প্রিয়ংবদা পর্ব ২০:২১

0
1069

#প্রিয়ংবদা
#বিংশ ও একবিংশ পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে।কৃষ্ণ গগণ ধারণ করেছে আরো গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ!হঠাৎ উড়ে আসা মেঘপুঞ্জ এসে আবৃত করে রেখেছে আকাশের একমাত্র চাঁদের টুকরোটা!সেই একফালি মেঘের আড়াল থেকেই আঁধার আকাশের বুকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে এক মুঠো রুপোলী দ্যুতি!তারাহীন ঐ বিশাল শূণ্যে কেবলমাত্র সেই এক মুঠো চাঁদের আলোরই রাজত্ব, আর সেই আঁধারিয়া রাজ্যেই এক দৃষ্টিতে উন্মীলিত নয়নে চেয়ে আছে হৃদিতা!
তার জীবনটাও তো ঐ আঁধার কালো আকাশটারই মতো!শুধু আর শুধুই আঁধার!তবে সেই দম বন্ধ করা অন্ধকার জীবণে একমুঠো রুপোলী আলো হলো তার আদৃতবাবু!যে মানুষটার একচ্ছত্র রাজত্ব তার এই ছোট্ট জীবনময়!
তবে, চাঁদেরও তো ক্ষয় হয়!হৃদিতা ভাবে, তার জীবনের চাঁদটুকুও কি ক্ষয়ে যাবে কখনো?তাকে মাঝপথে আবার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে চলে যাবে?
উত্তর আসেনা!প্রশ্নটাও যেন ঘুরেফিরে মিলিয়ে যায় ঐ আঁধারিয়া আকাশের কৃষ্ণগহ্বরে!
তবে এই যে বিষের মতো চিন্তাটুকু,এটুকুই মুহূর্তে বিষিয়ে দিয়ে যায় হৃদিতার মনটা,ঠিক যেন হেমলক!
হৃদিতার বড় বড় চোখের পাপড়িগুলো ভিজে ওঠে ক্ষণেই!আঁখিদুটি ভরে ওঠে কানায় কানায়!ছলকে ওঠা নয়ন আর মেলে রাখা যায় না, চোখ বুজতেই গড়িয়ে পড়ে শ্রাবণধারা!
হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ মেলে সে!হাতের উল্টোপিঠে চোখের জলটা মুছে নিয়ে ঠোঁটের কোণজুড়ে বিস্তৃত করে কৃত্রিম হাসির রেখা!
পিছু ফিরে হাসিমুখেই বলে ওঠে,
“আরে, অনু!এসো এসো!বসো!”

অন্বেষা স্নিগ্ধ হাসে। হৃদিতার পাশে বিছানার এককোণে বসে পড়ে তখনই!তারপর হৃদিতার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে,
“কি ব্যাপার?কি ভাবছিলে শুনি?দাভাইয়ের কথা? ”

হৃদিতা হকচকিয়ে যায়! সে যে আদৃতের কথাই ভাবছিল তা তো কারো জানার কথা নয়,তবুও মেয়েটা কেমন করে যেন বুঝে গেল!আহা!কি লজ্জা!
হৃদিতার মুখের সেই কৃত্রিম হাসির স্থানে এসে ভর করলো এক আকাশ অকৃত্রিম লজ্জা!
অন্বেষা হয়তো,বুঝতে পারলো হৃদিতার ভেতরের লাজুকতা।তাই আর কথা বাড়ালো না।মেয়েটা আজ এমনিই ভীষণ লজ্জা পেয়েছে হুট করে আশির্বাদের অনুষ্ঠানটা হয়ে যাওয়ায়!আবারো তাকে অযথা লজ্জায় ফেলতে তাই ইচ্ছে করলো না অন্বেষার।
তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টে হৃদিতার হাত জোড়া কোলের ওপরে টেনে নিয়ে শুধালো,
“চূড়গুলো পছন্দ হয়েছে হৃদ?”

হৃদিতা প্রশস্ত হেসে মাথা নাড়তেই অন্বেষা ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
“তবে আমার একদম ভালো লাগে না জানো!এসব এত মোটা,ভারী গয়না দেখলেই আমার ভয় লাগে, না জানে তুমি কিকরে পড়ে আছো এতক্ষণ যাবৎ!”

হৃদিতা হাসে। পরণের শাড়ির ভাজ ততক্ষণে এলোমেলো হয়ে গেছে অনেকটাই!সেফটিপিন খোলা শাড়ির আঁচল ভাজ খুলে এলিয়ে পড়েছে গোটা হাতময়!অন্বেষা লক্ষ্য করে!শাড়ির আচলটা উল্টো একভাজে আবারো কাঁধের ওপরে তুলে দিতে দিতে বলে,
“কালো শাড়িতে কিন্তু তোমাকে সত্যিই খুব মানিয়েছে হৃদ!দাভাই যখন আমাকে মেসেজ করে জানালো, আন্টিকে বলে রাখতে তোমাকে যেন আজ কালো রঙের কোন শাড়ি পড়ায় তখন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম জানো তো!আশির্বাদে কে কালো শাড়ি পড়ে!তবুও দাভাই যখন বলেছে তখন আর চিন্তা ভাবনা না করে আন্টিকে বলে দিলাম কালো শাড়ির কথা। অবাক হলেও উনিও না করেননি!
এখন বুঝতে পারছি, দাভাই কেন বলেছিল।তোমাকে কালো শাড়িতেই সবচেয়ে বেশি মানাবে বলেই হয়তো!”

হৃদিতা ম্লান হাসে। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে ওঠে,
“তোমার দাভাইয়ের হয়তো কালো খুব প্রিয় অনু!নইলে, কি কেউ যেচে কালো মেয়ে পছন্দ করে!
আবার শখ করে সেই কালো মেয়েকেই কালো টিপ,কালো শাড়িতে সাজাতে চায়!
আদৃতবাবু মানুষটা বড় অদ্ভুত অনু!ওনার সবকিছুই আলাদা, আর পাঁচটা মানুষের চেয়ে ভিন্ন!”

অন্বেষা হাসিমুখে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“একদম দাদুর ধাঁত পেয়েছে তো,তাই!
তবে হৃদ!আমার অদ্ভুত দাভাইটাকেই যে তুমি খুব ভালোবাসো, তা কিন্তু আমি জানি,আচ্ছা?
নইলে আমার সাথে দাভাইকে দেখেই তোমার জ্বর আসতো বলো?ভাবো তো, কি পরিমাণ জেলাস ছিলে তুমি?সেই মন পোড়া তাপেই হয়তো জ্বর এসে গেছিলো!ঠিক বললাম না!”

হৃদিতা আবার লজ্জা পায়!লাজুক হেসে মুখ নামিয়ে নেয়!তা দেখে হেসে ফেলে অন্বেষাও!

হঠাৎ কি মনে করে হৃদিতা চোখ তুলে চায়!অন্বেষার দিকে তাকিয়ে একদম তার চোখে চোখ রাখে!তারপর মিষ্টি হেসে বলে ওঠে,
“অনু!তোমার কাছে কোন কিছু চাইলে দেবে আমাকে?”

অন্বেষা ভ্রু কুচকে হাসে!তারপর কৌতুহলী দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রয় হৃদিতার মুখপানে!ঠাওর করার চেষ্টা করে অন্বেষার বলতে চাওয়া কথা!তবে পারেনা।তাই কৌতুহল মাখা কন্ঠেই উত্তর দেয়,
“তুমি যা চাইবে তা যদি আমার সাধ্যের মাঝে থাকে তবে কেন দেব না?নিশ্চয়ই দেব।যতই হোক, তুমি তো আমার একমাত্র বৌদিভাই হবে! বলো!”

হৃদিতা হেসে বলে,
“তোমার সাধ্যের ভেতরেই চাইবো!”

অন্বেষাও হাসিমুখে উত্তর দেয়,
“আচ্ছা, তবে দেব!প্রমিস!এবারে বলো!”

হৃদিতা বলে ওঠে,
“এবার আর হোস্টেলে ফিরে যেও না অনু!বাড়িতেই থাকো!প্লিজ!
রাখবে না আমার কথাটা?”

অন্বেষা ক্লান্ত হেসে তাকায়! বিষাদমাখা কন্ঠে ধ্বনিত হয়,
“হৃদ,কেউ নিজের বাড়ি থেকে সাধ করে তো দূরে থাকে না বলো!পরিবারের সবার সাথে থাকতে,কার না ভালো লাগে?
কিন্তু, ও বাড়িটা আমার দাদু-ঠাম্মির যৌথ প্রয়াসে তৈরী!ওনাদের কত-শত অক্লান্ত পরিশ্রমই না লুকিয়ে আছে প্রতিটা ইটের গাঁথুনির ফাঁকে ফাঁকে, প্রতিটা দেয়ালের কোণে!
অথচ সেই বাড়িতেই আমার ঠাম্মি থাকে না!আমার যে দাদু,আমার ঠাম্মিকে ছাড়া অসহায়ের মতো বাঁচে,সেই প্রতিনিয়ত ও বাড়িতে একাকি রাত কাটায়,সর্বক্ষণের সুখ-দুখের সঙ্গিনীর সাথে চাইলেও সব সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারেনা।
এসবের জন্য তো আমার মা’ই দায়ী বলো?পিসিদিদুনকে আমি খুব একটা দোষ দিইনা। কিছু মানুষের স্বভাবই হয়,অন্যের সংসারে এসে অশান্তি বাঁধানো! উনিও এমন স্বভাবেরই মানুষ, নিজের স্বভাবসুলভ কাজ করাতে দোষের কিছু নেই!
তবে পরিবারের সকলকে সেক্ষেত্রে সাবধান হতে হয়,যাতে বাইরের কারো করা আঘাতে নিজেদের একতার ভীত না টলে!
তবে আমার মা সেই সাবধানতা অবলম্বন করেইনি!বরং পিসিদিদুনের কথায় তাল মিলিয়ে আমার ঠাম্মিকে নিজের সংসার ছেড়ে যেতেই বাধ্য করেছে!
যেখানে আমার ঠাম্মি সারাটাজীবন আমার মাকে নিজের মেয়ের মতো ভালো বেসে গেছে!
ভালোবাসার প্রতিদানটা মা এমন ভাবে দিল যে আমাদের গোটা পরিবারটাই ছিন্ন হয়ে গেল ভালোবাসার সুতো থেকে!
এত কিছুর পর,তুমিই বলো হৃদ, আমি কি করে থাকি ও বাড়িতে?
আমি পারবো না হৃদ। ক্ষমা করো!তোমার কথা রাখতে পারবো না!”

হৃদিতা শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ অবধি। এবারেও তেমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা অনু,আমাকে একটা কথা বলো,তুমি যখন ছোটবেলায় কোন ভুল করতে, কোন দোষ করতে তখন কি তোমার মা তোমাকে একা ফেলে অন্য কোথাও চলে যেত?
যেত না কিন্তু! বরং মা, তোমাকে বকে,মেরে যেভাবে হোক তোমার করা ভুলটা তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে শুধরে দিত। আর তারপরে আবারও আদরে মুড়িয়ে রাখতো!তাই না?
শুধু তোমার মা না কিন্তু! পৃথিরবীর প্রায় সব বাবা-মা’ই এমনটাই করে,করে এসছে এতকাল ধরে!
সন্তানের ভুলের জন্য তার হাত ছেড়ে দিয়ে কিন্তু বাবা-মা অত সহজে চলে যায় না!
এবার তুমি বলো, যে বাবা-মা আমাদের সব ভুল ভুলে গিয়ে আমাদের বারবার আপন করে নেয়, তাদের দু একটা ভুল কি আমরা শুধরে দিয়ে আবারও তাদের পাশে থাকতে পারিনা?
ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়!তোমার মাও তেমনই একটা ভুল করে ফেলেছে!হয়ে গেছে!তাই বলে তাকে একা করে দিয়ে তোমরা সকলে চলে যাবে?বেঁচে থাকা মানুষটাকেই আত্মগ্লানির অনলে পুড়িয়ে তিলে তিলে মেরে ফেলবে?
তারচেয়ে তাকে বুঝিয়ে হোক,রাগ দেখিয়ে হোক,তার ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে তা শুধরে নিতে সাহায্য করাটা কি বেশি শ্রেয় হবে না অনু?
একটা কথা তো জানোই তুমি, পাপকে ঘৃণা করা উচিৎ, পাপীকে নয়!
তেমনই ভুলটাকে এড়িয়ে যাও, যে কারো কু মন্ত্রণার বশবর্তী হয়ে ভুলটা করে ফেলেছে তাকে কেন এড়াবে?
তাছাড়া, প্রতিটা মায়ের কাছেই সন্তানের সুখ-দুঃখটাই প্রথম গুরুত্বের!আর পিসিদিদুন সেটা বুঝেই তোমার মায়ের সেই দূর্বলতায় আঘাত হেনেছে!তোমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ওনার মনে।হিট অফ দা মোমেন্ট ওনার কাছে নিজের পিসির কথাগুলোই ঠিক মনে হয়েছে আর তাই দিদাকে বলে ফেলেছেন কথা গুলো!
তবুও পরে কিন্তু উনিই নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। আদৃতবাবুকে বলেওছেন দিদাকে ফিরিয়ে আনতে।
হয়তো আত্মগ্লানী,লজ্জাবোধ,অপরাধবোধ থেকে দিদার সম্মুখীন হতে পারেননি উনি তবে তাই বলে নিজের করা ভুলের শাস্তি উনি প্রতিনিয়ত পেয়ে গেছেন, স্বামী -সন্তান সকলের মাঝে থেকেও না থেকে!
এটুকুই কি যথেষ্ট নয় ওনার আত্মশুদ্ধির জন্য? অবশ্যই যথেষ্ট!
তাই এবারে তোমাদের সকলের ওনার পাশে থাকা উচিত অনু!ওনারও খারাপ লাগে, ওনারও কষ্ট হয়, দাদুর মতো উনিও একাকিত্বকে সঙ্গী করেই বেঁচে আছেন। তিনটে বছরে রোজ রোজ আপনজনের অবহেলা সয়ে যাচ্ছেন মুখ বুজে!
এবারে মুক্তি দাও!এবারে ওনাকে আবার কাছে টেনে নাও!প্লিজ!
আমি কথা দিচ্ছি, দিদাকে মেঘকুঞ্জে আবারো ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমি নেব!প্রমিস!
এবারেও কি রাখবে না আমার কথাটা?”

হৃদিতা থামে, লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে তাকায় অন্বেষার মুখপানে। নজরে আসে অন্বেষার চিন্তামগ্ন অস্থির দুটো চোখ, ভাবনায় হেলে পড়া চিবুক!
হৃদিতা আবার ডাকে,
“অনু!”
অন্বেষা তাকায়! কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে চেয়ে রয় নিষ্পলক!তারপরে মিষ্টি হেসে বলে,
“রাখবো হৃদ!
এত সুন্দর করে বোঝালে কি কথা না রেখে থাকা যায় বলো!অবশ্যই রাখবো!দাভাই ঠিক বলে, তুমি নিজেই একটা আস্ত ভালো লাগা হৃদ। তোমাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না! ”

হৃদিতা হালকা হেসে বলে,
“ধন্যবাদ অনু!”

অন্বেষা হাসিমুখে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম হৃদ!”

তারপরে শিশুসুলভ হাসিতে মেতে ওঠে দুজনেই!বহুদিনের একটা ভারী পাথর বুক থেকে নেমে গিয়ে হৃদয়ে শান্তি ছুঁইয়ে গেছে বলে মনে হতে থাকে!

দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল আদৃত। ঘরের ভেতরে দুজনের কথা শুনে খুশি হয় সেও!দুজনের হাসির আওয়াজ হাসি ফোটায় তারও ওষ্ঠপ্রান্তে!আদৃত স্বস্তিতে শ্বাস ফেলে নিজ মনেই বিবৃত করে,
“আপনাকে এজন্যই এত ভালোবাসি হৃদ!আপনি আমার জীবনের আস্ত ভালোবাসা!
ভালোবাসি হৃদ।খুব খুব খুব ভালোবাসি!”
.
ড্রয়িংরুমের সোফায় মুখোমুখি বসে আছেন ঋতমবাবু,ও আশুতোষবাবু!পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন টাপুর দেবী!
তিনজন মিলেই অনেকক্ষণ যাবৎ ভেবে যাচ্ছে কিছু নিয়ে!তাদের এই ভাবনায় মত্ত পরিবেশে হঠাৎ আদৃত এসে স্বগোতক্তি করে,
“কি ব্যাপার?সবাই চুপ কেন?কি ভাবছো দাদু?আঙ্কেল আন্টি, কি ভাবছেন?”

ঋতমবাবু গম্ভীর মুখে তাকান। গমগমে ভারী কন্ঠে বলেন,
“ভাবছি, সামনে দূর্গাপূজো!তারপরেই মেয়েটার টেস্ট!টেস্টের পরে হাতে যা দু-একমাস সময় পাবে, তার মধ্যে কি বিয়ের আয়োজন করা উচিৎ হবে?
না মানে, আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নেই,আমরা ঘরোয়া ভাবেই সব আয়োজন করে নেব!আত্মীয় স্বজনও নেই তেমন একটা আমাদের!তবে বিয়েটা কি এত তাড়াহুড়োয় দেয়া ঠিক হবে?আদৃত,তুমি কি বলো বাবা?”

আদৃত হালকা হেসে জবাব দেয়,
“আঙ্কেল, হৃদ কে বিয়ে করা নিয়ে আমার তেমন তাড়া নেই। আপনারা যখন চান বিয়ে দিতে পারেন, ওর উচ্চ মাধ্যমিকের পরে হলেও সমস্যা নেই!তবে যখনই বিয়ে হোক,আমার আর ওর বিয়েতে শুধু আমাদের দুটো পরিবারের উপস্থিতি ছাড়া আর কারো উপস্থিতি থাকবে না!একদম ঘড়োয়া ভাবে বিয়ে হবে। আমি চাইনা, সো কল্ড কিছু আত্মীয় স্বজন ডেকে এনে হৃদকে অপমানের মুখোমুখি করতে!
আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আঙ্কেল! ”

ঋতমবাবু মাথা নাড়েন। আশুতোষ বাবু ডান হাতের তর্জনী আঙুলে চোখের চশমাটা নাকের ওপরে একটু ঠেলে দিয়ে বলে ওঠেন,
“বিয়ে যখন অনাড়ম্বরেই হবে, তখন আমার ঘরের লক্ষ্মীকে আর বাপের বাড়িতে ফেলে রেখে কি হবে?দূর্গাপুজোর মাঝেই একটা শুভ তিথি দেখে হয়ে যাক বিয়েটা। সবে তো ভাদ্র চলছে। পুজো হবে আশ্বিনের শেষের দিকে!তাতে তো এখনো ঢের দেরী!হাতে অনেক সময়! বিয়ের আয়োজন এর মাঝেই হয়ে যাবে!
দিদিভাই না হয়, পরীক্ষা অবধি থাকলো এ বাড়িতেই!পরীক্ষার পরে, আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তখন না হয়, ঘটা করে বৌভাতের অনুষ্ঠান করা যাবে!

বিয়েটা হয়ে থাকলে তো সমস্যা নেই!কি বলো ঋতম?টাপুর মা, তোমার কি মত?”

টাপুর দেবী নম্র হেসে বলেন,
“আপনারা যা ভালো বোঝেন মেসোমশাই!আমার কোন আপত্তি নেই!”
ঋতমবাবু সপ্রতিভ হেসে বলেন,
“ঠিক আছে মেসোমশাই, আপনি যখন বলছেন, তখন পুজোতেই বিয়েটা হয়ে যাক!আয়োজনের যখন কোন ঘটা নেই, তখন দ্রুত হলেও তো সমস্যা নেই!আমারও কোন আপত্তি নেই! ”

আশুতোষবাবু খুশি মনে টাপুর দেবীর উদ্দেশ্যে বলেন,
“তাহলে মা, পঞ্জিকাটা আনো তো দেখি!একটা বিয়ের দিন দেখে রাখি!সব ঠিক থাকলে ঐ দিনই বিয়ে হবে!আর সে মতোই আয়োজন করা যাবে!
আমি নাহয়, খোকা ফিরলে তাকে বলবো, বৌমাকে নিয়ে একবার তোমাদের সাথে এসে দেখা করে যেতে!”
ঋতমবাবু সহাস্যে সম্মতি জানান।টাপুর দেবী, পুজোর ঘর থেকে পঞ্জিকাটা এনে দেন আশুতোষবাবুর কাছে।
আশুতোষবাবু, পাতা উল্টান, চশমার ভেতর দিয়ে খুব মনোযোগ নিয়ে পরখ করেন সাদা পৃষ্ঠায় লেখা সময়-তিথি!
তারপর পঞ্জিকা বন্ধ করে হেসে বলেন,
“আগামী ২১ শে আশ্বিন, গোধুলি বেলায় বিয়ের লগ্ন আছে!ঐ দিনই তবে দিন ঠিক থাক!কি বলো!”

ঋতমবাবু খানিক ভেবে বলেন,
“২৪ আশ্বিন পুজো শুরু!পুজোর একদম আগেভাগে বিয়ে! মেসোমশাই, আপনাদের বাড়ির বউ হবে হৃদ। পুজোতে তো তখন আপনাদের বাড়িতে থাকতে বলবেন, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে পুজোর দিন কটা কি করে কাটবে বলুন!”

ঋতমবাবু হাসেন। তারপরে আস্বস্ত কন্ঠে বলেন,
“চিন্তা করোনা ঋতম। তোমার মেয়ে তোমার বাড়িতেই থাকবে!বিয়ে হয়ে থাক। আমরা কেউ ওকে নিয়ে যেতে চাইবো না। ওর কথা খুব মনে পড়লে না হয় নিজেরা এসেই দেখে যাব!কি দাদুভাই কি বলিস?”

আদৃত এতক্ষণ নিচের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আশুতোষ বাবুর ডাক কানে যেতেই মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“তুমি যা ঠিক মনে করো দাদু!”

আশুতোষবাবু এবার চওড়া হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলেন নিজের ঠোঁটের কোণে। আনন্দিত কন্ঠে পঞ্জিকাটা সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখে বলে ওঠেন,
“তাহলে ঐ কথাই রইলো!২১শে আশ্বিন হৃদিতা দিদিভাইকে, আমাদের বাড়ির বউ করে রেখে যাচ্ছি! ওর পরীক্ষার পরে নিয়ে যাব!কি ঋতম?তোমার আর কোন দ্বিধা নেই তো?”

ঋতমবাবু প্রসন্ন কন্ঠে উত্তর দেন,
“না মেসোমশাই!আর কোন দ্বিধা নেই!আপনার কথাই রইল তবে! ২১শে আশ্বিনই বিয়ে!”

আশুতোষবাবু খুশি হন। অত্যন্ত খুশিমনে টাপুর দেবীকে বলেন,
“টাপুর মা, দাঁড়িয়ে আছো কেন?এত বড় একটা সুখবর!যাও মিষ্টি নিয়ে এসো!মিষ্টিমুখ করি!”

টাপুর দেবী হাসিমুখে সায় জানিয়ে প্রস্থান করেন রান্নাঘরের দিকে।
ঋতমবাবু ও আশুতোষবাবু মগ্ন হয়ে পড়েন বিয়ের আলোচনায়!
আর আদৃত!সে এককোণে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখে যায় বিয়ের আয়োজন-আলোচনা!নিজের মনে বিরবির করে বলে ওঠে,
“অবশেষে আপনার-আমার এক হবার সময় এসে গেলো হৃদ!আপনি আমার কাছে বাঁধা পড়েই গেলেন!”

🍁

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যায় সকলের।ক্লান্ত দেহে অন্বেষা ভুলেই যায় মায়ের সাথে কথা বলার কথা!অবসন্ন শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিতেই দুচোখে ভর করে গভীর নিদ্রা!সব ভাবনা-চিন্তাই তলিয়ে যায় সেই নিদ্রার আড়ালে!
পরের দিন তার ঘুম ভাঙে বেশ ভোরে!ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে সোজা নেমে আসে নিচে!পুজোর ঘরে শাখ বাজার শব্দ শুনে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকেই!
বাইরে তখনো আবছা অন্ধকার, জট পাকানো কুয়াশার ভীড়ে সেই আঁধার চাপা পড়ে হয়ে উঠছে আরও রহস্যময়! নিশাচর পাখিরা সারারাত্রি এদিক সেদিক ঘুরে মাত্র ডানা ঝাপ্টে ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের বাসার পথে!
অন্বেষা পুজোর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়! মল্লিকা দেবী পুজো করছেন নিজ মনে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সারা শরীর।
অন্বেষা বুঝতে পারে মা কাঁদছে!সে কিছু বলার আগেই মল্লিকা দেবীর চাপা কন্ঠ এসে বারি খায় তার কানে,
“আর কতদিন ঈশ্বর?আর কতদিন আমার করা পাপের শাস্তি পাব আমি?
আমার করা অন্যায়ের জন্য মা শাস্তি পাচ্ছেন অযথাই!ঘর-সংসার ছেড়ে বাস্তুহারার মতো পড়ে আছেন বৃদ্ধাশ্রমে!এ বাড়ি ভর্তি এত লোক, তবুও ওখানে ঐ মানুষটা একা, দুদন্ড কথা বলার জন্য একটা সঙ্গীও নেই!
কিন্তু আমিই বা কি করবো?যতবার ভাবি মায়ের কাছে গিয়ে ওনাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো, ততবারই কোন এক অদৃশ্য বাঁধা বেঁধে দেয় আমায়!ভীষণ লজ্জা আর অপরাধবোধ কুড়ে খায় ভেতরটা!কোন মুখে দাঁড়াবো ওনার সামনে?
যে মানুষটা বিয়ের পর থেকে আমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেছে, বন্ধুর মতো মিশেছে, তাকেই যা নয় তাই বলে অপমান করেছি আমি!তারপরে কোন মুখ নিয়ে যাব ওনার সামনে?কিভাবে যাবো?
কিভাবে?”

মল্লিকা দেবী ফুঁপিয়ে ওঠেন। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্বেষারও চোখ ভিজে ওঠে জলে! তার মনে হয়, হৃদিতা ঠিকই বলেছে, একদম ঠিক!তার মাকে, তারা সকলে মিলে, লঘু পাপে গুরুদন্ড দিয়ে ফেলেছে।
এ জগতের সবচেয়ে বড় প্রায়শ্চিত্ত হলো, আত্মোপলব্ধি!তার মা তো সেই প্রায়শ্চিত্ত দীর্ঘ তিন বছর ধরে করে আসছে!তবে কেন তারা এখনো তাকে কষ্ট দিচ্ছে এভাবে?
অন্বেষা চোখের পলক ঝাপটে আসন্ন অশ্রুকণাটুকু সামলে নিয়ে মল্লিকা দেবীকে ডেকে ওঠে,
“মা!”

মল্লিকা দেবী চোখ মেলে তাকান। গাল গড়ানো অশ্রু নিয়েই পিছু ফিরে মেয়ের মুখখানা দর্শন করেন। কান্নার বেগ আরো বৃদ্ধি পায়! মেয়েটা আজ কত দিন পরে তাকে “মা” বলে ডাকলো!তিন বছর হবে না?হবে তো!

মল্লিকা দেবী ঈশ্বরের চরণে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ান। আস্তে আস্তে এগিয়ে যান মেয়েটার দিকে!অন্বেষার দু গালে হাত রেখে কান্নামাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“তুই আমায় ডাকলি অনু?এতদিন পরে ডাকলি?মায়ের ওপর থেকে সব রাগ চলে গেছে তোর?”

মাতৃকন্ঠের এমন কাতরতায় অন্বেষার আঁখিজোড়া আবারো সিক্ত হয়ে আসে!সে কম্পিত স্বরে উত্তর দেয়,
“মায়ের ওপরে কি রেগে থাকা যায় মা?আমি রাগ করিনি তোমার ওপর!শুধু অভিমান হয়েছিল।
তোমার অচেনা রুপটা মেনে নিতে পারিনি আমি! তবে এখন আর সেই অভিমান নেই মা!একজন বুঝিয়ে দিয়েছে, অভিমান করে দূরে সরিয়ে দিলে কষ্ট দু পক্ষেরই হয়!তাই দেখ না, আমার সব অভিমান মরে গেছে!সব!”

মল্লিকা দেবী মেয়েকে বুকে টেনে নেন। তারপর ভাঙা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“কার কথা বলছিস অনু?”

অন্বেষা আলতো হেসে জবাব দেয়,
“হৃদিতার মা!ও কাল আমার থেকে কি চেয়েছে জানো মা?আমি যেন আর এ বাড়ি থেকে হোস্টেলে না ফিরি!আমি যেন তোমার সাথে আবার আগের মতো হয়ে যাই!
ওর কথা শুনেই তো বুঝতে পারলাম মা, আমরা ভুল করেছি মা।তোমার হঠকারিতায় করা একটা ভুলের জন্য তোমাকে এমনভাবে একা করে দেয়াটা আমাদের কারোরই উচিত হয়নি মা।একদম না!”

মল্লিকা দেবী আর কিছু বলেন না। মেয়েটাকে বহুদিন পর বুকের মাঝে পেয়ে অশান্ত, ব্যাকুল মাতৃমনটা শান্ত হয়ে আসে একটু একটু করে!আর মনে মনে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে যায় হৃদিতা নামক মেয়েটির উদ্দেশ্যে!
.
পৃথিবীর বুকে সকাল নেমেছে!নিষ্কলঙ্ক স্বর্ণআভায় ছেয়ে গেছে ভূবনের আনাচ-কানাচ!
সূবর্ণকান্তী সূর্য তার তেজ বিস্তার করে যাচ্ছে সমহিমায়!চারিদিক তার সেই তেজস্বী রশ্মিতেই উজ্জ্বল,অম্লান!
কে বলবে ভোরবেলাতে এই রবি আলোকের অনুপস্থিতিতেই, ধোঁয়াটে কুয়াশার রাজত্ব চলেছিল নিশি জগতের বুকে!
হৃদিতা প্রাত্যাহিক নিয়মমাফিকই কলেজে যায়!
টানা তিন ঘন্টার ক্লাস শেষ করে গরমে নাজেহাল হয়ে বেরিয়ে আসে ক্লান্ত পা ফেলে!
আসার সময় ঠিক করেই এসেছিল আজ দিদার সাথে দেখা করতে যাবে!সে মতোই পা বাড়ায় বৃদ্ধাশ্রমে যাবার রাস্তাটার দিকে! তবে কি মনে করে যেন থেমে যায়!
ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ডায়াল করে আদৃতের নাম্বারে!
আদৃত তখন ল্যাপটপের পর্দায় চোখ রেখে অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চেক করতে ব্যস্ত!সকল ডকুমেন্টে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলানোর মাঝপথেই বেজে ওঠে মুঠোফোন। আদৃত ভ্রু কুচকে মুখ তুলে তাকায় সেদিকে।কাজের মাঝে বিনা অনুমতিতে ফোনটার এমন অসভ্যের মতো বেজে ওঠায় প্রবল বিরক্ত হয় সে! বিরক্তি নিয়ে ফোনটা তুলে চোখের সামনে ধরতেই কুঞ্চিত ভ্রুযুগল শিথিল হয়ে আসে। বিরক্তি কেটে গিয়ে মুখমন্ডলে ভর করে প্রগাঢ় স্নিগ্ধতা!
ফোন স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে, “হৃদ” নামটা!
আদৃতের ঠোঁটের কোণ অজান্তেই প্রসারিত হয়!খুব দ্রুত হাত চালিয়ে ফোনের রিসিভারটা অন করতেই কানে বাজে প্রিয়তমার ব্যস্ত কন্ঠস্বর,
“ফোন ধরছিলেন না কেন?কতক্ষণ থেকে বাজছে!আরেকটু হলে তো কেটেই যেত রিংটা!”
তারপর কিছু একটা ভেবে আওয়াজ নামিয়ে নরম স্বরে শুধায়,
“আপনি কি ব্যস্ত আদৃতবাবু?আমি কি অসময়ে কল করে বিরক্ত করলাম?”

আদৃত মগ্ন হয়ে শুনছিল হৃদিতার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ।মুগ্ধ হচ্ছিল হৃদিতার অব্যক্ত অধিকারবোধে, কিন্তু শেষোক্ত বাক্যটি শুনে বিচলিত হয়ে জবাব দিল,
“আরে, না না হৃদ!আমি বাড়িতেই!এই, একটা ফাইল চেক করছিলাম জাস্ট!আপনি বলুন কি বলবেন?কোন দরকার ছিল?”

হৃদিতা আবারো স্বর পাল্টায়!গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি বাড়িতে?”
আদৃত ফোনটা কান থেকে ইঞ্চি চারেক দুরে সরিয়ে নিয়ে বিরবির করে ওঠে,
“মেয়ে মানুষের কি স্বভাবই নাকি ফোন কানে নিয়ে চেঁচানো?নাকি এরা বিপরীত দিকের মানুষ গুলোকে কানে কালা ভাবে?
এমন করে চেঁচিয়ে উঠলে তো এমনিতেও কালা হয়ে যাব!খুব কঠিন কিছু তো না?”

আদৃত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে!ফোনটা আবারো কানের কাছে এনে বলে,
“হ্যাঁ হৃদ!আমি বাড়িতেই!আপনি বলুন কি বলবেন!”
হৃদিতা আগ্রহ ভরে বলে ওঠে,
“আমি কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে আছি আদৃতবাবু!আপনি কি এসে একবার আমাকে নিয়ে যাবেন?”

আদৃত অবাক করা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায়?”

হৃদিতা মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়,
“আপনার বাড়িতে!”

আদৃতের অবাক হবার মাত্রা চড়চড় করে বেড়ে ওঠে!সে অবাক ভাব নিয়েই পুনরায় প্রশ্ন করে,
“আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন?সত্যি?”

হৃদিতা একগাল হেসে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ!একদম সত্যি! ”

এবারটা হাসে আদৃতও!হাসিমুখে জবাব দেয়,
“আধ-ঘন্টা থামুন, আমি আসছি!”
.
শহরতলীর ব্যস্ত রাস্তা!পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে শনশনে শব্দে চলছে আদৃতের গাড়ি!ফ্রন্টসিটে হেলান দিয়ে বসে আছে হৃদিতা। জানালার কাচ বন্ধ! এসির ঠান্ডা হাওয়ায় শীতলতায় ছেয়ে আছে বদ্ধ গাড়ির প্রতিটা কোণ!
হৃদিতার চোখ বাইরের দিকে নিবদ্ধ! সারে সারে উঁচু বিল্ডিং, সবুজ গাছপালা, সব চোখের পলকে ছাড়া পড়ে যাচ্ছে পেছনে, মিলিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টির অগোচরে!
হৃদিতা আচমকা চোখ ফেরায়!আদৃত মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে তখন!হৃদিতা মৃদু আওয়াজে বলে ওঠে,
“এসিটা বন্ধ করে দিননা আদৃতবাবু, আমি জানালাটা খুলে দিই?”

আদৃত হালকা হেসে মাথা নেড়ে সায় জানায়!এসির বাটন টাতে চাপ দিয়ে তা বন্ধ করে দিতেই হৃদিতা নামিয়ে দেয় জানালার কাচ!
ফুরফুরে সজীব হাওয়ায় ভরে যায় গোটা গাড়ি!
হৃদিতা প্রাণভরে শ্বাস টেনে নিয়ে আড়চোখে তাকায় আদৃতের দিকে!
আদৃতের চোখের দৃষ্টি তখনো স্থির। সামনের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত সে!
হৃদিতা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়! আবার তাকায় জানালার বাইরে!হাওয়ার তোড়ে বুজে আসতে চায় চোখের পাতা!
আদৃত সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে,
“কিছু বলবেন হৃদ?”
হৃদিতা ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। হালকা হেসে বলে,
“কই,না তো!”
আদৃত ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
“হৃদ!তবে কি আমার দিকে এমনি এমনি তাকিয়ে থাকতেই আপনার ভালো লাগে?আড়চোখে তাকাচ্ছেন কেন?”

হৃদিতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চোখ নামায়!লাজুক হেসে কৃত্রিম প্রতিবাদের স্বরে বলে ওঠে,
“মোটেও তেমন না!আমি তাকাইনি!”

আদৃত ফিচেল হেসে বলে,
“তাকাননি বলছেন?তবে আমি ভুল দেখলাম বলুন?তাই হবে হয়তো!তবে আমার মনে হয় আপনি ট্যারা হয়ে গেছেন হৃদ!সেজন্যই না তাকাতেই মনে হচ্ছে যে তাকিয়ে আছেন!”

হৃদিতা এবার রাগী চোখে আদৃতের দিকে তাকায়! আদৃতের ঠোঁটের কোণ তখনও প্রসারিত!
হৃদিতা রাগত স্বরে বলে ওঠে,
“আপনি কি বললেন?আমি ট্যারা?
আমাকে দেখে ট্যারা মনে হয় আপনার?ফাজিল লোক!একদম কথা বলবেন না আর আমার সাথে!
আর যদি তাকিয়েও থাকি, তাতেই বা কি?আমার চোখ আমি তাকিয়েছি আপনি বারণ করার কে শুনি?”

আদৃত হেসে ফেলে বলে,
“হ্যাঁ সেই!আপনার চোখ,আপনি তাকিয়েছেন। তাতে আর আমার কি বলুন!তবে তাকালেন তো আমারই দিকে!তাই বলা আরকি?”

হৃদিতা আবারো ফুঁসে উঠে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ!তো?কি হয়েছে আপনার মুখের দিকে তাকিয়েছি তো?আপনার মুখের দিকে তাকানো যাবে না?সোনার মুখ নাকি আপনার?তাকালে সোনায় খাঁত বাড়বে?”

আদৃত চাপা হেসে বলে ওঠে,
“বাহ্!হৃদ!আপনার আগের রুপ ফিরে এসছে দেখি!কথায় কথায় প্রশ্ন!গুড গুড!আপনার এ রুপ দেখেই তো প্রথম পা পিছলে পড়েছিলাম!”

হৃদিতা বড় বড় চোখে তাকিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“কোথায়? কোথায় পড়ে গেছিলেন?”

আদৃত আবারো ফিচেল হেসে জবাব দেয়,
“কেন?আপনার প্রেমে!”
হৃদিতা এবারে লজ্জা পায়!লাজুক হেসে মাথা নোঁয়ায়! আদৃত সে লজ্জার আগুনেই ঘি ঢেলে দিয়ে বলে উঠল,
“আপনি নিজে থেকে আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে চাইছেন,এর মানে কি আপনি বোঝেন হৃদ?”

হৃদিতা লাজুক হেসে মাথা নাড়ে!মিনমিন করে উত্তর দেয়,
“না!”
আদৃত ঠোঁটের দুধারের হালকা প্রসারণকে সঙ্গী করে বলে,
“এর মানে,আপনার সারাটা অস্তিত্ব জুড়ে যেমন আমি আমার সকল অনুভূতির জাল বুনি, ঠিক তেমনভাবেই আমার সকল অস্তিত্বটুকুও আপনার মনে এক দৃঢ় অনুভবের মায়াজাল বিস্তার করে ফেলেছে হৃদ! সে প্রণয়মায়ার মায়াতেই তো আপনার সব দ্বিধা কেটে গেছে হৃদ!আমার সাথে আপনি যে একটু একটু করে সাবলীল হয়ে উঠছেন তা কি আপনি বোঝেন না হৃদ?এত অবুঝ কেন আপনি?
আমি আপনার মনটা অবধি বুঝে ফেলি, আর আপনি নিজের মনটাই বুঝতে পারেন না?”

হৃদিতা লাজুক হেসে আবারো মুখ নামায়!আনত মুখে খুব ধীরে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“আমাকে বোঝার জন্য তো আপনি আছেন আদৃতবাবু!আমার নিজেকে না বুঝলেও চলবে!”

আদৃত হাসে!সেই হাসিতে লুকিয়ে থাকা তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ে তার মুখশ্রীর সর্বত্র!
চলন্ত রাস্তার বাঁক, আর শনশনে সমীরণ সাক্ষী হয়ে থাকে সেই প্রেমিকযুগলের প্রণয়ালাপণের!

#চলবে!

[কাল বিশেষ কিছু সমস্যা থাকায় উপন্যাস দিতে পারিনি।দুঃখিত। আজ ডাবল পার্ট দিয়ে দিয়েছি!
হ্যাপি রিডিং টু অল]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here