প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-২৭

0
960

“প্রিয় দিও বিরহ”

২৭.

নিশীথের অন্ধকারে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দটা বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে।
অস্পর্শে নিভৃতে ভালোবাসা একে দিচ্ছে যেনো বৃষ্টিকন্যারা ধরণীর বুকে। এই তো সেই দিন সবেমাত্র শীত এলো। পিঠেপুলির পার্বণের ধুম লেগেছিলো। কত পদের খাবারের তোড়জোড় শুরু হয়েছিলো। এখন তার রেশ নেই বললেই চলে। শীত বিদায় নিয়ে হালকা হালকা গরম পড়েছে। ঋতুরাজ বসন্তের আগমণ হবে কয়দিনের মধ্যেই। ফাল্গুনী গন্ধে মো মো করবে শহরটা। চমৎকার সাজে সজ্জিত হবে লজ্জায় লাল হয়ে উঠবে।

ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে বিছানায় চোখ বুলিয়ে নিলো মেহতিশা। দর্পণ নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া
সাদা রঙয়ের ছোট কাগজটি বালিশের পাশে নড়েচড়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। এটি সম্পর্কে মেহতিশা অজানা নয়। কারণ রোজই দর্পণ এই কাজটা করে। ব্যতিক্রম হয় সেদিন, যখন দর্পণ ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে। মেহতিশা খেয়াল করেছে দর্পণ খুব সময়সচেতন মানুষ। ঘড়ির কাটাও সবসময় দশ মিনিট ফাস্ট করে চলে। এমন মেইনটেইনিং লাইফ মেহতিশা একমাত্র এনাকেই লিড করতে দেখেছে। মেহতিশা নিজে জীবনেও এত কিছু নিয়ম মেনে করতে পারেনা। তা-ই হয়তো বলে, জীবনসঙ্গী হিসেবে উপরওয়ালা বিপরীতমুখী কাউকে বাছেন। নাহলে, মেহতিশার যে কী হতো! এই ভেবে মুচকি হাসে মেহতিশা। কাগজটা খুলে দেখে রোজকার মতো কিছু উপদেশ বাক্য –

‘মালাকে বলে দিয়েছি, তোমাকে নাস্তা দিয়ে যাবে। দুধটুকু পুরোটা খাবে। সবজিগুলো ফেলবেনা। আমার নয়টায় মিটিং। দশটায় কল করবো। মোবাইল পাশেই আছে। ফ্লোরে ম্যাট্রেস বিছানো আছে। সাবধানে হাত মুখ ধুয়ে এসো। বই পড়ো, গান শোনো কিন্তু লাফালাফি করতে যাবেনা। আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো। ‘

মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সুখগুলো আমাদের জীবনে চিরস্থায়ী কেনো হয়না! কেনো সুখ খনিকের জন্য এসে মায়া বাড়ায়! অনেক হয়েছে। এবার সব মোহমায়া থেকে বের হতে হবে। সত্যটা আড়ালে ৷ কিন্তু খুব বেশি গভীর নয়। একটু নিচে গেলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মেহতিশা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সেই কাজ করবে। ধাঁধার সমাধান করবেই। পথ দুটো, একটা সত্যি জেনে শান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচবে। নাহয়, জালে ফেঁসে অতলে গহ্বরে তলিয়ে যাবে। দেখা যাক কী হয়। মেহতিশা হাত মুখ ধুয়ে আসে। বোরকা পড়ে রেডি হয়ে নেয়। নিকাবটা মুখে পেচিয়ে চোখ মুখ ঢেকে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন হাসি পেলো তার। বোরখা পড়ে ফুলো পেটে কেমন বয়স্ক দেখাচ্ছে বাহির থেকে। যদিও মেহতিশা তেমন মোটা হয়নি। শুধু পেটটাই উঁচু। কিন্তু তবুও কালো রঙচঙহীন বোরকা কখনো পড়া হয়নি। মেহতিশা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। মোবাইলটা ব্যাগে ভরে মনে মনে ভাবে, আমি আপনাকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসি দর্পণ। কিন্তু আমার বাবার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তো আমি অবশ্যই একটা কঠিন পদক্ষেপ নেবো। শতকষ্ট হলেও নেবো।

রুম থেকে বের হয়ে মেহতিশা নিজের শ্বাশুড়ি মা’কে খুঁজলো। তিনি পরম আনন্দে স্টার জলসা দেখছেন। মেহতিশা ধীর পায়ে এসে বাহিরে যাওয়ার পায়তারা করতেই টপকে পড়লো মালা। মেহতিশাকে দেখেই গলা ফাটানো শব্দ করে বললো,

‘আরেএএ ছুডো ভাবিজান! আপনে উঠসেন,আমারে কবেন না? হায়হায়রে! ভাইজান আমারে কয়া গেসিলো আপনার নাস্তা দিতে। কিন্তু, আপনে ঘুমাইতাসেন ভাইবা আমি আর আপনেরে ডিস্টাব করতে যাইনাই। ‘

মেহতিশা ভাবছে,এ তো মহাজ্বালা! মালা মেয়েটা হচ্ছে দর্পণ ভক্ত। সারা বাড়িতে এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি করবে আর দর্পণের অর্ডার মেনে গোয়েন্দাগিরী করবে। দর্পণ যদি বলে, মালা এখনই বনবাসে চলে যা। ওখানে পশুপাখির সঙ্গে সংসার শুরু কর। তাহলে, মালা হেলেদুলে সত্যি সত্যি চলে যাবে। খুব একটা অবাস্তব নয়। দর্পণ মালাকে ফুলবিক্রি করতে দেখে নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে। তার কাজ শুধু মেহতিশার খেয়াল রাখা। কিন্তু মেহতিশা অতিরিক্ত গোয়েন্দাগিরীতে বিরক্ত হয়ে ওকে নিশিতার খেয়াল রাখার জন্য লাগিয়েছে। দর্পণ রোজ মালাকে বলে যায় মেহতিশার খাবার দাবারসহ যাবতীয় সবকিছুর খেয়াল রাখতে। যারপরনাই প্রচুর বিরক্ত মেহতিশা। মালা এখনও একগাল হেঁসে বললো,

‘ছুডো ভাবিজান,আপনে খারান। আমি খাওন সাজাই দিতাছি। আপনি খাইয়া লন। আর বোরখা পইড়া আপনে কই যান?’

মেহতিশা জানতো এই ঈগলচোখী মেয়েটা অবশ্যই এই প্রশ্নটা করবে। মেহতিশা বললো,

‘সারপ্রাইজ দিতে। ‘

‘কারে সারপেরাইজ দিবেন ভাবীজান? ‘

‘তোমার ভাইজানকে! আমি তার অফিসেই তো যাচ্ছি। এখন সে দেখে আমাকে খুব খুশি হবে। তোমার ভাইজান কল করলে বলবে, আমি ঘুমাচ্ছি। খবরদার, বলে দিওনা যেনো কিছু। ‘

মালা ভাবুক গলায় বললো,

‘ভাইজান সারপেরাইজ পাইলে খুশি হইবো?’

‘হ্যারে বাবা। ‘

‘আচ্ছা, তাইলে আপনে যান। কিন্তু নাস্তা? ‘

‘ওহহো! ওটা আমি এসে করে নেবো। বেশি সময় লাগবেনা আমার। মা এখন তো টিভি দেখছে, তাঁকেও কিছু বলার দরকার নেই। ‘

মালা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। মেহতিশা বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। হাফ ছেড়ে বাঁচল একপ্রকার। উফ, এই মালা মানে একটা জ্বালা। সবদিকে নজর রাখে। বয়স খুব কম। পনেরো কিংবা ষোলো হবে। কিন্তু, বুদ্ধি আছে প্রচুর।

মেহতিশা মুখটা পুরোপুরি ঢেকে নিলো। এবার কেউ বুঝতেই পারবেনা, কালো বোরকার আড়ালে মেহতিশা লুকিয়ে আছে। একটা অটোরিকশা ভাড়া করে রওনা হলো মেহতিশা। আধা ঘণ্টা সময় লাগলো পৌঁছাতে। মেহতিশা ভাড়া দিয়ে ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করলো ৷ হ্যা, এটাই সেই ঠিকানা ৷ যেটা মেহতিশা অনেক খুঁজে বের করেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মেহতিশা ভালো করে দেখে চিপা গলিতে প্রবেশ করলো। পঁচা একটা গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠছে। এখানে থাকে কীভাবে মানুষজন? চিপা গলিগুলির একটির ভিতর দিয়ে বস্তিবাসীরা থাকে। টিনের বেড়াজাল দিয়ে তৈরি নিম্নবর্গের বাড়ি। এক বা দুই রুম হবে। তাও কুটিরের মতো। মেহতিশা একটা বাচ্চাকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

‘ফজলু দারোয়ানের বাড়ি কোনটা?’

ছোটো ছেলেমেয়ে গুলো হাত দিয়ে জীর্ণ শীর্ণ একটা বাড়ি দেখিয়ে বললো ওটাই তাঁর বাড়ি। মেহতিশা সেদিকে পা বাড়ালো।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ তুলতেই একটা কম বয়সী মেয়ে বের হয়ে আসলো। পেছন থেকে একটা পুরুষালী শুষ্ক কন্ঠের আওয়াজও পেলো। মেয়েটা মেহতিশাকে দেখে সালাম দিয়ে বললো,

‘আপনি কে?’

‘আমি মেহতিশা। ফজলু মির্জা কী এখানেই থাকেন?’

‘হ্যা, বাবা হন আমার তিনি। ভেতরে আসুন। ‘

মেহতিশা ভেতরে আসে। খুব বেশি জিনিসপত্র নেই। একটা চোকির মতো খাট আর আধভাঙ্গা চেয়ার টেবিল। খাবারের থালা গুলো মেঝেতে রাখা। মেহতিশাকে চেয়ার টেনে বসতে বলে মেয়েটা। সামনেই খাটে শুয়ে আছে কেউ একজন কাঁথা মুড়ি দিয়ে। মেয়েটা ব্যাক্তিটির কাছে গিয়ে বললো,

‘আব্বা ও আব্বা, একজন আসছে আপনার সাথে দেহা করতে। ‘

অপরপক্ষ থেকে বললো,

‘কে আইসে তুলি?’

‘আমি চিনিনা আব্বা, আপনি উঠেন৷ ‘

লোকটি উঠে বসলেন কাঁথা সরিয়ে। মেহতিশা তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। কলিজাটা কেঁপে উঠলো যেনো। কী বিভৎস লাগছে লোকটার মুখ। মুখটা আগুনে পুড়ে থেতলে আছে। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে লোকটি বললেন,

‘ভয় পাইয়ো না মা, কে তুমি কও । ‘

মেহতিশা বুঝে উঠতে পারেনা কী বলা উচিত। অনেক ভেবেচিন্তে বলে,

‘আপনি যদি ফজলু মির্জা হয়ে থাকেন তাহলে ‘ময়ূখ’ কারাখানার পুরনো দারোয়ান আপনিই ছিলেন তাইনা?’

লোকটি ভড়কে গেলেন। কাঁপা গলায় বললেন,

‘কে তুমি? ‘

‘আমি শামীউল্লাহ জামানের মেয়ে মেহতিশা। ‘

তিনি নড়েচড়ে বসেছেন ইতিমধ্যেই। এতক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন,

‘আপনে চইলা যান । পুরানো কিছুই আমি বলতে পারমুনা৷ ‘

মেহতিশা বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই কেউ লোকটাকে চেপে রেখেছে যাতে কাউকে বলতে না পারে। মেহতিশা অনুরোধ করে বলে,

‘দেখুন চাচা, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি কেউ জানবেনা আপনি আমাকে কিছু বললে। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। আপনার আর্থিক সমস্যাও দেখবো। ‘

‘ঠিক আছে, বলেন কী জানবেন?’

মেহতিশা ভাবেনি তিনি এতো দ্রুত রাজি হয়ে যাবেন। উৎসাহীত হয়ে বললো,

‘যেদিন ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছিলো তখন ওখানে কী নতুন কেউ এসেছিলো?’

‘হ্যা, চারজন কর্মকর্তা আর অন্য প্রতিষ্ঠানের মালিক এসেছিলো।’

‘আপনি নাম জানেন সেই প্রতিষ্ঠাতার?’

ফজলু খানিকটা দোনোমোনো করছে। কারণ, তার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটাকে কে দেখবে! এসব ভেবে মেহতিশা বললো,

‘আপনি বলুন চাচা, কেউ জানবেনা। কে ছিলো সে? ‘

‘অনন্য শায়ের। ফায়ারবেটাল ইন্ডাস্ট্রির মালিক। ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
শব্দসংখ্যা-১০৮৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here