“প্রিয় দিও বিরহ ”
৩.
কারো মোলায়েম কন্ঠস্বর। কানের পর্দায় মিষ্টি সুর হয়ে বাজছে। মেহতিশা একবার ঘুমের মাঝেই মুচকি হাসে।
অনবরত কারো ডাকে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। চট করে চোখ মেলে তাকাতেই বুক ধক করে ওঠে। ঘুম ডানা ঝাপটা দিয়ে পালায়। কয়েক মুহুর্তের জন্য মোহাবিষ্ট হয়ে মূর্তরূপ ধারণ করে। সামনে উপুর হয়ে আছে দর্পন। মুখে কালকের মতোই মুচকি হাসি বিদ্যমান।
মেহতিশা থমকে গিয়ে ভাবে, আশ্চর্য! কালকের কুৎসিত কথার পরও লোকটা হাসছে! কীভাবে?
মনে মনে কিঞ্চিৎ অনুতপ্ত হয়। রাগের মাথায় কী করে নিজেরও হুঁশ থাকেনা। দর্পন হাসির রেখা বিদ্যমান রেখেই বলে,
‘ঘুম কেমন হলো বউজান? ‘
মেহতিশা তাকায়। কয়েকটিবার পলক ওঠানামা করে ,
মনের কথা মনে রেখে বাহিরে শক্ত হয়ে বলে,
‘সরুন। গাধার মতো ঝুঁকে আছেন কেনো? ‘
দর্পন সোজা হয়ে বসে। গালে হাত রেখে বলে,
‘গাধীটা উঠছিলো না তাই। ‘
মেহতিশা উঠে দাঁড়ায় ততক্ষণে। কাপড় ঠিকঠাক করে ভ্রু কুচকে বলে,
‘এক মিনিট, গাধী কাকে বললেন? ‘
‘গাঁধার বউকে। ‘
মেহতিশা তেড়েফুঁড়ে যায়। মুখ ফুলিয়ে রাগের বহিষ্কার ঘটায়। আঙুল উঁচু করে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
‘খবরদার! একদম ওভারস্মার্ট দেখানোর চেষ্টা করবেন না। কথায় কথায় বউ বলে কী প্রমাণ করতে চান? একদম দূরে দূরে থাকবেন। ‘
‘ঠিক আছে, একদম দূরে দূরে থাকবো। আপনি কাছে এসে পড়লে আবার আমাকে দোষারোপ করবেন না। ‘
‘আমার বয়েই গেলো আপনার কাছে আসতে! ‘
মুখ ঝামটি মেরে দেয় মেহতিশা। হনহনিয়ে চলে যায়। তবে দর্পণকে অতিক্রম করার আগেই হুইলচেয়ারের চাকায় ভারি শাড়ির একাংশ বেঁধে আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পড়ে যায়। দর্পনের হুইলচেয়ার সামনে থাকায় ওটাকেই আঁকড়ে ধরে। দর্পনের কাঁধে এক হাত রেখে তাল সামলায় বহু কষ্টে। দর্পনের কপালের সঙ্গে মেহতিশার কোমল ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে যায়। চমকে তাকাতেই দেখে দর্পণ খিলখিল করে হেসে বলে,
‘প্রথম স্পর্শটা আপনিই দিলেন! কাছে নাকি আসবেন না? ‘
মেহতিশা ভেতরে লজ্জা পেয়েও চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়।
হঠাৎ এভাবে পড়ে যাবে ভাবেনি। অগত্যা মেঘমুখ করে লজ্জা ঢেকে একপ্রকার পা চালিয়ে পালায়।
দর্পণ সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
–
ক্ষুধায় পেট গুনগুন করে গাইছে। খিদে সহ্য হয়না মেহতিশার। অদ্ভুত হলেও সত্যি, মেহতিশা খেতে ভালোবাসে এবং একটু পর পরই খায়। নিজের বাপের বাড়িতে থাকতেও একজন কাজের মহিলাকে পেমেন্ট করা হতো শুধু মাত্র মেহতিশাকে একটু পর পর এটা ওটা বানিয়ে দেয়ার জন্য। ধনী বাবার ঘরে জন্ম হওয়ায় কোনো সমস্যাই হয়নি। বলার আগে, খাবার হাজির, চাওয়ার আগে পোশাক রেডি। এই রেডিমেড জীবনযাপনে অভ্যস্ত মেহতিশা। বিয়েটা যদিও ওর বাবার মতোই বড়লোক ঘরে হয়েছে। কিন্তু নতুন সদ্য বউ তো আর মুখ ফুটে বলতে পারেনা খিদের কথা। তবুও, রাগে দুঃখে মেহতিশার বলতে ইচ্ছে করছে,
‘এইসব ফালতু নিয়ম আমি মানি না, হ্যানত্যান না করে এবার আমাকে খেতে দাও! ‘
বলতে না পেরে খিল মেরে বসে আছে মেহতিশা। বউ ভাতের অনুষ্ঠান চলছে। আত্মীয় স্বজনরা এসে একের পর এক প্রশ্ন করছে। তবে, তার বেশিভাগই প্রশংসা বাকী কিছুটা হিংসা। অন্য আট দশটা মেয়ের মতো তো আর মেহতিশা নয়। রূপে, অর্থে টক্কা দেয়া তো মুশকিল। গুণের দিক থেকে যদিও তা শূন্য। কথায় আছে, মানুষ একদিক না একদিক থেকে কম হবেই। সেটা মেহতিশার গুণ। না পারে রান্নাবান্না, আর না কোনো মেয়েলি কাজ৷ মোটকথা সে সংসারের কাজ কারবারিতে সর্বদাই গোল্লা। কিন্তু ঐ যে, বাহ্যিক সৌন্দর্য! সৃষ্টিকর্তা গুণের খাতা শূন্য রাখলেও রূপের খাতাটায় নম্বর একেবারে দুই হাত ভরে ঢেলে দিয়েছেন। আর সেটার জন্যই মূলত আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে প্রতিবেশী সকলেই খুঁটে খুঁটে দোষ খুঁজে পাচ্ছেনা বিধায় মুখভরে প্রশংসা করে যাচ্ছেন।
পাশে লালিমা শেখ গর্বে ফুলেফেঁপে একাকার। এতোদিন কিছু কিছু মানুষ তাঁকে খোঁচা দিয়ে বলেছিলো, ‘তোমার ছেলেটা তো একেবারেই অচল হয়ে গেলো! এখন একেবারে নিম্নবর্গের মেয়ে ছাড়া বিয়ে দিতে পারবেনা। ‘
এখন সেই কথাটাকে ভুল প্রমাণিত করে পুতুলের মতো অর্থবিত্ত সম্পন্ন বউ পেয়ে তাদের সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছেন। যেমন, তার বড় ননদই একসময় বিদ্রুপ করেছিলো। এখন সুযোগ বুঝে তার জবাবটা দিলেন লালিমা। বড় ননদ সুহাসীনি বউ দেখে নাম টাম জিজ্ঞেস করছিলেন। লালিমা তাকে দেখে বললেন,
‘সুহা, দেখো দেখো, তুমি বলেছিলে না আমার ছেলেটার কপালে নাকি কানা, বয়রা কেউ জুটবে! ভালো করে দেখে নাও, ছেলের বউ কিন্তু সবদিক থেকেই পার্ফেক্ট! ‘
সুহাসীনি নাক কুঁচকে বলেন,
‘শুধু রূপই আছে! নাকি কাজকর্মও পারে! ‘
‘পারে পারে! ‘
সুহাসিনী চলে যান। মেহতিশা অবুঝের মতো এদিকে ওদিকে তাকায়। ক্ষুধায় এখন আর অন্য দিকে ধ্যান নেই। সে শুধু ঢোক গিলে পেটকে বুঝ দিচ্ছে। মেহতিশা ঠোঁট চেপে বসে থাকে। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখায় দূর থেকে কোনো পুতুলই মনে হবে। মেহতিশা তখন মনে মনে কিছু ভাবছিলো, হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ আওয়াজে কেঁপে উঠলো। চারপাশের সবাই চুপ হয়ে গেছে। মেহতিশা বুঝতে না পেরে বসে থাকে হলরুমের বিরাট সোফাটায়। সেদিকেই নিস্তব্ধতা সৃষ্টি করা ব্যাক্তি এগিয়ে আসছে। দর্পণকে আসতে দেখে চমকায় । তবে, বুঝতে পারেনা কেন ওকে দেখে সবাই একসাথে চুপ হলো! দর্পণ একটা জায়গায় হুইলচেয়ার থামায়।
মেহতিশার পিলে চমকে ওঠে। এই প্রথম বার মেহতিশা দর্পণকে ভিন্নরূপে দেখলো। সেই গতকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত যে হাসিটা মুখে লেগেছিল তা এখন নেই।
মুখে দেখা যাচ্ছে, একরাশ গম্ভীরতা ও রাগ। দর্পণ কাকে যেন চিৎকার করে ডাকে, লালিমা শেখ এসে তাড়াতাড়ি করে দাঁড়িয়ে বলেন,
‘কী হয়েছে বাপ? এতো রাগতেসো কেনো? ‘
দর্পণের চোখে মুখে প্রচন্ড ক্রোধ। সে হুংকার ছেড়ে বলে,
‘বউজানকে এখানে কে এনেছে?’
লালিমা শেখ তুতলিয়ে বলেন,
‘কেনো বাপ? আজ বউভাত না! বউ না আনলে মানুষ দেখবে কেমনে? ‘
দর্পণ দাঁত চেপে চেচিয়ে বলল,
‘বউজানের এক্ষুনি ঘরে যাওয়ার ব্যবস্থা করো, এক্ষুনি মানে এক্ষুনি!’
মেহতিশাকে লালিমা শেখ দ্রুত অন্দরে নিয়ে গেলেন। মেহতিশা বুঝতে পারলো, লালিমা শেখ যখন মেহতিশার হাত ধরেছিলো তখন কাঁপছিলেন। পাশে কাজের মহিলাদের মধ্যে কে যেনো বিরবির করে বলছেন,
‘ সর্বনাশ! শেখ মহলে আবারও কোনো লাশ পড়বে! ‘
চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।