#প্রিয়ংবদা🧡
#ষষ্ঠ_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়
সেদিনই সন্ধ্যাবেলা ঘটে গেল এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার।
হৃদিতা তখন বাড়ি ফিরে ক্লান্ত দেহটাকে সজীব করতে সায়াহ্নস্নানে ব্যস্ত। স্নান সেড়ে একটা হালকা গোলাপি কামিজ আর গাড় নীল স্যালোয়ার পড়ে বেড়িয়ে এল সে। ভেজা চুল বেয়ে তখন টপটপ করে জল পড়ছে। হৃদিতা চটজলদি হাতের তোয়ালেটা মাথায় পেঁচিয়ে নিল!পশ্চিমের দেয়ালে থাকা ফ্যানের সুইচে চাপ দিতেই শনশনে বৈদ্যুতিক হাওয়ায় ভরে গেল বদ্ধ ঘরের আনাচ কানাচ। হৃদিতা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে একপলক দেখে নিয়ে কি মনে করেই যেন কপালে পড়লো ছোট্ট কালো একটা টিপ!তারপর চুল থেকে তোয়ালেটা ছাড়িয়ে বাঁদিকে একটুখানি হেলে গিয়ে ভেজা চুল গুলোকে এক আধবার ঝেড়ে নিল। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই চুলগুলো সব এসে একত্র হলো বাঁদিকের গলার পাশে। হৃদিতা কৃষ্ণ গলদেশে লেপ্টে থাকা কৃষ্ণ কেশগুচ্ছকে নিজের হাতে সরিয়ে দিল। ভেজা চুলে ছেয়ে গেল পিঠ, ভিজে গেল জামার বেশ খানিকটা অংশ। হৃদিতা সেদিকে নজর দিলনা। গাঢ় নীল রঙা জর্জেটের ওড়নাটা দুভাজ করে দুদিকের কাঁধ দিয়ে ফেলে দিল পিঠে,তারপর নিজের ঘর লাগোয়া বারান্দার সরু লোহার তারটাতে মেলে দির আধভেজা তোয়ালে।
ঘরে এসে বিছানাতে একটু গা এলিয়ে বসবে তার আগেই কলিং বেল বাজার আওয়াজ কানে এল। প্রথমে একবার, তারপর আরেকবার, আর মিনিটের ব্যবধানেই এরপর আরো তিনবার! হৃদিতা ভ্রুকুচকালো। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িতে দেখলো সন্ধ্যা ৬ টা ৪৩!
ভর সন্ধ্যেতে আবার কে এল, এই ভাবনা মাথায় খেলতেই কানে এলো মায়ের চিৎকার। টাপুর দেবী জোড়ে ডেকে বলে উঠলেন,
“হৃদ, আমি সন্ধ্যাআরতি করছি!দেখ তো কে এল। দরজাটা খুলে দে। বাড়িতে কি আমি একাই মানুষ নাকি?তোর কি কানে তালা লাগানো?কতক্ষন ধরে বেল বাজছে আর তুই শুনছিস না?এসব কেমন অভদ্রতা?যা জলদি দরজা খোল। দেখ কে এলো। আর দরজা খুলে ভেতরে এনে বসতে বলিস। আমি পুজোটা সেড়ে নিয়েই আসছি!”
হৃদিতা প্রত্তুত্ত্যর করলো না। শুধু অবাক হয়ে ভাবলো, মা এত এত কথা না বললেই তো সে আরো একটু তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে পারতো?মাই তো দেরী করালো। তবে উত্তর দেবার সাহস করলো না। এমনি তেই বাবা বাড়িতে নেই। এসময় তার নিষ্পাপ,নিরপরাধ কান দুটো যদি মায়ের জাদরেল হাতের কবলে পড়ে তো তাদের শেষ গতি হওয়া আর কেউ ঠেকাতে পারবেনা। তখন দেখা যাবে, সত্যি সত্যিই মায়ের ভাষণ সত্যি করে তার কানজোড়ায় তালা লেগে গেল!মারাত্মক ব্যাপার স্যাপার!
হৃদিতার ভাবনার মাঝেই আবার কলিং বেল চাপলো বাইরে দাঁড়ানো অধৈর্য আগন্তুক। হৃদিতা চট জলদি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল মায়ের আরো এক প্রস্থ চিৎকার।
“হৃদ?কথা কানে যায় না?কখন খুলতে বলেছি দরজা?”
হৃদিতা আর একমুহূর্ত দেরী না করে একছুটে চলে গেল সদর দরজার কাছে। ওয়াচ গ্লাসে বাইরে দাঁড়ানো ব্যাক্তির মুখটি দেখার চেষ্টা করলো, তবে লাভবিশেষ হলোনা। কারণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে হয়তো বিরক্ত হয়েই সে উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদিতা ঝটপট দরজা খুলে দিল। মিনমিনে আওয়াজে বললো,
“কাকে চাই?”
ছেলেটি হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে সামনে ঘুরতেই চমকালো। চমকে গেল হৃদিতাও। এতো সেই ছেলে।এ এখানে কি করে আবার?হৃদিতার মনে এই প্রশ্ন ভাসতেই সে হালকা উচ্চ স্বরে বললো,
“এই, কে আপনি?কি সমস্যা?ফলো করতে করতে বাড়িতেও চলে এসছেন দেখছি?ব্যাপার কি?”
ছেলেটি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলো। সে নিজেও বুঝলো হৃদিতার মনে জাগা এই প্রশ্ন যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত! তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিল,
“আসলে আম এক্সট্রিমলি সরি বাট আমি সত্যিই আপনাকে ফলো করতে আসিনি। আমি আপনার বাড়ি অবধি কখনো আসিনি তাই জানতাম না এটা আপনারই বাড়ি। সবসময় কাঁচা রাস্তার মাথা থেকেই ফিরে যেতাম, কালও তো আপনাকে ওখানেই নামিয়ে দিলাম। দুঃখিত ম্যাম।বুঝতে পারছি আপনার মনে সন্দেহ আসাটা স্বাভাবিক তবে আমি একটি বিশেষ প্রয়োজনে ঋতম রায়ের সাথে দেখা করতে এসছি। উনি কি আছেন?”
হৃদিতা এবারে সবটা বুঝতে পেরেছে এমন একটা ভাব করে অতি স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল,
“বাবা তো বাড়িতে নেই। আপনি আসুন ভেতরে। একটু বসুন, বাবা সাড়ে সাতটার ভেতরেই চলে আসবে।”
ছেলেটি কিছুক্ষণ একটু দ্বিধায় থাকলেও পরে তা কাটিয়ে ভেতরে বসে অপেক্ষা করারই সিদ্ধান্ত নিল। ততক্ষণে হৃদিতা দরজার পাশে সরে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে প্রবেশ করার পথ করে দিয়েছে।
ছেলেটি ভেতরে ঢুকতেই হৃদিতা দরজা আটকে তার পিছু পিছু বসার ঘরে এলো। সিঙ্গেলে সোফাটায় বসতে বলতেই ছেলেটি বসে গেল টুপ করে। হৃদিতা সহাস্য মুখে জিজ্ঞেস করলো,
“চা দিই?”
কথাটা বললেও মনে মনে প্রার্থনা করলো যেন ছেলেটি না করে কেননা হৃদিতা রান্না তো দুর, সামান্য চা টাও ঠিকমতো বানাতে পারেনা। মনে মনে তুমুল বেগে প্রার্থনা চালালেও লাভ হলো না। তার সব প্রার্থনাকে বিফল করে ছেলেটি বললো,
“খুব ভ্যাঁপসা গরম পড়েছে তো গোটা শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, এককাপ র-চা হলে কিন্তু মন্দ হয়না।শরীরের সাথে সাথে মনটাও ফ্রেশ হবে কিছুটা।”
হৃদিতা যেন অথৈ পাথারে পড়লো। পুজোর ঘর থেকে মায়ের ঘন্টা বাজানোর শব্দ কানে এল তখনই। হৃদিতা বুঝলো মা বেরোতে আরো দশ পনেরো মিনিট লাগবে। ততক্ষনে কি আর কাউকে চায়ের জন্য বসিয়ে রাখা যায়?
হৃদিতা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে জোড়পূর্বক একটা হাসি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। ছেলেটি তার যাবার পানে দৃষ্টি মেলল।হৃদিতার চুল তখনও ভেজা, চুলের ডগা বেয়ে জল গড়াচ্ছে তখনো।সেই চুলের জলে ভিজে গেছে কোমড়ের কাছের জামা। নরম কটিদেশের নারীসুলভ বাক ভিজে জামার মধ্যে দিয়েও একদম, স্পষ্ট, আবেদনমাখা।
ছেলেটি চোখ সরিয়ে নিল।পরনারীর দেহের অনাকাঙ্ক্ষিত ভাজ দেখে ফেলায় মনে মনে কিছুটা লজ্জিত হল।
হৃদিতা ততক্ষণে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে।সেদিকে একবারটি দেখে নিয়ে একাকি সময়টুকু কাটাতে সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা একটা ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিল ছেলেটি। চোখ পড়লো, ওপরে জ্বলজ্বল করে ভাসমান লেখায়,
“অনুষ্টুপ
অনিল আচার্য্য”
.
ছেলেটি যখন ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ বোলাতে ব্যস্ত তখন রান্নাঘরে একপ্রকার বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে হৃদিতা।
একের পর এক কেবিনেট খুঁজেও চা পাতা, চিনির খোঁজ সে পাচ্ছে না।
তবে বেশ কিছুক্ষণের অক্লান্ত পরিশ্রম আর পুরো রান্নাঘর জুড়ে তান্ডবের চিহ্ন রাখার পরে অবশেষে যখন সে কাঙ্খিত বস্তুদ্বয়ের সন্ধান পেল, তখন আনন্দে আত্মহারা হৃদিতা সানন্দে গ্যাস জ্বালিয়ে তাতে চায়ের সসপ্যানটা বসিয়ে দিল।
তারপর একে একে তাতে জল, তেজপাতা, লবঙ্গ, আর একটু আদার রস দিয়ে ফুটিয়ে নিল। তারপরে চাপাতা ফেলে দিতেই শান্ত জল কেমন যেন উথলে উঠলো। মিনিট দুয়েকের মাথায় উথলানোজলের ওপর থেকে সাদা ফ্যানার পরদটুকু সরে গিয়ে দেখা মিলল লালচে রঙের। হৃদিতা বুঝলো চা হয়ে গেছে।
গ্যাস বন্ধ করে দিল। স্টিলের হাতলের গায়ে যুক্ত সুক্ষ জাল দিয়ে বাঁধা চা ছাকনিটা হাতে নিল সে। নীল ফুলতোলা একটা পেয়ালায় ঢেলে নিল চা টুকু। পাশ থেকে একটা ট্রে নিয়ে প্রিচে বসানো চায়ের কাপটা রাখলো তাতে।খুঁজে খুঁজে বিস্কুট বের করে তাও আরেকটা হাফ প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে রাখলো সেই ট্রেতেই। তারপর চিনির কৌটোটায় একটা চামচ পুরে হাটা লাগালো ড্রয়িংরুমে ।
চায়ের রুপ দেখে মনে হলো তা ভালোই হয়েছে, প্রথমবারের চেষ্টাতেই এত ভালো চা বানানোতে নিজ মনে খানিকটা গৌরববোধও হল তার।
ড্রয়িং রুমের সেন্টার টেবিলটাতে চা-বিস্কুটের ট্রেটা রাখতেই ছেলেটি ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ তুলে তাকালো। হৃদিতার সাথে চোখাচোখি হতেই সোজন্যের হাসি হাসলো দুজনেই।
হৃদিতা চায়ের কাপটা তার সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলো,
“ক চামচ চিনি দেব?”
ছেলেটি হালকা হেসে জবাব দিল,
“দেড় চামচ!”
হৃদিতা প্রত্তুত্তর করলো না।চিনির কৌটো থেকে পরপর দুবারে দেড় চামচ চিনি ফেলে দিল চায়ে।তারপর চামচটা ঘুরিয়ে চিনিটুকুর অস্তিত্ব মিশিয়ে দিল যেন।
ছেলেটির সামনে বিস্কুটের প্লেটটা নামিয়ে দিয়ে বললো,
“নিন, খান!”
ছেলেটি একটা বিস্কুটে কামড় বসাতেই টাপুর দেবীকে দেখা গেল।লাল পেরে সাদা একখানি জামদানী শাড়ি গায়ে জড়িয়ে কোমড় ছড়ানো খোলা চুলে তিনি বের হলেন পুজোর ঘর থেকে।
ড্রয়িংয়ের সোফায় এক অপরিচিত যুবককে দেখামাত্র তিনি সেদিকে এলেন।
মেয়ে জীবনে প্রথম বার কারো জন্য সামন্যটুকু আয়োজন করেছেন বলেমনে মনে অবাক হলেও প্রকাশ করলেন না। ধীর পায়ে ছেলেটির সামনে এসে দাড়িয়ে হৃদিতার দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“হৃদ!কে ছেলেটা?”
টাপুর দেবীর মুখ থেকে হৃদিতার আদুরে নামটা শুনে ছেলেটি বেশ ক বার নিজের মনে আওড়ালো,
“হৃদ, হৃদ, হৃদ!”
তার ভারনায় ছেদ ঘটালো হৃদিতা।
মেয়েটা মিনমিন করে উত্তর দিল,
“বাবার সাথে দেখা করতে এসছেন মা।বাবা তো একটু বাদেই ফিরবে তাই একটু বসতে বলেছি।”
মেয়ের আচরণে টাপুর দেবী মনে মনে খুশিও হলেন। ছেলেটি ততক্ষণে দুটো বিস্কুট খেয়ে নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ছুঁইয়েছে। তবে চাটুকু জিভে পড়তেই ছেলেটির মুখের ভাব বদলে গেল। টাপুর দেবী তাকে চা মুখে অমন থমকে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হল বাবা?কোন সমস্যা? ”
ছেলেটি বহুকষ্টে মুখে থাকা চাটুকু গলধকরণ করে জবাব দিল,
“আজ্ঞে আন্টি, না মানে, আসলে চায়ে ভুল করে চিনির বদলে লবণ দিয়ে দিয়েছেন উনি। ব্যাপার না। ভুল হতেই পারে। আমি এটাই খেয়ে নিচ্ছি।”
টাপুর দেবী চোখ পাকিয়ে তাকালেন হৃদিতার দিকে। হৃদিতার মুখখানিও ততক্ষণে শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। কিন্তু সে সত্যি সত্যি বোঝেনি চিনি আর লবণের তফাৎ। তাদের বাড়িতে মা সবসময় চিনি ব্লেন্ড করে একেবারে মিহি করে রাখে। সেই সাদা মিহি চিনি, আর লবণ একই দেখতে। অন্য সময় মা খুঁজে দেয় বলে সমস্যা হতো না, তবে আজ একা একা সেটাই গুলিয়ে ফেলেছে ভেবে খারাপ লাগলো। ছেলেটি ততক্ষণে কাপের চাটুকু শেষ করে ফেলেছে।
টাপুর দেবী অত্যন্ত লজ্জিত স্বরে বলরো,
“কিছু মনে করো না বাবা। ও রান্না করে না তো খুব একটা, তাই জন্যই বুঝতে পারেনি।!”
ছেলেটি সহাস্যে জবাব দেয়,
“কিছু মনে করিনি আন্টি।মাঝে মাঝে একটু ভিন্ন রকমের স্বাদ মুখে পড়লে মন্দ হয়না। তবু ভাগ্যিস দেড় চামচ দিতে বলেছিলাম।তাই জন্য খাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল নইলে!”
টাপুর দেবী জোরপূর্বক হাসলেন। রাগে কটমট চোখে মেয়েকে আরেকবার দেখে নিয়ে বললেন,
“উনি আসুক, আমি আবার চা বসাচ্ছি। একটু দাঁড়াও!”
ছেলেটি কয়েকবার বারণ করলেও টাপুর দেবী শুনলেন না। কোমরে আঁচল গুঁজে রান্নাঘরে গেলেন। মিনিট পাঁচেকের মাথায় আবার কলিং বেল বাজলো। হৃদিতা ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো বাবার ক্লান্তমুখ।তবে মেয়ের মুখদর্শন মাত্র সেই ক্লান্ত মুখের ক্লান্তির রেশটুকু কেটে গিয়ে ফুটে উঠলো স্নিগ্ধতা। ঋতমবাবু ভেতরে গেলেন। দরজা আটকে ভেতরে গেল হৃদিতাও। ঋতমবাবু ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো। ভদ্রতার সাথে বলে উঠল,
“প্রণাম আঙ্কেল। আসলে আমি আপনার সাথে দেখা করতেই এসেছি!”
ঋতমবাবু হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে অফিসের ব্যাগটা মেয়ের হাতে দিয়ে নিজেও বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
“প্রণাম। তোমাকে আশুতোষবাবু পাঠিয়েছেন তাই তো?উনি বলেছিলেন। তোমার নামটা বাবা?”
ছেলেটি মৃদু হেসে উত্তর দিণল,
“আমার নাম আদৃত,আদৃত সেন।আশুতোষ সেন আমার দাদু।উনিই পাঠিয়েছেন। আসলে বাঁদিকের যে জমিটা আছে আপনার ওটা দাদু নিতে চেয়েছিলেন, সবটা দেখতেই আমাকে পাঠিয়েছেন। আর জমিটা আমার পছন্দ হয়েছে।প্লেসওয়াইজ একদম পারফেক্ট।আমরা জমিটা কিনতে চাই। আপনার কি মত?”
ঋতমবাবু উত্তর করার আগেই টাপুর দেবী চায়ের ট্রে হাতে এসে দাঁড়ালেন। একটা কাপ অতিথির দিকে আর অন্যটা স্বয়ং তার স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
ঋতমবাবু আদৃতকে হাতে ইশারা করে বললেন,
“চা টা আগে খেয়ে নাও তারপর কাজের কথা বলছি!”
আদৃত কথা শুনলো। চা পানের পর্ব মিটতেই ঋতমবাবু আসল কথায় ফিরলেন,গমগমে রাসভারী কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“জায়গাটা পছন্দ হয়েছে, তাতো খুব ভালো কথা আদৃত। তবে এদিকে পাঁকা রাস্তা নেই, মাটির রাস্তা একটু বৃষ্টিতেই কাঁদা জমে যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়। তোমাদের এতবড় অফিস এখানে হলে কি ভালো হবে?স্টাফরা কি আসতে চাইবে?”
আদৃত খানিকটা চিন্তা করে বললো,
“আমার এই প্লেসটা ভালো লেগেছে আঙ্কেল। আর কন্ট্রাকশনের কাজ শুরু করতে এখনো মাস দুয়েক দেরি আছে।ততদিনে নাহয় এদিককার রাস্তায় মাটি কেটে তা ইট দিয়ে বেঁধে দেব।আসলে কি বলুনতো, এই জায়গাটা একদম প্রকৃতির কোলে। চারিদিকে এত সবুজ, ফ্রেশ এয়ার, সবটাই ভীষণ হার্টটাচিং। আশেপাশে খুব একটা জনবসতিও নেই। আপনারা সহ মোট চারটে ঘর দেখলাম হয়তো। তো এমন একটা নিরিবিলি, কোলাহল মুক্ত পরিবেশে কাজ করেও স্টাফরা শান্তি পাবে। সেজন্যই এই জমিটা চয়েস করা।আর আমার ধারণা দাদুও না করবে না। এবার আপনি যদি রাজি থাকেন তো জমিটা নিতে চাই আমি।পরে কোন সমস্যা যদি হয়ও সেটা তখন দেখা যাবে।”
ঋতমবাবু খুশি হলেন। ছেলেটি সত্যি সত্যিই যথেষ্ট এফিশিয়েন্ট এবং ওয়েল প্ল্যানার তাতে কোন সন্দেহ নেই। এতটুকু ছেলের চিন্তার পরিপক্বতা দেখে তিনি মুগ্ধও হলেন। তাই আর চিন্তা না করেই জমি বিক্রির প্রস্তাবটাতে রাজি হলেন তিনি।
ঋতমবাবুর সম্মতি পেয়ে আদৃত দাদুর সাথে কথা বলে নিল। আশুতোষবাবু আপত্তি জানালেন না,বরং খুশিই হলেন। আদৃত এবার অ্যামাউন্টের কথা তুলতেই ঋতমবাবু বললেন,
“জমিটা আমি বেঁচতাম না আদৃত।আশুতোষবাবু বয়স্ক মানুষ তাছাড়া ওনার ব্যবহারে যথেষ্ট নমনীয়তা লক্ষ্য করেই আমি জমি দিতে রাজি হয়েছি।এখন জমি তোমাদের পছন্দ হয়েছে, আর তা তোমাদের উপকারেই লাগবে। কারো সামান্য পরিমাণ উপকার করার পরিবর্তে আমি দর হাঁকতে পারবো না বাবা। তোমাদের যা ইচ্ছে হয় দিতে পারো। আর না দিলেও ক্ষতি নেই। আমি ছা পোষা বাঙালি, আমার চাকরির বেতনেই আমার এই ছোট সংসার বেশ ভালো করে চলে যায়। অযথা বিত্তের লোভ আমার নেই, আর না আছে বিত্তবান হবার আকাঙ্খা। ”
বয়স ৪৫ এর কোঠায় থাকা এই পিতৃতুল্য পুরুষটির এমন সুদৃঢ় চারিত্রিক কাঠিন্যে আদৃত মুগ্ধ না হয়ে পারলো না।
সে নিজেই একটা মনমতো দাম বললো, যাতে মান থাকে দুতরফেই। ঋতমবাবু তাতেই এক কথায় রাজি হয়ে যান। আদৃত সেই নির্ভেজাল, নির্লোভ ব্যাক্তিত্বের মানুষটির দিকে একপলক পরমশ্রদ্ধা নিয়ে তাকায়।
ঋতমবাবু তখন আইনি কাগজপত্র নিয়ে কথা বলছেন। আদৃত খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে নেয় সবটা।তারপরে উঠে দাঁড়ায়। যেতে যেতে ঋতমবাবুর উদ্দেশ্যে বলে যায়,
“আমি দুদিনের মাঝেই দলিলপত্র তৈরী করে আনবো আঙ্কেল। আপনার কোন সমস্যা হবে না তো?”
ঋতমবাবু জবাব দেন,
“না, কোন সমস্যা হবেনা। তুমি এসো!”
আদৃত প্রসন্ন মুখে টাপুর দেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“চা টা ভালো ছিল আন্টি।ধন্যবাদ! ”
টাপুর দেবী আন্তরিক হাসেন। হৃদিতা তখন মায়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে কেবল মাথা বের করে দআছে। তাকে উদ্দেশ্য করেও আদৃত বলে ওঠে,
“আপনার করা চাটাও ভালো ছিল হৃদ। একটু ইউনিক। আপনাকেও ধন্যবাদ। ”
আদৃতের কন্ঠে “হৃদ” সম্বোধনে হৃদিতা কেঁপে ওঠে।অজানা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নেয় মায়ের পিঠের আড়ালে। আদৃত তা দেখে হেসে ফেলে।
সে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পরেই দরজা আটকে দেন ঋতমবাবু। ফ্রেশ হতে নিজের ঘরে চলে যেতেই টাপুর দেবী পা বাড়ান রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।
আর হৃদিতা!সে এক দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরে। বারান্দাতে দাঁড়িয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় আদৃতের প্রস্থান। সে একদৃষ্টে সে পথেই তাকিয়ে রয় যতক্ষণ অবধি না আদৃতরুপী পুরুষাবয়বটি আঁধারের বুকে বিলীন না হয়।সেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে তখনো উপচে পড়া লজ্জার ছটার সাক্ষী হয়ে থাকে এই নিকষ অন্ধকার।আর তাই হয়তো, সেই লাজুকদৃষ্টি থেকে আদৃতকে বাঁচাতেই আঁধারের কুন্ডলিরা দ্রুত আদৃতের ছায়াটুকু মিলিয়ে দেয় তাদের ভীরে।
#চলবে।
[আমি কলকাতা থেকে না। বাংলাদেশেই থাকি!😊
😁 নায়কের নাম বলে দিয়েছি। রক “হৃদৃত”💛।
আমি কিন্তু দ্বিতীয় পর্বেই বলেছিলাম, এই উপন্যাসের শব্দচয়ন একটু গুরুগম্ভীর হবে।তবে অনেকে এতে দ্বিমত পোষণ করায় এবার থেকে একটু সোজা করে লেখার চেষ্টা করবো। তবে উপন্যাসের স্বার্থে যতটা দরকার তা রাখতেই হবে।
আর আজকের পর্ব বড় হয়েছে না?আরো বড় হত। কিন্তু সময় পাইনি আর।
লেখিকা ডিপ্রেসড। কেউ একটু মোটিভেট করে যাবেন প্লিজ পারলে। পড়তে হবে, জেনেও পড়া হচ্ছে না।🥺]