প্রিয়োসিনী পর্ব-৩৩

#প্রিয়োসিনী
#নীরা_আক্তার
#পর্ব_৩৩
আমানের বাবা মায়ের গল্পটা ছিলো আর সব সাধারণ গল্পের মতোই।একজন বখে যাওয়া পুরুষ আর একজন অসাধারণ নারীর গল্প।সেখানে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না।আমান মায়ের লিখার প্রতি পরদে পরদে ভালোবাসার নতুন নতুন মানে খুজে পাচ্ছিলো আমান।ইস্ মা কতো আবেগ দিয়ে লিখেছে বাবার জন্য।কিন্ত শেষের দিকে….শেষের দিকে এমন কেন?বড্ড অগোছালো,বড্ড কষ্ট মেশানো উক্তিগুলো?মা কি কষ্ট পেয়েছে? বাবা মায়ের মাঝে কি কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এসেছিলো?
আমান বেশ বুঝতে পারছে শেষের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠায় মা নিজের কষ্টগুকে মেলে ধরেছে। তাদের মাঝে হয়তো কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটেছিলো।তবে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটাকে…?
আমান এমন কিছু ভাবছিলোই হটাৎ কোথা থেকে জিনাত সিকদারের আগমন ঘটে,
-কি করো আব্বা?
আমান জিনাত সিকদারের গলা পেয়ে চমকে উঠে,তিনি থমথমে মুখে সেখানে দাড়িয়ে আছেন।

জিনাত সিকদার আমানের পাশে গিয়ে বসে।আমান মেঝেতে দুই পা ভাজ করে বসে বসে মায়ের ডায়েরি টা পড়ছিলো ।জিনাত সিকদার শান্ত গলায় বলে উঠে,
-শুধু শুধু মন খারাপ করার জন্য এই ঘরে কেন এলে বাবা।কি দরকার ছিলো অতীত হাতড়ানোর?তাতে যে কষ্ট বাড়ে।
আমান উঠে গিয়ে জিনাত সিকদারের কোলে মাথা রাখে,
-আমার বাবার কি চরিত্র খারাপ ছিলো বড় মা?মাকে কষ্ট দিয়েছিলো?

-ছিহ্ বাবা, নিজের বাবা নিয়ে এমন কথা বলতে নেই তার উপর তিনি মৃত।আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুক।তুমি ঘরে যাও।অতীত শুধু কষ্ট দেবে আর কিছুই না….
জিনাত সিকদার আমানকে কিছু বলতে না দিয়ে ঠেলে ঘরে পাঠিয়ে দেন।
আমানেী ঘরের দরজা খুলার শব্দেই তিনি টের পেয়েছিলেন আমান এই ঘরে এসেছে।আসবেন কি আসবেন না ভাবতে ভাবতে চলে এলেন।
-বড়মা,বাবা কি মাকে ঠকিয়েছিলো?
জিনাত সিকদার আমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন,
-আমি শুধু এতোটুকুই বলতে পারি যে তোমার বাবা তোমার মাকে এতোটাই ভালোবাসতো যে তোমার মা চাইলে তোমার বাবা তাকে আকাশের চাঁদও এনে দিতো….তুমি এই সব নিয়ে ভেবো না।
আমান হা করে তাকিয়ে থাকে জিনাত সিকদারের দিকে,
-ভুলবোঝাবুঝি হয়েছিলো বাবা।সামান্য ভুল বোঝাবুঝি।ভালোবাসাই বিশ্বাস থাকতে হয়।ধৈর্য থাকতে হয়।তুমি এইসব নিয়ে ভেবো না হায়াত মুউত আল্লাহর হাতে।আল্লাহ ভালোমানুষদের বেশি দিন দূরে রাখে না।
তিনি একটু থেমে শান্ত গলায় বলে উঠেন,
-ঘরে যাও।
আমান বড় মা কে কোনো প্রশ্ন করে না।মাথা নিচু করে ঘরে চলে যায়।

[[[জিনাত সিকদার জা-এর ছবিটার সামনে দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন।যেদিন এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী, গুনি,শিক্ষিত মেয়েটাকে তার দেবর বিয়ে করে ঘরে এনেছিলো সেদিন প্রথমবারের মতো জিনাত সিকদার হিংসা কি জিনিস তা উপলব্ধি করেছিলো।প্রিয়োতা অবশ্য তাকে বড় বোনের মতো করে মানিয়ে নিয়েছিলো।প্রতি পদে পদে তাকে সন্মানের আসনে বসিয়ে রেখেছিলো।প্রিয়োতাকে জিনাত সিকদারও বড় বোনের মতো করে কাছে টেনে নিয়েছিলো।মাঝে মাঝে তিনি নিজে থেকেই বলে উঠতেন,
তার দেবরের মতো বানরের গলায় কি করে প্রিয়োতার মতো মুক্তার হার উঠলো??
প্রিয়োতা হেসে গড়া গড়ি খেতো।

বেশ সুখের সংসার ছিলো তাদের।তবে সুখের নদীতেও ভাটা পড়ে।
সেই ভাটা ছিলো শিউলি পারভিন। শিউলির জোয়ারে প্রিয়োতার সংসারটা একেবারে ভেসে চলে গিয়ছিলো।

স্বামীর সাথে তালাক করিয়ে বোন শিউলিকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন সিকদার বাড়িতে।তাদের বাপের বাড়ি তখন প্রত্যন্ত গ্রামঅঞ্চল বললেই হয়।সেই সময় তালাক প্রাপ্ত মেয়েদের সমাজের বোঝা বলেই ধরে নেওয়া হতো। এমন মেয়ে ঘরে রাখলে লোকজন ও নানা রকম অকথা কু কথা বলতো, কুনজর তো স্বাভাবিক ব্যাপ্যার ছিলো।

একরকম জোর করেই শিউলি কে জিনাতের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তাদের বাবা মা।শিউলিকে তিনি সিকদার বাড়িতে নিয়ে যান।শিউলি তখন এ বাড়িতেই থাকতো।

আমানের বাবার চরিত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও প্রিয়োতার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সে স্বামীকে লাগাম পড়াতে ব্যার্থ হয় নি কখনোই।প্রিয়োতার ভালোবাসায় আমানের বাবা নিজেকে একদমই পাল্টে ফেলেছিলেন।

কিন্তু কবে কি ভাবে সেই বন্ধন আলগা হলো তা প্রিয়োতাও বুঝতে পারে নি।তবে স্বামীর বদলে যাওয়া রূপটার সাথে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছিলো সে।
সেদিন আমান আর তার মা প্রিয়োতা তাদের নানা বাড়িতে বেড়াতে যায়।আমানের বাবা অবশ্য এ বাড়িতেই ছিলো।আর ইশা জিনাত সিকদারের পেটে…তখন তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ।এসময় মেয়েরা সাধারণত বাবার বাড়িতেই থাকে।তিনিও সেখানেই ছিলেন।
ইসরাকের স্কুলে পরীক্ষা থাকায় ইসরাকের দায়িত্ব বোনকে দিয়ে তিনি বাবার মায়ের কাছে বেশ নিশ্চিতেই ছিলেন।

বিপত্তি বাঁধলো সে দিন যখন প্রিয়োতা হুট করে বাড়ি এসে আমানের বাবা আর শিউলিকে এক সাথে দেখে ফেলে।খুব অন্তরঙ্গ অবস্থায় না হলেও বেশ কাছাকাছি ছিলো তারা।প্রিয়োতা বড়াবড়ই ছিলো শক্ত পোক্ত, বাঘিনীর মতো।নিজের জিনিসের প্রতি একটু বেশিই যন্তশীল।একটু বেশিই দৃঢ় ব্যক্তিত্তের মানুষ।

স্বামীকে এভাবে অন্য নারীর সাথে দেখে ঘায়েল বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়ে দুইজনের উপর।ছোট্ট আমান মায়ের এমন পাগল প্রায় রূপ দেখে ভয় পেয়ে ছুট লাগায় দীদার কাছে।এদিকে প্রিয়োতা হাতের কাছে যা পায় তা দিয়ে আঘাত করতে থাকে শিউলির উপর।স্বামীকেও ছাড় দিচ্ছে না সে।
কোনো রকমে আমানের বাবা তাকে বাঁধা দিলে সেই মুহূর্তে তিনি স্বামীকে ত্যাগ দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।

প্রিয়োতার শেষ কথা ছিলো আমার সংসার,আমার স্বামী শুধুই আমার।আমার গন্ডিতে আমি কাওকে আসতে দেবো না।আর যদি সেটা আমার না হয় অন্য কারো হবে না।

প্রিয়োতার সাথে সাথে আমানের বাবাও বেরিয়ে যায় তার পিছু পিছু….
সেটাই তাদের একসাথে শেষ যাত্রা।সেদিন তারা একসাথে ফিরেছিলো ঠিকিই তবে লাশ হয়ে।বেসামাল গাড়ি চালানোর ফলে গাড়ি দূর্ঘটনার স্বীকার হয়।দুজনই একসাথে মারা যায়।

জিনাত সিকদার বাবার বাড়িতে থাকায় এইসবের কিছুই জানতো না।পরে জেনেছিলো।কিছু কথা কাজের লোকের কাছে কিছু কথা পরিবারের লোকজনের কাছে আর বেশির ভাগ শিউলি পারভিন নিজেই জানিয়ে ছিলো।জিনাত সিকদার সেদিনই বোনকে ত্যাগ করেছিলো।চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলো।

লাথি মেরে শিউলি পারভিনকে বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলো সেদিনই।কিন্তু কিছু দিনের মাঝেই খবর আসে শিউলি পারভিন নাকি অন্তঃসত্ত্বা।

জা আর দেবর হারানোর ধাক্কা সহ্য করে উঠতে না উঠতে বোনের এমন নোংরামির খবর শুনে জিনাত সিকদার একে বারে থমকে যায়। ইশা তখন ১ মাসের নবজাতক।
বাবা-মা তাকে ডেকে পাঠায় শিউলির ব্যবস্থা করার জন্য।জিনাত সিকদার এক কথায় না করে দেয়।এমন বোনের জন্য তিনি আর কিছুই করবেন না।তার মতে শিউলি পারভিনের লাশও তিনি সিকদার বাড়ির সীমানায় আনবেন না।

বোনের উপর ঘৃনা থেকেই তিনি এক প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।কিন্তু সমস্যা বাধে তখন যখন গ্রামের লোক জানা জানি হয়ে যায়।
আড়াই বছরের ডিভোর্সি মহিলা নাকি অন্তঃসত্ত্বা,ঘটনাটা বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, এমন কলঙ্কিনী মহিলাকে গ্রামে রাখা যায় না।
গ্রামে বিচার সভা বসে,শিউলি পারভিনের মাথার চুল কেটে, মাথায় ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে বিতারিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।পরিবার না মানলে পরিবার সহ উচ্ছেদ করা হবে তাদের।সন্তানের বাবার নাম বা পরিচয় কিছুই জানতে চাওয়া হয় না সেই বিচারে।
সবাই জানে এখানে সিকদার বাড়ির কোনো পুরুষ জড়িত তবে সরাসরি বলার ক্ষমতা কারোর নেই…।
সিকদার বাড়ির প্রতিপত্তির সামনে তারা তুচ্ছ।সকল শাস্তি শিউলি পারভিনের প্রাপ্য।

মেয়ের এমন শাস্তি কখনোই কোনো পিতার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।মেয়ে যতোবড়ই অন্যায় কারী হোক না কেন।সন্তানের অসন্মানে মাতা পিতার হৃদয় কেঁপে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। জিনাত সিকদারের বাবা সেখানেই হার্ট অ্যাটাক করেন।গোটা একটা দিন শিউলি পারভিন কে দরগার সামনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।এক ফোটা পানিও দেওয়া হয় না।যে যখন যেভাবে পেরেছে আঘাত করেছে।কেউ জুতা পেটা করেছে কেউ বা ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।কেউ বা থুথু ছিটিয়েছে।

বাবার এমন খবর শুনে জিনাত সিকদার ছুটে আসে বাবার কাছে। বাবা মেজো মেয়ের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারেন নি।জিনাত সিকদারের পায়ে পরে যান তিনি।একটাই করুন আকুতি শিউলিকে বাঁচা।দোষ শিউলির একার নয়।পুরুষমানুষ ও তো দোষ করেছিলো।

মৃত্যু পথ যাত্রী বাবার এমন করুণ আকুতি জিনাত সিকদার ফেলতে পারে নি।জিনাতের দূর্বলাতর সুযেগ নিয়ে তার বাবা তার থেকে মেয়েকে বাঁচানোর কথা আদায় করে নেন।মেয়ের দায়িত্ব তার ঘারে সপে দেন।জিনাত সিকদার বাবার মরঃ মরঃ মুখের দিকে তাকিয়ে কথা দিয়ে দেয়।তার চেয়ে বড় কথা ঘটনাটা যতো বাড়বে সিকদার বাড়ির গায়েও ততো কালি লাগবে।

যদিও জিনাত সিকদার মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো দোষ শিউলি পারভিনেরই।চাইলেই সে নিজেকে সড়ে আনতে পারতো।অথবা তাকে জানাতে পারতো।না সে তা করে নি।সে নিজে থেকেই আমানের বাবাকে তার দিকে আকৃষ্ট করেছে।সিকদার বাড়ির বউ হওয়ার প্রবল ইচ্ছে থেকেই সে এমনটা করেছে তা জিনাত সিকদার বেশ বুঝতে পেরেছে।সে এই শাস্তিরই যোগ্য।তবে বাবার কথা রাখতে সে আধমরা বোনকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যায়।বোনের শারিরীক অবস্থা দিন খারাপ হতে থাকে।অত্যাচার অপমানে সে একেবারে নুইয়ে পড়েছিলো।তার কিছুদিন পরই বাচ্চাটাও নষ্ট হয়ে যায়।সব কিছু যেন রাতারাতি শেষ হয়ে যায়।শিউলি পারভিন একে বারে ভেঙ্গে পড়ে।তবে জিনাত সিকদার সেদিন তাকে সান্ত্বনা দেয় নি।
এককথায় জানিয়ে দিয়েছে,
“যেমন কর্ম করবি তেমন ফল পাবি”

তারপর
জিনাত সিকদার বোনকে তাদের অন্য এক বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।কিছুদিন পর সিকদার বাড়ির সবার মাথা মুরব্বিদের সম্মতিতেই শিউলি পারভিনকে আবার এবাড়িতে এনে রাখা হয়।সে এখন সিকদার বাড়ির সন্মানের জন্য ক্ষতিকর।অন্যকেউ হলে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতো কিন্তু জিনাত সিকদারের বোন সে জিনাত ও বোনের প্রাণ নিতে রাজি হবে না।

তারপর থেকে শিউলি পারভিন এই পরিবারের স্থায়ী আশ্রিতা।বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিনাদ সিকদার বোনকে ঘর ছাড়া করতে পারে না।তখন অবশ্য বাপের বাড়ির গ্রামে শিউলি পারভিনের প্রবেশও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো।চাইলেও তাকে সেখানে পাঠানো যেতো না]

জিনাত সিকদার আচল টেনে চোখের পানিটা মুছে নেয়।প্রিয়োতার এই পরিনতির জন্য পরোক্ষ্য ভাবে সে নিজেই দায়ী।না সে বোনকে এখানে আনতো না এই জটিলতার সৃষ্টি হতো।

মনে মনে জিনাত সিকদার আজোও নিজেকেই সব কিছুর জন্য দায়ী মনে করেন।অনুশোচনায় বার বার মাথাটা নুইয়ে পড়ে তার। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে যান।তারপর বিশাল বড় একটা তালা ঘরের দরজার সামনে ঝুলিয়ে দেন।
তিনি চাননা আমান এইসব জানুক সেটা শিউলি পারভিনের জন্য নয় বরং আমানের নিজের জন্য।শিউলির যা শাস্তি তা তো সে পেয়েছেই। তার নিজের সন্তানও তাকে মা বলে ডাকে না।

তার চেয়ে বড় কথা বাবার চরিত্র মায়ের সাথে হওয়া অন্যায় সব জানলে ছেলেটা নিতে পারবে না।হয় তো বাবাকে ঘৃনা করবে।মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবাকে দায়ী করে সারা জীবন অন্ধকারে কাটিয়ে দেবে।একটু একটু করে কষ্ট পেয়ে বড় হবে।তাই জিনাত সিকদার চায় নি আমান সবটা জানুক।বাবাকে ঘৃনা করুক।জীবনের এমন অধ্যায় গুলো আড়ালে থাকায় ভালো।এতে সন্তানের মানসিক সুস্থতায় ব্যাঘ্যাত ঘটে।
_________________
ভোর বেলা ফজরের নামাজ শেষ করে,
নওরিন বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো।আজ তিনদিন হলো সে বাড়িতে ফিরে এসেছে।তিশা আর নিবিড় তিশার বাবার বাড়িতে।
নওরিন আজ থেকে কলেজ যাবে। পরীক্ষার বেশি দিন বাকি নেই।অনেকটা সময় সে নষ্ট করে ফেলেছে।আর নষ্ট করতে চায় না।
এই দুইদিন ইসরাকের সাথে তার কোনো রকম কথা হয় নি।যোগাযোগ একে বারে বন্ধ বললেই চলে।ইসরাক কয়েকবার কল করেছে তবে সে রিসিভ করে নি।

নওরিন ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে ফোনটা বাজছে।ইসরাক আবারও ফোন করেছে।রোজ এই সময় ইসরাক তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তারপর নওরিনকে ফোন দেয়,
দুদিন যাবত সে কলটা ইগনোর করছে।ইসরাকের সাথে সে কথা বলতে চায় না। লোকটার মধ্যে কেমন একটা জাদু আছে।বড্ড টানে…

নওরিন এইসব ভাবতে ভাবতেই তার ফোনে টুং করে মেসেজ আসে।ইসরাক টেক্সট করেছে,
“তুমি নিচে নামবা নাকি আমি গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে পুড়া এলাকা বাসির ঘুম ভাঙ্গাবো”

নওরিন মেসেজ সিন করে রেখে দেয়,এমা সত্যি সত্যিই ইসরাক হর্ণ বাজাচ্ছে। ইচ্ছে মতো।থামার নাম নেই।
-উফ্ লোকটা বড্ড জ্বালায়।সময় হোক সব সুধে আসলে বুঝিয়ে দিবো।

নওরিন কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়। নিচে তাকে যেতেই হবে।নওরিন মাথায় ওড়না পেচিয়ে, আলমারি থেকে একটা কাগজ হাতে নিচে নেমে যায়।মুখে শয়তানি হাসি।

নওরিন কে আসতে দেখে ইসরাক মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নওরিন কাছে আসতেই সে দুহাত বাড়িয়ে দেয় জড়িয়ে ধরার জন্য।
নওরিন হাত বাড়িতে ইসরাককে থামিয়ে দেয়,
-আমাকে ধরবেন না প্লিজ!
-তুমি এখনো রেগে আছো?
-কিসের রাগ?আমি কখনো রাগ করি না।
-প্লিজ বাড়ি ফিরে চলো….
-স্বামী, সাগর নেই, হাসপাতাল থেকেই বাড়ি চলে গেছে।এখানে আর আসে নাই।আর যদি থাকতোও তবুও আমি পিছলাইতাম না আমাকে একটু বিশ্বাস করতে পারতেন।
-আমি তো বিশ্বাস,
-বাদ দিন যে ভালোবাসাই বিশ্বাস নেই সে ভালোবাসার কোনো মানে নেই।
নিন…
নওরিন কাগজটা ইসরাকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে
-সই করে দিন।
ইসরাক অবাক চোখে তাকায়,
-কি এটা?
-ডিভোর্স পেপার,
-তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নওরিন।তোমার মনে হয় না তুমি একটু বেশি বেশি করতেছো?
-দেখুন আমাদের সম্পর্কটা কখনো মেঘ কখনো রোদ্দুরের মতো।কখনো রোদ্দুরের মতো খুশি ঝলমল করে চারদিক।কখনো আমাদের আকাশে মান অভিমানের মেঘ ছেয়ে থাকে তারপর আমার চোখের পানি বৃষ্টির মতো ঝড়ে পরে।এভাবে কতোদিন চলবো বলুন।এবার তো আমাদের কিছু একটা বাছতে হবে…!
ইসরাক নওরিনের দিকে তাকিয়ে আছে,
-ভাইয়ের কথায় এতোটা প্রভাবিত হলে?
-কারো কথায় নয় স্বামী।নিজের মর্জিতে চাইছি।আপনার থেকে দূরে যেতে চাইছি।ভালোবেসে কখনো বিন্দু মাত্র সন্মান দেন নি।আপনি বিচ্ছেদই ডিসার্ভ করেন।আমি মেঘটাই বেছে নিলাম
-তোমার তাই মনে হয় নওরিন?
-সবারই তাই মনে হয়।
–আমি সত্যিই কখনো তোমাকে অসম্মান করতে চাই নি!
-বাদ দিন। আপনি না বলেছিলেন আমি চাইলেই নাকি আমাকে ছেড়ে দেবেন আমি চাইছি।দিন এবার মুক্তি দিন
-সত্যিই চাও?
-হুম্ম…
-বেশ….
ইসরাক চোখ মুখ লাল করে রাগে গর গর করতে করতে কাগজটা না পড়েই সই করে দেয়…
-খুশি…??
-ভালোবাসলে যত্ন করতে হয়।বেঁধে রাখতে হয় ভালোবাসার মানুষকে।এটা অধিকার আর দায়িত্ব দুটোরই সংমিশ্রণ।এভাবে মাঝ পথে হাত ছেড়ে দিতে নেই
-তুমি চেয়েছো নওরিন
-কিছু চাই না আমি…আপনার চোখের পানি নাকে পানি যদি এক না করিয়েছি আমি নওরিন সিকদার নই…সরি এখন তো আমি আর সিকদার বাড়ির বউ নেই….
নওরিন পেপার নিয়ে উল্টো পথে হাটা ধরে,
ইসরাক নওরিনের হাত টেনে ধরে,নওরিন ঝিটকানি দিয়ে হাত সড়িয়ে নেয়,
-ডোন্ট টাচ মি।কতো কিছু সহ্য করেছি আমি তবুও ঘর ভাঙ্গতে চাই নি।কিন্তু আপনি…..

নওরিন ছুটে ঘরে চলে যায়।ইসরাক তাকিয়ে আছে নওরিনের দিকে।সত্যিই বলতে সে নওরিনকে যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছে।তবুও তো মেয়েটা তাকে ছেড়ে যায় নি আজ হটাৎ কি হলো….?কেন করছে এমন?নওরিন কি সিরিয়াস?ঐটা কি আদও ডিভোর্স পেপার ছিলো?কি চায় নওরিন?

ইসরাকের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কষ্ট আর বিস্ময় মিশ্রিত অনুভূতি। ইসরাক কোনো রকমে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি আসে।ঘরে এসে সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।সারা শরীর ঘেমে একাকার ভীষন নার্ভাস লাগছে তার।
নওরিন কি সত্যিই সত্যিই সবটা শেষ করে দিলো?
______________
সাগর আর স্নেহা কফি সপে পাশা পাশি বসে আছে।স্নেহা নিজেই সাগরকে ডেকেছে।সাগর মুখ কাচু মাচু করে বসে আছে।
স্নেহা বেশ কিছুক্ষণ সাগরের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দেয়,
-প্লিজ এতোটা নার্ভাস হবে না।আমি আপনাকে বিপদে ফেলার জন্য ডাকি নি!
সাগড় চোখ মুখ কুচকে উওর দেয়,
-আপনি যতোবারই আমাকে দর্শন দিয়েছেন ততোবারই ঝড় তুলে দিয়েছেন,সাথে থাপ্পড় ফ্রী
স্নেহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সাগরের দিকে,
-সরি বিশ্বাস করুন আমি ভুল বুঝেছি আপানাকে।সত্যিই আমার এমনটা করা উচিৎ হয় নি।সরি বলার জন্যই তো কফি শপে ডাকলাম এটা আমার পক্ষ থেকে সরি ট্রিট।
সাগর মুখ ঘুরিয়ে নেয়,
–আমার বাবা মাও কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি।আর আপনি কখনো ছাড় দেন নি।
স্নেহা মুখ টিপে হাসে,
– ঠিক আছে ঠিক আছে।এই কান ধরলাম মাফ করে দিন।
সাগর ছোট্ট করে হেসে উওর দেয়,
-ইট’স ওকে।

এবার বিদায়ের পালা।স্নেহা সাগরের থেকে বিদায় নিয়ে বিল মিটিয়ে আগে আগে বের হয়ে যায়।সাগর স্নেহার পিছু পিছু আসতে থাকে।
প্রায় মাঝ রাস্তায় আসতেই সাগর চেঁচিয়ে উঠে,
-এই যে মিস আপনার জামার হুক খোলা সব দেখা যাচ্ছে।সাগর কথাটা বেশ চেচিয়েই বলে উঠে,
সাগরের কথায় স্নেহা দাঁড়িয়ে যায়।আশে পাশের লোকজন তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
স্নেহা রাগে গজ গজ করতে করতে তেড়ে আসে।সাগরের গালে আবারও একটা চড় বসিয়ে দেয়,
-আপনার ব্যাপ্যারে শুনে আপনাকে তো ভালো ভেবেছিলাম সাগর।কিন্তু আপনি তো আসলেই একটা বখাটে…..এভাবে আমায় লজ্জায় ফেলে প্রতিশোধ নিলেন
সাগর গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠে,
-আপনার কখনো বিয়ে হবে না মিস ঝগড়ুটে,মারখুটে মেয়ে মানুষ। বিয়ে হলেও আপনার বরের উচিৎ হবে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা আপনার হাত বেঁধে রাখা।
-কি বললেন?বখাটে…সন্ত্রাসী..
-ব্যাস থামুন…আপনার পিঠের লাল তিলটা দেখা যাচ্ছে।বেশ সুন্দর তিলটা।ফর্সা পিঠে লাল তিল দেখে যে কেউ কু নজর দিবে।আমি কিন্তু দেই নি।আমাকে ভুল বুঝবেন না।
স্নেহা দমে যায় আসলেই তো তার পিঠে একটা তিল আছে।হুক খোলা না থাকলে এটা দেখার কথা না।
সাগড় গা থেকে ব্লেজার খুলে স্নেহাকে পড়িয়ে দেয়,
তারপর একটা রিক্সা ডেকে স্নেহাকে তুলে দেয়,স্নেহা মুখ ছোট করে বলে উঠে,
-এটা ফিরিয়ে দেবো কি করে?আপনার নাম্বারটা
-ফেসবুকে অলরেডি ব্লক করেই দিয়েছি।আমি মরে গেলেও আপনাকে আমার নম্বার দেবো না প্লিজ এবার মাফ করুন..আমাকে।আর চড় খেতে চাই না পায়ে ধরি,প্রয়োজন ফুড়িয়ে গেলে এটা ফালায়ে দিবেন।
স্নেহা মুচকি হেসে বলে উঠে,
-একটা আইডিতে ব্লক দিলে আরো দশটা খুলতে পারবো।আর রইলো নাম্বারের কথা, সেটা চাইলে জোগার করে নিতে পারবো, দিতে হবে না।সরি শেষ বারের মতো মাফ করে দিন।

সাগর মুখ ঘুরিয়ে নেয়। স্নেহা সেখান থেকে চলে যায়।তবে যতোক্ষণ সাগর চোখের আড়াল না হয় ততোক্ষণ পর্যন্ত স্নেহা পেছন ফিরে সাগরের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
কি অদ্ভুত মেয়েরে বাবা।একেবারে ঝড়ো হাওয়া। সাগর নিজে নিজেই হেসে দেয়,সেই হয়তো পৃথিবীর প্রথম পুরুষ যে বিনা কারনে একটা মেয়ের হাতে চড় খেয়েও এভাবে হাসছে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here