প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-২৯

0
923

“প্রিয় দিও বিরহ”

২৯.

শান্ত নৈশব্দিক বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। চারপাশে এক বিন্দু আওয়াজ নেই। পিন ড্রপ অফ সাইলেন্স। কিন্তু, আদৌও কী পরিবেশ এতোটা ঠান্ডা? দর্পণের মুখশ্রী একেবারে স্বাভাবিক।
চোখ মুখে হাসি। অথচ,মেহতিশার চোখ মুখে ভয়াবহ আতঙ্ক। মনে মনে বারবার প্রার্থনা করছে এবারের মতো আল্লাহ বাঁচিয়ে দাও। মেহতিশাকে অবাক করে দর্পণ বলল,

‘তুমি আজকে ডিম খাওনি, তবুও মিথ্যা বললে কেনো? ‘

মেহতিশা বড় বাঁচা বাঁচল। জানটা এতোক্ষণ হাতে চলে এসেছিলো। বড় একটা শ্বাস নিয়ে উপরওয়ালার শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলো,

‘আসলে, মালা ডিম নিয়ে এসেছিলো কিন্তু আমার বমি পাচ্ছিলো বলে খেতে পারিনি। মালা বলল,আপনার কাছে বিচার দিবে তাই আরকি। সরি!’

দর্পণ হাসলো। মেহতিশাকে টেনে পাশে কোলে বসালো। মেহতিশা পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। দর্পণ তার চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,

‘বউজান,এই যে আমি তোমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করছি এটা কী আমার জন্য? তুমি না খেয়ে দেখো কী দূর্বল হয়ে গেছো! সাত মাসে কিন্তু পেট অনেকটাই বেড়ে যায় তোমার কিন্তু তেমন বাড়েনি। তুমি বেশিক্ষণ হাঁটতে পারোনা। দূর্বল হয়ে যাও। ডক্টর কিন্তু বলে দিয়েছে এমন হতে থাকলে তোমার সিজারিয়ান অপারেশন করাতে হবে। নরমালে করালে তোমার কোনো রিস্ক থাকবেনা, সিজারিয়ানে কিন্তু অনেক ভোগান্তি। তাছাড়া অনেক সাইড ইফেক্ট আছে। তুমি এমন কেনো করো? ‘

‘আমি খেতে না পারলে কী করবো! ‘ আহ্লাদী সুরে বলল মেহতিশা।

‘আমি এখন থেকে তোমাকে খাইয়ে দিবো। তাহলে হবে?’

‘খুব হবে! ‘

‘পাগলী আমার! ‘

মোবাইলটা হাতে নিয়ে একের পর এক কল করছে মেহতিশা। কালকে অবিরাম খুনসুটির পর। দুজন অনেকক্ষণ গল্প করেছে। আজকে দর্পণ অফিসে চলে যাওয়ার পর মেহতিশা দরজা বন্ধ করে দিয়ে যতটুকু তথ্য আপাতত জমা আছে ততটুকু দিয়েই কাজ শুরু করে দিলো। প্রথমে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফায়ারবেটাল ইন্ডাস্ট্রির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বের করলো৷ তারপর, সেখানের মালিকের কিছু তথ্য জেনে নিলো। দেখা গেল, ২০১০ এ শুরু হওয়া এই কোম্পানি খুব একটা জনপ্রিয় ছিলোনা। তেমন প্রফিটও মিলছিলোনা। কিন্তু, হঠাৎ করেই আজ থেকে দুই বছর আগে থেকে আগুনের মতো তড়তড় করে লাভ, ডাকনাম সব বেড়ে গেলো। একের পর একে বেস্ট ডিল গুলো এই কোম্পানিই ক্র্যাক করে যাচ্ছে। একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেলো, দর্পণের কোম্পানি বেটার চয়েজ এবং মেহতিশার বাবার কোম্পানি ময়ূখ দু’টোই অনেকগুলো বছর টপে ছিলো কিন্তু, ঠিক দুই বছর ধরে এই দুটোকে পিছে ফেলে টপলিস্টে জায়গা করে নিয়েছে ফায়ারবেটাল। কিন্তু কীভাবে! মাত্র দুই বছরেই কী করে এতোটা ডেভেলপমেন্ট হলো! এর পেছনে কোনো রহস্য নেই তো!
বিরাট একটা খটকা লেগে গেলো মেহতিশার মনে। একের পর এক তথ্য বের করার চেষ্টায় অনড়ভাবে এগিয়ে আসলো মেহতিশা। অনন্য শায়েরের নামে সার্চ করে দেখলো, সেখানে শ্যাম বর্ণের একজন ফ্যাশেনেবল চশমা পরিহিত একজনের ছবি দেখা যাচ্ছে। একটা আরাম চেয়ারে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। একটা পা অন্যটার উপর তুলে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে ছবিটা তুলেছে। মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। স্বাভাবিকও হতে পারে। কিন্তু, মেহতিশার চোখে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র জিনিসও বিশাল লাগছে। ল্যাপটপ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কাগজে লিখে নিলো সে। তারপর অনেকটা সময় পর একটা নাম্বার খুঁজে পেলো। যদিও এটা অনন্য শায়েরের এসিস্ট্যান্টের। হতেই তো পারে, এর মাধ্যমেই অনন্য শায়েরের দেখা পাওয়া সম্ভব! মেহতিশা মোবাইলে নাম্বারটা উঠিয়ে কল করা শুরু করলো। কিন্তু ওকে হতাশ করে দিয়ে বারবার কল কেটে যেতে লাগলো। মেহতিশা পঞ্চম যেইনা অধৈর্য হয়ে নিজেই কল কেটে দিতে নিলো তখনই বিস্মিত করে একজন ছেলে কন্ঠে বলল,

‘হেলো, কে বলছেন?’

মেহতিশার মুখে হাসি ফুটলো। খুশিতে খাটে উঠে লাফাতে ইচ্ছে করলো কিন্তু তা এই মুহূর্তে করা একেবারেই সম্ভব না। মেহতিশা খুশিটা সামলে বলল,

‘মিস্টার অনন্য শায়েরকে পাওয়া যাবে?’

অপরপক্ষ থেকে একটা বিরক্তিসূচক ‘চ’ শব্দ ভেসে আসলো। মনে হচ্ছে মহা ব্যস্ত লোক।

‘পাওয়া যাবে, কিন্তু সবার জন্য নয়। ‘

‘দেখুন, প্লিজ তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই আমি। আপনি কলটা তাঁকে দিন। নাহলে, তাঁর নাম্বারটাই দিন। ‘

‘স্যারের নাম্বারটা বুঝি মগের মুল্লুক পেয়েছেন! যে চাবে তাঁকেই দিয়ে দেবো! আরে কে আপনি?’

‘আমি বেটার চয়েজের মালিক দর্পণ শেখের স্ত্রী মেহতিশা বলছি।’

‘ওহ নতুন প্রধানমন্ত্রী বুঝি? ‘

‘আপনি কী আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছেন?’

‘আপনি বুঝলেন কী করে! ‘

‘প্লিজ, একটু সাহায্য করুন আমার। আমার নাম আর পরিচয় বললেই আপনার স্যার আমাকে চিনবেন। ‘

‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে! আমি বলছি। ‘

অনেকটা বিরক্তি নিয়ে কল কেটে দিলো অমি। গলার টাইটা টেনে ঢিলে করে নিলো। মনে মনে ভাবলো, এসব পাগল আসে কোথা থেকে! দর্পণ শেখের স্ত্রী! কচুও চিনবেনা অনন্য স্যার। দেখা যাক,কথায় কথায় নামটা জিজ্ঞেস করবে। নাহলে, তিনি যে মানুষ!

ডেস্ক থেকে নেক্সট এপয়মেন্টের ডেট ফিক্স করে উঠলো অমি।
তারপর, ছুটলো বসের রুমের দিকে। হাতে কাগজপত্র একগাদা।
ভয়ে ভয়ে দরজায় নক করলো। ভয়ের কিছুই নেই তবুও অমির প্রচুর ভয় লাগে। এ পর্যন্ত স্যার তাঁর সঙ্গে বিন্দুমাত্র কড়া চোখে তাকায়নি তবুও ওই বাজপাখির মতো দৃষ্টি দেখে কাপে থরথর করে সে। মনে হয়, মুখ না মস্তিষ্ক দিয়ে সব কাজ চালায় লোকটা। দরজা খুলে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। কাচুমাচু করে বলল,

‘স্যার, মিস্টার দত্তর ফাইলগুলো রেডি হয়ে গেছে। এখন আপনার সাইন লাগবে। ‘

চোখের চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে অনন্য। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল,

‘দত্ত সাহেব কী এমাউন্টের ব্যাপারে কিছু বললেন?’

‘স্যার, তিনি বললেন ৪০ কোটির উপরে আর এক টাকাও বেশি দিবেন না তিনি। ‘

অনন্য চোখ খুলে ঠোঁট কাপড়ে হাসলো। টেবিলে রাখা হাতগুলো নাচাতে নাচাতে বলল,

‘দত্ত সাহেবের ভালো থাকতে ইচ্ছে করেনা বোধ হয়! ‘

অমি ভড়কে গিয়ে আঁড়চোখে তাকালো। ওর দৃষ্টি দেখে অনন্য স্বশব্দে বলল,

‘ওহ কাম অন, বাই হুক ওর বাই ক্রক কাজ হাসিল করে নিতে শেখো অমি! ষ্টুপিডটি করা কী মানায় দুনিয়ায়! কেউ কারো জন্য এক টাকাও খরচ করেনা মনে রাখবে। ‘

‘জ্বি স্যার! ‘

ফাইলগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,

‘স্যার, ইয়ে মানে একটা কথা ছিলো। ‘

‘বলে ফেলো। ‘

‘একটা মেয়ে ফোন করেছিলো! আপনাকে চাইছিলো। ‘

অনন্য মুখে তুলে তাকিয়ে বলল,

‘সে তো রোজই কতশত করে! নতুন কী? ‘

‘না স্যার, আজকে যিনি কল করেছিলেন তিনি বেটার চয়েজ কোম্পানির মালিকের স্ত্রী বলছিলেন,আর তাঁকে নাকি আপনি চিনবেন। ‘

অনন্য একটা ফাইলে সাক্ষর দিচ্ছিলো। হাতটা থমকে গেলো তাঁর। মনটাও যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে ভেসে গেলো অন্য কোথায়। কলম রেখে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলল,

‘কী বলেছে সে?’

‘উনি বললেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। আর আপনার নাম্বারও চাইছিলেন। ‘

‘দিয়েছো তুমি? ‘

‘না স্যার, আমি বেশ ধমকি-ধামকি দিয়ে না করে দিয়েছি। ‘

বেশ গৌরব নিয়ে কথাটা বলল অমি। কত মেয়েই রোজ কল করে অনন্যের নম্বর চায়। কিন্তু, সবকিছু অমি হ্যান্ডেল করে নেয়।
এতে কেমন যেন একটা আত্মতুষ্টির অনুভূতি পায় সে। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে কত মেয়ে পেছনে ঘুরেছে, হাজার হাজার কল দিয়েছে সবার ইগনোরেন্সই পেয়েছে বেশিরভাগ। এখন, কত মেয়ে কল দেয়! অথচ,সে ঝাড়ি দিয়ে কল কাটে। সেখানেই তো মজা! অমি দাঁত বের করে হাসছে। অনন্যের কী হলো বোঝা গেলোনা। সে গম্ভীর গলায় বলল,

‘মেয়েটাকে কল করো এবং জানাও সে যখন সময় পাবে তখনই চলে আসতে, কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আর আগ বাড়িয়ে পাকনামি করতে কে বলেছে তোমাকে! ‘

অমি হা করে তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম বার এমন কোনো ঘটনা হলো যার আগামাথা বুঝলোইনা সে। থতমত খেয়ে বলল,

‘সত্যি স্যার! ‘

‘কাগজগুলো উঠাও আর বের হও। আই নিড রেস্ট। ‘

অমি হা করেই বের হলো। তারপর ডায়াললিস্ট থেকে নাম্বারটা বের করে মেহতিশাকে কল করে জানিয়ে দিলো। সে যখন পারে তখনই যেনো আসে।

মেহতিশা ইয়াহু বলে চিৎকার করলো। হঠাৎ করেই মনে পড়লো, অনন্য শায়ের এতো দ্রুত কীভাবে রাজি হয়ে গেলো! এটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা! তবে? সে যাই হোক মেহতিশা যতদ্রুত সম্ভব হয় যাবে। দেখা করাটা খুব দরকার!

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
শব্দসংখ্যা-১১১৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here