#প্রিয়ংবদা
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়
৩৩.
সময়ের সুতো কেটে যায় ক্ষণে ক্ষণে!পা রাখে এক অধ্যায় থেকে নতুন অধ্যায়ে!আশ্বিনী শুভ্রতাও তেমনই লুপ্ত হয়ে গেল সময়ের আবর্তনে। চারিদিকে তখন কেবল সবুজ আর সবুজ!চাষীদের মুখে খুশি, এবছর বৃষ্টি-রোদ সবই হচ্ছে ঠিক মতো!ফলনও নিশ্চই ভালো হবে। আশায় বুক বাঁধে সকলে!
হৃদিতার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে!পরপর পাঁচটা পরীক্ষা হয়েও গেছে!আর বাকি শুধু দু’টো!মনোবিজ্ঞান আর ভূগোল!
আদৃতের মাস্টারীর দৌলতে সব পরীক্ষাগুলোই হয়েছে মোটামুটি ভালো।টেস্টে ফেল করে যাবার যে ভয়টা সে পেয়েছিল তা আর এখন নেই!
ভূগোল পরীক্ষার আগেরদিনই পাওয়া গেল দুটো ছুটি!হৃদিতা একটু আয়েশ করে কাটাতে চাইলো দিন দুটো,তবে পারলো না।
আদৃত হঠাৎ এসে প্রশ্ন করলো,
“বসে আছো কেন?পড়বে না?”
হৃদিতা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।জবাব দিল,
“পড়বো না কেন?পড়বো।তবে আজ না প্লিজ!পরীক্ষার আগে দু’দিন বন্ধ আছে তো!দুদিনে পড়বো!প্লিজ!”
আদৃত সে কথা শুনলো না। জোড় করে পড়তে বসালো।হৃদিতার আর কি করার। অসহায় হরিণীর মতো পিটপিটে নয়নে ছটফট করেই পড়ে গেল ভূগোলের পাঠ!
বলা বাহুল্য মাঝখানের দিনদুটোও এমন পড়াপড়া অত্যাচারেই কেটে গেল!তবে ফলাফলটাও সেই সুবাদে খারাপ হলো না।
বাকি দুটো পরীক্ষাও বেশ সফলভাবেই শেষ করলো হৃদিতা!
পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরেই সব বই তুলে রাখলো স্যুটকেসে।আদৃত অবাক হয়ে শুধালো,
“এসব তুলে রাখছো কেন?ফাইনাল এখনো বাকি হৃদ!পড়াও বাকি!”
হৃদিতা কড়া চোখে তাকালো!আদৃতের একদম চোখে চোখ রেখে কটমট স্বরে বললো,
“হোক।তিনমাস সময় আছে। আমি আপাতত এক সপ্তাহের জন্য বই-খাতার আগে-পিছেও নেই!তুমি জোড় করলেও না!তাই লাভ নেই। এক সপ্তাহ একটু শান্তি দাও না। রেস্ট করতে দাও!প্লিজ!”
শেষের কথাটা একটু অনুরোধের সুরে বললো হৃদিতা।আদৃত আর বারণ করতে পারলো না। সত্যিই মেয়েটাকে দিয়ে এ’কদিন প্রচুর পরিশ্রম করিয়েছে। ক’টা দিন যখন একটু বিশ্রাম নিতে চাইছে তখন নিক!সমস্যা তো নেই!
.
রাত যখন গভীর হলো!কৃষ্ণরঙ গ্রাস করে নিল সমস্ত অন্তরীক্ষ, সকলে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে, ঠিক তখনই ঘুমন্ত গগণ জেগে উঠল। মেঘের গর্জনে থেকে থেকে কেঁপে উঠলো পৃথিবী!হৃদিতার ঘুম ভেঙে গেল সহসাই!আদৃতের বুকের ওপর থেকে মাথা তুলে তাকালো জানালা দিয়ে!জানালার স্বচ্ছ কাচের ওপর দিয়ে পর্দা টেনে দেয়া হয়নি। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে তাই আলোকছটার ঝিলিক চোখে পড়লো বারবার!সাথে সাথে কানে এসে আঘাত হানলো ক্রুদ্ধ নীরদের হৃদয় কাঁপানো হুংকার!
হৃদিতা চমকে গেল, খামচে ধরলো আদৃতের বুকের কাছের টি-শার্ট,ফল স্বরুপ বুকের ওপর হালকা আঁচড়ে জ্বলন ধরলো।আদৃতের তন্দ্রাভাব কেটে গেল সেই জ্বালায়!হৃদিতার পিঠের ওপরে তখনও তার একহাতের অবস্থান!আদৃত সদ্য ঘুমভাঙা ভারী কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কি হয়েছে হৃদ?ভয় পাচ্ছো?ভয় কি?আমি আছি তো!”
হৃদিতা ভয়ার্ত চোখে তাকালো!কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,
“আকাশ চমকাচ্ছে আদৃত!আমার ভয় করে!”
হৃদিতার কথার মাঝেই প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো কাছে কোথাও।এত শব্দে কানে তালা ধরে গেল যেন!হৃদিতা কেঁপে উঠে আদৃতের বুকের ওপর নখ ডাবালো আরও জোড়ে। আদৃত এবারে ব্যাথায় হালকা আর্তনাদ করে উঠলো!
হৃদিতা চকিতে চাইলো।ব্যস্ত হয়ে শুধালো কি হলো?তারপর নিজের নখের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি আদৃতের টির্শার্টটা টেনে তুললো বুকের ওপর!কাতর স্বরে বললো,
“হাত তোল। খুলে দিই!নখ ডেবে আঁচড় লেগে গেছে।একটু ওষুধ লাগিয়ে দিই!নইলে খুব জ্বলবে!”
আদৃত আপত্তি করলো না। হাত গলিয়ে বের করে নিল পরণের টি-শার্ট।
হৃদিতা উঠে বসলো পুরোপুরি। বেডসাইড ড্রয়ারটা খুলে ভেতর থেকে বের করে নিল একটা অয়েন্টমেন্ট!সেটাই খুব আলতো হাতে লাগিয়ে দিল আদৃতের বুকে!আদৃত হালকা জ্বালায় চোখ-মুখ কুচকে নিল। হৃদিতা তা দেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“সরি!বুঝতে পারিনি!তোমায় ব্যাথা দিয়ে ফেললাম!”
আদৃত হালকা হেসে হৃদিতাকে বুকে টেনে নিল,সেই উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখেই হৃদিতার গোটা শরীরে আবারো খেলে গেল বিদ্যুৎ!
আদৃত বুঝলো!হালকা হেসে বললো,
“ব্যাথা দিলেই যখন তখন উপশমও দাও।আমার সকল ব্যাথার উপশমই তুমি!”
হৃদিতা কান্নাসিক্ত স্বরেই জবাব দিল,
“হু।আমি তো তোমার কাছেই!ব্যাথা সেরে যাক!”
আদৃত দুষ্টু হাসলো এবার।হৃদিতাকে জ্বালাতেই বললো,
“এভাবে হবে না।আরও কাছে আসতে হবে!যতটা কাছে এলে পরস্পরের অস্তিত্ব সবচেয়ে গাঢ় ভাবে অনুভব করা যাবে,ঠিক তত কাছে!”
আদৃত ভেবেছিল হৃদিতা হয়তো বাঁধা দেবে,লজ্জা পেয়ে বরাবরের মতো মুখ গুঁজে পড়ে রবে তারই বুকটায়!তবে আজ তেমনটা হলো না।বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে তুমুল বেগে।মুষলধারার সাথে পাল্লা দিয়ে ডেকে যাচ্ছ মেঘরাও!হৃদিতা সেই বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের মাঝেই আদৃতের মুখপানে চাইলো!দুচোখে তখন প্রবল তৃষ্ণা!আদৃত তা দেখেও দেখলো না।
শেষমেশ মুখ ফুটলো হৃদিতারই!বিভোর কন্ঠে ব্যক্ত করলো,
“বাইরে আজ বর্ষণ হচ্ছে আদৃত!সেই বর্ষণে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে সমস্ত প্রকৃতি!
আজ আমারও বর্ষণ চাই আদৃত,প্রণয়বর্ষণ!যে বর্ষণে ভিজবো শুধু আমি!
দেবে আমায়?প্রেমের বৃষ্টি?ভাসাবে প্রণয়বানে?
বলো না ভাসাবে?”
হৃদিতার শেষের প্রশ্ন ক’টায়,আদৃত নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। প্রথম বারের মতো খুব গভীর স্পর্শ আঁকলো হৃদিতার শরীরে।গাঢ় হলো আলিঙ্গনের বাঁধন!
খুব যত্নে অধরস্পর্শ এঁকে গেল, কাঁধে,গলায়,গালে!
হৃদিতা কেঁপে উঠলো প্রতিবার! বহুদিনের খুব আকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ গুলো শিহরণ জাগালো মনে!
নিশুতিরাতের ঝুম বৃষ্টি,ব্যালকনি থেকে ভেসে আসা মাধবীলতার সুবাস,সবটাই যেন সেই আকাঙ্খায় নেশা ছড়িয়ে গেল নিজ গুণে।
রাত যত গভীর হলো,প্রণয়বর্ষণও হলো তত গাঢ়।আর কার্ত্তীকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষণ সাক্ষী হয়ে রইলো এক প্রেমিকযুগলের বহুকাঙ্ক্ষিত এই রজনীর!
.
পরের সকালটা শুরু হয় অন্যরকমভাবে!বরাবরের ঘটনার ব্যতিক্রম ঘটে আগে ভেঙে যায় আদৃতের ঘুম। হৃদিতা তখন তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে!আদৃত হাসে সেই ঘুমন্ত মুখখানি দেখে। সিঁদুর লেপ্টে গেছে সারা কপালে!
সন্তর্পণে হৃদিতাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।হালকা হেসে চাদর টেনে ঢেকে দেয় প্রিয়তমার অনাবৃত দেহ!ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে একদম শাওয়ার নিয়েই!হৃদিতা ততক্ষণে উঠে পড়েছে। বিছানার ওপর দু হাটু ভাজ করে বসে আছে গুটিসুটি মেরে!
আদৃত হাসে। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,
“ফ্রেশ হয়ে নাও!সাতটা বাজে কিন্তু!”
হৃদিতা লাজুক হেসে ঘাড় নাড়ে। চাদরটা ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে নিয়েই চলে যায় ওয়াশরুমে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে হালকা নীল একটা শাড়ি পড়ে!
আয়নার সামনে গিয়ে ভেজা চুলগুলো ঝেড়ে নিয়ে তোয়ালেটা মেলে রেখে আসে বারান্দায়!তারপর আবারও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলোকে আলগা খোপায় বেঁধে সিঁথিতে রাঙায় টুকটুকে সিঁদুর!আঙুলের ডগায় লেগে থাকা সিঁদুর ছোঁয়ায় হাতের শাখা-নোয়ায়!
কপালে পড়ে একটা ছোট কালো টিপ।
বিয়ের পরের ক’দিন সিঁদুরের টিপই পড়তো,কিন্তু ঐ যে আদৃতের তাকে কালো টিপ পড়তে দেখলেই ভালো লাগে, তাই এখন কালো টিপই পড়ে!
আদৃত আচমকা এসে হৃদিতাকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে।গায়ে হালকা অ্যাশ রঙের শার্ট,হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রাখা!হৃদিতা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বলে ওঠে,
“ছাড়ো।মাত্র শাওয়ার নিয়ে এলাম।”
আদৃত দুষ্টু হেসে বলে,
“রিল্যাক্স!কিছু করবো না।শুধু কিছু বলার ছিল হৃদ!”
হৃদিতা কৌতুহলী চোখে চায়,শুধায়,
“কি বলবে?”
আদৃত মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়,
“আমার ভালোবাসাটুকুকে পূর্ণতা দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ হৃদ!ভীষণ সুন্দর একটা রাত উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ!
ভালোবাসি হৃদ,আমার প্রিয়ংবদাকে খুব ভালোবাসি!”
হৃদিতা লাজুক হাসে।নামিয়ে নেয় চোখ। উত্তরে কিছু বলার আগেই বেজে ওঠে কলার টোন!
হৃদিতা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে।তারই ফোন!আদৃত খুলে দেয় হাতের বাঁধন!
হৃদিতা বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে “বাবা” নামটা ভাসতে দেখেই খুশি হয়ে যায় খুব। চটজলদি কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কানে ভেসে আসে,
“হৃদ!কেমন আছিস মা?”
হৃদিতা একগাল হেসে জবাব দেয়,
“আমি খুব ভালো আছি বাবা!তুমি কেমন আছো?মা কেমন আছে?তোমরা কবে ফিরবে বাবা?”
ঋতমবাবু মেয়ের প্রশ্নের ভীড়ে হালকা হাসেন!ভীষণ মোলায়েম আওয়াজে বলেন,
“তোর মা ভালো আছে!একেবারে ফিরতে তো কিছুদিন সময় লাগবে মা। নতুন করে পোস্টিং পেয়ে আবারও পোস্টিং নেয়া তো সোজা কথা না তাই না বল!
তবে তোর জন্য একটা চমক আছে?”
হৃদিতা একপলক আদৃতের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে প্রশ্ন করে,
“কি চমক বাবা?ও বাবা,ও বাবা বলো না প্লিজ!”
ঋতমবাবু মেয়ের ছেলেমানুষী দেখে হেসে ফেলে বলেন,
“শান্ত হ মা। বলছি তো!আসলে আমার তো এখানে নতুন পোস্টিং!তুইও নেই!দূর্গাপূজোয় তো সব স্টাফদের ছুটি দেয়নি,আমিও আমার ছুটিটা নিইনি তখন।
দুদিন আগে ঢাকা যাবার জন্য ছুটির আবেদন করেছিলাম।কাল রাতে মেইল করে জানিয়েছে অ্যাপ্লিকেশন গ্রান্টেড!
পাঁচদিনের ছুটি পেয়েছি!আমরা আজই রওনা হচ্ছি হৃদ।এই একটু পরেই!এত সকালে বাস-ট্রেনের টিকেট পাইনি রে!আর আমি একটা দিন নষ্ট করতে চাইনি।প্লেনের টিকেট ছিল তবে তোর মা ভয় পায় তাই একটা কার ভাড়া করেছি। ছয়-সাত ঘন্টা লাগবে হয়তো!তুই চিন্তা করিস না!ঢাকা পৌঁছে কথা হচ্ছে মা!”
হৃদিতা খুশি হলেও চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“ঢাকা তো অনেক দূর বাবা!এত দূরে কারে করে আসা কি ঠিক হবে।তার ওপর শীত শীত পড়েছে, কুয়াশা তো বেশি থাকে ওদিকে। কি দরকার বাবা?বাস-ট্রেনের জন্য একটু অপেক্ষা করলেই তো পারো বলো!”
ঋতমবাবু মেয়েকে ভরসা দিয়ে বললেন,
“তুই কিছু চিন্তা করিস না মা। কিছুই হবে না!ঢাকা পৌঁছে দেখা হচ্ছে মা।তুই ছুটে বাবা বলে এসে জড়িয়ে ধরবি, এই দৃশ্যটা একদম চোখের সামনে ভাসছে রে হৃদ!”
হৃদিতা আর আপত্তি করেনা। মুচকি হেসে বাবাকে বলে,
“আচ্ছা,সাবধানে এসো বাবা!রাখছি!”
কল কেটে ফোনটা রেখে আদৃতের দিকে তাকাতেই আদৃত হেসে বলে ওঠে,
“তাহলে ম্যাডাম!বাবা-মা আসছে অ্যাট লাস্ট!এবারে আমার বউটা খুশি তো!”
হৃদিতা আদৃতের বুকে মাথা রেখে নরম স্বরে উত্তর দেয়,
” হুম।খুউউউউউব!”
.
সেদিন সারাদিন হৃদিতা খুশিমনে করে গেল বাবা-মায়ের পছন্দ মতো রান্না!প্রায় এক মাস পরে বাবা-মায়ের সাথে দেখা হচ্ছে বলে কথা,এটুকু আয়োজন না করলে কি চলে?একদম না!বাবা-মা ফিরে আসা নিয়ে তার আনন্দের কোন সীমাই রইলো না যেন!বাড়ির প্রতিটা মানুষই দুচোখ ভরে দেখে যেতে লাগলো এক প্রিয়ংবদার বাধানছেড়া খুশি!
তবে এই আনন্দই যে এত স্বল্পস্থায়ী হবে তা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল। ভাবেনি।তবুও ভাবনাতীত সে ঘটনাটিই ঘটে গেল!
ঋতমবাবুরা রওনা দিয়েছিলেন সকাল আটটায়!সেমতো ওনাদের ঢাকায় এসে পৌঁছনোর কথা বিকেল তিনটে-চারটে নাগাদ। রাস্তায় যদিও বা জ্যাম থাকে তবুও সন্ধ্যা ছ’টার বেশি সময় লাগার তো কথা নয়!তার ওপর ভাড়া করা কার।স্টেশনে স্টেশনে নেই থামার কোন প্যারা।
তবুও সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও ঋতমবাবুরা এসে পৌঁছালেন না!
হৃদিতার খুশি উবে গিয়ে ক্রমশ মনের মাঝে ডানা ঝাপটাতে লাগলো কোন অজানা শঙ্কা!হৃদিতা স্থির বসতে পারলো না। বাবা কখন আসবে,এখনো আসছে না কেন, বলে বলে মাথায় তুলে নিল গোটা মেঘকুঞ্জ।আদৃত শান্ত করার চেষ্টা করলো,কাজ হলো না। মল্লিকা দেবী আর কাদম্বিনী দেবী এসে আগলে নিলেন মেয়েটাকে!
হৃদিতার এবার সে কি কান্না। বারবার ফুঁপিয়ে উঠে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলে যেতে লাগলো,
“বাবা কই?বাবাকে এনে দাও!মার কাছে যাব।এনে দাও!”
আদৃতের ভেতরটা সে কান্নায় কেমন পুড়ে গেল।দিশেহারা নাবিকের মতো ফোন নিয়ে একের পর এক ডায়াল করে যেতে লাগলো ঋতমবাবুর নাম্বারে,লাগলো না। ফোনের ওপাশ থেকে বারবার কেবল সাড়া দিয়ে গেল একটা বিরক্তিকর নারীকন্ঠ,
“সরি,দা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ কারেন্টলি আনরিচেবল!”
আদৃতের এবারটা ভয় হলো। এতক্ষণ হৃদিতাকে আশ্বাস দিয়ে এলেও এবার নিজের মনেই ভর করো খুব বাজে কিছু ঘটে যাবার আশঙ্কা!
আদৃত কি মনে করে যেন কল লাগালো টাপুর দেবীর নাম্বারে। এই নাম্বারে তেমন একটা কল করা হতো না বলে নাম্বারটা পাওয়া গেল ডায়াল লিস্টের অনেক নিচে।
আদৃত রুদ্ধশ্বাস নিয়ে কল লাগালো,দমবন্ধ করে অপেক্ষা করে গেল ফোনটা রিং হবার!
তার প্রচেষ্টা সফল হল, টাপুর দেবীর নাম্বারে কল ঢুকলো,রিং হল পরপর!রিসিভ হচ্ছে না দেখে একটুখানি কমে আসা চিন্তা বেড়ে গেল আবারও!তবে শেষ মুহূর্তে ফোনের রিসিভার অন হলো। আদৃত একটা লম্বা শ্বাস টেনে কিছু বলবে তার আগেই এক অপরিচিত কন্ঠস্বর কানে এসে বারি খেল,
“হ্যালো, আপনারা কি ঋতম রায়ের বাড়ির লোক বলছেন?”
আদৃতের বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো!কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিল,
“হ্যাঁ!আপনি?”
অপর দিকের লোকটি জবাব দিল,
“আসলে আমি এখানকার স্থানীয়।ওনারা সম্ভবত বাড়ি
ফিরছিলেন কারে করে! রাস্তার বাঁকে উল্টো দিক থেকে একটা ট্রাক আসছিল, আচমকা হয়ে যাওয়ায় কার ড্রাইভার বুঝতে পারেননি!একদম ফেস টু ফেস কলিশন!ট্রাকটা তো সাথে সাথে পড়ে গেছে রাস্তার পাশের বিশাল পুকুরে!কারটা কোনরকম রাস্তায় আটকে ছিল। ওনাদের আমরা সাথে সাথে পাশের হসপিটালে ভর্তি করাই!ড্রাইভার আর সাথে যেই ভদ্রমহিলা ছিলেন, ওনাদের তো স্পট ডেথ হয়ে যায়, তবে ঋতমবাবু বেঁচে ছিলেন!কিন্তু ওনাকে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছতে পৌঁছতেই অবস্থা এত খারাপ হয়ে যায় যে আর বাঁচানো যায় নি!
অ্যাক্সিডেন্ট কেস তো!পুলিশ কার,ঋতমবাবুর বডি চেক করে ওনার পকেট থেকে আইডি কার্ডটা পান।নামটা জানা সেখান থেকেই,আর ফোনটা গাড়ি থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে ভেঙে যায়!তাই ফ্যামিলির কারো সাথে কন্ট্যাক্ট করা হয়নি!তাছাড়া অ্যাক্সিডেন্ট ডেথ, হসপিটাল থেকে বডি রিলিজ করার সব প্রোসেসেই সন্ধ্যা হয়ে যায়! একটু আগে গাড়ির এক কোণে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ দেখে সেটা নিয়ে পুলিশ স্টেশনে দিতে যাচ্ছিলাম, কোনভাবে হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে ওনাদের।
তখনই আপনি কল করলেন, ফোনটা বেজে ওঠায় রিসিভ করলাম।
আমি থানার বড়বাবুর কাছে ফোনটা জমা দিচ্ছি, আপনারা যোগাযোগ করে নিন!”
আদৃতের গলা শুকিয়ে আসে!আড়চোখে একবার দেখে নেয় ক্রন্দনরত হৃদিতার দিকে।দরজার দিকে আরেকটু সরে গিয়ে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কোন জায়গা একটু বলবেন?আর কখন হয়েছে অ্যাক্সিডেন্ট?”
প্রশ্নটা করতেই আদৃতের চোখ ছলছল করে ওঠে,মনে পড়ে যায় ঋতমবাবু-টাপুরদেবীর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত, কি ভীষণ সাবলীল ছিলেন মানুষদুটো!তারা কিনা আর নেই,না!আর ভাবা যায় না!
লোকটি আবারও উত্তর দেয়,
“এটা নরসিংদী!
এই তো দুপুরের দিকে!দুটো,তিনটে নাগাদ!রাস্তা ফাঁকাই ছিল বুঝলেন তবুও কি করে যে কি হলো বুঝতেই পারলাম না। আসলে আল্লাহ্ যার মৃত্যু যেভাবে লিখে রাখেন সেভাবেই হয়!কোন কিছুতেই তখন বাঁধা যায় না মরণকে!”
আদৃতের গাল গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা জল।ফোনটা পকেটে ভরে খুব শান্ত হয়ে গিয়ে দাঁড়ায় দাদুর পাশে। আশুতোষবাবুকে সবটা বলামাত্র চমকে তাকান তিনি।
কারো কাছে ফোন লাগিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে ঋতমবাবু আর টাপুর দেবীর বডিদুটো বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন!
আদৃত আর হৃদিতার সামনে দাঁড়ায় না।ডেডবডি বাড়ি আসার আগে অবধি কিছু জানাতেও চায়না মেয়েটাকে।কষ্টটাতো পাবেই।একটু দেরী করেই নাহয় পাক!
আশুতোষবাবুর চেনাশোনা থ্রুতে মৃতদেহ এসে মেঘকুঞ্জে পৌঁছে রাত দশটা নাগাদ!
গেটের দিকে থেকে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ পেয়ে হৃদিতা ছুটে যেতে চায় বাইরে।আদৃত হাত ধরে আটকায়!শান্ত স্বরে শুধায়,
“কই যাও হৃদ?দাঁড়াও চুপচাপ!”
হৃদিতা তখন চাতক পাখির মতো ছটফটিয়ে যায় হাত ছাড়িয়ে বাইরে যেতে।ছাড়া না পেয়ে চেঁচিয়ে বলে,
“হাত ছাড়ো আদৃত,দেখতে পাচ্ছো না হর্ণ বাজলো।বাবা-মা এসেছে!যেতে দাও!”
আদৃত আগেরমতোই শান্ত কন্ঠে উত্তর দেয়,
“চল আমিও যাব!”
হৃদিতা বাঁধা দেয় না আর!আদৃতের হাত ধরেই বেরিয়ে যায়। পিছুপিছু বেরিয়ে আসেন বাকি সবাইও!আশুতোষবাবু ছাড়া বাড়ির কেউই তখনও জানেন না হৃদিতার বাবা-মার মৃত্যু সংবাদ!
হৃদিতা যখন আদৃতের হাত ধরে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় তখন বাইরে অন্ধকার খুব!তবে সারা বাগানময় জ্বলতে থাকা সাদা আলোয় সেই অন্ধকার বোঝা যাচ্ছে না একটুও!
গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন স্থানীয় থানার ডিসি!আশুতোষবাবুর সাথেই পরিচয়। উনি এগিয়ে যান,কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞেস করেন,
” ওরা দুজন?”
ভদ্রলোক ম্লানমুখে জবাব দেয়,
“অ্যাম্বুলেন্সে আসছেন,পেছনে!”
হৃদিতা আদৃতের হাত খামচে ধরে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে তার তবুও বলে ওঠে,
“অ্যাম্বুলেন্সে কে আসবে আদৃত?বাবা-মা কই?এই লোকটা কে?”
আদৃত উত্তর দেয় না।হৃদিতার আবার প্রশ্নের মাঝেই হঠাৎ বেজে ওঠে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন!হৃদিতা চমকে তাকায়!
দুজন ওয়ার্ডবয় তারই সামনে রেখে যায় তার বাবা-মায়ের মরদেহ। সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত নিথর দেহদুটির সামনে বসে পড়ে হৃদিতা!কম্পিত হাতে সরিয়ে দেয় মুখ ঢেকে রাখা কাপড়।
বাবা-মা চোখ বুজে শুঁয়ে আছে!হৃদিতা ডাকে,
“বাবা”
বাবা আর সাড়া দেয়না!আবারও মাকে ডাকে।তবে মাও পড়ে রয় নিশ্চুপ!
হৃদিতা এবারে বাবা-মায়ের বুকে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
“তোমরা কথা কেন বলছো না?ওঠো!কথা বলো!”
বাবার বুকের ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে বলে,
“বাবা,তুমি বলেছিলে না আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরবো এতদিন পর দেখে, দেখ আমি ধরছি জড়িয়ে, তুমি না বললে তুমি এলে আমার সাথে কথা বলবে!তবে এখন চুপ করে কেন আছো বাবা?ও বাবা কথা বলো!বাবা!”
ঋতমবাবু উত্তর দিলেন না। দেবেন কি করে?দিতে যে আর পারবেন না!উনি যে এখন জগতের সবকিছুর উর্ধ্বে,জাগতিক সব মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন বহু দূরে!
এখন যে আর কারো কান্নাই তাকে ভাবাবে না। যে মেয়ের একটু কান্নাতেই পিতৃহৃদয় হন্নে হয়ে বলে উঠত,
“আহা!হৃদ কাঁদেনা মা।তুই কাঁদলে যে আমার ভালো লাগে না! চুপ কর কাঁদিস না!”
আজ তারই গগণবিদারী হাহাকারে পিতৃহৃদয় একটুও টললো না।হৃদিতা অভিমানী নয়নে তাকালো বাবার বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে!
মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
“মা,ও মা?দেখেছো বাবা কেমন করছে?একটুও ভালো বাসেনা আমাকে মা!একটুও না!তুমি তো বাসো বলো, তুমি কথা বলো।কথা বলো না মা!ও মা!”
উত্তর মিলল না মায়ের থেকেও!
হৃদিতার বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠলো গোটা মেঘকুঞ্জের পরিবেশ,চোখে জল চলে এলো সকলেরই!
আদৃত এসে বসলো মেয়েটার পাশে!মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কাঁদে না হৃদ। বাবা কাঁদতে বারণ করেছে না তোমাকে?কাঁদেনা। বাবা মা কি দূরে যেতে পারে হৃদ পারেনা।ওরা তোমার পাশেই আছে, তোমার ভালোবাসায় মিশে আছে।কেঁদো না আর।এবার থামো!”
হৃদিতা ডুকরে উঠলো এবার।আদৃতের বুকে মাথা রেখে চেঁচিয়ে বললো,
“আমি নিষেধ করেছিলাম আদৃত!আমি বলেছিলাম কারে করে না আসতে!শুনলো না। শুনলো না আমার কোন কথা!
আর এখন এমন পাথরের মতো শুঁয়ে আছে!কথা বলছে না আমার সাথে। কি নিষ্ঠুর হয়ে গেছে আমার বাবা-মা আদৃত!কি ভীষণ নিষ্ঠুর!”
আদৃত উত্তর দেবার ভাষা পেলনা আর। দুগাল মাখামাখি হলো চোখের জলে!মানুষদুটোর সাথে তারও তো স্মৃতি কম কিছু ছিল না, তবুও তার শোক করার সময় নেই, তাহলে তাদের আদরের ধনটিকে কে সামলাবে?
কাঁদতে কাঁদতে আদৃতের বুকেই জ্ঞান হারায় হৃদিতা!আদৃত তাকে আগলে নেয় নিজের বাহুডোরে!
৩৪.
সেই রাতেই মুখাগ্নি করা হলো!শ্মশান ঘাটে গিয়ে চিতায় আগুন দিল আদৃতই!তাছাড়া আর কিছু করার নেই যে!হৃদিতা যে এখনো চৈতন্য হারিয়ে মুষরে পড়ে আছে!
হৃদিতার জ্ঞান ফিরলো পরেরদিন বেলা করে। বেলা এগারোটার মতো হবে!আদৃত ভাবলো মেয়েটা আবারও কাঁদবে,কিন্তু তেমন কিছু হলো না!হৃদিতা চুপচাপ গুটিসুটি মেরে বসে রইলো বিছানার ওপর!
আদৃত ডাকলো সারা দিল না।
বারবার ডেকেও সারা না পেয়ে চিৎকার করে উঠলো,হৃদিতা তবুও আগের মতোই,বসে রইলো নিশ্চুপ,পুতুলের মতো!
চিৎকারের শব্দে তাদের ঘরে ছুটে এলো বাড়ির সবাই, কি হয়েছে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আদৃত দাদুর কাছে গিয়ে শুধালো,
“দাদু,ও কথা বলছে না কেন দাদু?ওকে কথা বলতে বলো না প্লিজ,ও দাদু!”
আশুতোষবাবু নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন।মল্লিকা দেবী এগিয়ে গেলেন হৃদিতার দিকে।ভেজা চোখজোড়া আচলে মুছে নিয়ে এগিয়ে গেলেন হৃদিতার দিকে,
মাথায় হাত রেখে ডাকলেন,
” হৃদ মা?আমার দিকে তাকাও?আমিও তো মা হই সোনা।মায়ের কথা শুনবে না?”
হৃদিতা এবারে চোখ তুলে তাকালো,স্বচ্ছ চোখ জোড়ায় ভর করলো পুকুরসম অশ্রু!মল্লিকা দেবীকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠলো!কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“মা!”
মল্লিকা দেবীর চোখ ভরে গেল আবার।মেয়েটা কখনো তাকে “দিদার বৌমা” ছাড়া “মা” বলে ডাকেনি অথচ আজ তারই মুখে মা ডাক শুনে খুশি হবার বদলে কান্নারা এসে গ্রাস করলো মন!
মল্লিকা দেবী কাঁপাস্বরে বললেন,
“হ্যাঁ। মা!বলো!মা শুনছে!”
হৃদিতা আবারো হিচকি তুলতে তুলতে বলতে লাগলো,
“ওরা আমায় ছেড়ে কেন চলে গেল মা?কেন একটুবার ভাবলো না,ওদের ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য কতটা কষ্টের কেন মা?ওরা কি আমাকে ভালোবাসতো না মা?”
মল্লিকা দেবী নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়ে বললেন,
“কেন ভালোবাসবেনা মা? ভালো তো বাসতেন!তুমি তো জানো!তবে জন্ম-মৃত্যু তো আমাদের হাতে নেই মা!সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে?হয় চলে যেতে!
তাই বলে তাদের ভালোবাসায় কি সন্দেহ করতে আছে বলো?
বাবা-মা তোমার চোখের জল একটুও সইতে পারতেন না মা!কেঁদোনা!কাঁদলে যে বাবা-মার আত্মা কষ্ট পাবে সোনা!কাঁদেনা!”
হৃদিতার কান্না থামালো না। কেবল মল্লিকা দেবীর বুকে ঠায় লেপ্টে রইলো একভাবে,শোকের মাথায় বিলাপ করে যায় নাগারে!
আর তার সেই হৃদয়বিদারক কান্না দেখে কেঁদে ওঠে সেনপরিবারের প্রতিটা মানুষ!গমগমে হাওয়ায় ভরে যায় সারা মেঘকুঞ্জ!
#চলবে