প্রিয়ংবদা পর্ব ৩১:৩২

0
1170

#প্রিয়ংবদা
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

৩১.
সপ্তমীর সকাল!কুয়াশাঘেরা পুরো পৃথিবীর বুক চিরে ঠিকরে বেরোচ্ছে একমুঠো রোদ্দুর!সদ্য প্রভাতের সেই রবিপ্রভায় মাখামাখি হচ্ছে মেঘকুঞ্জের বাগান,শিউলিতলা।শুভ্র শিউলিফুলের ওপরে সেই উপচানো স্বর্ণআভা তাদের সৌন্দর্যে ছোঁয়াচ্ছে সোনাকাঠি!
হৃদিতা যেন প্রায় আগন্তুকের মতোই অনধিকার প্রবেশ করলো সেখানে!প্রথম সকালের নরম রোদ্দুর আর শ্বেতাভ শিউলির অদৃশ্য প্রণয়কাব্যে বাঁধ সেধে ঘটালো তাদের বিচ্ছেদ!সবুজ ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা শিউলিমেলা নিজের হাতের ফুলের সাজিটায় কুড়িয়ে নিল খুব যত্নে!শিউলি-রোদের বিচ্ছেদ হলো!তবে অসভ্য রোদপুরুষ দমলো না!গাছের তলার শিউলি হারিয়ে সে এবার আচল ধরলো জ্যান্ত শিউলিটির,লাল পেড়ে সাদা রঙের আটপৌরে করে পড়া শাড়িতে সজ্জিতা হৃদিতার!সদ্য বিচ্ছিন্ন প্রেমিকার থেকে তার মন মজলো নব্য এই নারীতে।নির্লজ্জের মতো বিচরণ করে যেতে লাগলো হৃদিতার গোটা গায়ে, শাড়ির ফাঁক গেলে দৃশ্যমান কোমড়ে-উদরে!
ফুল গুলোকে খুব যত্নে সাজিতে তুলে নিয়ে হৃদিতা হাটা দিল বাড়ির ভেতরে, তাদের পূজোর ঘরে!নিজহাতে খুব যত্নে একের পর এক ফুল সুতোয় সাজিয়ে গাঁথলো বিশাল মালা!বড় পিতলের থালাটায় সাজিয়ে রাখলো তা!তারপরে একে একে সাজালো ফুল,বেলপাতা,ধূপ,প্রদীপ,দূর্বা,ধান,সিঁদুর আর একবাক্স সন্দেশ!
হৃদিতার পুজোর থালা সাজানোর মাঝেই পিছে এসে দাঁড়ালো আদৃত!কর্মে ধ্যানমগ্ন হৃদিতা তা টের পেল না মোটেই!
কাজ শেষে গৃহদেবতা প্রণাম করে যখন উঠে দাঁড়িয়ে পিছে ঘুরলো ঠিক তখনই দৃশ্যমান হলো আদৃতের উপস্থিতি!হৃদিতা চমকে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে!
প্রেমিকপুরুষের দিকে পিটপিটে চাহুনি ছুঁড়ে দিয়ে অসন্তোষে শুধালো,

“আপনি এমন করেন কেন?আমাকে কি মেরে ফেলতে চান নাকি হার্ট অ্যাটাক করিয়ে!এমন নিঃশব্দে পিছে এসে দাঁড়ান কেন?ভয় পাইনা?আমার তো আত্মারামই খাঁচা ছেড়ে পালাবে!”

আদৃত নিঃশব্দে হাসলো।কৌতুক করে বললো,

“ভয় কেন পাবে?ভয় পেলে তো হবে না।তুমি সাহসী নারী!অচেনা এক পুরুষ কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়ে পরিত্যক্ত বাড়িতে ফেলে রাখলেও তুমি ভয় পাও না।একের পর এক তার মুখের ওপর রাজ্যের সব আজব আজব কথা বার্তা বলে পাগল করে দাও!
সেসব কি কি যেন?হিমু আর গু!
আহ্!এখনো ভাবলে কেমন একটা লাগে,আর তুমি সেদিন কি নির্দ্বিধায় এসব কিছু বলে গেলে, বলেই ক্ষান্ত হলে না তার এক্সপ্লেনেশনও দিলে!ভাবা যায় এসব!
সেই মেয়ে আজ নিজেরই বাড়িতে সেই অচেনা যুবকটিকে বর হিসেবে পেয়ে তার নিঃশব্দ উপস্থিতি ভয় পাচ্ছে! আহা এতো দেখি ডিমোশন!ব্যাপক ডিমোশন!”

হৃদিতা ভ্রু কুচকে তাকালো!দুচোখে ভর করলো রাজ্যের বিতৃষ্ণা!কপট রাগ নিয়ে সে বললো,

“ফাজলামি করেন আমার সাথে, পূজোর দিনে ফাজলামি?একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। কিছু না বলে পিছনে এসে দাঁড়ালে কিকরে বুঝবো আপনি নাকি চোর-ডাকাত!সেদিন যখন কথা বলেছিলাম তখন তো আপনি সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই সাহস ছিল!
সেদিন আর আজ এক নয়!হুহহহ্!আমার মোটেও ডিমোশন হয়নি,বরং প্রমোশন হয়েছে, সেদিনের এক অচেনা-অজানা অপহরণকারীনী থেকে আজ খুব চেনা,ভীষণ জানা প্রেয়সী হয়েছি, আপনার বিয়ে করে ঘরে তোলা অর্ধাঙ্গিনী হয়েছি!এর চেয়ে বড় প্রমোশন আর কিছু হয়না!বুঝলেন?”

আদৃত মুচকি হাসলো!হৃদিতার রাগের পারদ আরেকটু উসকে দিতেই ফিচেল স্বরে বললো,

“আহা প্রেয়সী!কি ভালো লাগলো না শুনতে!
প্রেয়সী কি জানে, রাগ করলে তার রক্তিম গাল দুখানা এই প্রেমিকপুরুষের খেয়ে নিতে মন চায়!
শুধু রাক্ষস পদবি পাবার ভয়ে তা করা হয়না!
রাগলে কিন্তু তোমায় বেশি সুন্দর লাগে হৃদ!”

হৃদিতা আবারো চাপা রাগ নিয়ে উত্তর দিল,

“ছি!কি লাগামছাড়া কথা!ঠাকুরঘরে দাঁড়িয়ে এমন অশ্লীল কথা বলতে লজ্জা করেনা আপনার?সব লজ্জা কি ধুঁয়ে খেয়ে ফেলেছেন নাকি?দেখি সরুন!যেতে দিন!”

হৃদিতা পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আদৃত আটকে ফেলে!থালা ধরে রাখা হাতের বাহুজোড়া টেনে নিয়ে আসে নিজের কাছে!তারপর কপালে বেরিয়ে আসা কেশরাজিকে কানের পিঠে ঠেলে দিয়ে প্রণয়বারি বর্ষণ করে হৃদিতার ওপর!বলে,

“তোমার সাথে আমার সব বাক্যালাপই শ্লীল,বৈধ এবং শুদ্ধ! তোমার আমার বন্ধনটাই এতটা পবিত্র যে এখানে অশ্লীল শব্দটারই কোন স্থান নেই!
আর রইলো বাকি লজ্জার কথা, তবে শোনো মেয়ে,
কৃষ্ণরঙা শিউলিফুলের প্রণয়ডোরে যে পুরুষ বাঁধা পড়ে, তার লজ্জা পেতে বারণ, তার শুধু প্রেমে পড়তে হয়,বারবার,হাজার বার!
তোমার মনে আছে হৃদ,এক শ্রাবণ বিকেলে ঠিক এমনই শিউলিসাজে দেখেছিলাম তোমায়,ঠাম্মির দেয়া লালা-সাদা শাড়িটা পড়ে!সেদিন আমার দৃষ্টি থমকেছিল বরাবরের জন্য, বুঝেছিলাম এই দৃষ্টি আর অন্য কোথাও মুগ্ধ হবে না, এই দৃষ্টির মুগ্ধতা কেবল এই শিউলিটিকে ঘিরেই!
সেদিন আমার পাকাপোক্ত সর্বনাশটা হয়ে গিয়েছিল হৃদ,হৃদয় হারানোর সর্বনাশ,হৃদে হারানোর সর্বনাশ!
আর সেই সর্বনাশেই ধুঁয়ে গেছে সব লাজ,সব দ্বিধা, সব দ্বন্দ্ব!
তাই এখন আর লজ্জাটা আসে না হৃদ,শুধু প্রেম আসে,শুধুই প্রেম!”

হৃদিতার মুখ থেকে সবটুকু রাগ উবে যায় হঠাৎই, সে স্থান দখল করে প্রকট হয় মনরাঙানো লজ্জা,সেই রাঙালাজ রক্তিম কপোলে ফেলে আরও রক্তিম ছায়া!হৃদিতা লাজুক হেসে বলে ওঠে,

“হয়েছে ছাড়ুন!বুঝেছি সব!যেতে দিন এবারে, বাইরে দিদা,অনু,দিদার বৌমা অপেক্ষা করছে!মন্দিরে যাব না?অঞ্জলি দিতে হবে তো!আপনার সেসব খেয়াল তো নেই!পাঞ্জাবির বোতামগুলো যে খোলা দেখেছেন?যান লাগিয়ে নিন!লাগিয়ে আপনিও আসুন।আমাকে ছাড়ুন এবারে!”

আদৃত ছেড়ে দিল আকড়ে রাখা হাত,আলগা করলো বন্ধন!হৃদিতা বেরিয়ে গেল সাথে সাথেই!আদৃত ডানহাতে কপালের সামনে আসা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বিস্তর হাসলো!পাঞ্জাবির বোতাম গুলো চটজলদি লাগিয়ে নিয়ে নিজেও হাঁটা দিল নিচে!হাজার হোক তার প্রিয়ংবদার আদেশ,মানতে হবে বৈ কি!
.
সেদিন সকালে অঞ্জলি দিয়ে বাড়ি ফিরে হৃদিতা হঠাৎই ঘোষণা করলো, আজকের রান্না সে করবে!খিচুড়ি সাথে পটল,বেগুন আর আলুভাজা!
কাদম্বিনী দেবী বারণ করে বললেন,

“কি দরকার দিদিভাই?তোমার অভ্যেস নেই!আমি,বৌমা আছি তো!আমরা করে নেব!তুমি ঘরে যাও!”

হৃদিতা নাছোড় কন্ঠে বললো,

“না না দিদা।আমিই করবো!এটা কি আমার বাড়ি না বলো?আমার বাড়িতে আমার পরিবারের জন্য কি আমি কিছু করতে পারিনা?তাছাড়া আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতে!
ও দিদা,প্লিজ মেনে যাও!রাঁধতে পারমিশন দাও!প্লিজ!”

কাদম্বিনী দেবী আর অমত করলেন না। মেয়েটা এত মিষ্টি করে বলে,না করাই যায় না!তাই অনুমতি দিয়ে বললেন,
“আচ্ছা করো তবে!কিন্তু আমিও থাকবো তোমার সাথে। হাতে হাতে এগিয়ে দেব!না করবে না। তোমার অভ্যেস নেই! হাত-টাত কেটে গেলে, ছ্যাঁকা লাগলে!না বাবা সাবধানের মার নেই!”

হৃদিতা একটা তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,

“আচ্ছা! ”
.
কাদম্বিনী দেবী সহায়তা করলেও হৃদিতা সব কাজ করলো নিজের হাতেই!নিজে নিজেই ডাল বাছলো,চাল ঝাড়লো, আলু,পটল কেটে নিল!একটু ভয়ে ভয়ে কাটলো বেগুনগুলোও!
তাদের বাড়ির সেই মিনি পিকনিকের মতো আজ আর পটল দিয়ে পোকা-টোকা বেরোলো না!
হৃদিতা খুশি মনে চুলোতে হাড়ি বসালো!আঁচে তেঁতে যাওয়া হাড়িতে তেল ঢেলে তাতে একে একে ফোড়ন দিল!একদম মা যেভাবে করতো সেভাবেই,ঐ যে ঐ দিন দেখেছিল মায়ের পাশে বসে!
তারপর চালডাল ধুঁয়ে দিয়ে মায়ের দেখে শেখা নিয়মমাফিকই রেঁধে ফেললো সব!
কাদম্বিনী দেবী সন্তুষ্ট নয়নে দেখে গেলেন হৃদিতার একাগ্রতা!
মনে মনে বললেন,

“তুমি বাস্তবিকই খুব আলাদা দিদিভাই,আমার নাতিটার প্রেমে পড়াটাও একদমই যৌক্তিক!তোমার মতো কাউকে নিমেষে আপন করে নেবার ক্ষমতা যে সত্যিই খুব কম মানুষের থাকে দিদিভাই!
আশির্বাদ করি, সবসময় এমনই থেক!তোমার মঙ্গল হোক!সুখী হও!”
.
রান্নাবান্নার পর সকলকে নিজের হাতে তা পরিবেশন করলো হৃদিতা। ডায়নিংয়ের বদলে সকলে মিলে গোল হয়ে বসলো মাটিতে!পূজো উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন!
কেটে ধুঁয়ে রাখা কলাপাতায় চুলো থেকে নামানো গরম খিচুড়ি বেড়ে দিয়ে তার পাশেই দেয়া হলো তিন রকমের ভাজা!
সকলে তৃপ্তি করেই খেল সবটা!মল্লিকা দেবী প্রসন্ন হেসে স্বামীকে বললেন,

“আমারও যে এবারে সংসার থেকে অবসর নেবার সময় এসে গেল আদৃতের বাবা!আমাদের বৌমাটি যে সব খুব সুন্দর করে সামলে নেবে তা কিন্তু আমি নিশ্চিত!আমার এই বন্ধুটির হাতে সংসারের সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে আমি একদম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো!”

আনন্দবাবু সহাস্যে সায় জানালেন,তবে প্রতিবাদ করলো হৃদিতা!সে জ্বলন্ত স্বরে বললো,

“মোটেও না দিদার বৌমা!আমি কেন সংসারের দায়িত্ব নিতে যাব!সংসার সামলাবে তোমরা বড়রা, তা না করে ছোট একটা বাচ্চার ওপরে সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তোমরা নিশ্চিন্ত হবার কথা ভাবছো?খালি ফাঁকিবাজি তাই না?না না, এসব ফাঁকিবাজি চলবে না।
আমার তো সংসারের দায়িত্ব চাইনা,আমি চাই সবসময় তোমাদের নিয়ে মিলেমিশে হেসে খেলে থাকতে!তা আমি এমনিই পারবো,দায়িত্বের মতো ভারী শব্দটা আমার কাঁধে এমন চাপিয়ে দিও না তো!আমি এসব নিতে পারবো না!
তোমার সংসার তুমি সামলাও!আমি পারবো না!”

মল্লিকা দেবী মুগ্ধ হাসেন।তার চেয়ে এই যে বয়সে এত ছোট একটি মেয়ে, তার এমন নিঃসঙ্কোচ বন্ধুসুলভ ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারেন না।মেয়েটা যে জাগতিক সব আড়ষ্টতা থেকে মুক্ত,একদম ভোরের প্রথম রবিলোকের মতোই পবিত্র,শুদ্ধ মননশীলতার অধিকারীনী তাতে কোন সন্দেহ থাকে না তার!
বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না, তার ছেলেটির আচমকাই হৃদে আসক্ত হবার কারণ!এমন সারল্য যার মনে, তাকে ভালো না বেসে থাকে কার সাধ্য?
.
দিনের আলো যখন হারিয়ে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে,সপ্তমীর বাঁকা চন্দ্র জ্বলে ওঠে আকাশে,টিমটিমে তারার হীরকোজ্জ্বল দ্যুতিতে আলোকিত হয় কৃষ্ণকালো অন্তরীক্ষ তখন সন্ধ্যে আরতি থেকে সদ্য ঘরে ফেরে হৃদিতা!
সকাল থেকে ছেড়ে রাখা চুলগুলো তখন কেবল অগোছালো হাতখোপায় বাঁধা!
হৃদিতা বিছানার ওপরে বসে!বেডসাইড টেবিলের ওপরে ঢেকে রাখা জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢোকে শেষ করে পুরোটা!গলাটা একদম শুকিয়ে এসেছিল।
উফফফ!খিচুড়ি খেলে এই এক সমস্যা, শুধু ঘনঘন পিপাসা পায়!
হৃদিতা হাতের গ্লাসটা আবারও নামিয়ে রাখে জায়গামতো!তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে আসে আদৃত!
কাল অষ্টমী!মন্দিরের ভেতরের উঠোনটায় প্রসাদী ভোগ খেতে বসবে কত-শত ভক্ত!তাদেরই জন্য সেখানে প্যান্ডেল করার কাজে হাত লাগালো সে এতক্ষণ!বড় বড় বাঁশ গেড়ে,সেগুলোকে রঙিন কাপড় দিয়ে ঘিরে বসার জায়গাগুলো ভালো মতো ঝাড় দিয়ে তবেই হলো ছুটি!সে যে এই পাড়ারই ছেলে,মায়ের পূজোর আয়োজনে হাত না লাগালে কি আর চলে?

আদৃতের সেই ক্লান্ত মুখখানির পানে তাকিয়ে হৃদিতা ব্যাকুল হয়ে পড়ে!তড়িঘড়ি হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে জগ থেকে আবারও জল ঢালে গ্লাসে! জলভরা গ্লাসটা আদৃতের হাতে ধরিয়ে কাঁধে ফেলে রাখা আটপৌরে শাড়ির শেষ কোণাটা আলগা করে আলতো হাতে মুছে দিল আদৃতের কপাল-গলায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম!কাতর নয়ন মেলে ব্যাকুল হয়ে শুধালো,

“খুব খাটুনি গেল তাইনা?হাফিয়ে গেছেন একেবারে!আহা!নিন তো জলটা খেয়ে নিন!”

আদৃতের সব ক্লান্তি যেন জুড়িয়ে গেল পলকে!প্রিয়তমার সামান্য ব্যাকুলতাই মনে তুলল প্রশান্তির ঝড়!সে হৃদিতাকে আস্বস্ত কন্ঠে জবাব দিল,

“আমি ঠিক আছি হৃদ,চিন্তা করোনা তো!ওটুকু খাটুনিতে কিছু হয়না!তুমি ব্যস্ত হয়োনা!আচ্ছা? ”

হৃদিতা অশান্ত নয়নেই মাথা নাড়ে।আদৃত হালকা হাসে। জলটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে কাবার্ডের দিকে গিয়ে খুলে দেয় বন্ধ পাল্লা!ভাজ করে রাখা কাপড়ের মাঝ থেকে বের করে আনে একটা সবুজরঙা শপিং ব্যাগ!
হৃদিতা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়!আদৃত এসে দাঁড়ায় তার সামনেই!ব্যাগটা হৃদিতা হাতে ধিয়ে দিয়ে বলে,

“এটা তোমার জন্য।মা আনতে বলেছিল।কাল মহাঅষ্টমী!মা দূর্গার সন্ধিপূজো!এ পাড়ার মন্দিরে সন্ধিপূজোর সেই একশত আটটা প্রদীপ বহুদিন ধরেই আমার মা-ঠাম্মি জ্বালিয়ে আসছেন!এবারে ওনাদের ইচ্ছে এ কাজটা তুমি করো!
সেখানে নতুন শাড়ি পড়তে হয়,সেজন্যই আনা!দেখতো পছন্দ হয় কিনা!অনেক খুঁজে পছন্দ করেছি!দেখ কেমন লাগে!”

হৃদিতা স্নিগ্ধ হাসে!ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনে নতুন ভাজের শাড়িটি!
গাঢ় গোলাপী পাড়ের বেগুনী একখানা ঢাকাই জামদানী!পাড়ের পুরোটা জুড়েই হালকা সোনালী সুতোর নকশা!হৃদিতা তা দেখে বিস্তর হেসে উত্তর দেয়,

“পছন্দ না হয়ে যাবে কই?খুব সুন্দর হয়েছে!আপনার পছন্দ কিন্তু খুব সুন্দর!”

আদৃত হৃদিতার হাত ঘুরিয়ে কাছে টানে, নিজের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করায় তাকে।আলগোছে বেঁধে রাখা খোপাটা খুলে দেয় হাতের টানে!সারা পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে ঘন কালো কুন্তল!আদৃত হাতের স্পর্শে চুলগুলোকে সামনে ঠেলে দেয়!তারপর প্রিয়তমার কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বিভোর কন্ঠে বলে,

“জানি তো!সেজন্যই তো তোমায় পছন্দ করেছি!”

হৃদিতা আর উত্তর দেয় না।তার কালোরুপের জীবনটাতেও যে একটা মানুষের এত অপার ভালোবাসা তার প্রাপ্য ছিল তা ভেবেই বারংবার পুলকে ছেঁয়ে যায় প্রেমপিপাসু হিয়া!আর অনুভব করে যায় সেই পরম শুদ্ধ ভালোবাসাটুকুর গভীরতা,প্রণয়ের নিপুণতা!

৩২.
অষ্টমীর সকালটা শুরু হলো আরেকটু ভিন্নভাবে!সদ্য ভোরে স্নান সেরে আদৃতের এনে দেয়া শাড়িটা গায়ে চাপিয়ে বেরোতেই হাতে হ্যাঁচকা টান অনুভব করলো হৃদিতা।ঘটনার আকস্মিকতায় টাল সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে পড়লো বলিষ্ঠ কোন বুকের ওপর!পরিচিত সেই আশ্রয়ের মালিকানা যে আদৃতেরই তা বুঝতে সময় লাগলো না!হৃদিতা বুক থেকে মাথা তুলে আদৃতের চোখে চোখ রেখে বললো,

“সাত সকালে আবার শুরু হলো আপনার পাগলামো?কি যে করেন না। চমকে গেছি পুরো!বলি এত টানাটানির কি আছে বলুন তো!একটু ধীর-স্থির ভাবে ডাকলে কি হয়?আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?”

জবাবে আদৃত ফিরিয়ে দিল মুচকি হাসি!বললো,

“পালাতে চাইলেই কি আমি পালাতে দেব নাকি?একদমই না। এমনকরেই বুকে জড়িয়ে আগলে রাখবো!কোথাও পালাতে দেব না!”

হৃদিতা লাজুক হাসলো!তারপর নামানো স্বরে বললো,

“আচ্ছা, দিয়েন না পালাতে, এবারে ছাড়ুন,তৈরী হই!আজকের পূজোয় অনেক কাজ তো!দিদা-দিদার বৌমাকে সাহায্য করতে হবে না?ভোগ রাধতে হবে তো!এভাবে ধরে রাখলে তো সেসব করা যাবে না!ছাড়ুন!আর আপনিও স্নান সেরে নিন।আজ কিন্তু অঞ্জলি দেবার সময় আরও আগে!জলদি করুন!”

আদৃত ছাড়েনা।একগুঁয়ে হয়ে সেভাবেই ধরে রাখে!হৃদিতা এবারে কপাল কুচকে তাকায়।নাক ফুলিয়ে বলে,

“ছাড়বেন না?ছাড়ুন না!”

আদৃত ছাড়ে,তবে যেতে দেয়না।নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকড়ে ধরে রাখে হৃদিতার হাতটা।তারপর হাত ধরেই বসিয়ে দেয় খাটে!নিজের খাদির খয়েরী পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে আনে একটা রক্তলাল তরলে ভরা কাচের বোতল!হৃদিতার বুঝতে অসুবিধা হয়না,আলতা!
সে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“আলতা!কই পেলেন!আর এটা দিয়ে কি করবেন এখন?”

আদৃত জবাব দেয়না।হৃদিতার মুখপানে চেয়ে স্মিত হেসে নিজের হাতে তুলে নেয় হৃদিতার বাঁ পাটা!হৃদিতা আৎকে ওঠে, চাপা চিৎকার করে বলে,

“কি করছেন আদৃতবাবু?কি আশ্চর্য পায়ে হাত দেন কেন?বিয়ের আগে একবার দিতে দিয়েছি বলে আজও দেবেন?জানেন না, স্বামীকে স্ত্রীর পা ছুঁতে নেই!আমার পাপ হবে আদৃতবাবু!ছাড়ুন,পা ছাড়ুন!”

আদৃত হৃদিতার ছটফটানো পা’টাই আরো জোড়ে চেপে ধরে নিজ হাতে!তারপর হালকা শাসনের স্বরে প্রত্ত্যুত্তর করে,

“এসব কথা যুক্তিহীন হৃদ!স্ত্রীর পায়ে স্বামী হাত দিতে পারবে না এমন কোন নিয়ম,শাস্ত্রে আমি বিশ্বাসী নই!স্বামী হলো স্ত্রীর অংশ,আর স্ত্রী হলো স্বামীর!নিজের অংশেরই একটি দেহাংশে হাত দেয়া কি করে পাপ হয়?
তাছাড়া তুমি তো আমাকে তোমার পায়ে হাত দিতে বলোনি,তোমার পায়ে হাত দিচ্ছি আমি,নিজে স্বেচ্ছায়। আমার স্বেচ্ছাকৃত এই কর্মের দায়ভারও তাই একান্ত আমার।আমার কর্মের ফল তোমার ওপর বর্তিয়ে তোমার পাপবৃদ্ধি হবে এ কেমন কথা?
এ কথার কোন ভিত্তি নেই হৃদ।তাই আমার এসবে বিশ্বাসও নেই!
এবার নড়াচড়া বন্ধ করো,আর চুপ করে বসো!আমাকে আমার কাজ করতে দাও!বিরক্ত করবে না!”

হৃদিতা কথা বাড়ালো না আর।আদৃতের হাতে থাকা নিজের পা’টাকে তার কাছেই সঁপে দিল চুপচাপ।
আদৃত হাসলো।আলতার বোতলের মুখের ছিপিটা খুলে তাতে ডোবালো সরু তুলোর তুলিটা।সাদা তুলির আগা যখন আলতা রঙে মাখামাখি হলো, তখন খুব যত্নে,তা দিয়ে পায়ের ওপরে দাগ কেটে গেল পরপর!হৃদিতার অনাড়ম্বর চরণযুগল ক্ষণিকেই রাঙিয়ে দিল লাল টুকটুকে আলতায়!
তারপর খুব যত্নে নামিয়ে রাখলো নিচে!হৃদিতা এখনও নীরবে চাক্ষুষ করলো সবটা!আদৃত এবারে মৌনতা ভাঙলো!পায়ের গিটের ওপরে শাড়িটা একটু তুলে ধরে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো হৃদিতার দিকে!
হৃদিতা যেন সে চোখের ভাষাই বুঝে গেল।মুচকি হেসে বললো,

“খুলে রেখেছি ড্রেসিং টেবিলের ওপর।আপনিই পড়িয়ে দিন।আসলে কাল একবার কাজের ফাঁকে খুলে পড়ে গিয়েছিল, আমি ভাবলাম এতবার বাড়ি-বাইরে করছি, কখন আবার খুলে পড়ে যাবে রাস্তায়, আর তো পাবো না।তাই খুলে রেখেছিলাম। সরি!আর হবে না। রাগ করবেন না!”

আদৃত উত্তর দিল না!সটান উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের দিকে! টেবিলের ওপর থেকে সাদা পাথর বসানো সেই রুপোর নুপুর জোড়া তুলে নিয়ে আবারও ধপ করে বসে পড়লো হৃদিতার সামনে।আলতারাঙা পা দুটো নিজের হাতের ওপর তুলে নিয়ে আবারও খুব যত্নে পড়িয়ে দিল নুপুরজোড়া!
তারপর আদেশের স্বরে বললো,

“আর যেন না খোলা হয়!তাহলেই খবর আছে!”

হৃদিতা সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে মৃদু হাসলো।বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

“আমি যাচ্ছি নিচে,আপনি তাড়াতাড়ি স্নান করে আসুন কেমন?”

আদৃত হালকা হেসে ঘাড় দোলাতেই হৃদিতা প্রস্থান করলো ঘর থেকে।আদৃত নিজহাতে মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে মুচকি হেসে ঢুকে গেল বাথরুমে!মনে মনে বললো,

“ভালোবাসি প্রিয়ংবদা,তোমায় ভালোবাসি, তোমার প্রতিটা কথাকে ভালোবাসি!”
.
অষ্টমীর সারাটাদিন কাটলো মহাব্যস্ততায়!সারাদিন দৌড়ঝাপ করে ভোগ রান্না, সন্ধি পূজোর আয়োজন সবেতেই দেখা গেল হৃদিতার প্রাণোচ্ছল ব্যস্ততা!
সন্ধি পূজোর শেষে সারাদিনের ব্যস্ততায় ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ঘরে আসতেই হৃদিতার চোখ উঠলো কপালে!মনে মনে ভাবলো তার কি আদৌ বিয়ে হয়েছে?নাকি বাবা-মা দেখে শুনে কোন টিচারের হাতে গচ্ছিত রেখে গেছে তাকে!
হৃদিতার চিন্তায় কান্না এসে গেল!বড় একটা শ্বাস টেনে উল্টো ফিরে যেই ঘরের বাইরে পা রাখবে অমনি হাতে পড়লো হ্যাঁচকা টান!হৃদিতা উল্টো ফিরেই বললো,

“হাত ছাড়ুন, ছাড়ুন হাত!একদম কথা বলবেন না আমার সাথে!আপনি আজও আমাকে সারারাত জাগিয়ে পড়াবার তাল করছেন?আমি পড়বো না!ছাড়ুন!”

আদৃত ছাড়লো না, বাঁধন শক্ত করে কাছে টেনে বললো,

“ছাড়া যাবে না।পড়তে হবে!সময় বেশি নেই!আসো,বসো!পূজোর চক্করে তো দুদিন থেকে পড়াশুনা করছো না।পৌরনীতির বাকি অর্ধেকটা পড়া তো বাকি এখনো!ভুলে গেছ?এখন সেটা কম্প্লিট করবে!এসো, ঝটপট!”

হৃদিতার মুখভঙ্গি এমন হলো যেন ছেড়ে দে মা,কেঁদে বাঁচি! মনে মনে বার কয়েক প্রতিজ্ঞা করে ফেললো, এজীবনে আর কখনো,কোনদিনও সে বিয়ে করবে না!পরমুহূর্তেই মনে হলো, বিয়ে তো করবে না, তাতে কি?তার বিয়ে তো হয়ে গেছে, আর ভাগ্যক্রমে টিচার মার্কা জামাইয়ের সাথেই!হৃদিতা নিজের কপাল চাপড়ালো!বেছে বেছে কেন এমন মাস্টারমশাইয়ের প্রেমে পড়লো তা নিয়েও নিজ মনে চললো বেশ বাকবিতন্ডা।
হঠাৎ আদৃতের ডাকে হুশে ফিরলো সে। কোন উপায় নেই দেখে মুখ ভার করে বসে পড়লো পড়তে।
পড়ার জন্য তার বই খাতাই এতক্ষণ বের করে রাখছিল আদৃত!হৃদিতা পড়তে বসলেও পড়া বেশি এগোলো না। দু লাইন পড়ে পাঁচমিনিট করে টুপে গেল ঘুমে!আদৃত প্রতিবার নিজ দায়িত্বে চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে ঘুমের চিহ্নটুকুও ধুঁয়ে দতে লাগলো পূর্ণ উদ্যমে!
হৃদিতা প্রতিবার কাঁদো কাঁদো আঁখি মেলে চাইলো, প্রণয়বাণে কাবু করতে চাইলো প্রেমিকপুরুষের মন।তবে লাভ হলো না। কারণ সেই প্রেমিক পুরুষের মনটি আপাতত প্রণয়স্বরুপ বদলে ফেলে মাস্টারস্বরুপ ধারণ করেছে!
হৃদিতার আর কি করার!ঘুমে টুপতে টুপতেই শেষ করলো পৌরনীতির বাকি ক’টা অধ্যায়!যখন বই বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকালো, তখন বাজে রাত দেড়টা।

হৃদিতা ধুপ করে উঠে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো সোফায়। ঘটনার আকস্মিকতায় আদৃত হা করে চেয়ে রইলো সেকেন্ড মতো!তারপর কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

“সোফায় গেলে কেন হৃদ?বিছানায় অনেক জায়গা!বিছানায় এসো!”

হৃদিতা রাগী চোখে তাকিয়ে ঝংকার তুলে বললো,

“আপনার বিছানায় আপনি থাকুন।আমি যাব না। বউয়ের চেয়ে যে পুরুষের বই বেশি প্রিয় তার সাথে আমি কিছুতেই এক খাটে শোবো না!আপনি বই নিয়ে ঘুমান। শুধু পৌরনীতি কেন?
পৌরনীতি,ভূগোল,ইতিহাস,মনোবিজ্ঞান সব বই আছে আমার কাছে। বের করে নিজের পাশে সাজিয়ে ঘুমান। বইকেই বুকের ওপর চাপা দিয়ে রাখুন!আমার কাছে আসবেন না ব্যাস্!”

আদৃত হতচকিত নয়নে তাকিয়ে বললো,

“এসব কি বলো?বইকে নিয়ে কেন ঘুমাবো!তুমি থাকতে?আমার একটা মাত্র বউ!”

হৃদিতা এবারে ফুঁসে উঠলো!সোফা থেকে উঠে বসে আদৃতের মাথার ওপরে জলের গ্লাসটা হালকা হেলে ধরে বললো,

“দিই?মাথায় জলগুলো সব ঢেলে দিই?বেশি বেশি তাইনা?পড়াতে বলেছিলাম বলে এমন নির্যাতন করে পড়াবে?ফাজলামি করো?ঘুমে চোখ জ্বলে যাচ্ছিল আর তুমি? জল ছিটিয়ে আমার ঘুমের দফারফা করে পড়াচ্ছ?বেশি পন্ডিতি?থাকো তোমার পন্ডিতি নিয়ে!আমাকে কি দরকার!”

আদৃত এবারে বাঁকা হাসলো!হৃদিতার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে জলের গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো টেবিলের ওপর!তারপর কোমড়ে টান মেরে সোজা বসালো নিজের কোলে!হৃদিতা নড়েচড়ে সরতে চাইলো তবে পারলো না!
আদৃত এবারে মুখ ডোবালো হৃদিতার গলায়!
হৃদিতা কেঁপে উঠলো!আদৃত তা বুঝতে পেরে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,

“রাত-বেরাতে হুট করে আপনি টু তুমিকে কনভার্ট হয়ে গেলে হৃদ!আহা!এখন আবার বলছো তোমাকে কি দরকার?ওয়েট। মুখে বললে তো বুঝবে না!প্র্যাকটিকালি বোঝাচ্ছি!”

হৃদিতা কেঁপে উঠলো।আদৃতের বাহুবেষ্টনী থেকে সরে আসার চেষ্টা করে কম্পিত স্বরে বললো,

“কি করবে?আমি কিছু বুঝতে চাইনা।ছাড়ো,ঘুমাবো!ঘুম পাচ্ছে!”

আদৃত মুচকি হাসলো। বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিয়ে হৃদিতাকে টেনে নিল বুকের ওপর!মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো,

“কিছু করবো না। শুধু আমার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আমার সব ক্লান্তি অবসান করার জন্য তোমাকে দরকার।আমার সব শূণ্যতা দূর করতে তোমায় দরকার!এবারে এখানে ঘুমাও।তুমিও নিশ্চিন্ত আর আমিও!”

হৃদিতা নিঃশব্দে হাসলো।প্রত্ত্যুত্তর করলো না মোটেই।আদৃতের কথামতোই তার বুকে মুখ গুঁজে ঠাঁয় পড়ে রইলো চুপচাপ।প্রিয়তমর বুকের প্রতিটা হৃৎস্পন্দনের তালে অনুভব করে গেল নিজের অস্তিত্বের উপস্থিতি!আর সেই মিষ্টি অনুভূতিটুকু নিয়েই পারি জমালো ঘুমের রাজ্যে!
.
নবমীর সকালে পূজো শেষে অঞ্জলি দিয়ে বাড়ি ফিরতেই কাদম্বিনী দেবী চলে গেলেন ছাদে। যাবার আগে ডেকে নিলেন হৃদিতাকেও!হৃদিতা দিদার কথা মতো গেল তার পিছুপিছু!
ছাদে উঠেই কাদম্বিনী দেবী হেসে বললেন,

“বোসো দিদিভাই!বড়ি দেব। দেখ বসে বসে!”

হৃদিতা ভ্রু কুচকে শুধালো,
“বড়ি কি দিদা?”

কাদম্বিনী দেবী স্মিত হেসে জবাব দিলেন,
“বড়ি হলো একধরণের পাপড় দিদা।মাসের ডাল বেটে ভালো করে ফেটিয়ে তাতে লবণ,কালোজিরে মাখিয়ে পরিষ্কার কাপড়ের ওপরে গুঁটি গুঁটি করে সাজিয়ে রোদে শুকিয়ে নিলেই বড়ি হয়ে যায়!পরে তেলে ভেজে খেতে হয়!তোমার দাদুর ভুব পছন্দের।শেষ হয়ে গেছে তো,তাই আবার বানাচ্ছি!”

হৃদিতা হালকা হাসলো!কাদম্বিনী দেবীর বড়ি দেয়া দেখে নিজেও অনুযোগের স্বরে বায়না করলো,
“আমিও তোমাকে সাহায্য করি দিদা?আমিও একটু দিই!শেখা হয়ে যাবে, তোমার কাজও দ্রুত আগাবে!দিই?”

কাদম্বিনী দেবী সম্মতিসূচক হাসলেন।হৃদিতা খুশি মনে কাপড়ের ওপর বড়ি দিতে লাগলো দিদার মতো করে!তারপর হঠাৎ কাদম্বিনী দেবীকে প্রশ্ন করলো,

“আচ্ছা দিদা?দাদুর কি কি পছন্দ সবই তুমি জানো তাইনা?কি করে বলো তো?আমি তো তোমার নাতির কোন পছন্দই জানিনা ঠিকঠাক!দাদু কি নিজে থেকে তোমাকে বলতো নিজের সব পছন্দের কথা? আমিও তবে ওনাকে জিজ্ঞেস করবো?”

কাদম্বিনী দেবী হেসে বললেন,

“সব কি আর জিজ্ঞেস করে হয় দিদি!কিছু কথা বুঝে নিতে হয়!তোমার দাদুর পছন্দ খুব সামান্য। একটু খেয়াল রেখেই বুঝতে পেরে গেছি সব।উনি নিজের মুখে কিছুই বলতেন না। তুমিও আমার দাদুভাইয়ের পছন্দ গুলো বুঝে নাও।”

হৃদিতা হেসে বললো,
“তোমার আর দাদুর কেমিস্ট্রিটা কিন্তু দারুণ দিদা।তোমাদের প্রেমগাঁথা যতবার শুনেছি ততবার মনে হয়েছে এর চেয়ে বেশি ভালোবাসা যায় না,কিন্তু তোমার বলা পরের কথাটা শুনেই আবার মনে হয়ছে না এর বেশি ভালোবাসা যায় না।তোমাদের ভালোবাসাটা খুব সুন্দর দিদা!”

কাদম্বিনী দেবী হাসেন।বলেন,
“তোমাদের রসায়নটিও কিন্তু কিছু কম নয় দিদা।
আসলে কি জানো তো! আমরা সকলে বলি ভালোবাসা প্রজন্মভেদে পাল্টায়।বিষয়টা ঠিক না। ভালোবাসাটা চিরকালই এক থাকে।প্রজন্ম ভেদে পাল্টায় তা প্রকাশের ধরণ। কিন্তু প্রতিটা প্রজন্মই কিন্তু নিজের সবটুকু উজার করেই ভালোবাসে তাদের প্রিয় মানুষটিকে।
তোমার আমার ভালবাসাটা কিন্তু দুটো ভিন্ন প্রজন্মের।তবুও দিনশেষে তোমার দাদু আমাকে আর আমার দাদুভাই তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, নিজের নিজের মতো করে,এটাই সত্যি!
তাই ভালোবাসাটা আমাদের সবার জীবনেই সুন্দর। ভালোবাসা মাত্রই সুন্দর!”

হৃদিতা হাসে।আর দ্বিরুক্তি করেনা। দ্বিরুক্তি করার কোন কারণ নেই।দিদার বলা প্রতিটা কথাই যে সত্যি। ভালোবাসা মানেই সৌন্দর্য। সব ব্যবধান মিটিয়ে কাছে টেনে নেবার অপার ক্ষমাতার নামই ভালোবাসা!
.
দশমীর সকাল!চারিদিকে কেমন বিষাদের ছাপ।মায়ের বিদায়বেলা আসন্ন।পাট থেকে নামানো হয়েছে দেবী প্রতিমা!মায়ের যাবার শোকে হয়তো প্রকৃতির চোখেও আজ বিষন্নতা।রোদে ঝলমলে সকালটা হঠাৎ করেই কেমন গুম মেরে বসে আছে চুপচাপ।ধূসর মেঘের আড়ালে হারিয়েছে সোনা সোনা রোদ!সেই ধূসর মেঘের দল যেন মুখভার করে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদায়কান্নার।মায়ের ভাসানবেলায় কেঁদে কেটে ঝড়ে পড়ার!

মেঘকুঞ্জের সকলে গেছে মন্দির প্রাঙ্গণে!সকল সধবারা একে একে বরণ করে নিচ্ছেন মাকে!
বরণ শেষে সিঁদুরখেলায় মেতে উঠছে প্রত্যেকে!রক্ত লাল গুড়োয় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে সকলের গাল,সিঁথি!
হৃদিতাও সিঁদুর পড়াচ্ছিল মল্লিকা দেবীকে। সিঁদুর পড়ানো শেষে পিছু ফিরতেই হাতে টান পড়ায় চোখ তুলে চাইলো সেদিকে। আদৃত মিটিমিটি হেসে দাঁড়িয়ে আছে।হৃদিতা সন্দিহান নয়নে তাকালো।শুধালো,
“এভাবে হাসছো কেন?কাহিনি কি?কি কুবুদ্ধি ঘুরছে মাথায়? ”

আদৃত জবাব দিলনা।কেবল চোখের পলকে মুঠোভর্তি সিঁদুরে ভরে গেল হৃদিতার সিঁথি!নাকের ওপরে এসে পড়লো লাল রঙা গুড়ো!হৃদিতা রাগতে চেয়েও রাগলো না!আলতো হেসে বললো,
“জানো,তোমার হাতে সিঁদুর পড়া আমার খুব প্রিয়। আমি মা দূর্গার কাছে সবসময় চাই,আমি যেন সারাজীবন এই সিঁদুর নিয়ে বাঁচতে পারি। আমার সিঁথি কখনো ফাঁকা না করুন মা।তোমার আগে যেন আমার ডাক আসে!সিঁথিভরা সিঁদুর নিয়ে যেন শেষ শ্বাস ত্যাগ করি!”

আদৃত ব্যাথিত চোখে তাকালো। রাগমিশ্রিত কাতর স্বরে বললো,
“একদম এসব বাজে কথা বলবে না হৃদ।বছরকার দিন!মায়ের বিদায়বেলায় এমন অকথা কুকথা মুখে আনার মানে নেই!
তারচেয়ে প্রার্থনা করো, যে কটাদিন আয়ু আছে, সে কটাদিন দুজনে একসাথে হাতে হাত রেখে যেন বাঁচতে পারি।
তুমি ছাড়া আমার জীবনটা যে মৃতসম হবে হৃদ।তা কি তুমি চাও?”

হৃদিতা আদৃতের মুখে হাত রেখে বললো,
“কখনো না। তুমি যা চাও তাই হোক। তোমার আমার দুজনার জীবন একসাথে কাটুক আজীবন!মা তোমার মনের আশা পূরণ করুন!”

আদৃত হাসে।কানে এসে বারি খায় বিদায়ী ধুন। ঢাক-কাসর সবেতেই কেমন যেন বিদায়ব্যাথা খেলে যেতে থাকে!আদৃত প্রতিমা ধরতে সাহায্য করে। বড় একটা পিক-আপের ওপর তুলে দিয়ে সকলে মিলে হাটা দেয় তার পিছু পিছু!পাড়ার মাঝের বিশাল দিঘিটায় বিসর্জন দেয়া হয়!
হৃদিতা নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলে।আদৃত ব্যস্ত কন্ঠে শুধায়,
“কি হলো হৃদ! কাঁদো কেন?”

হৃদিতা ফুঁপিয়ে উত্তর দেয়,
“মা চলে গেল,মন খারাপ লাগে!”

আদৃত হালকা হেসে বললো,
“পাগলী!মন খারাপ করে না। আসছে বছর মা আবার আসবেন।তুমি আমি আবারও সিঁদুর খেলবো।কাঁদেনা হৃদ!”

হৃদিতা ভেজাচোখে আলতো হাসে।
আদৃত তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,
“চলো এবার বাড়িতে। সবাইকে দশমীর প্রণাম করতে হবে তো!আর আঙ্কেল-আন্টিকেও তো ফোন করতে হবে। দশমীর প্রণাম জানাবে না?”
হৃদিতা সায় জানায়!আদৃতের সাথে ফিরে আসে বাড়িতে। ঢাকের শব্দ মিলিয়ে যায় হাওয়ায়, পূজো পূজো আমেজটা কেমন ধারা হারিয়ে যায় দৈনন্দিন ব্যস্ততায়!আবারও জীবনটা বাঁধা পড়ে সেই একঘেয়ে রুটিনে,ঘরবন্দী জীবনে!

#চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here