প্রিয়োসিনী পর্ব -২

#প্রিয়োসিনী
#নীরা_আক্তার
#পর্ব_2
-“ভাবি শুনেছি তোমার ছেলের বউকে নাকি ছেলেপুলেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। ভালো মন্দ কিছু করে ছেড়ে দেয় নি তো?জেনে শুনে এমন মেয়ের সাথে কেন বিয়ে দিলে ছেলেকে,মেয়ের কি অভাব পড়েছিলো দুনিয়াতে?”…
আজ নওরিনের বউ ভাত।সিকদার বাড়িতে মোটামুটি ভালোই আয়োজন করা হয়েছে বউভাতের।যেহেতু হুট করেই দেখতে গিয়ে বিয়ে তই খুব বড় করে না করলেও মোটামুটি কাছের রিলেটিভ দের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।

অতিথিদের মাঝেই কিছু প্রতিবেশিরা নওরিনকে নিয়ে এইসব বলা বলি করছিলো।আড়ালে মুখ টিপে হাসছে।
জিনাত সিকদারের কথাগুলো শুনে মুখ কাচু মাচু করে দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।একমাত্র ছেলের বিয়ে নিয়ে কতোই না স্বপ্ন ছিলো তার।সব ভেঙ্গে চুড়মাড় করে দিলো তার শ্বশুর- শ্বাশুড়ি।
হুট করেই ইসরাকের কাছে বিয়ের আবদার করে বসলো।কোন না কোন কালে কার কাছে কথা দিয়ে রেখেছিলো।তার ফল ছেলেকে ভোগ করতে হচ্ছে।ছেলেটাও হয়েছে তেমন দাদু-দীদার কথা ফেলতে পারলো না।
জিনাত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঘরের দরজা এটে বসে কান্না করছে সে।পাশে শিউলি পারভিন বসা।নওরিনের অতীতের পাতাটা বড্ড কালিমালিপ্ত।এটা মোটামুটি সবারই জানা।নারী দেহে লাগা কলঙ্ক ছাই চাপা আগুনের মতো।যখন তখন জ্বলে উঠতে পারে।তাকে নেভানো এতো সহজ না।তাকে সম্পূর্ণ নেভানোও সম্ভব না।সারা জীবন লোকের কথা শুনতে হবে তাকে।

-বুবু সবাইই তো মনে হয় জানে তোর ছেলের বউয়ের শরীরে কলঙ্ক আছে।কি জানি ছেলেগুলো কি করেছিলো ওর সাথে।ইস্ ছি ছি।আমার ইসরাক বাবা যে হিরার টুকরা ছেলে। কোথায় ভেবেছিলাম তার জন্য চাঁদের মতো বউ আনবো….

শিউলি পারভিনের কথায় কেঁপে উঠে জিনাত সিকদার।অভিমানের দৃষ্টিতে তাকায় বোনের দিকে।বোন তো জানে এমন কথায় তার কষ্ট হয় তাও কেন যে বলছে!

[নওরিনকে সে ছোট থেকেই চিনে।ইশার খুব ভালো বন্ধু হওয়ার সুবাধে নওরিনকে বেশ কাছ থেকেই দেখেছে মেয়েটার মাঝে বড্ড মায়া।দুই ভাইয়ের এক মাত্র বোন। মেয়েটার আদর ভালোবাসার অভাব হয় নি কখনো।সব দিক দিয়েই বেশ গুনি সে।কিন্তু এ যে কলঙ্ক।নিজের ছেলেকে এমন মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।চোখের পানি ছেড়ে দেয়।

শিউলি পারভিন মুখ টিপে হাসছে।বোন এমন যাতাকলে পড়েছে দেখে তার বেশ মজা লাগছে।মনে মনে বার বার উপরওয়ালাকে সে শুকরিয়া জানাচ্ছে।জিনাত তার বড় বোন।মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সে।জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়ে আজ সে রাজরানি আর সে বোনের বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে বেঁচে আছে।বাবা মা নিজের সর্বস্ব উজার করে দিয়েছে বোন জিনাতকে অথচ শিউলি পারভিনকে নিয়ে তারা কখনো মাথায় ঘামায় নি তারা।ছোটবেলা থেকে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত সে।বাবা মা তেমন না দেখে শুনেই এক নেশাখোরের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো তাকে।মারতে মারতে আধমরা করে ফেলতো তাকে।বোন দুলাভাই সেখান থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখেছে।তাতে কি হাজার হলেও তো সে বোনের কাছে আশ্রিত।

জিনাত সিকদারকে কষ্ট পেতে দেখে এতোদিনের গায়ের জ্বালা মিটছে তার।শিউলি চায় জিনাত আরো কষ্ট পাক কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরুক।জীবনের সমস্ত না পাওয়ার রাগ উপরে দিতে ইচ্ছে করছে বোনের এপর]

জিনাত সিকদার নিজেকে কিছুটা সমলে নিয়ে উওর দেয়,
-চাঁদের গায়েও তো কলঙ্ক আছে যেমন নওরিনের গায়ে আছে।ত

শিউলি পারভিন মুখ বাঁকিয়ে উওর দেয়,
-হ্যা আপা তোর ছেলে সেই কলঙ্কিত চাঁদই ঘরে তুলে এনেছে।বুবু তোর ছেলের বউ আদও কুমারী আছে তো?শুনেছি অনেকজন ছেলে পুলে ছিলো।কিছু না করে কি ছেড়ে দেবে?

অসহায় দৃষ্টিতে জিনাত সিকদার তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। মুখে কোনো কথা নেই।
-বুবু এদিকে আয় একটা বুদ্ধি দেই।এতেই বোঝা যাবে কুমারী কি না!কাল তো ইসরাক বাবা ছাদেই ঘুমিয়েছে আজ নিশ্চয়ই বউয়ের কাছে যাবে!!!
…………
বাড়িতেই ছোট খাটো ভাবে বউ ভাতের আয়োজন করা হয়েছে।সেখানেই ছোট্ট একটা স্টেজ করা হয়েছে বউ আর বরের জন্য।নওরিন সকাল থেকে একাই সেখানে বসে আছে।ইসরাক একবারের জন্যও নওরিনের সামনে আসে নি বসা তো দূরের কথা।

নওরিন বউয়ের জন্য রাখা চেয়ারটাই বসে আছে আর সেটার হাতলে হেলান দিয়ে বসে আছে ইশা।
-জান তোকে খুব সুন্দর লাগছে আজকে।জানিস শাড়িটা ভাইয়া নিজে পছন্দ করে কিনেছিলো
একটু অবাক হয়ে তাকায় নওরিন।
-কি?
-হুম। সে অনেক আগেই তো কিনেছিলো।
-আমার জন্য?
-আরে না।একটা দোকানে গিয়ে পছন্দ হয়েছিলো কিনে রেখেছিলো নিজের ফিউচার ওয়াইফের জন্য।
-ওহ্।
-হুম্ম। কিন্তু শাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে তোকে কল্পনা করেই কিনেছিলো।
নওরিন একটু লজ্জা পায়,
-আমি তো কখনো কল্পনাও করিনি তুই আমার ভাবি হবি!
-(…)
-শহরে গিয়ে তোকে কত্তো মিস করেছি জানিস বেস্টু।

ইশা নওরিনকে এটা সেটা বলছে আর নওরিন হু হা করছে।নওরিনের চোখ জোড়া আপাতোতো তার স্বামীকে।কিন্তু তার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না।
-কি রে শুনছিস কিছু?
নওরিন থতমত খেয়ে যায়
-সরি…
ইশা একটু রাগ করে অন্য দিকে তাকায়।
নওরিন বলে উঠে,
-ইশু তুই জানতিস তোর ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে….!
-কি বলবো তোকে আমি, ভাইয়া তো বিয়ের কথা শুনলেই পাগলা ঘোড়ার মোতো ছুটে পালাতো।সেই ভাইয়া হুট করে বিয়ে করে বসলো তাও আবার তোকে।আমি তো বেশ অবাক হয়েছি….ভাইয়া এমন হুট হাট বিয়ে করে বসবে তাও আবার তোকে…

কথাটা বললই ইশা একটু থেমে যায়।আড় চোখে তাকায় নওরিনের দিকে।
-সরি আসলে আমি
-বাদ দে….আসলেই আমার মতো এমন কলঙ্কিনী মেয়েকে কোনো পুরুষ বিয়ে করবে এটাই তো কখনো কল্পনা করি নি।
নওরিনের গাল বেয়ে একফোটা পানি পড়ে।তোর ভাই হয় তো অনেক বড় মনের মানুষ

ইশা নওরিনকে জড়িয়ে ধরে সরি বলে।
সেদিন যা কিছু ঘটেছিলো তাতে নওরিনের কোনো দোষ নেই।দোষ তো তার নিজের।তার জন্যই তো তার বেস্ট ফ্রেন্ডকে মাথায় এতো বড় কলঙ্কের বোঝা নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে।
*****

নওরিনের বাড়ি থেকে নওরিনের বড় ভাই-ভাবি,ছোট ভাবি। বাবা আর চাচারা এসেছে।নওরিনের ছোট ভাই শহরে জব করে।হটাৎ বিয়ে হওয়াতে ছুটিটা ম্যানেজ করতে পারেনি।

ছোট ভাবি নওরিনের পাশে এসে বসে।
-হ্যা রে রিনি কাল রাতে কি হয়েছিলো বলতো?তোর বুড়ো জামাই কি তোকে কম আদর করেছে তাই রাগ করেছিলি?নাকি পারে নাই…?

কথাটা বলেই মুখ চেপে হাসতে থাকে সে।পাশে নওরিনের বড় ভাবি প্রিয়া ও তালে তাল মিলিয়ে হাসছে।
-সমস্যা জামাইকে আমরা বলে দিবো যাতে কালকে ঘার্তি পরা আদরটা যেন আজ পুষিয়ে দেয়।

নওরিন একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নেয়।

নওরিন ভাবিদের কিছু বলতে যাবে তখনই মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে ইশরাক দাড়ানো।চোখ দুটো রক্ত বর্ণ ধারন করে আছে।রাগে ফুসছে সে!
ইসরাকের সাথে তার আরো দুইজন ফ্রেন্ড ও আছে।তারা মুখ টিপে হাসছে।

ভাবিদের কথা হয়তো তারা শুনে ফেলেছে।নওরিনের এই মুহূর্তে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।

ইসরাক বেশ শান্ত স্বরেই বন্ধুদের সাথে নিওরিনের পরিচয় করিয়ে দেয়।

নওরিন সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিতে গেলেই ইসরাকের বন্ধুদের মাঝে একজন বলে উঠে,
-তুমি তো কক্সবাজারের সেই নওরিন না?তোমাকে তো আমি ভালো করেই চিনি!আমার বন্ধু তো…

বন্ধুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ইসরাক তার মাথায় হাল্কা করে একটা বাড়ি দেয়।
সে চুপ হয়ে যায়।ইসরাক আর তার বন্ধুরা সেখান থেকে চলে যায়।নওরিন মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
“ইস্ কি লজ্জা।তার জীবনের সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা কক্সবাজারেই ঘটেছিলো।তার মানে এরাও কি সব জানে?”

নওরিনের গাল বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।নওরিন চোখ মুছে নিজেকে সামলে নেয়।নওরিনের ভাবিরাও সেখানেই ছিলো। তারা নওরিনকে এটা সেটা বলে সান্ত্বনা দিতে থাকে।

বউ ভাতের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে।অতিথিরা মোটামুটি সবাই চলে গেছে।
নওরিনের বাড়ির লোকেরা ড্রইং রুমে বসে আছে জামাই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।সঙ্গে ইসরাকের দাদা আমজাদ শিকদার,দাদী তনয়া শিকদার আর বাবা ইমতিয়াজ শিকদারও সেখানে রয়েছে।নেই শুধু ইসরাকের মা।তিনি সেই দুপুর থেকেই ঘরের দরজা আটকে বসে আছেন।একবারের জন্যই বার হন নি।

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর,
ইসরাক নিচে নামে।পেছন পেছন নওরিনও নেমে আসে সঙ্গে একটা ল্যাগেজ।ইসরাক ভ্রু কুচকে তাকায় তার দিকে,

সবাই বিদায়ের জন্য তৈরী হতে থাকে।এমন সময় ইসরাক সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠে,
-আপনার মেয়ের নাকি আমাকে পছন্দ হয় নি।সে আমার সাথে থাকতে চায় না।চলে যেতে চায়।সে যদি যেতে চায় আপনারা তাকে নিয়ে চলে যান।আমি কোথাও যাবো না।সে চলে গেলে আমার পরিবারের করো কোনো আপত্তি নেই।আমারও নেই।মাসে যা খরচ লাগে আমি পাঠিয়ে দেবো।প্রয়োজনে একটু বারিয়ে দেবো।

ইসরাকের এমন কথায় সবাই ভ্যাব্যাচ্যাক্যা খেয়ে যায়।বিশেষ করে নওরিনের বাবা।বিয়ের পর দিনই জামাইয়ের এমন কথা সে যেন হজম করে উঠতে পারছে না।তবে কি এমন হুট হাট করে বিয়ে দেওয়াটা তার ভুল হয়ে গেলো?মেয়েটাকে কি সারা জীবন পুড়তে হবে এই কলঙ্কের অনলে?

নওরিন সেখানেই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
প্রিয়া মুখে হাসি হাসি ভাব এনে বলতে শুরু করে
-আসলে জামাই ভাবি ননদের মাঝে এমন কতো কথা হয়।রিনি মজা করেই কথাগুলো বলেছে।তাই না রিনি?কি হলো বল জামাইকে
নওরিন মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।

ইসরাক মুচকি হেসে উওর দেয়,
-আমি কিন্তু মজা করিনি ভাবি।সিরিয়াসলি বলেছি।
ইমতিয়াজ শিকদার ছেলেকে ধমক দেয়।
পাশ থেকে আমজাদ শিকদারও নাতীকে বলে উঠে,
-এ কেমন কথা দাদু ভাই।
-সরি দাদু।আমি কোথাও যাবো না
-দাদুভাই…
-প্লিজ দাদু বিয়ে করতে বললে করলাম আর কিছু বলো না প্লিজ…!
তিনি আরো কিছু বলতে চাইলেও পাশ থেকে তার স্ত্রী বারন করে।অতিথি দের সামনে কথা না বাড়ানোই ভালো।

ইসরাক সেখানে আর দাড়ায় না।সোজা নিজের ঘরে চলে যায়।

সে যে নওরিনদের বাড়ি যাবে না এটা সবাই বুঝে গেছে।নওরিনের বাবা অসহায় দৃষ্টিতে নওরিনের দিকে তাকায়।নওরিন মুচকি হেসে ল্যাগেজ হাতে ঘরে ফিরে আসে।

ল্যাগেজ রেখে এদিক সেদিক খুজতে থাকে ইসরাককে।লোকটার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
নওরিন এদিক সেদিক দেখে কিন্তু কোথাও নেই ইসরাক।
একটু পরেই নওরিন সিগারেটের গন্ধ পায়।বারান্দা থেকে আসছে গন্ধটা। নওরিন উঁকি দেয়।

ইসরাক বারান্দায় দাড়িয়ে স্মোক করছে।
নওরিন একটা কাশি দেয়।ইসরাক না তাকিয়েই প্রশ্ন করে,
-কিছু বলবেন?
-একটু কথা ছিলো আপনার সাথে!
-হু
-আমি আসলে ঐ ভাবে কিছু বলিনি।আপনি বোধয় রেগে আছেন।
-তো?
-চলুননা আমাদের বাড়ি যাবেন এটা তো নিয়ম!!

ইসরাক সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নওরিনের কাছে এসে গা ঘেসে দাড়ায়,
-আমার সাথে থাকতে হলে আমি যা চাইবো তাই করতে হবে।বেশি পন্ডিতি আমি ইসরাক সিকদার পছন্দ করে না।

নওরিন একটু ভয় পেয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যায়।নওরিন ইসরাকের সামনে থেকে চলে যেতে নিলে ইসরাক খপ করে নওরিনের হাত ধরে নেই। তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ফেলে দেয়।তারনিজে নওরিনকে চেপে ধরে বিছানায় সাথে।ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দেয়।
নওরিন বেশ বুঝতে পারছে এবার কি হতে চলেছে।
নওরিন কিছুটা ছটপট করতে করতে বলে উঠে,
-আমি প্রস্তুত নয়।
-সো হোয়াট?
-আই নিড টাইম। প্লিজ…আজ না
-আই ডোন্ট কেয়ার…..আই ওয়ান্ট ইউ রাইট নাও

নওরিন আর কিছু বলে না।চোখের কোন বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে…..

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here