানি পাঠালো বড় আম্মু। অভীর কাছে যাওয়ার পূর্বে প্রিয়তাকে শাসানো গলায় বললো,

‘ আর কোনো অকাজ করিস না কিন্তু। তোর মা এখনও খেয়াল করেনি তুই শরবতে চিনির জায়গায় লবণ দিয়েছিস। জানলে সবার সামনেই ধমকে বাড়ি তুলে ফেলত। এখন পানির গ্লাস দিয়ে চুপচাপ যা ছেলেটার কাছে। তাকে দরজা পর্যন্ত গিয়ে বিদায় দিয়ে আসবি। বুঝলি?’

‘ হুম।

‘যা তাহলে।

দরজার কাছে অভীকে দিয়ে আসার সময় অভী হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে ধরিয়ে দিলো প্রিয়তার হাতে। প্রিয়তা হতভম্ব হলো। বললো,

‘ কি এটা?’

‘চিনো না? এটা বাদাম।’

‘ বাদাম দিলেন কেন?’

অপ্রস্তুত হয়ে বললো প্রিয়তা। অভী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো না। গেটের বাইরে ভিড়ানো বাইকে বসে পড়লো। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দিলো গা জ্বালানো হাসি। বললো,

‘ বাদাম খেলে বু্দ্ধি খুলে ম্যাডাম। তোমার বুদ্ধি সহ মাথাটাও খুলবে। যখন তখন অন্যমনষ্ক হয়ে তাইলে চিনির জায়গায় লবণ দিতে পারবে না। বিয়ের আগে নিজের ফ্যামিলির মান ইজ্জত লুটলেও বিয়ের পর আমার মান ইজ্জত লুটার চিন্তাভাবনা করতে পারবে না।’

প্রিয়তা তিরিক্ষি মেজাজে তাকালো অভীর দিকে। বললো,

‘ আপনিও আমায় বিয়ে করার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিন। আপনাকে বিয়ে আমি করবো না। কিছুতেই করবো না৷ বিয়ে না করার জন্য যা করার সবই আমি করবো।’

‘ আর তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমার যা করা দরকার সেগুলো সবটাই আমি করবো। বুঝলে মিস.তাহমিনা প্রিয়তা? সো, অভিমানী মন নিয়ে আমায় ইগ্নোর করা যেমনটা তুমি করতে পারবে না তেমনি অদ্রির সাথে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী পদক্ষেপও নিতে পারবে না৷ অভী তার থেকেও দুই ডিগ্রি উপরে৷ হ্যাভ অ্যা নাইস ডে! ‘

শুকনো কাগজের মতো হয়ে গেলো প্রিয়তার তিরিক্ষি মুখ। হতভম্ব দৃষ্টি এড়াতে পারলো না। অভী তখন চলে গিয়েছে দৃষ্টিসীমানার বাইরে। লেন এখন নীরব, কোলাহলবিহীন৷ প্রিয়তা অদূরে দাঁড়ানো দেবদারু গাছের দিকে তাকালো। সেও যেন বিদ্রুপ করে বলছে,

‘ আশ্চর্য হচ্ছো কেন প্রিয়তা? ধৈর্য ধরো। আজ অভী ভয়াবহ দুটো কথা বলেছে। কাল চু’মুও খেয়ে ফেলতে পারে। অল দ্যা বেস্ট!’

.
.আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে এক্ষনি ফ্লো করুন ✊🖐️
.
.
.
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here