“প্রিয় দিও বিরহ”
২০.
আকস্মিকতায় হতভম্ব মেহতিশা। যে দর্পণ এতো দিনের সংসারে একবার কড়া চোখেও তাকায়নি। সে কিনা আজ গলা চেপে ধরেছে। ব্যাথার চেয়েও বেশি বুকে কষ্ট হচ্ছে। যার চোখে এতোগুলা দিন ভালোবাসার অথৈজল দেখতে পেয়ে অভ্যস্ত আজ সে চোখদুটো বড়ই অচেনা। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ চোখ ভারি হয়ে গেছে। মস্তিষ্কশূন্য পুরোপুরি।
দর্পণ কী করে পারলো এতো বড় নাটক করতে! মেহতিশা উন্মাদের মতো দর্পণের বুকে ঝাপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘এসব মিথ্যা তাই না?আপনি মজা করছেন আমার সঙ্গে! নাহলে এইসব স্বপ্ন! হ্যা হ্যা সব স্বপ্ন! ‘
দর্পণের ভেতর কী ভাবানুভূতি হলো বোঝা যাচ্ছে না। সে মেহতিশার মাথাটা টেনে শক্ত করে বুক থেকে সরালো। ধারালো ফলার বর্শা ছুড়ে বললো,
‘মিথ্যা নয় মেহতিশা। এসব সত্য। আপনাকে তো মানতে হবে। ‘
তারপর ছেড়ে দিয়ে বিছানায় রাজার মতো বসে পায়ের উপর পা তুলে হেসে বললো,
‘আফটার অল, আপনি শামীউল্লাহ জামানের কন্যা। নাটক করা তো আপনাদের কাজ। ‘
মেহতিশা ক্ষণকাল অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললো,
‘আমি কোনো নাটক করিনি। ‘
‘সত্যিই কোনো নাটক করেননি! ‘
মেহতিশা মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে পড়লো, বললো,
‘হ্যা, বাবা আমাকে বাধ্য করেছিলো আমি যেনো আপনাকে নাটক করে কাগজ গুলো হাতিয়ে নেই। আমার প্রচুর রাগ ছিলো আপনার উপর। আপনাকে তখন একটুও সহ্য হচ্ছিল না। আমার অমতে এমন কেনো বিয়ে দিলো? কেনো? কেনো? আমার মাথায় এসব বারবার আঘাত করতো৷ আমি রাজি না থেকেও রাজি ছিলাম। ধীরে ধীরে আমি নাটক করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার সাদাকালো জীবনে একফালি সবুজ সিগন্যালের মতো আপনি আসলেন। কারো একজনের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আমি নিঃশব্দে কাটিয়ে দিতে পারি,কারো অপেক্ষায় রাত জেগে চোখর নিচে ডার্ক সার্কেল বানাতে পারি, কাউকে সবটা দিয়ে ভালোওবাসতে পারি। এসব কোনো নাটকের স্ক্রিপ্ট না। আপনাকে ভালোবাসা এখন আর কোনো নাটক সিনেমা নয়। আপনাকে ভালোবাসাটা এখন আমার প্রাণবায়ু। ‘
দর্পণের চোখ দু’টোতে তাচ্ছিল্য। তা দেখে বুকে মুচড়ে ধরে কষ্ট গুলো মেহতিশার। তবে কী দর্পণ তাকে কখনো ভালোইবাসেনি! তার সাথে ধোঁকাবাজি করেছে। মেহতিশা ধপাধপ পা ফেলে দর্পণের সামনে আসলো। তারপর শক্তি দিয়ে দর্পণের কলার টেনে ধরলো। চিৎকার করে বললো,
‘এমনটা আপনি কী করে করতে পারেন! আপনার সাহস কী করে হয়! এবার আপনি দেখবেন এই মেহতিশা কী। ‘
দর্পণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘কী করবেন আপনি? ‘
মেহতিশা উন্মাদের মতো দর্পণের থেকে দুই কদম পিছিয়ে গেলো। টলমল চোখে হাসলো। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে। দর্পণের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আপনার মতো বেইমানের সন্তানকে আমি আমার গর্ভে জায়গা দেবো কেনো দর্পণ শেখ? ‘
দর্পণ চমকে উঠলো। সে দ্রুত পদে উঠে দাঁড়ায়। মেহতিশা বাহুদ্বয় শক্তি দিয়ে চেপে ধরে। মেহতিশা ভাবাবেগশূণ্য। দর্পণ ক্রুদ্ধ নয়নে বলে,
‘এরকম কিছু করার চিন্তা ভাবনা বাদ দিন মেহতিশা।
খবরদার! আমার বাচ্চার সাথে যদি কিছু করার চেষ্টাও করেন, কসম আমি আপনার বংশকে নির্বংশ করে দেবো। ‘
মেহতিশা হাসে। যেন তার কিছু আসে যায় না। দর্পণ কী করতে পারে সে দেখতে চায়। দর্পণ রাগে কাপে থরথর করে। লম্বা শ্বাসে সে তা নিয়ন্ত্রণ করে আনে।
আগের মতো নিষ্পাপ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
‘অনেক হয়েছে। আপনি এখন ঘুমাবেন। আর একটা কথাও বলবেন না। যা জেনেছেন ভালো হয়েছে। কালকে আমার সঙ্গে হ্যা-তে হ্যা বলবেন। ‘
মেহতিশা শক্ত হয়ে থাকে। সে ঘুমাবেনা। তার প্রশ্নের জবাব চাই। চোখ বন্ধ করে বললো,
‘আমি আমার প্রশ্নের জবাব চাই৷ ‘
‘কীসের জবাব? ‘
‘আপনি এমন কেনো করলেন? আপনি কী সত্যি মেঝোচাচাকে খুন করেছিলেন? ‘
দর্পণ হাসলো। মেহতিশাকে জোর করে চেপে বিছানায় শোয়ালো। মেহতিশা পণ করেছে কিছুতেই শোবেনা।
দর্পণ বললো,
‘আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। ‘
মেহতিশা মুখ পাশ ফিরিয়ে নেয়। সবটা হজম করতে হিমশিম খাচ্ছে সে৷ কীভাবে কেউ এতো ভালো নাটক করে! দর্পণ রোজকার মতোই তাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজ নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করতেই জল হয়ে বের হয়ে গেলো বুকের নোনাব্যাথা। চোখে ঘুম আসার পর অনুভব হলো তার ঘাড়েও উষ্ণ জলের কণা গড়িয়ে পড়লো বুঝি।
–
লালিমা শেখ খুশিতে কেঁদে যাচ্ছেন। দিয়াও খুশিতে চোখ মুছলো। কতগুলো দিন পর নিজের ভাইটাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখছে সে। দর্পণের বাবাও হাসছেন। অর্পণ যবে থেকে নেই তখন থেকে খুব একটা কথা বলেননা তিনি। চুপচাপই থাকেন। আজ তিনিও ছুটলেন গরীব মিসকিনদের খাওয়াতে। মিষ্টি খাওয়াবেন সাত পাড়ায়। সামনেই দর্পণ মুচকি হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সাজানো নকল ডাক্তারটা বড়ই পেশাদার ভঙ্গিতে ডাক্তারি সুটকেস আটকাচ্ছে। মেহতিশা বড়ই অবাক হয় এই অভিনেতাদের দেখে। মেহতিশা মনে মনে ভাবলো, এরা তো নোবেল পাওয়ার অধিকার রাখে! এতো নিখুঁত অভিনয় কী করে করলো!
সদ্য ঘুম থেকে উঠেই মেহতিশা দেখলো তাকে আদুরে কন্ঠে ডাকছে দর্পণ৷ পাশে মা বাবা আর দিয়া দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে। মেহতিশা বোকার মতো চেয়ে রইলো।
কী হচ্ছে বুঝতে পারছেনা। তারপর দেখলো দর্পণ তাকে চোখ গরম করে ইশারা করছে, যেনো সেও সমানতালে নাটক করে। নাহলে, ফলাফল ভালো হবেনা। সেও হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘আরে,আপনার পা ঠিক হয়ে গেছে! ‘
‘হ্যা বউজান, দেখুন আমি একদম সুস্থ হয়ে গেছি। সকাল বেলা উঠে দেখি পা নাড়াচাড়া করতে পারছি। সব আপনার সেবা যত্নের ফলে। ‘
মেহতিশা মুখ খিঁচে রাখলো। মা বাবাকেও কত বড় ধোঁকায় রাখছে লোকটা! অসভ্য লোক ৷ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ডক্টররা চলে গেলো। বলা বাহুল্য, এই
লোকগুলোকে দর্পণই ভাড়া করে এনেছে। ভালোই নাটক জানে সবগুলো।
অনেক দিন পর সবার সামনে হেঁটে বাইরে আসতে পারলো দর্পণ। নিজেকে অনেক দিন পর মুক্ত লাগছে তার। অফিসে ঢোকার কারণে এতোদিন পর সবাই চমকে উঠলো। কেউ এতো তাড়াতাড়ি তাকে আশা করেনি। সেই আগেরকার মতো সবাই মাথা নিচু করে সালাম জানালো তাকে৷ দর্পণ মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। সবার আগে অর্পণের কেবিনটায় গেলো। সেখানের জিনিসপত্রে ধুলো পড়েছে। দুটো ফটোফ্রেম রাখা। একটাতে অর্পণের সেলফি। আর আরেকটাতে দর্পণের সঙ্গে। দুইভাই ঘুরতে গেছিলো, তখনকার সময়ের। দর্পণের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। সে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বললো,
‘ভাই, মিস ইউ। ‘
চলবে-
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।