প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-২৬

0
967

“প্রিয় দিও বিরহ”

২৬.

আকাশের মেঘগুলো কমলা রঙে মাখামাখি করে ভেসে বেড়াচ্ছে।
তো কখনো আবার কালো মেঘে পরিবর্তন হচ্ছে। ঘাসের উপর একটা ছোটো মেয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়ে আসছে।
পাশেই সাদা রঙহীন কাপড়ে সুই দিয়ে সেলাই করতে করতে মলিন দৃষ্টিতে একটা গাছের নিচে বসে আছে মেহতিশা। চেহারায় রাজ্যের বিষন্নতা। যেনো পৃথিবীর সকল দুঃখ কষ্ট গুলো তার একার। দর্পণ হেঁটে আসতে আসতে দেখে ছোট বাচ্চা মেয়েটা চঞ্চল পায়ে ছুটে ওর দিকেই আসছে।

কী নির্মল স্নিগ্ধ একটা মুখ! দর্পণ কেমন একটা যেনো অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে পৃথিবীর সবচেয়ে দানবীয় আদরটা করতে। দর্পণ হাসিমুখে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! দর্পণ যতই এগোচ্ছে ততই যেনো পথগুলো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। পথগুলো বিস্তীর্ণ থেকে বিস্তীর্ন হয়ে চলেছে ফেটে চৌচির হলো ধরণীতল। আকাশটাও ঝুম বৃষ্টি দিয়ে শোক প্রকাশ করছে। মেহতিশা দর্পণের দিকে তাকিয়ে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে বললো,

‘খুনী আপনি, আপনাকে আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না!’

কথা বলতে গিয়ে যখন গলা দিয়ে শত চেষ্টার পরও কোনো শব্দ বেরই হলোনা তখন দর্পণ সমস্ত শক্তি জোগাড় করে চিৎকার করে উঠলো। চোখ খুলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে দর্পণ। এ যেনো কোনো ভয়ঙ্কর ফাঁদ থেকে ছুটে আসা। পুরোটাই একটা স্বপ্ন ছিলো তাহলে। দর্পণের শ্বাস এখনো হাপরের মতো উঠানামা করছে। গায়ের শার্টটা ভিজে গেছে ঘেমে। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। দর্পণ বিছানার পাশ হাতরে দেখলো মেহতিশা বিছানায় নেই। বুকটা আবারও কেঁপে উঠলো তার।

দর্পণ গলা বাড়িয়ে মেহতিশাকে ডেকে উঠলো। মেহতিশা নিশিতার ঘরে বসে ওকে খাওয়াচ্ছিলো। হঠাৎ ডাকে দ্রুত ছুটে আসলো। উপর নিচ ছুটাছুটি করলে শ্বাস টেনে টেনে নিতে হয়। তবুও, দর্পণের চিন্তায় দ্রুত এসে পড়লো। দরজা চাপানো ছিলো। ওটা ফাঁকা করে ঘরে এসে দর্পণের পাশে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে নিঃশব্দে জিজ্ঞাসার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতেই দর্পণ অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে মেহতিশার কোমর জড়িয়ে মুখ গুঁজে রাখলো। মেহতিশা চমকালো। কী হলো লোকটার! একটু আগেই অফিস থেকে এসে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

যেহেতু মেহতিশা দর্পণের সঙ্গে গত কয়েক দিন ধরে অতি প্রয়োজনীয় টপিক ছাড়া কথা বলেনা। তাই দর্পণ এটা ওটা নিয়ে প্রচুর জ্বালিয়েছে। যেই ঘুমিয়ে পড়লো, মেহতিশা লুকিয়ে লুকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিলো। এর মধ্যেই কী হলো? মেহতিশা দর্পণের মাথায় হাত রেখে চিন্তিত মুখে বললো,

‘বাজে স্বপ্ন দেখেছেন?’

‘হু। ‘

‘এই সময়ের স্বপ্ন সত্যি হয়না, আপনি আসুন নিচে মালা খাবার বাড়ছে। ‘

দর্পণ ছাড়েনা মেহতিশাকে। বরং আরও দৃঢ় হাতে জড়িয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। মেহতিশাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসায়। কপালে চুমু খেয়ে বলে,

‘নাহ, আপনি কেনো আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন? আমি ভয় পেয়েছি। ‘

মেহতিশা সিরিয়াস মোমেন্টেও হেঁসে ফেললো। এতদিনের রাগগুলো ধুয়ে গেলো একেবারে। হাসতে হাসতে বললো,

‘আপনি কী ছোটো বাচ্চা দর্পণ? এখন কী আপনার ভয় পাওয়ার বয়স আছে! ‘

ছোটো বাচ্চা বলায় দর্পণের স্বপ্নে দেখা বাচ্চাটার কথা মনে পড়লো। সত্যিই কী স্বপ্নটা অর্থহীন! নাকি কোনো বড় ব্যাখ্যা আছে! দর্পণের হাতটা মেহতিশার উদরে বিচরণ করছে। এমন অদ্ভুত আচরণের কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছেনা মেহতিশা। দর্পণ মেহতিশার পেটের উপর মাথা রেখে বললো,

‘মেহু, আমি কালকে হুজুর নিয়ে আসবো। কী যেনো একটা করেনা! ঘর বন্ধ করা। আমি বলে দেবো ঘরে দোয়া কালাম পড়ে ঘর বন্ধক দিতে। এতিমখানায় বাচ্চাদের খাবার খাইয়ে দিবো সঙ্গে। ‘

মেহতিশা চুপচাপ শুনে যায়। বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই ভয়াবহ ভয়টা পেয়েছে বলেই এমন করেছে। সে নিশ্চল কন্ঠে বললো,

‘আর?’

দর্পণ ভাঙা গলায় বলতে থাকলো,

‘বৃদ্ধাশ্রমেও কিছু ডোনেশন দিয়ে দেবো। ‘

‘আর?’

‘রাস্তার মানুষ গুলোকে দুই বেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবো। ‘

‘আর?’

‘আপনাকে ঘরবন্দী করে রাখবো। কোথাও যেতে দেবোনা। ‘

‘আর?’

‘আপনাকে আরও বেশি ভালোবাসবো। ‘

‘তাই? আর যদি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাই! ‘

‘তাহলে আমি খুব খুব কাঁদবো! কেঁদে কেঁদে মরে যাবো। ‘

ওয়াশরুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে দর্পণ।
এই নিয়ে ভয়ে ভয়ে চতুর্থবার দরজায় নক করে বললো,

‘বউজান, তুমি ঠিক আছেন?’

ভেতর থেকে হাত মুখ ধুয়ে বের হলো মেহতিশা। চোখ মুখ লাল হয়ে এসেছে। কিছু খেতে পারছেনা সকাল থেকে। রাতেও দুইবার বমি হয়েছে। ভাতটুকু শেষ হওয়ার আগেই আবার দৌড়ে এসেছে। দর্পণ নক করায় ধমকও খেয়েছে। অযথাই বকা শুনেছে। মেহতিশার মুড সুইং হয় ঘন ঘন। কখনো রাতের দুইটা তিনটায় জেগে হাঁটাহাঁটি করে। আবার, এটা ওটা বানায় খাওয়ার জন্য অথচ, খেতে নিয়ে বলে এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু ভুলেও দর্পণকে কিছু বলেনা। দর্পণের পায়ের কথাটা যবে থেকে জেনেছে, তখন থেকে দর্পণকে ডিস্টার্ব করা বন্ধ করে দিয়েছে। দর্পণ এখন আর ল্যাপটপ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেনা।একটু পরপর জিজ্ঞেস করে, কিছু খাবে?কিছু লাগবে?এনে দেই? একটু খাও! দেখবে ভালো লাগবে।

মেহতিশা তখন প্রতুত্তর করেনা। চুপ করে শুনে যায়। রেগে কখনো দুই তিনটে কথা শোনায়। যেমন, বেইমান লোক, অসভ্য ধোঁকাবাজ, মাথাপাগল ব্যাটা ইত্যাদি। এরও ভেরাইটিস আছে নানাপ্রকার। দর্পণ কিছুক্ষণ মুখ গম্ভীর করে পুরনো চেহারায় চলে যায়। তারপর বউয়ের কাছে পাত্তা না পেয়ে হাসফাস করতে করতে এসে বলে,

‘বউজান, আপনি খুব পাষাণ। একটু ভালো ব্যবহার করলে তোমার কী হয়?’

মেহতিশা আড়চোখে তাকিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

‘কিছু হয়না, তবে আপনার ‘ তুমি, আপনি’ এর ফালুদা বানানো বন্ধ করলে বেশি ভালো হয়!’

‘আমি তো চাই বিশ্বাস করুন বউজান, কিন্তু কীভাবে যেনো দুটো মিক্স করে ফেলি তোমার সামনে। ওহ শিট! আবারও’

এহেন এলোমেলো কথায় হো হো করে হেঁসে উঠলো মেহতিশা। দর্পণের গালগুলো টানতে টানতে লাল বানিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে বললো,

‘হোয়াই সো কিউট!’

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here