প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-২৫

0
995

“প্রিয় দিও বিরহ”

২৫.

টলমলে অশ্রুতে সিক্ত হয়ে চোখদুটো আরও মায়াময় লাগছে। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। জোৎস্নার মতো অপরূপা লাগছে মেহতিশাকে। ঘুমিয়ে মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে। দর্পণ বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। দর্পণ মেহতিশাকে সেসময় সবটা খুলে বলতে চেয়েছিলো, মেহতিশা তার আগেই তাকে বলেছে,এসব বলার কোনো প্রয়োজন নেই। তারপর বিছানায় চুপ করে শুয়ে রইলো। দর্পণ কাছে আসতে চাইলেও মেহতিশা তাকে আসতে দেয়নি। কথাগুলোর মাঝে কতটুকু অভিমান লুকিয়ে ছিলো তা বুঝতে বাকি নেই দর্পণের।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাতের ঘড়িটা পড়ে নিয়ে মেহতিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

‘বউজান, আপনি আমার কাছে ভালোবাসার চেয়ে বেশি। আপনাকে পেতে যদি আমি খুন করতে পারি। তাহলে, আপনাকে আমার কাছে আঁটকে রাখতে কী করবো তা আপনার ধারণারও বাইরে। আপনি অভিমান করুন,রাগারাগি করুন, কিন্তু সবশেষে আপনি আমার হয়েই থাকুন৷ আপনার আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার সকল পথ আমি বন্ধ করে দেবো। আপনি ডানে, বামে, উপরে, নিচে যতবার ভরসার হাত খুঁজবেন শুধু আমাকেই পাবেন।

আমার আরশীজগতে প্রবেশ আপনার ইচ্ছেতে হলেও গমণ আমার শেষ নিঃশ্বাসের পরই হবে। আপনি যতবার ভাববেন, আপনি মুক্ত হয়ে গেছেন ততবার আমি আপনাকে নতুন করে আমাতে মেশাবো। ‘

দর্পণ মুখে হাসিটুকু অটল রেখে মোবাইল কানে লাগিয়ে কথা বলতে বলতে বের হয়ে গেলো। অথচ, বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকা মেহতিশা কিছু শুনলোইনা।

টিকটিক করে ঘড়ি জানান দিলো বিকেল চারটে বাজে। আপেলের জুসের গ্লাসটা হাত থেকে রেখে গায়ে চাদরটা টেনে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। একবার ছাঁদে একা যাওয়ার সিদ্ধান্তে মনস্থির করলেও আবার ভাবলো কাউকে সাথে নিয়ে গেলে ভালো হবে।
সেই ভেবেই নিচের দিকে গেলো, দিয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ওকে তো আর ডিস্টার্ব করা সাজেনা। মেয়েটা পড়ুক মন দিয়ে। জীবনে বড় কিছু করতে পারলে তখন আর নিজেকে নিয়ে এতো হীনমন্যতা থাকবেনা। মেহতিশা ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে লালিমা শেখ টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন৷ মেহতিশা ভেবে পায়না, একটা মানুষ দিনে কতগুলো সিরিয়াল দেখতে পারে! ওর মনে হয় হিন্দি যতগুলো সিরিয়াল তৈরি হয়েছে এই পর্যন্ত তিনি সবগুলোর নামই মুখস্থ করে রেখেছেন। কোনটার পর কোনটা হয় সেগুলোও জানেন। মেহতিশা টিমটিমে পায়ে হেঁটে লালিমার পাশের গিয়ে বসলো। লালিমা প্রথমে ওর শরীরের খোঁজ নিয়ে তারপর গদগদ হয়ে এখনের সিরিয়ালের একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে শুরু করলেন। কিন্তু, মেহতিশা যেহেতু এসব টিভি সিরিয়াল দেখেনা তাই ওর মন বসছেনা। লালিমা শেখের গল্পের মূল কনসেপ্ট হচ্ছে, আজকে যমুনা ঢাকি শত্রুপক্ষকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে এবং নায়ক তাকে প্রচন্ড সাপোর্ট দিচ্ছে। ইহা বড়ই আনন্দের ব্যাপার স্যাপার।
মেহতিশা কিছুক্ষণ বসে তারপর বললো,

‘মা, আমি একটু নিশিতা আপুর ঘর থেকে ঘুরে আসি। সেই সকালে একবার গিয়েছিলাম। তখন, আপু ঘুমিয়ে ছিলো। ‘

লালিমা মুখটা কালো করে বললেন,

‘নিশিতার কাছে তুমি যখন তখন যাবেনা মা, দেখোই তো ও পাগল কিসিমের মানুষ। যদিও, বলতে নেই তবুও বলি নিশিতা একটা অপয়া। আমার ছেলেটার মাথা তো খেয়েছিলো। একেবারে শেষ না করা পর্যন্ত ক্ষ্যান্ত হয়নি৷ চার মাসের বাচ্চাটাকেও খেয়েছে। ওর থেকে যত দূরে থাকবে ততই মঙ্গল। এজন্যই তো আমি মুনিয়াকে রেখেছিলাম৷ যাকগে,মতো পছন্দ হয়নি তাই বাদ দিলাম। কিন্তু তোমার ওর সাথে বেশি ঘেঁষার দরকার নাই। ‘

মেহতিশার খারাপ লাগে নিশিতার সম্বন্ধে কেউ এ ধরনের কথা বললে। এখন যদি মেহতিশা আগের মতো ঠোঁট কাটাই থাকতো তাহলে সহজেই একটা ঠান্ডা মাথার বাঁশ দিয়ে দিতো। কিন্তু এখন কথা অনেক বুঝে সুঝে বলতে হয়। মেহতিশা মুখ সংযত রাখার চেষ্টা করেই বললো,

‘মা, মানুষের হায়াত উপর থেকে একজন লিখেই পাঠান। অর্পণ ভাইয়াকে আমি বাস্তবে কখনো দেখিনি। তবুও, আপনাদের কাছে শুনে আমার কষ্ট হয় তার জন্য। আর আপনার কত কষ্ট হয় তা তো বুঝি। কিন্তু, নিশিতা আপুরই বা কী দোষ! সেও তো আপনার মতোই নিজের সন্তান হারিয়েছে। তার অসুস্থতার জন্য মা বাবাও বোঝা ভেবে বাড়িতে নেয়নি। নিশিতা আপু হয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু পশুও ভালোবাসা আর অবহেলার পার্থক্য বোঝে। আমরা যদি আপুকে একটু ভালোবেসে খেয়াল রাখি, হতেই তো পারে সে আগের মতো হয়ে যাবে! অর্পণ ভাই নাকি আপুকে খুব ভালোবাসতেন। তাহলে, আপুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও কিন্তু অর্পণ ভাইয়া কষ্ট পাবেন। ভাইয়া কিন্তু এই পরিবারের উপরই আপুর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। ‘

মেহতিশা উঠে যায়। কথাগুলে না বললে মনে শান্তি পেতো না একটুও। বড়রা যে সবসময় সঠিক হবে এমন কোনো কথা নেই। তাদের ভুলটাও একটু কৌশলে হাসিমুখে শুধরে দেওয়া সম্ভব৷ এতদিন সুযোগ্য সময়ের অভাবে যা পারেনি তা আজ বলেই ফেললো সে। অন্তত,এবার একটু হলেও বাধ্য হবেন ভাবতে। লালিমা শেখ চিন্তিত মুখে বসে আছেন। টিভিটা চলছে, কিন্তু মনটা হঠাৎ কোথায় যেনো ছুটে চলেছে।

নিশিতা খাতায় পেন্সিলের খোঁচায় একমনে কিছু এঁকে যাচ্ছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ যেনো কিছু। মেহতিশা মৃদু হেঁসে ঘরে আসে। নিশিতা এলোমেলো চুলে মুখ নিচু করে খাটে বসে আছে। মেহতিশা খাটে বসে হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বললো,

‘নিশি আপু, তুমি কী আঁকছো?’

নিশিতা মুখ তুলে চায়। দাঁত বের করে নিষ্পাপ হাসে। হাতের খাতাটা সামনে তুলে বলে,

‘দেখো দেখো, আমি আমাদের এঁকেছি! সুন্দর হয়েছে না বলো! ‘

মেহতিশা খাতায় নজর দেয়। চোখদুটো বড় বড় করে তাকায়। সত্যিই নিশিতা অনেক সুন্দর এঁকেছে। এটা দুইদিন আগের ঘটনা। যখন মেহতিশা নিশিতার মাথায় তেল দিয়ে বিনুনি করে দিয়েছিলো। দুজনে অনেক গল্প করেছিলো। সেসময়টা একেবারে অবিকল ফুটিয়ে তুলেছে নিশিতা৷ দেখে মনে হচ্ছে তারা যেনো কত বছর ধরে একে অপরের সঙ্গে আছে। দু’টো বোন পাশাপাশি থাকলে যেমন লাগে তেমন। মেহতিশা মনে এক অন্য রকম অনুভূতি পায়। কোনো বড় ভাই কিংবা বড় বোন ছিলো না ওর৷ নিশিতাকে মনে হয় যেনো সে সত্যিই ওর আপন বড় বোন। মেহতিশা নিশিতাকে বলে,

‘আপু, তুমি এতো সুন্দর আঁকতে পারো! আগেও বুঝি আঁকতে! ‘

নিশিতা হেঁসে বলে,

‘আগেও এঁকেছি। আমার ছোট বোন নিয়ামা, ওর জন্য মাঝে মাঝে আঁকতাম। কিন্তু.. ‘

‘কিন্তু কী আপু?’

নিশিতা মুখ গোমড়া করে বললো,

‘নিয়ামা তো এখন আর আমার কাছে আসেনা। একবার যখন এসেছিলো, তখন আমার সাথে কথাও বলেনি। আমাকে কেউ আর ভালোবাসেনা। অপু বলতো,খারাপ মানুষদের কেউ ভালোবাসেনা কথা বলেনা৷ আমিও খারাপ হয়ে গেছি, একদম পঁচা হয়ে গেছি। ‘

মেহতিশা নিশিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। নিশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘তুমি একটুও পঁচা হওনি আপু৷ তুমি খুব ভালো। দেখবে, তুমি একসময় খুব বেশি ভালো থাকবে। আমি তোমার ছোট বোন হয়ে আজীবন পাশে থাকবো, আর কেউ থাকুক আর না থাকুক। ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here