প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-৪

0
1303

“প্রিয় দিও বিরহ ”

৪.

কেঁপে ওঠে অন্তরআত্মা। ললাট বেয়ে নামে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা। শুঁকনো ঠোঁটদ্বয় বারংবার জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেয় মেহতিশা। চিন্তায় হাত কচলাতে কচলাতে চামড়ায় শুষ্কতা তৈরি হচ্ছে। তবুও হাত থামছে না। অতিরিক্ত অস্থিরতায় শরীরটাও কাঁপছে।
মেহতিশা বিয়ের রাত থেকে যে দর্পণকে দেখেছে সেটা এই দর্পণ নয়। এরকম হলে তো মেহতিশা যেই কাজে এই বাড়িতে এসেছে তা করা সম্ভব না। মেহতিশা বিছানা ছেড়ে উঠে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। নিজের মোবাইলটা বের করে নিজের বাবাকে কল করে। তিন বার রিং হওয়ার পর রিসিভড হলো। মেহতিশা ভীত গলায় বলে,

‘বাবা, তুমি আমাকে এখানে থেকে নিয়ে যাও! ‘

শামীউল্লাহ জামান চমকে উঠলেন। দুইদিন হলো না বিয়ে হয়েছে। তিনি নরম গলায় বললেন,

‘কী হয়েছে মা? এতো অস্থির হচ্ছো কেনো? ‘

‘বাবা, কালকে ভেবেছি দ্রুত উদ্দেশ্য সফল করে পালিয়ে যাবো। কিন্তু নাহ! দর্পণের আজকের রূপ দেখে আমার ভয় হচ্ছে, আমি ধরা পড়লে না জানি কী হবে! ‘

‘দেখো মা, ভয় পেয়ো না। বাবা তো আছি। তোমাকে যেটা করার জন্য এতো কষ্ট করে বিয়ে করিয়েছি, সেটা শেষ করতেই হবে। তুমি চাও না বলো, সবাই ভালো থাকুক? ‘

মেহতিশা ভাবুক গলায় মলিন স্বরে বলে,

‘চাই বাবা চাই। আমি এটা করলে সবাই ভালো থাকবে সত্যি? ‘

‘হ্যা মা, তুমি তোমার বাবাকে ভরসা করো না? ‘

‘করি বাবা। আচ্ছা ঠিকাছে আমি থাকবো। ‘

‘আচ্ছা মা, সাবধানে থেকো। আর তো মাত্র ছয়টা মাস। তারপর কাজ শেষ হলেই তোমাকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিবো। আর নিজেকে নরম দেখাবেনা একদমই। কাল যেমন ছিলে তেমনই থাকবে৷ আমাকে তুমি ওয়াদা দিয়েছো মনে রেখো। ‘

মেহতিশা কেটে যাওয়া কলটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ শ্বাস। মেহতিশা মনে মনে সেইদিনের কথা ভাবে, যেদিন তার জীবনে হঠাৎ করেই এক কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়। মেহতিশা চোখ বুঁজে ফেলে, চোখে ভেসে ওঠে একটা নির্মম দৃশ্য। জলন্ত আগুন সব ধ্বংস করে দিচ্ছে। লাল ডানা দিয়ে রাক্ষসীর ন্যায় জীবন্ত মানুষগুলোকে খেয়ে ফেলছে।
মেহতিশার দুই চোখ বেয়ে নেমে আসে নোনাজল। ঠোঁট চেপে মেহতিশা বিরবির করে বলে,

‘আর কতদিন নিজেকে আড়ালে রাখবেন দর্পণ শেখ?
একদিন না একদিন তো পতন হবেই। ‘


চুলোয় চায়ের পানি ফুটছে। সামনেই আনাড়ি মেহতিশা দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝতে পারছেনা!
একবার টি টেবিলের দিকে উঁকি দেয়। একগাদা মহিলারা বসে আছে। এরা লালিমা শেখের বাপের বাড়ির আত্মীয়। বিয়ের সময় আসতে পারেনি বলে আজ এসেছে। সেই উপলক্ষে লালিমা শেখ বলেছেন মেহতিশাকে সবার জন্য হাল্কা নাস্তার ব্যবস্থা করতে।
চা সঙ্গে ফুলকপির পাকোড়া। বিপদের ঘড়ি, কপালে ঘোর শনি! অতএব চুলোয় পানি ফুটতে দিয়ে অসহায় দৃষ্টি মেহতিশার। মোবাইলটা কাছে থাকলে এই মুহুর্তে ইউটিউব দেখেই চটপট বানিয়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মোবাইলটা দ্বিতীয় তলায় ঘরে। ড্রইংরুম পেরিয়ে গেলেই প্রশ্ন করা হবে, নাস্তা বানানো শেষ? কচুর শেষ! পানি ফুটতে ফুটতে পাতিল পুড়ে যায় প্রায়। বুঝতে পারেনা মেহতিশা। আন্দাজেই পানিতে প্রথমে চিনি ঢেলে দেয়। তারপর ছয় সাত চামচ চায়ের পাতা ৷ প্রথমে দুই চামচ দিয়ে কম মনে হওয়ায় এতগুলো দিলো সে৷ কিন্তু তারপর পানি লাল রঙের জায়গায় কুচকুচে কালোতে পরিণতি হলো।
ভড়কে গেলো মেহতিশা। এমন তো হওয়ার কথা না। চায়ে অল্প একটু দুধ মেশালো। ওমা! রক্তের মতো দেখা যাচ্ছে! মেহতিশা করুণ চোখে চায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হচ্ছে যেনো চায়ের পাতিলটা ওকে উপহাস করছে। রাগে ফসফস করতে থাকে।
রান্নাঘরের দিকে ধীরে ধীরে হুইলচেয়ার চালিয়ে দর্পণ এলো। অনেকক্ষণ ধরে ঘরে নেই বলেই এসেছে। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে আর পাতিলটা দেখেই বুঝতে পারে দর্পণ। উল্টো পাল্টা কাজ করে বেচারি ফেঁসে গেছে। ঠোঁট টিপে হেসে দর্পণ মৃদুস্বরে বলল,

‘কোনো সমস্যা হয়েছে বউজান? ‘

মেহতিশা ঘুরে তাকায়। দর্পণের সামনে নিজের অসহায়তা প্রকাশ করতে নারাজ সে। তাই নাক ফুলিয়ে বলে,

‘নাহ, কোনো সমস্যা নেই। ‘

‘চা বানাতে পারেন না, এটা বললেই পারেন! ‘

মেহতিশা অহং দেখিয়ে বলে,

‘আমি আপনাকে কিছু বলেছি? আপনি যান তো যান! ঘরে যান।’

দর্পণ মুচকি হেসে বলে,

‘এতোবার জান বললে কীভাবে যাই? ‘

মেহতিশা বেকুবের মতো বলল,

‘আমি কখন জান বললাম! ‘

‘এই যে এইমাত্র বললেন। ‘

মেহতিশা বিরক্তি নিয়ে তাকায়। দর্পণ সেদিকে তোয়াক্কা করে না। চুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘পাতিলটা নামিয়ে ফেলুন পুড়ে যাচ্ছে। ‘

মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাতিল নামায়। দর্পণ আদেশ দেয়ার গলায় বলে,

‘নতুন পাতিল বসান পানি দিয়ে। ‘

মেহতিশা বুঝতে পারলো, দর্পণ ওকে সাহায্য করতে এসেছে। মেহতিশা নিঃশব্দে নতুন পাতিল বসায়। সে জানে, এখন ভাব দেখিয়ে দর্পণকে যেতে বললে নিজেরই বিপদ। সবার সামনে হেয় হতে হবে। পাতিল বসিয়ে দর্পণের দিকে তাকায়। অর্থাৎ, এখন সে কী করবে? দর্পণ হাসিমুখেই গাইড করে মেহতিশাকে। চায়ের মশলা বের করে পাশে রাখে। তারপর ফুলকপি ধুয়ে নিয়ে পিস করে কেটে নেয়। মেহতিশা একদমই কাটতে পারছিলো না বিধায় দর্পণ শান্ত গলায় বলল,

‘ওটা আমাকে দিন। ‘

মেহতিশা প্রশ্নবোধক চাহনি দিলো। হুইলচেয়ারে বসে কীভাবে কাটবে? দর্পণ মুচকি হেসে নিজেই কাটিং বোর্ড নিয়ে নেয়। মেহতিশাকে ইশারা করে সামনের ছোট টুলটা এগিয়ে দিতে। মেহতিশা চুপটি করে এগিয়ে দেয়। দর্পণ বোর্ডের উপর রেখে কাটতে শুরু করে। মেহতিশা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ মেহতিশা টের পায়, সামনে বসে থাকা শ্যামবর্ণীয় মায়াময় পুরুষের মুখটা তার ভীষণ স্নিগ্ধ ঠেকছে।
স্নান করা ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে গুছিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এমন বেয়াদব চিন্তা ভাবনাকে লাথি মেরে বের করে মেহতিশা। চোখ সরায়। চা প্রায় হয়ে এসেছে। এবার সে বুঝতে পেরেছে, কেনো চা হয়নি তখন। মনে মনে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে দর্পণের প্রতি। মস্তিষ্কের কোথাও একটা প্রশ্ন জাগে, এত সুন্দর নিরীহ দেখতে মানুষটা কী আদৌও এতোটা ভালো? নাহ! একটুও না। যে লাখ লাখ মানুষকে কয়েকটা টাকার জন্য মারে সে কীভাবে ভালো মানুষ হয়! ঘৃণায় মুখ কুঁচকে আসে মেহতিশার৷ অন্তঃকরণে সৃষ্টি হয় ক্রোধ।
দর্পণের ফুলকপি কাটা শেষ। সে যত্ন করে বাটতে উঠিয়ে সেগুলো মশলা মেখে দেয়। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এবার শুধু বেসনে ভেজে নিলেই হবে। ‘

মেহতিশা বাটিটা উঠিয়ে নেয়। কিছুটা কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে,

‘আপনি রান্না জানেন কীভাবে? ‘

‘কারণ জানতাম, আমার ফুলনদেবী রান্না পারেনা। তার জন্য আমাকে অবশ্যই রান্না শিখতে হবে। তাই শিখে ফেললাম! ‘

মেহতিশা ভ্রু কুচকে বলল,

‘ফুলনদেবী কে? ‘

দর্পণ দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘আমার গার্লফ্রেন্ড। ‘

মেহতিশা রাগে ফেটে চৌচির, কন্ঠ উঁচু হয়ে যায়,

‘বেহায়া লোক! বিয়ের পর কীসের গার্লফ্রেন্ড? ‘

দর্পণ হাসে কিছু বলেনা। হাতটা টিস্যু দিয়ে মুছে নেয়। হুইলচেয়ার চালিয়ে চলে যায় রান্নাঘর ছেড়ে। মেহতিশা রেগে মুখ ফুলিয়ে ফেলে। গটগট করে ফুলকপি গুলো ভেজে পাকোড়া বানায়। মেহমানদের দিয়ে দুইটা কথা বলে ঘরে চলে যায়। রাগে গা কাঁপছে। যদিও আরেক মনে প্রশ্ন আসে, দর্পণের গার্লফ্রেন্ড থাকলে তার কী! তবুও রাগ কমেনা। মনে মনে ভাবলো, ঘরে এসে সবার আগে দর্পণকে ইচ্ছে মতো ধুয়ে বের করবে, কে ওর গার্লফ্রেন্ড! থাপড়িয়ে কানপট্টি গরম করবে। গার্লফ্রেন্ডকে জুতোপেটা করে দেশছাড়া করবে। প্রেমের ভূত নামাবে। ঘরের দরজা খুলে ঢুকে যায়। রান্নাঘরের গরমে শাড়ির আঁচল সরে যায় কোমর থেকে। এলোমেলো পায়ে এসে ধপ করে দর্পণের পাশে বসে। প্রশ্ন করার জন্য যেই কলারটা টেনে ধরবে, দর্পণ মেহতিশার খুব কাছে চলে আসে। দুই হাতে কোমড় জড়িয়ে উন্মুক্ত কোমরে নাক ঘষে বলে,

‘আমার ফুলনদেবীকে রাগলে ভয়াবহ রকমের সুন্দর লাগে।’

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(শব্দসংখ্যা-১০৩৭)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here