প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-২৪

0
972

“প্রিয় দিও বিরহ”

২৪.

‘আরেকটু খেয়ে নিন বউজান। ‘

‘আমি বললাম তো খাবোনা, সমস্যা কী আপনার?’

‘আমার অনেক সমস্যা, আপাতত আপনি খেলে আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ‘

‘আমি আপনার সমস্যা সমাধান করতে মোটেও ইন্টারেস্টেড নই। ‘

দর্পণ খাবারটা মুখের সামনে ধরেই রাখলো। গত এক ঘন্টা যাবৎ খাবার নিয়ে ঘোরাচ্ছে মেহতিশা। ইচ্ছে করেই অবশ্য। মেহতিশা জোরপূর্বক খাবারটুকু মুখে নেয়। দর্পণ হাসে। অতঃপর উঠে দাঁড়ায়। চুলটা আঁচড়ে নিয়ে ওয়ালেট পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে মেহতিশার কাছে এসে বসে। দুই হাতে মেহতিশার কোমর জড়িয়ে উদরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুমু খায়। মেহতিশা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে শক্ত হয়ে।কালকের পর আর একবারও দু’জনের কথাবার্তা হয়নি। মূলত মেহতিশাই বারবার দর্পণকে সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে।

দর্পণ এটা ওটা নিয়ে কথা বললেও মেহতিশা হু হা করে কাটিয়েছে৷ সকালেও ঘুম থেকে উঠে দর্পণকে ডাকেনি। এখন দুপুরের সময় অফিস থেকে দর্পণ লাঞ্চ ব্রেকে ছুটে এসেছে। যদিও মেহতিশা কোনো প্রকার হাসিখুশি প্রতিক্রিয়া দেখায়নি এতে। দর্পণ মেহতিশার হাত ধরে রেখেছে। মেহতিশা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তবে পারলো না। দর্পণ হাতটা টেনে ঠোঁটে চেপে ধরলো। মেহতিশা কিছু বলতে পারেনা৷ হাসফাসে নিশ্বাসগুলো গুমোট করে দিচ্ছে ভেতরটাকে। দর্পণ গম্ভীর গলায় বলে,

‘মেহতিশা! ‘

মেহতিশা খেয়াল করেছে দর্পণ ওকে তখনই নাম ধরে আর তুমি করে ডাকে যখন কোনো ব্যাপারে চিন্তিত থাকে বা গম্ভীর হয়ে যায়। মেহতিশা আড়দৃষ্টিতে তাকায়। দর্পণের চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। দর্পণ ভারি গলায় বলল,

‘মেহতিশা, আমি সারাক্ষণ তোমার পাশে থাকবোনা। মানে থাকতে চেয়েও পারবো না। বাবার বয়স হয়েছে।
ভাইয়া থাকতে কখনো বুঝিনি কাজ করে টাকা কামাতে কতো কষ্ট। আমি শুধু ঘুরেছি ফিরেছি রাজনীতি করে বেরিয়েছি। ভাইয়া যেদিন মারা গেলো, হুট করেই সেই শূন্যতাটুকু বুঝতে শুরু করে করলাম।
বয়স্ক বাবা, মা, বোন আর বোনের চেয়েও বেশি আমাকে ভালোবাসা ভাবী মানুষটা। সবাইকে ভালো রাখার দায়িত্বটা যখন কাঁধে এসে পড়লো তখন বুঝলাম। আমি জানি, সব মেয়েরাই নাটক সিনেমার মতো চায় তার প্রেগ্ন্যাসির সময় স্বামী সারাক্ষণ তার পাশে পাশে থাকবে কেয়ার করবে। অনেক ভালোবেসে আনন্দে রাখবে৷ বিশ্বাস করো, আমিও চাই তোমার পাশে থাকতে। দশটা মাস তুমি আমার সন্তানের জন্য কষ্ট করবে, আমারও ইচ্ছে করে তোমার পাশে থেকে সময়টা কাটাতে। আমি সারাটাদিন অফিসে থাকি৷ কিন্তু আমার মনটা আমি এখানেই ফেলে চলে যাই। তুমি সারাক্ষণ কী করছো, কী খাচ্ছো, ঘুমাচ্ছো কিনা ঠিকঠাক ঔষধ নিচ্ছো নাকি, কোনো দৌড়ঝাঁপ করছো নাতো! ঠিক আছো তো, এসব ভাবতে ভাবতে আমার কাজে মন বসেনা। আমার ইচ্ছে করে ছুটে চলে আসতে। তখন ভাইয়ার কথা মনে পড়ে। আমার ভাইটাও তো একইভাবে স্বপ্ন দেখতো, এতদিনে সেই বাচ্চাটাও ঘরে ছুটে বেড়াতো। আমার ভাইয়া বেঁচে থাকলে কতোটা আনন্দ করতাম আমরা! ‘

মেহতিশার চোখও ভিজে জুবুথুবু। দর্পণ ছেলে মানুষ বলেই হয়তো চোখের জল চেপে রেখেছে। দর্পণ হাফ ছেড়ে আবারও বললো,

‘মেহতিশা, আমি এমন করলে কী আমার ভালো লাগে? তুমি ঠিক মতো খাচ্ছো না, ঘুমাচ্ছো না, মা ফোন করে ঘন্টায় ঘন্টায় অস্থির হয়ে বলছেন, তুমি নাকি ঘরে বসে বসে চুপ করে পড়ে থাকো এক কোণায়। এমন কেনো করো তুমি? ‘

মেহতিশা রেগে গেলে যেনো। সে দর্পণকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ভারি শরীরে খুব জোরে কথা বললেই শ্বাসকষ্ট উঠে যায় ওর। তবুও, দানবীয় শক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,

‘তো কী করবো আমি! সব কী আপনার কথা মতোই হবে! আমি তো সবার হাতের পুতুল তাইনা?যে যা মন চায় আমার সঙ্গে তা করবে। আরে, আমি কাকে কী বলছি! হচ্ছেই তো! শুরু থেকেই হচ্ছে। ভালোই তো ছিলাম আমি। পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ছিলো। রক্তের সম্পর্কে মা বাবা না হলেও কখনো ভালোবাসার অভাব হয়নি। হঠাৎ করেই, একদিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে গেলো। আমাকে বন্ধুর মতো গাইড করা মানুষটা, আমার মেঝো চাচা সাহিল জামান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। লাশটাও বাড়ি পৌঁছালো না। সুস্থ হাসিখুশি মানুষটার একটা পোড়া হাত শুধু ফিরেছিলো। পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসলো। যতটা না কষ্ট হয়েছিলো, সাহিল চাচ্চু মারা যাওয়াতে তার চেয়েও বেশি হয়েছিলো যখন আমার বাবা প্রতিশোধের নেশায় প্রতিপক্ষ দলের আপনাকে পথে বসাতে আপনার কোম্পানির সব পেপার হাতিয়ে নিয়ে চলে আসতে। কথা ছিলো, আপনাকে ভালোবাসায় ফাঁসানো অথচ দেখুন বিয়ের পরে কীভাবে আমিই ফেঁসে গেছি আপনাতে!

বাবা ঠিকই বলেছিলো, নিজের জন্য মাঝে মাঝে খুব স্বার্থপর হতে হয়। আমি হতে পারিনি, যখনই ভেবেছি আপনাকে ঠকাবো ততবার মনে হয়েছে, পারবোনা এই মানুষটাকে ঠকাতে! ভালোবেসে ফেলার অপরাধের মাশুল তো দিচ্ছিই। দেখছেন না, বাজে ভাবে ঠকে গেছি! আমি কিছু না জানলেও, আপনি ঠিকই জানতেন আমার বাবা আমাকে আপনার সাথে বিয়ে দেয়ার মতো বোকামিটা করে ফেলবে। তাই তো দূর্বল সেজেছিলেন। আর এই বাচ্চাটাও আপনি এজন্যই চেয়েছিলেন, যাতে বাধ্য হয়ে আমি আপনার কাছেই থেকে যাই। আর বাবার প্ল্যান সফল না হয়,আমাকে দেখতে না পেয়ে বাবাও যেনো একই কষ্ট পায়।

আমার অসহ্য লাগে সবকিছু! যতবার আমি ভাবি আমি বাবার আর আপনার কাছে প্রতিশোধের গুটি এছাড়া কিছুনা ততবার আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে!আমি মরিনা কেনো দর্পণ?’

দর্পণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই দুই হাতে শক্ত করে মেহতিশাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

‘আমি আপনাকে সব বলবো বউজান! আপনি ছাড়া আমার কে আছে! ভালোবাসি তো! ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

(কালকে একটা পর্ব আসবে ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here