প্রিয় অসুখ
পর্ব ৪
মিশু মনি
.
শীতুলের ঘুম আসছে না। খুব ছটফট লাগছে। বিষণ্ণ মনে ছাদে এসে দাঁড়ালো। চমকে উঠলো যখন একটা মেয়ের কান্নার শব্দ কানে এলো। কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশ ফিরে দেখলো কিছুটা দূরে একটা মেয়ে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। খানিক বাদেই বুঝতে পারলো ওটা শ্রবণা। শীতুল কাছে এগিয়ে এসে গলা খাকারি দিলো।
শ্রবণা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে শীতুলের দিকে তাকালো। জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলো শীতুলের দিকে। শীতুল অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘সরি, আপনার কি অনেক দুঃখ?’
শ্রবণা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কেন?’
– ‘রাতে খাবার খাননি আবার এখন কাঁদছেন। আমার মনেহচ্ছে আপনার অনেক দুঃখ।’
শ্রবণা চোখ মুছে বললো, ‘আমার দুঃখ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। তখন খুব তো অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। এখন আবার কেন এসেছেন?’
– ‘এত রাতে ছাদে একা একটা মেয়ে কাঁদছে। তাও আবার একটা নির্জন আইল্যান্ডে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তার কান্না দেখে যাবো?’
– ‘সেটা তখন মনে হয়নি? এই নির্জন দ্বীপে এত বড় প্রাসাদে শুধু দুজন মানুষ। অপর মানুষটার সাথে ভদ্রতার খাতিরেও কথা বলা যায়?’
– ‘ওহ আচ্ছা। আমার এটা একদমই মনে হয়নি। অপর মানুষটা তো একাই সাহস করে এসেছে। সে হয়ত একা থাকতেই ভালোবাসে।’
– ‘সে যেটাই ভালবাসুক। নিজে থেকে তো আপনার কাছে গিয়েছিল কথা বলার জন্য তাই না?’
শীতুল মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘ইশ! তাহলে তো অন্যায় করে ফেলেছি। এখন কি মহারাণী ক্ষমা করে দিতে পারেন?’
– ‘না পারি না। আপনার উপর আমার অনেক অভিমান জমে গেছে।’
– ‘ওহ আচ্ছা।’
– ‘আমার সামনে এরকম ওহ আচ্ছা ওহ আচ্ছা করবেন না।’
– ‘ওহ আচ্ছা’
শ্রবণা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই শীতুল বললো, ‘আর বলবো না।’
– ‘হুম। আপনি এত রাতে ছাদে কেন?’
– ‘আমার কথা ছাড়ুন। আপনি এত রাতে ছাদে কি করছেন?’
– ‘কাঁদছি।’
– ‘কাঁদুন কিন্তু বেশি না। কারণ বেশি কাঁদলে গালে ঘা হয়।’
– ‘বেশি কাঁদলে গালে ঘা হয়? এই অদ্ভুত তথ্য কোথায় পেয়েছেন আপনি?’
শীতুল বললো, ‘চোখের জলে নুন থাকে। কেঁচোর গায়ে নুন ছিটালে কেঁচো গুলিয়ে মুলিয়ে দলা পাকিয়ে মরে যায়। মেয়েদের গাল আরো বেশি সংবেদনশীল। তাহলে মেয়েদের গালে ইনফেকশন হবে না বলুন?’
শ্রবণা ভ্রু কুঁচকে তাকাল শীতুলের দিকে। ওর কান্না পুরোপুরি থেমে গেছে। শীতুলের এই অদ্ভুত তথ্য শুনে ওর চোখেমুখে বিস্ময়! এমন কথা জীবনেও কখনো শোনেনি ও।
শীতুল বলল, ‘এই দেখুন আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন। তাই আপনার কান্নাও থেমে গেছে।’
শ্রবণা হেসে বললো, ‘আপনি যে কি! অদ্ভুত একটা মানুষ।’
শীতুল মুচকি হেসে বললো, ‘সবাই তাই বলে। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে সবাই আমাকে নিয়ে অনেক মজাও করে। সবাই আমাকে কি নামে ডাকে জানেন?’
– ‘কি?’
– ‘অদ্ভুতকর্মা।’
শব্দ করে হেসে উঠলো শ্রবণা। হাসতে হাসতে বললো, ‘অদ্ভুতকর্মা! সত্যিই নামটা একেবারে আপনার জন্য পারফেক্ট হয়েছে।’
– ‘হ্যাঁ আমিও তাই বলি। আপনার কি এখনো কষ্ট হচ্ছে?’
শ্রবণার মুখে একটা অন্যরকম আভা ফুটে উঠলো। চোখেমুখে দেখা দিলো রাজ্যের বিস্ময়! একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘নাহ। এখন আর একটুও কষ্ট হচ্ছে না।’
– ‘যাক, শুনে ভালো লাগলো। আমার ঘুম আসছিলো না। খুব অস্থির লাগছিলো। তাই ছাদে উঠে এলাম।’
শ্রবণা কৌতুহলী হয়ে বললো, ‘অস্থির লাগছিলো কেন?’
– ‘সে কারণটা জানলে নিজেই অস্থিরতা কমিয়ে ফেলতাম।’
– ‘আমি কমিয়ে দেই?’
চমকে উঠলো শীতুল। শ্রবণার কণ্ঠে অচেনা এক ধরণের সুর শুনে ভেতরটা কেঁপে উঠেছে ওর। মগজে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। শ্রবণার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো খুব মায়া নিয়ে বসে আছে মেয়েটা। সেই মুখ দেখে মনেহচ্ছে কত যুগ যুগ ধরে অপেক্ষার প্রহর গুণছে আর ভাবছে কবে আসবে! এই মুহুর্তে শ্রবণাকে অনেক বেশি শ্যামলতা মনে হচ্ছে। হার্টবিট বেড়ে যেতে লাগলো শীতুলের। শ্রবণার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি নেইলপলিশ দিতে পছন্দ করো?’
শ্রবণা মুখ বেঁকিয়ে বললো, ‘ধুর। নেইলপলিশ আমার অসহ্য লাগে। ওটা নখে থাকলে ওযু হয়না। তাছাড়া আমার ধবধবে সাদা আঙুল ভালো লাগে।’
হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে ফেললো শীতুল। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া হৃদপিন্ডের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করলো। বুকের ঢিপঢিপ শব্দটা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। শ্যামলতা চিঠিতে লিখেছে নেইলপলিশের কথা, অথচ শ্রবণা নেইলপলিশ একেবারেই পছন্দ করেনা। অযথা শ্রবণাকে শ্যামলতা ভেবে ভূল করতে যাচ্ছিলো শীতুল।
এদিকে শ্রবণা মনেমনে ভাবছে, ‘আমি নেইলপলিশ পছন্দ করিনা কিন্তু লাল আলতা আমার অনেক ভালোলাগে। পায়ে মোটা করে আলতা দিয়ে পুরো বাড়ি নেচে নেচে বেড়াতে ইচ্ছে করে। একটা চিঠিতে প্রিয় অসুখকে বলেছিলাম এই ইচ্ছের কথা। আজকে প্রিয় অসুখ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু চিঠিটা আর দেয়া হলো না।’
যখনই আলতার কথা বলতে যাবে এমন সময় একজন বেয়ারা এসে বললো, ‘ম্যাডাম আপনার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?’
শ্রবণা হেসে বললো, ‘না রবিউল ভাই। আমি ওনাকে চিনি, সমস্যা নেই। আপনি যান।’
শীতুল জিজ্ঞেস করলো, ‘ওনারা কি আপনার দেখাশোনা করছেন?’
– ‘আসলে এই রিসোর্টটা আমার মামার। মামা সবাইকে বলে দিয়েছেন আমার যেন কোনো সমস্যা না হয়।’
– ‘ওহ আচ্ছা। তাই তো বলি একা একটা মেয়ে এই নির্জন দ্বীপে থাকার সাহস পান কোথা থেকে। এইযে এত রাতে ছাদে একা আমার সাথে বসে আছেন। আমি যদি আপনার কোনো বিপদ ঘটিয়ে ফেলি?’
– ‘আমিতো সেটাই চাই।’
– ‘হোয়াট!’
শ্রবণা হেসে বললো, ‘মজা করছিলাম। ছাদের চারকোণায় সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে খেয়াল করেননি বোধহয়।’
– ‘ছাদেও! বাহ সিকিউরিটি অনেক ভালো বলতে হবে।’
এরপর রিসোর্ট প্রসঙ্গ নিয়ে কথা চলতে লাগলো। শীতুল বিভিন্ন বিষয় জানতে চাচ্ছিলো আর শ্রবণা সেসবের উত্তর দিচ্ছিলো। এভাবেই আলতা/নেইলপলিশের প্রসঙ্গটা চাপা পড়ে গেলো। শ্রবণা ভূলেই গেলো আলতা ভালোলাগে সেই কথাটা শীতুল কে বলতে। এটা বললেই শীতুল কিছুটা নিশ্চিত হয়ে যেতে পারতো এটাই ওর শ্যামলতা। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, প্রকৃতি ওদের সত্যিকার পরিচয় হতে দিলো না।
রিসোর্টের প্রসঙ্গ থেকে শ্রবণার বাড়ি কোথায়, বাসায় কে কে আছে এসব নিয়ে কথা হলো। দুজনে কথা বলতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। শীতুলের এই প্রথম মনেহচ্ছে মেয়েটা বন্ধু হিসেবে অনেক ভালো। অনেক মিশুক, হাস্যোজ্জ্বল, সবকিছু সহজে বুঝে নিতে পারে। শীতুলের এই মানসিকতা গুলো অনেক ভালো লাগলো ওর।
আড্ডা দিতে দিতে রাত অনেক বেড়ে গেলো। শীতুল হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুমাবেন না আপনি?’
– ‘আমার তো গল্প করতে অনেক ভালো লাগছিলো।’
– ‘সত্যি! আমারও অনেক ভালো লাগছে। আপনি কিন্তু অনেক মিশুক টাইপের। আমি আবার কারো সাথে মিশলেও আগে নিজে কথা বলতে পারিনা। কেউ কথা বলতে বলতে সহজ করে দিলে তাহলে আমিও অনায়াসে কথা বলতে পারি।’
কথাটা শুনতে শ্রবণা’র কি যে ভালো লাগলো! দুজনার দুটি মন তাহলে একই আছে। এখন আরো কিছু সময় একসাথে কাটাতে হবে তারপর সরাসরি মনের কথাটা শীতুলকে বলে দিতে হবে। তাহলেই যেন আটকে থাকা দম অক্সিজেন ফিরে পাবে। উফফ!
শীতুল বললো, ‘এখন তাহলে রুমে যাওয়া যাক।’
– ‘হুম, যেতে চাইলে কি আর করার।’
– ‘মানে কি? আপনি কি সারারাত এখানে বসে কাটিয়ে দিতে চান নাকি?’
– ‘আমার আপত্তি নেই। সারারাত গল্প করলে আরো ভালো হবে। রুমে তো আর আপনি থাকবেন না।’
অবাক চোখে তাকালো শীতুল! শীতুল ওকে খারাপ ভাবতে পারে তাই ঝটপট হেসে শ্রবণা বললো, ‘আরে মজা করছিলাম।’
শীতুল হেসে বললো, ‘কি যে বলেন! আপনি অনেক অদ্ভুত ফান করেন।’
– ‘হুম। সেটা শুধু আপনার ক্ষেত্রেই হচ্ছে। এর আগে কখনো মুখ দিয়ে এমন আজেবাজে কথা বেরোয়নি বিশ্বাস করুন। আমাকে প্লিজ খারাপ ভাববেন না।’
– ‘ওকে বাবা ভাব্বো না। আর এতে খারাপ ভাবার কিছু নেই। অবশ্য এভাবে আমি আপনাকে বললে আপনি আমাকে খারাপ কেন, একেবারে থার্ড ক্লাস লুইচ্চা ছেলে ভাবতেন।’
শ্রবণা আবেগী গলায় বললো, ‘আমি কিছুই ভাবতাম না। বরং আরো ভালো লাগতো।’
– ‘কিহ! ভালো লাগতো?’
– ‘হা হা হা। আরে বাদ দিন। মাইন্ড করবেন না, গল্প করতে ভালো লাগছিলো তো। তাই বললাম আরকি।’
– ‘ওহ আচ্ছা। কিন্তু আপনি অনেক ভয়ংকর।’
– ‘সিরিয়াসলি?’
– ‘নাহ। আপনি মেয়ে হিসেবে অনেক নমনীয়, সুইট আর মিশুক। এতটুকুই বুঝতে পেরেছি।’
শ্রবণা হেসে বললো, ‘আমি এতেই ধন্য।’
কথা বলতে বলতে শীতুলের রুমের সামনে এসে গেলো। শীতুল দরজা খুলতে খুলতে বললো, ‘আজকের মত শুভরাত্রি তাহলে?’
শ্রবণার ছটফট লাগছে। কিছুতেই শীতুলকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, ইচ্ছে করছে আরো কিচ্ছুক্ষণ বসে গল্প করতে। কিন্তু শীতুল ইতিমধ্যেই দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে তাকিয়ে আছে। বাধ্য হয়ে শ্রবণা বললো, ‘ওকে শুভরাত্রি তাহলে।’
শীতুল মিষ্টি হেসে দরজা লাগিয়ে দিলো। শ্রবণার মনে জ্বালা শুরু হয়ে গেছে। শীতুলকে মনের কথাটা না বললে কিছুতেই শান্তি হচ্ছে না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বলে দেয়াটাও ঠিক হবেনা। ছেলেটা যদি না করে দেয় তাহলে তো মহা বিপদ। ধীরেধীরে একটা ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলে তারপর অনায়াসে বলা যেতো। তাছাড়া মাত্র একদিনের পরিচয়। শ্রবণা যে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে শীতুল তো সেটা জানেনা। ওর কাছে শ্রবণা কেবলমাত্র একটি সাধারণ মেয়ে।
নিজের রুমে পায়চারি করতে করতে ছটফট করছিলো শ্রবণা। মিনিট দশেক পর শীতুলের দরজায় এসে নক করলো। শীতুল এখনো ঘুমায়নি। দরজায় শব্দ হতেই ও এসে দরজা খুলে দিলো। শ্রবণাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু হয়েছে?’
শ্রবণা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। আমতা আমতা করে বললো, ‘না মানে আমার না খুব পিপাসা লেগেছে। একটু পানি খাবো। আপনার রুমে পানি হবে?’
– ‘ওয়েট নিয়ে আসছি।’
– ‘আমি ভেতরে আসি?’
শীতুল কড়া গলায় বললো, ‘না। করিডোরে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। আমি চাইনা আপনার মামা অন্যকিছু ভাবুক।’
শ্রবণা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। শীতুল পানির বোতল নিয়ে এসে শ্রবণার হাতে দিয়ে বললো, ‘খান।’
শ্রবণা পানির বোতল নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ভাবছিলো কিছু বলা যায় কিনা। কিন্তু শীতুল তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলে বাধ্য হয়ে নিজের কক্ষে চলে আসতে হলো। তবুও শ্রবণা’র শান্তি হচ্ছেনা কিছুতেই। কোথায় যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে আর সেই আগুনের আঁচ শ্রবণার গায়ে লাগছে। এ একটা অসহ্য যন্ত্রণা। শীতুলের সাথে কথা না হলেও ছেলেটা যদি পাশে বসিয়ে রাখতো কিংবা আশেপাশে থাকতো! এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়?
শীতুলের কাছে আবারো যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন যে এমন লাগছে সেটাই বুঝতে পারছে না শ্রবণা। শীতুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে, কথা বলতে ভালো লাগে। নাহ, একদমই থাকতে পারছে না শ্রবণা। শীতুলকে কিছু একটা বলতেই হবে। শ্রবণা’র মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বার শীতুলের দরজায় শব্দ করলে বিরক্তমুখে দরজা খুলে দিলো শীতুল। ঘুম ঘুম চোখে জানতে চাইলো, ‘কি সমস্যা আপনার?’
শ্রবণা আমতা আমতা করে বললো, ‘আমার না ঘুম আসছে না।’
– ‘তো? ঘুম না এলে বসে থাকুন। আমার দরজায় কেন?’
– ‘আমার না আপনার সাথে থাকতে ইচ্ছে করছে।’
– ‘মানে!’
শ্রবণা আমতা আমতা করে বললো, ‘মানে আপনার সাথে বসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার কথা বলার কেউ নেই তো। আমার রুমে একা একা ভালো লাগছে না।’
শীতুল কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। এই মেয়েটার কোনো সমস্যা আছে নাকি? একটা মেয়ে এত রাতে বারবার আসছে। ব্যাপারটা কেমন হয়ে যাচ্ছে না?
শ্রবণা বললো, ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। খুউউব..’
শীতুল শ্রবণার দিকে তাকালো। দেখলো শ্রবণার চোখে পানি। ও মাথা নিচু করে রেখেছে। গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শীতুলের ছটফট লাগছে এখন। একটা মেয়ে এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তাকে তো কিছু বলাও যায় না। তাড়িয়ে দিলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। কি যে করবো এখন?
শীতুল বললো, ‘আচ্ছা আপনি রুমে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।’
শ্রবণার মুখে কোনো কথা নেই। এখনো মাথা নিচু করে রেখেছে।
শীতুল অপ্রস্তুত বোধ করছে এখন। দারুণ সমস্যায় পড়া গেলো। মেয়েটা নড়ছেও না, সরছেও না। আবার কথাও বলছে না।
শীতুল ভেবে বললো, ‘আচ্ছা তাহলে বাইরে গিয়ে বসি?’
শ্রবণার তবুও কোনো সাড়া শব্দ নেই। শীতুল বাধ্য হয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা ধরল। পিছন ফিরে দেখলো শ্রবণা দাঁড়িয়ে আছে। শীতুলের এখন চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কি একটা ঝামেলায় পড়া গেলো। ও ধীরগলায় বললো, ‘আসুন?’
শ্রবণা আস্তে আস্তে শীতুলের পিছে হাঁটা শুরু করলো। শীতুল বাইরে এসে নারিকেল গাছে বাঁধা দোলনার কাছে চেয়ার টেনে বসলো। শ্রবণাকে বললো দোলনায় শুয়ে পড়তে।
শ্রবণা বাধ্য মেয়ের মত দোলনায় শুয়ে শীতুলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অস্বস্তি লাগছে শীতুলের। বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম করে হাতুরি পিটছে। এই নির্জন রাতে একটা মেয়ের সাথে একাকী বসে থাকাটা নিতান্তই অস্বস্তিকর ব্যাপার। তার উপর মেয়েটা যদি নিজের প্রিয়জনের মত হয়!
শ্রবণা দোলনায় শুয়ে নিষ্পলকভাবে চেয়ে আছে শীতুলের দিকে। শীতুল কি করবে বুঝতে না পেরে বললো, ‘আমি একটা গল্প শোনাই? আমি ঘুমানোর চেষ্টা করুন?’
শ্রবণা নিশ্চুপ। শীতুল মুখ কাচুমাচু করে চেয়ে আছে। দূর থেকে ভেসে আসা ইলেক্ট্রিসিটির আলোয় শ্রবণার ভেজা গাল দেখে বড্ড মন কেমন করছে। এভাবে আর কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলে নির্ঘাত কিছু একটা হয়ে যাবে। প্রেমে পড়ে যাবে শীতুল।
শ্রবণা দৃষ্টি সরাচ্ছে না। আবছা অন্ধকার, আবছা আলোয় শীতুলকে মন ভরে দেখছে। শীতুল অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে একটা গল্প শুরু করলো। রূপকথার গল্প। গল্প বলতে গিয়ে বারবার শীতুলের গলা কেঁপে যাচ্ছিলো। নিজেকে সংযত করে গল্প চালিয়েই গেলো। একসময় তাকিয়ে দেখল শ্রবণা ঘুমিয়ে পড়েছে। শীতুল শ্রবণার মুখের দিকে তাকানো মাত্র বুঝতে পারলো ওর নিজেরও মনের অবস্থা ভালো নয়। বেগতিক ঝড় বইছে। এই মেয়ের সামনে আর কখনো পড়া যাবে না।
দ্রুত নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো শীতুল। এতক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কি যে যন্ত্রণা হচ্ছে!
৬
সকালের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেলো শ্রবণার। নিজেকে বাইরের দোলনায় আবিষ্কার করে রাতের কথা মনে পড়ে গেলো ওর। মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। ঘুম ঘুম চোখে উঠে রুমের দিকে পা বাড়ালো।
শীতুলের দরজার সামনে এসে চোখ বন্ধ করে শীতুলের মুখটা দেখতে পেলো শ্রবণা। তারপর মুচকি হেসে নিজের রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
শ্রবণার ঘুম ভাংলো সকাল সাড়ে দশটায়। উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করার জন্য ক্যান্টিনে চলে আসলো। খাবার খেতে বসে বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করলো শীতুল নাস্তা করেছে কিনা?
বেয়ারা জানালো, ‘স্যার তো সকাল আট টায় নাস্তা করে চলে গেছেন।’
– ‘কোথায় গেছেন?’
– ‘স্যার তো চেক আউট করে চলে গেছেন। উনি একদিনের জন্য বুক করেছিলেন।’
বড়সড় ধাক্কা খেয়ে গেলো শ্রবণা! শীতুল চলে গেছে!
চলবে..