#প্রিয়ংবদা
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়
#অন্তিম_পাতা
৩৫.
এই পৃথিবী ভীষণই অদ্ভুত!সময়ের আবর্তনে যেমন জীবনে তৈরী হয় নতুন নতুন ক্ষত ঠিক তেমনই সময়ের বয়ে চলাই করে দেয় সেই ক্ষতের উপশম!
ঋতমবাবু আর টাপুর দেবীর মৃত্যুটাও হৃদিতার জীবনের সবচেয়ে দগদগে একটা ক্ষত,তবে ওনাদের মৃত্যুর দীর্ঘ ছ’মাস পর আজ হৃদিতার সেই ক্ষত শুকিয়ে এসেছে অনেকটাই!
সারাজীবন খুব যত্নে তাকে আগলে রাখা সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দুটো,হৃদিতার নিঃসঙ্গ জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু দুজন তাকে ছেড়ে চলে গেছে,চাইলেও আর সে কখনোই তাদের ছুঁতে পারবে না,ছুটে গিয়ে বাবা-মা কে জড়িয়ে ধরে আদর খেতে পারবে না এসব চরম কঠিন সত্য হৃদিতার জন্য মেনে নেয়া এতটা সহজ ছিলনা!
তবুও কথায় বলে না,”টাইম ইজ দা বেস্ট হিলার!”
হৃদিতার ক্ষেত্রেও কথাটা সমানভাবে সত্যি।
বাবা-মা মারা যাবার ছ’মাস পর হৃদিতা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক,শান্ত!কষ্ট হলেও মেনে নিতে পেরেছে ওনারা আর নেই,এই এতবড় পৃথিবীতে তাদের একমাত্র হৃদকে ছেড়ে পারি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে!
প্রথম কিছুদিন তো কারো কোন কথাই শুনতে চাইতো না!কেবল বসে থাকতো গুম মেরে।থেকে থেকে কেঁদে উঠত ডুকরে, চিৎকার করতো আকাশের দিকে তাকিয়ে, বারবার মিনতির স্বরে বলতো,
“বাবা-মা ফিরে এসো না প্লিজ,কেন চলে গেলে?”
তবে তার সেই তীব্র হাহাকার,বুক ফাটা কান্না সবটাই ঐ সুবিশাল শূণ্যে মিলিয়ে যেত পৃথিবীর নিয়মে,পাল্টা কোন উত্তর পাওয়া হত না!
সে দিনগুলোতে হৃদিতাকে সামলাতে পারতো না আদৃতও!মেয়েটা কি ভয়ানক জেদি হয়ে গিয়েছিল, খেতে বললে রাগ দেখিয়ে গ্লাস-প্লেট সব আছড়ে ভাঙতো,বাবা-মা আর নেই এই কথাটা শুনলেই কেমন পাগলের মতো করতো যেন এখুনি শ্বাস আটকে মরে যাবে!
আদৃত ভয়ে ভয়ে থাকতো সর্বক্ষণ!যদি মেয়েটা কিছু ভুলভাল করে বসে, যদি বাবা-মায়ের ছেড়ে যাওয়াটা মানতে না পেরে সেও চলে যায় তাকে ছেড়ে!আদৃত আর ভাবতে পারতো না,কেঁদে ফেলতো নিঃশব্দে!
কত রাত যে জেগে কাটিয়েছে তার তো কোন ইয়ত্তা নেই!সারাদিন অফিস না গিয়ে বসে থেকেছে হৃদিতার সামনেই,যদি কিছু হয়ে যায়,যদি বাড়ি ফিরে আর হৃদকে না পায়!
ঋতমবাবুদের শ্রাদ্ধের দিন!আহা সে কি কান্ড!অপঘাতে মৃত্যু বলে শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হয় তিনদিনের মাথায়!
আদৃত গিয়ে যখন হৃদিতাকে ডাকে,
“হৃদ ওঠো!বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধ, তুমি বসবে না শ্রাদ্ধে?”
হৃদিতার সেদিন সে কি হুংকার!চিৎকার করে আদৃতকে বলেছিল,
“আমার বাবা-মার কিছু হয়নি,কিসের শ্রাদ্ধ?কোন শ্রাদ্ধে বসবো না আমি!বসবো না!”
আদৃত দিশেহারা চোখে চেয়ে দেখেছিল শুধু, কিছু বলতে পারেনি!সেদিন সামলে নিয়েছিলেন মল্লিকা দেবী!বাবা-মা মারা যাওয়া মেয়েটাকে একদম নিজের মেয়ের মতোই বন্ধুসুলভ ভাবে বুঝিয়েছিলেন,
“হৃদ,মা!বাবা-মায়ের কিছু তো হয়নি।জানি তো!বাবা-মা তো ভগবানের কাছে গেছেন,ভগবানের কাছে বাবা-মা তো ভালো থাকবেন তাইনা?
কিন্তু তুমি যদি এভাবে চিৎকার করো, কান্নাকাটি করো তবে তো ওনারা কষ্ট পাবেন। তোমার কাছে চলে আসতে চেয়েও পারবেন না আবার ভগবানের কাছে থাকতেও পারবেন না!তুমি কি ওনাদের এমন দোটানায় রেখে কষ্ট দিতে চাও বলো?”
হৃদিতা চুপচাপ শুনেছিল মল্লিকা দেবীর সব কথা! মাথা নেড়ে নেড়ে না বলেছিল!
মল্লিকা দেবী খুব স্নেহে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
“ভগবানের কাছে যেতে হলে, সবাইকে পবিত্র হতে হয়, তোমার বাবা-মায়ের আত্মাকে পবিত্র করার জন্য তোমাকে ওনাদের নামে পূজো করতে হবে হৃদ,ওনাদের একমাত্র মেয়ে তুমি, ওনাদের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করতে হবে, সব দোটানা থেকে তবেই ওনাদের মুক্তি হবে,একদম নির্বিঘ্নে যেতে পারবেন ভগবানের কাছে!
তুমি কি চাওনা, বাবা-মা ভগবানের কাছে যাক!চাও না?ওনারা শান্তি পাক চাওনা?”
হৃদিতা মল্লিকা দেবীর বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলেছিল,
“আমি তো চাই বাবা-মা ভালো থাক,শান্তিতে থাক!কিন্তু ওরা আমাকে একা রেখে কেন চলে গেল মা?কেন?”
মল্লিকা দেবীর বুকের ভেতরটা উথলে ওঠে কান্নায় কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেন,
“তুমি একা কই মা?আমি আছি তোমার সাথে, আদৃত আছে, তোমার দিদা আছে, দাদু,অনু,বাবা সকলে আছে!ওনারা তোমাকে কত কত ভালোবাসার ভীড়ে ছেড়ে রেখে গেছেন দেখ!
আর চলে কেন গেলেন?তার উত্তরে আমি বলবো, আচ্ছা মা, তুমি যখন ভগবানের জন্য ফুল নাও তখন কোন ফুলটা আগে সাজিতে তোলো?সবচেয়ে সুন্দর, সুঘ্রাণযুক্ত ফুলটা!
ভগবানও তেমনই!সব পুণ্যাত্মাকেই উনি আগে টেনে নেন নিজের কাছে!সবচেয়ে সুন্দর মনের অধিকারী মানুষগুলোকেই সবার আগে রাখেন নিজের সান্নিধ্যে!
তাই বাবা-মার চলে যাওয়া নিয়ে একদম মন খারাপ করবে না।ওনারা নিশ্চয়ই ভগবানের খুব প্রিয় ছিলেন,তাই ওনাদের ভগবান নিয়ে গেছেন নিজের কাছে!
এবারে ওঠো মা।শ্রাদ্ধে বসবে চলো!”
হৃদিতা সেদিন শুনেছিল তার আরেক মায়ের কথা।চুপচাপ বসেছিল শ্রাদ্ধে!পুরোহিত মশাইয়ের সাথে বোকা বোকা চোখে উচ্চারণ করেছিল সব মন্ত্র!পালন করেছিল সব আচার-নিয়ম!
সেদিনের পর থেকেই হৃদিতা একটু স্বাভাবিক হয়,মল্লিকা দেবীর মাঝেই খুঁজে নিতে থাকে নিজের মায়ের প্রতিবিম্ব,পেয়েও যায়। উনি ওকে মেয়ের মতোই আগলে রাখেন।
তবুও মেয়েটা কোথাও একটা গিয়ে হাসি ভুলে যায়, সারাদিন কেবল তাকিয়ে থাকতো নিষ্পলক,যেন কোন জড়!আদৃতের কষ্ট হতো তবুও সামলে নিত,মেয়েটা আর কাঁদছেনা, পাগলামি করছে না, এসবই বা কম কি?
হুট করে ওর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিধ্বংসী এই ঝড়ের প্রভাব তো থাকবেই,কাটিয়ে উঠতে সময়ও লাগবে,তাকে মেনে নিতে হবে, আর অপেক্ষা করে যেতে হবে হৃদিতার প্রিয় কথা গুলো শোনার,হাসি মুখটা দেখার!
আদৃতের অপেক্ষার অবসান ঘটে আরও মাস দুয়েক পর!হৃদিতার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার তখন মাত্র এক সপ্তাহ বাকি!তবে শোকে স্তব্ধ হৃদিতার পরীক্ষা দেবার কোন ইচ্ছে বা লক্ষণই চোখে পড়েনি কারো!আদৃত ভেবেছিল এ বছর হয়তো আর পরীক্ষাটা দেবে না!নিজেও কিছু বলেনি আর এ বিষয়ে!
পরীক্ষার দিন সাতেক আগে এসে হৃদিতা হঠাৎ আদৃতের হাত জোড়া ধরে বলে ওঠে,
“আমি পরীক্ষা দেব আদৃত!বাবা চাইতো আমি একদিন অনেক বড় হই!নিজের পায়ে দাঁড়াই!এই সমাজে আমার কালো রুপের জন্য যারা আজীবন দুরছাই করে এসেছেন,তাদের মুখের ওপরে যোগ্য জবাব হবে আমার প্রতিষ্ঠালাভ!
আমি বাবার কথাটা রাখতে চাই আদৃত!প্লিজ!”
আদৃতের চোখে সেদিন জল চলে এসছিল!মেয়েটা কতদিন পরে তার সাথে এমন করে কথা বললো!একদম আগের মতো!আদৃত জলেভেজা চোখেই সম্মতি জানিয়েছিল!
তবে পরীক্ষার দিন সকালে, হৃদিতাকে যখন গাড়িতে উঠে বসতে বললো,ঠিক তখনই ঘটলো আরেক বিপত্তি!হৃদিতা কার দেখেই কেমন যেন মিঁইয়ে গেল!গুটিশুটি মেরে লুকোলো আদৃতের পিছে,খামচে ধরলো পিঠের শার্ট!
আদৃত বুঝলো না কিছুই!অবাক হয়ে শুধালো,
“হৃদ কি হয়েছে?এমন করছো কেন?পরীক্ষা দিতে যাবে না, আসো, গাড়িতে আসো!”
হৃদিতা চোখমুখ খিঁচে সে কি কাঁপন!কাঁপতে কাঁপতেই জবাব দিল,
“আমি গাড়িতে উঠবো না আদৃত,উঠবো না, এটা ভালো না,বাবা-মাকে মেরে ফেলেছে, আমি বারণ করেছিলাম কারে আসতে,তবুও শোনেনি,না আমি উঠবো না,উঠবো না,আমি,কার,কার,কোন কারে উঠবো না!আমি যাব না কারে করে, না!”
আদৃত খেঁইহীন নৌকার মতোই উদভ্রান্ত চোখে দেখে গেছিল সবটা!মেয়েটার অমন ছটফটানো সইতে না পেরে বাসে করেই নিয়ে গিয়েছিল পরীক্ষা কেন্দ্রে!সে’ দিন ক’টা হৃদিতার সামনে আর গাড়ি নিয়ে আসেনি একটিবারও!
পরীক্ষা শেষে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথেও কনসাল্ট করে আদৃত,উনি হৃদিতাকে দেখে জানান, “বাবা-মার আকস্মিক মৃত্যু কার অ্যাক্সিডেন্টে হওয়ায় পুরো ঘটনাটাই ওর ব্রেনে এটা ঢুকিয়ে দিয়েছে,যে কার বা গাড়ি এমন যানবাহন যা ভয়ের,বিপদজনক!বলতে পারেন বিষয়টায় ওর ফোবিয়া এসে গেছে!তাই আপাতত এ বিষয়ে চাপ না দেয়াই ভালো! সময় কাটুক,আরেকটু স্বাভাবিক হোক,তারপরে নাহয় দেখা যাবে!”
আদৃত মেনে নিয়েছিল!
তারপর, এই যে পুরো ছ’টা মাস কেটে গেল হৃদিতা এক মুহুর্তের জন্য কখনো কারের আশেপাশে যায় নি,দেখলেই গুটিয়ে যেত!জোড় করেনি আদৃতও!
সময়ের তাগিদে হৃদিতা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক, মাঝে মাঝে খানিকটা মনমরা হয়ে থাকলেও প্রায় আগের মতোই হাসিখুশি হয়ে থাকে সারাক্ষণ!
বাড়ির সবার আদর,স্নেহ,আদৃতের উজার করা ভালোবাসার জন্যই হয়তো বিষয়টা সম্ভব হয়েছে এত দ্রুত!
ঋতমবাবুর বাড়িটা হৃদিতার নামে লেখা ছিল।বাবা-মা মারা যাবার পর হৃদিতার ইচ্ছেতেই সেই জায়গায় বানানো হয় একটা অনাথ আশ্রম!সে বাড়ি যেদিন ভাঙা হলো,সেদিনও মেয়েটার কি কান্না!পাগলের মতো,বাড়ির প্রতিটা আসবাব ধরে কেঁদেছিল,স্টাডি টেবিলের ওপরে মুখ গুঁজে খুব কেঁদেছিল,এখানেই তো বাবা কত কত বই পড়তো সকাল-বিকেল, তাকে পড়া বুঝিয়ে দিত।হৃদিতা চিৎকার করে বলেছিল,
“বাবা আমাকে এখন আর কেউ ইংরেজি পড়াবে না তোমার মতো করে,কেউ না!”
আদৃত দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল সবটাই,তবে বাঁধা দেয়নি,কাঁদতে দিয়েছিল,সেই সাথে সবার আড়ালে নিজেও কেঁদেছিল!
হৃদিতা যখন রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো তখন আদৃত বলেছিল,
“আর দেখতে হবে না হৃদ!বাড়ি চলো!”
হৃদিতা সেকথা না শুনে করুণ স্বরে বলেছিল,
“একটু যাই?একটু!”
আদৃত না করতে পারেনি।আস্তে করে বলেছিল,
“আচ্ছা!”
রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে মায়ের ব্যবহার করা সব কিছু দেখে ফুঁপিয়ে উঠেছিল খুব।বলেছিল,
“জানো মা,এখন আমিও রান্না পারি,সকলে খুব প্রসংশাও করে,কেবল তোমাদেরকে পারলাম না রেঁধে খাওয়াতে,পারলাম না!”
আদৃত এসে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে তখনই বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে!পুরোনো সব স্মৃতি যে পুড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার, আর কত পুড়বে মেয়েটা!
.
আদৃত যে জমিটা কিনেছিল,ঋতমবাবুর থেকে, এক মাসের মতো হলো, সে জমিতেও শুরু হয়েছে কনস্ট্রাকশনের কাজ!পাশেই বাচ্চারা থাকবে, তাই বেশ সচেতনভাবেই ওঠানো হচ্ছে বিল্ডিং!
খাই-খাই হোটেলের মোড় থেকে হৃদিতাদের বাড়ি অবধি যাওয়া মাটির রাস্তাটা ইট দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে!সেজন্যই এখন কাঁচামাল নিয়ে যেতে সুবিধা!
হৃদিতার পরীক্ষার রেজাল্টও দিয়ে দেবে আর দিন দশেকের ভেতরে!তবে তা নিয়ে কোন উৎকন্ঠা নেই কারোরই!রেজাল্ট যেমনই হোক,মেয়েটা এতকিছুর পরও পরীক্ষা দিয়েছিল তাই তো অনেক!
.
আজ হৃদিতার জন্মদিন!বাড়ির সকলেই বিষয়টা জানলেও হৃদিতা ভুলে গেছে একদমই!হৃদিতাকে সারপ্রাইজ দিতে আদৃতের কথায়,কেউ আর জানায়ওনি তাকে!
তবে বেশ কিছুদিন থেকে হৃদিতা সন্দেহ করছে কিছু একটা!শরীরটা ক’দিন থেকেই ভালো যাচ্ছে না!কেমন ম্যাজ ম্যাজ করে সারা গা!ঘুম ঘুম পায় সারাক্ষণ!ঠিক মতো খেতে পারেনা!যাই খেতে যায় তাতেই কেমন উটকো গন্ধে গা গুলিয়ে আসে,বমি পায়!একটু দাঁড়িয়ে থাকারও জোঁ নেই,মাথা ঘুরে ওঠে হুটহাট!
সব কিছু দেখে কাল একটা প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপ নিয়ে এসছে সে!
সকালে যখন টেস্ট করে, তখন তাতে স্পষ্ট ফুটে ওঠে দুটো লাল দাগ!হৃদিতা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে স্ট্রিপটার দিকে!সে মা হবে এই কথাটা পিংপং বলের মতো স্প্রিং করে ঘুরতে থাকে মস্তিষ্কের নিউরণে নিউরণে!হৃদিতার খুশি যেন উছলে পড়ে!পেটে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“স্বাগত জুনিয়র!তোমার বাবাকে বললে খুব খুশি হবে,চমকে যাবে একদম!”
হৃদিতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা হলদে খামে ভরে রাখে স্ট্রিপটা!সাথে রেখে দেয় ছোট একটা চিরকুট,
“কংগ্রাচুলেশনস নিউ পাপা!”
একদম আদৃতের মতো করে, হলদে কাগজে,লাল কালিতে!
তারপর আদৃতের প্রিয় শিউলি ফুল এনে ভরিয়ে রাখে সাজি,আর সেই সাজির ভেতরেই লুকিয়ে রাখে সেই হলদে রঙা খাম!
হৃদিতা যখন সব কাজ শেষে, মাত্র গিয়ে বিছানায় বসে,ঠিক তখনই আদৃত এসে হুরমুরিয়ে তাদের ঘরে ঢোকে!হৃদিতাকে দাঁড় করিয়ে বলে,
“হৃদ ওঠো!চলো আমার সাথে!”
হৃদিতা অবাক চোখে তাকায়,তারপর মিষ্টি হেসে বলে,
“আচ্ছা যাব!কিন্তু তার আগে দেখ,তোমার জন্য আমি বাগান থেকে শিউলি ফুল কুড়িয়ে এনেছি!এ বাড়ির শিউলি গাছে যে বারো মাস শিউলি ফুল ফোটে জানতামই না।কতদিন হয়ে গেল যাইনি শিউলি তলায়!আজ গিয়ে তো একদম অবাক হয়ে গেছি!”
আদৃত টেবিলের ওপরে রাখা শিউলির সাজিটার দিকে তাকায়!হালকা হেসে বলে,
“আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ!কিন্তু এবারে তুমি আমার সাথে চলো, আমি এসে তোমার শিউলি দেখবো!”
হৃদিতা আবারও অবাক হয়,শুধায়,
“কোথায় যাব?এত তাড়া দিচ্ছ কেন?”
আদৃত মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“আহা চলোই না,গেলেই দেখতে পাবে!সারপ্রাইজ!”
হৃদিতা আর না করেনা!আদৃত ওকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় নিজের কারটার কাছেই!হৃদিতা আবারও কেমন যেন ট্রমাটাইজড হয়ে যায়। লুকিয়ে পড়ে আদৃতের পেছনে।আদৃত বুঝতে পারে,তবে আর কত!এই ভয়টা তো কাটাতে হবে!একপ্রকার জোড় করেই বের করে নিয়ে আসে হৃদিতাকে!দুগালে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বলে,
“ভয় কি হৃদ!আমি আছি তো সাথে! আমি আছি!কিছু হবে না,বিশ্বাস রাখো!”
হৃদিতা ভয় পেলেও প্রিয়তমকে বিশ্বাস করতে ছাড়ে না!খুব শক্ত করে আদৃতের হাত আকড়ে বসে পড়ে ফ্রন্ট সিটে!আদৃত সিটবেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে বলে,
“হাতটা ছাড়ো,নইলে ড্রাইভ করবো কিকরে?”
হৃদিতা ছেড়ে দেয়!তবে গাড়ি চলা শুরু হলেই কেমন যেন ঘোরের মাঝে চলে যায়, আবারও ভয়ে কাঁপতে আরম্ভ করে!আদৃত হৃদিতার দিকে তাকিয়ে তাকে ভরসা দিতে দিতেই চলে আসে অনেকটা রাস্তা!একদম শুনশান ফাঁকা রাস্তাটায় এসে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“কিছুই হলো না হৃদ!দেখলে!আর একটু খালি!ভয় পেওনা আমি আছি তো!”
আদৃতের কথার মাঝেই হৃদিতা খুব জোড়ে চিৎকার করে উঠলো,
“আদৃততততত!সামনে তাকাও!আদৃত!”
আদৃত তড়িঘড়ি সামনে তাকাতেই দেখতে পায় একটা ইটের ট্রাক তাদের গাড়ির দিকেই আসছে!ঘটনার আকস্মিকতায় আদৃত টাল সামলাতে না পেরে গাড়ির ব্রেক চাপার আগেই ট্রাকটা এসে ধাক্কা দিয়ে দেয় তাদের গাড়িতে!ট্রাকটা উল্টে যায়, ট্রাকের সব ইট ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাস্তায়!বন্ধ হয়ে যায় গাড়ির দরজা খোলার রাস্তা!ইটের ধুলোয় মাখামাখি হয়ে যায় গাড়ির স্বচ্ছ কাচ,দেখা যায় না বাইরের কিছুই! আদৃতের মাথা গিয়ে লাগে গাড়ির হুইলে, কেটে যায় মাথার অনেকটাই!রক্ত বেরোতে থাকে দরদরিয়ে!আদৃত জ্ঞান হারায়!
হৃদিতার মাথা গিয়ে লাগে জানালার কাচে!কাচ ভেঙে গেঁথে যায় গালে,মাথায়,গলায়!গলগলিয়ে বেরোতে থাকে রক্ত!হাত দিয়ে কাচ আটকাতে গিয়ে জানালার আধভাঙা কাচে হাতের কব্জি লেগে কেটে যায় শিরা!ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে লাল লেহু!
হৃদিতার দুচোখ বুজে আসতে চায়,বুজে আসা চোখে আদৃতের মুখপানে তাকায়, দুর্বল হাতে একবার শেষবারের মতো স্পর্শ করে প্রিয়তমর সুন্দর মুখখানি!
মুচকি হেসে বলে,
“আমার জীবনে সারপ্রাইজ,চমক শব্দগুলো ভীষণ আনলাকি আদৃত!বাবা চমক দিতে চেয়ে চলে গেল একা ফেলে, আর তুমি চমক দিতে চাইলে,দেখ তোমাকে একা করে চলে যেতে হচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করো আদৃত,ক্ষমা করো!আমি জানি তুমি সুস্থ হবে আদৃত,ঠিক হয়ে যাবে!তুমি জ্ঞানে থাকলে হয়তো আমারও বেঁচে থাকা হতো, তবে তা হয়তো ভাগ্যে নেই!আমি এজন্যই কারে উঠতে চাইনি,তুমিও শুনলে না বাবার মতো!”
তারপর পেটে হাত দিয়ে কাতর স্বরে বলে ওঠে,
“পুচকু!মা অনেক সরি সোনা! তুমি আসছো খবরটা পাবার সাথে সাথেই তোমাকে নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে মাকে,পৃথিবীর এত সৌন্দর্য তোমাকে দেখাতে না পারার জন্য মা খুব সরি বাচ্চা!বাবাকে ছেড়ে যেতে তো কষ্ট হচ্ছে, তবে চিন্তা করোনা,ওখানেও তোমার দাদু-দিদা আছে!তুমি ওখানেও ভালো থাকবে!”
হৃদিতা আর কথা বলতে পারেনা,শ্বাসবায়ু ফুরিয়ে আসে ক্রমাগত। শেষবারের মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আদৃতের দিকে!চোখ দিয়ে অঝোরে গড়াতে থাকে রঙহীন জলকণা!
তবুও কষ্ট করে হলেও খুব ভালোবাসা নিয়ে প্রেমিকপুরুষের মুখখানি আরেকবার অবলোকন করে বলে ওঠে,
“মা দূর্গা,ওকে ভালো রেখো,সুস্থ রেখো!আমাকে সিঁথি রাঙিয়ে যাবার সুযোগ দেবার জন্য ধন্যবাদ মা!অনেক ধন্যবাদ!”
হৃদিতা আর কথা বলতে পারেনা!শ্বাস আটকে যায়, থেমে যায় হৃৎস্পন্দন,সেই স্পন্দন যার প্রতিটা ঢিপঢিপ শব্দে উচ্চারিত হতো আদৃতের নাম।চোখ দুটো বুজে আসে ক্ষণিকে,আর তারপর!তারপর সবটা অন্ধকার!সবটা!
.
আদৃতের যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে হসপিটালের বেডে শুয়ে!ডক্টর এসে জানায় তার মাথায় হালকা ইনজুরি হয়েছিল, অনেকটা রক্ত বেরিয়েছিল তবে এখন ঠিক আছে!ব্লাড দেয়া হয়েছে, আর মাথায় চারটে সেলাই!চিন্তার তেমন কিছু নেই!
আদৃত দুহাতে মাথা চেপে ধরে বলে ওঠে,
“ডক্টর, আমাকে এখানে কে নিয়ে এসছেন?”
ডক্টর আদৃতের বিপি চেক করতে করতে জবাব দেয়,
“পুলিশ। অ্যাক্সিডেন্ট স্পট থেকে আপনাকে পুলিশ উদ্ধার করে!বাইরে আপনার পরিবারের সবাই আছে!একটু পর দেখা করতে পারবেন!”
আদৃত ভ্রু কুচকে আবারও জিজ্ঞেস করে,
“আমি এখানে কতক্ষণ হলো আছি ডক্টর?”
ডক্টর স্যালাইনের ক্যানোলায় একটা টোক মেরে বলে
“প্রায় পাঁচ ঘন্টা!”
আদৃত এবার বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“আমার সাথে আমার ওয়াইফ ছিল ডক্টর!সে কই?ডক্টর?আমার হৃদ কই?ও ঠিক আছে তো!ও কি বাইরে,আমার পরিবারের সাথে? ”
আদৃত চেঁচিয়ে ওঠে,ডক্টর আর জবাব দেয় না। শুকনো মুখে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।আস্তে আস্তে কেবিনের ভেতরে ঢুকে আসে আশুতোষবাবু! আদৃত দাদুর দুহাত ধরে কাতর স্বরে শুধায়,
“ও দাদু!আমার হৃদ কই দাদু?ও ঠিক আছে তো?
ও কারে চড়তে চায়নি,কেন জোড় করলাম কে জানে। আমাকে খুব বকবে এবার তাইনা দাদু!বকুক,আর কখনো ওকে জোড় করবো না,কখনো না!ওর কাছে নিয়ে চলো না দাদু,প্লিজ!”
আশুতোষবাবুর চোখ জোড়া ভিজে ওঠে আদৃতের কথায়!তিনি নার্সকে ডেকে আদৃতের হাতের স্যালাইনটা খুলে নেন!তারপর নাতির হাত ধরে হাটা দেন, হসপিটালের মর্গে!আদৃত কেঁপে ওঠে হিম শীতল রুমটায় পা রাখা মাত্র!দাদুর হাত চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে,
“দাদু,ও দাদু!তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন?আমার হৃদের কাছে নিয়ে চলো!ও দাদু!দাদু!”
আশুতোষবাবু একজন ওয়ার্ডবয়কে হাতের ইশারা করতেই ওয়ার্ডবয় সরিয়ে দেয় একটা মরদেহের ওপর থেকে সাদা চাদর!হৃদিতার নিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক মুখটা ভেসে ওঠে আদৃতের সামনে!আদৃত দাদুর হাত ছেড়ে দেয়!কাঁপা কাঁপা পায়ে হৃদিতার সামনে গিয়ে আলতো হাতে স্পর্শ করে প্রিয়তমার গাল দুখানি!আদৃত শিউরে উঠলো, সে কি ঠান্ডা হয়ে আছে,যেন কোন বরফ টুকরো!
যেগালে তার একটু প্রণয়বাক্যেই খেলে যেত রক্তিম আভা,সেই গাল দুখানিই আজ কেমন ফ্যাকাসে,একদম রক্ত শূণ্য! আদৃতের একটু স্পর্শেই যে মেয়ে কেঁপে উঠতো লজ্জাবতীর নেতিয়ে পড়া ডালের মতো, সে মেয়ের সারা মুখে আদৃতের প্রেমময় হাত দুখানার বিচরণেও আজ আর সে নড়লো না অবধি!
আদৃত একটিবার ডাকলো,
“হৃদ!”
উত্তর এলো না!আদৃত আবারো ডাকলো,
“হৃদ!রাগ করেছো আমার ওপর!কথা বলবে না?এই হৃদ!”
হৃদিতা সাড়া দিলনা।আদৃতের ডাকের পর ডাককে অবলীলায় এড়িয়ে গিয়ে সে পড়ে রইলো চুপচাপ!
আদৃত আর ডাকলো না, অভিমানী নয়নে দাদুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“দেখলে দাদু,তোমার দিদিভাইকে!এই নাকি আমাকে ভালোবাসে!একটা ভুল করে ফেলেছি,সেজন্যই আর আমার সাথে রাগ করে কথা বলছে না!কি নিষ্ঠুর!”
আশুতোষবাবু নাতিকে জড়িয়ে নেন বুকে। হুহু করে কেঁদে ফেলেন নিজেও!ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন করেন,
“কেন ভগবান,কেন?কেন আমাদের মতো বুড়ো মানুষ গুলোকে রেখে বাচ্চা মেয়েটার দিকে চোখ পড়লো তোমার?কেন?”
উত্তর মেলেনা!তারপর স্নেহশীতল স্পর্শে নাতির মাথায় হাত রেখে করুণ কন্ঠে বলেন,
“ও আর কখনো কথা বলবে না দাদুভাই!ও আর নেই!ও আমাদের সবাইকে ছেড়ে পারি জমিয়েছে দূরে,যেখান থেকে আর ফেরা যায় না,কখনো না দাদুভাই,কখনো না!”
🍁
পরিশিষ্ঠঃ
বছর ঘুরেছে!মেঘকুঞ্জে আবার এসেছে পূজো পূজো আমেজ!তবে গত বছরের মতো এবারে আর কেউ মাতিয়ে রাখছে না গোটা বাড়ি!কেউ আর থেকে থেকে বায়না করছে না এটা করবো, সেটা করবো! মল্লিকা দেবী আজও নতুন নতুন পদ রাঁধেন!তার অবচেতন মন আজও অপেক্ষা করে কারো কন্ঠে শোনার,
“কি রাঁধছো দিদার বৌমা?নতুন রেসিপি!আমিও শিখবো,শিখিয়ে দাও না!”
তবে শোনা আর হয়না। কেউ আর ওনার কাছে বায়না করেন না নতুন নতুন পদ শেখার!
অন্বেষা এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী!হৃদিতারও খুব ইচ্ছে ছিল এখানে পড়ার, দুজনে মিলে প্ল্যান করেছিল একসাথে চান্স নেবে,অথচ ভার্সিটি ক্যাম্পাসে সে আজ একা!কেউ আর তাকে বলে না,
“জানো তো অনু,আমরা না আজ একসাথে ফুচকা খাবো!”
আশুতোষবাবুকে কেউ আর বলে না,
“দাদু,তোমার আর দিদার প্রেমকাহিনীটা কিন্তু মারাত্মক!”
আনন্দবাবুকেও আর কেউ সারাদিন বাবা,বাবা ডেকে পাগল করে দেয়না।
গত বছরের বড়ি ফুরিয়ে গেছে!কাদম্বিনী দেবী আবারো ছাদে বসেছেন বড়ি দিতে!কিন্তু আজ তিনি একা!কেউ আর তার কাছে আবদার করে বলেনা,
“দিদা,আমিও বড়ি দেয়া শিখবো, শেখাও হবে,তোমার সাহায্য করাও হবে!”
কেউ আর দুষ্টুমি করে বলে না,
“দিদা,তোমার আর দাদুর লাভ স্টোরিটা আরেকটু বলো না,শুনি!”
কেউ বলে না!
.
আদৃতের বারান্দার মাধবীলতা গাছটাতে সাদা-গোলাপী ফুল ফুটেছে আবারো,সেই মাধবীলতার তীব্র ঘ্রাণে ম ম করছে সারা ঘর!
কেবল সেই মাধবীলতা দেখে মুগ্ধ হয়ে,তার সুবাস নিয়ে স্নিগ্ধ হাসা তার হৃদপরীটি নেই!
বাগানোর বারোমাসি শিউলি গাছটার তলা আজও শুভ্র!কেবল সেই শিউলিকে আচলে তুলে পূজোর ঘরে নিয়ে যাবার জন্য তার জ্যান্ত শিউলিটি নেই!
আদৃত এখন আর কার ইউজ করেনা।তার কারটা বিক্রি করে দিয়েছে হৃদিতা মারা যাবার পরদিনই!সে এখন বাসে করেই চলাচল করে সর্বত্র!
.
হৃদিতার একটা হাসিমুখের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে আদৃত!হাতে ধরে রাখা সেই প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপটা!দাগগুলো এখন আর বোঝা যায় না তেমন,অনেকদিন তো হলো! মেয়েটাকে দাহ করে ফিরেই সেদিন মুষরে যাওয়া শিউলির ফাক গেলে তার চোখে পড়ছিল হলুদ খামটা!খাম খুলে প্রিগন্যান্সি পজিটিভ স্ট্রিপ আর হৃদিতার লেখা চিরকুটটা দেখে কেঁদেছিল খুব!
আজও সেগুলো রেখে দিয়েছে খুব যত্নে!বাড়ির আর কেউই জানেনা হৃদিতা সন্তানসম্ভবা ছিল!কেবল আদৃত ছাড়া। একটি প্রাণের হারিয়ে যাবার শোকই কেউ সামলে উঠতে পারছে না,সেখানে দুজনেরটা কি করে সামলাতো!
হৃদিতার ছবিটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আদৃত অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,
“জানো তো হৃদ, তোমার প্রেমে আমি হুট করেই পড়ে গিয়েছিলাম,একদম হুট করে!তারপর যত দিন গেছে প্রেম তত বেড়েছে,কমেনি কখনো!তোমাকে নিজের জীবনে পাওয়াটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল হৃদ।
তবে তুমি তা বোঝোনি!তুমি শুধু নিজেরটা ভেবে গেছ হৃদ,একদম স্বার্থপরের মতো!খুব সাঁধ করে চেয়েছিলে না মা দূর্গার থেকে, তুমি যাতে আমার আগে চলে যেতে পারো,দেখ,তোমার সারল্য ভরা ডাক মা এড়াতে পারেননি!তাই তো শোনেননি আমার কথা, রাখেননি তোমায় আমার কাছে!
দুদিন পর আবার পূজো শুরু হৃদ!কিন্তু এবার আর তুমি শিউলি মালা গেঁথে পূজোর থালা সাজাবে না হৃদ!আমার হাতে নিজের পা দুটোকে আলতায় রাঙাবে না!
তোমাকে বলেছিলাম, আসছে বছর আবার একসাথে সিঁদুর খেলবো, তাও আর হবে না হৃদ!তুমি বরাবর আমার সাথে নিষ্ঠুরতাই করে গেলে জানো তো!সেই প্রথম দিন থেকে!আজও তাই করে যাচ্ছো!অথচ তোমার নিষ্ঠুরতার বিনিময়ে আজও আমি তোমায় খুব ভালোবাসি হৃদ,খুব!
কি জানো তো হৃদ,তোমাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসলেও, তুমি কখনো আমাকে ভালোবাসোনি হৃদ,একটুও না!বাসলে কেন চাইবে আমাকে একা ফেলে যেতে!কেন?
আমার সারাটা অস্তিত্ব বিলীন করে নিয়ে হারিয়ে যেতে কি তোমার একটুও বাঁধেনি হৃদ,একটুও না?শুধু তোমার একটা কথা শুনিনি বলে এত নিষ্ঠুর হলে,যে চলেই গেলে একেবারে!
আমি ঠিকই বলছি হৃদ,তুমি আমাকে ভালোবাসোনি!কত নিষ্ঠুর দেখ তুমি!আমাকে আমার সন্তানের অস্ত্বিত্বটুকু অনুভবই করতে দিলেনা!
তোমার সকল কথা,আস্ত তুমিটাই আমার প্রিয় হলেও আমি তোমার প্রিয় ছিলাম না হৃদ।
আমার সবটুকু প্রণয় তোমায় ঘিরে থাকলেও,তোমার প্রণয়ে আমি ছিলাম না হৃদ!
তুমি শুধুই প্রিয়ংবদা ছিলে হৃদ, প্রণয়িনী হতে পারোনি!কখনও পারোনি!কখনও না!
~সমাপ্ত~
[🙂 আমার ওপর খুব রাগ হচ্ছে তাই না?ভাবছেন মৌ কত নিষ্ঠুর, কারো কথা শুনলো না!
আমি যে আপনাদের কথা না শুনে স্যাড এন্ডিং দিলাম তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী!
কিন্তু কি জানেন তো, উপন্যাস যখন ভেবেছিলাম তখন ঠিক করে রাখা ছিল উপন্যাসের শেষের লাইটটাই হবে নামের মর্মার্থ প্রকাশক!
এই যে আদৃতের এত ভালোবাসার বাঁধন ছিন্ন করে হৃদিতা চলে গেল, এতে তার চাপা অভিমান তাকে এটাই বলে হৃদ তাকে ভালোবাসেনি,বাসলে তো চলে যেত না।হ্যাঁ, জন্ম-মৃত্যুর ওপর কারো হাত নেই, কিন্তু ক’জন সেটা মানতে পারে বলুন,যাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসা হয় তার চলে যাওয়াটা মানতে কষ্টও হয় খুব!সে দিক থেকেই আদৃতের মনে হয়,হৃদিতার বলা প্রতিটা কথা তার কাছে প্রিয় হলেও সে হৃদিতার ভালোবাসা হতে পারেনি,পারলে কি ছেড়ে যেত! তাই এক অভিমানী প্রেমিকের মনের ভাব
“তুমি শুধুই প্রিয়ংবদা ছিলে হৃদ, প্রণয়িনী হতে পারোনি!কখনও পারোনি!কখনও না!”
এখন হুট করে আমি শেষ ভেবে রাখা উপন্যাসের সমাপ্তি কি করে পাল্টাতাম বলুন তো!পারতাম না!
আবারও ক্ষমাপ্রার্থী! সকলকে খুব কাঁদালাম হয়তো!
আমাকে বকে যেতে পারেন!
আর একটা কথা, আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে তখন আমাদের বাস অ্যাক্সিডেন্ট হয়, মায়ের হাতের রগ কেটে গিয়েছিল সেবার। তারপর থেকে প্রায় ১০ বছর মতো আমার বাসে চড়ায় ট্রমা ছিল, বাস দেখলেই কেঁপে উঠতাম,লুকিয়ে পড়তাম।বাবা তাই আমাকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরতো, এমনো দিন গেছে ৮০-৯০ কিলোমিটার রাস্তা রিক্সা করে গেছি সারাদিনে!
তারপর ক্লাস টেনে ওঠার পর ভয়টা কেটে যেতে থাকে,এখন আর নেই।
হৃদিতার কার ট্রমা নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকতে পারে তাই বলা!
উপন্যাসের শুরু থেকে অনেককে জ্বালাচ্ছি, কেউ কেউ অপেক্ষা করে গেছেন সমাপ্তি কবে হবে, অনেকের কাছেই লেইম, ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের কাহিনি লেগেছে।
তাদেরকে ধন্যবাদ নিজের মত প্রকাশের জন্য!
তবে ভাববেন না রাগ করে শেষ করলাম, শেষটা এমনি ভাবা ছিল,আর যতটুকু ভাবা ছিল তা লিখেছি!
আপনারা সকলেই জানেন,আমি অ্যাডমিশন সিকার,এর আগে অনেকবার বলেছি!সামনেই এক্সাম সিজন। পরপর পরীক্ষা, সকলের থেকে আশির্বাদপ্রার্থী!
আর এতদিন আমার জ্বালাতন সহ্য করার জন্য ধন্যবাদ, এত পঁচা একটা উপন্যাস নিজেদের পাঠের তালিকায় যে কজন স্থান দিয়েছেন ধন্যবাদ তাদের
প্রত্যেককে!পরিশেষে বলবো, আমার উপন্যাস পড়ে যদি কারো মনে একটুও দাগ কাটে তবে আজ অন্তিম পর্বে অন্তত নিজেদের অভিব্যক্তিটুকু ব্যাক্ত করে যাবেন!
ভালো খারাপ যাই হোক আমি শুনে নেব!
সকলকে কষ্ট দেবার জন্য অনেক দুঃখিত।লেখালেখির জগতে আর ফিরবো কিনা ঠিক জানিনা, হয়তো ফিরবো,কারণ না লিখে থাকা সম্ভব না,তবে এ বছর আর নয়!ভগবান সুস্থ রাখলে পরের বছর হয়তো আবার আসবো আপনাদের জ্বালাতে!
ততদিন ভালো থাকবেন সকলে। মৌ নামে যে কেউ ছিল একটু কষ্ট করে না হয় মনে রাখবেন।
সকলের জন্য ভালোবাসা, আমি আবারও সকলের নিকট আশির্বাদপ্রার্থী!
~মৌ]