#প্রেমদণ্ড (০২)💚
পরিচিত কন্ঠস্বরের উত্তেজিত আওয়াজে অনুজার নিদ্রা ভঙ্গ হলো। সম্ভবত ড্রয়িং রুম থেকে উচু আওয়াজের কথোপকথন ভেসে আসছে। সদ্য ঘুম ভাঙা তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কার কন্ঠস্বর! কিছুটা চেনা চেনা লাগছে বটে। এর আগেও এমন কন্ঠে কথা শুনেছে সে। অনুজা চোখ বন্ধ করেই ভাবতে লাগল কে! তাৎক্ষণিক মনে পড়ে গেল ইজহানের বড় বোন মুশফিকা নয় তো! উচ্চ আওয়াজের কারণ বুঝতে সময় লাগল না অনুজার। হঠাৎ করে একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় নিশ্চয় তিনি এত উত্তেজিত। অনুজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জীবনটা কয়েক ঘন্টার মধ্যে কেমন অপ্রত্যাশিত ভাবে বদলে গেল।
“হাতির শরীর বানিয়েছিস। এত ওজন কেন তোর? দেখি সর। হাত পা আমার পাউডার হয়ে গেল।”
ইজহানের কথায় অনুজা তরিৎ গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘুম ভাঙার পর নিজেকে উষ্ণতার মাঝে আবিষ্কার করে পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। সে বুঝে উঠতে পারেনি সে আসলে ইজহানের বুকে মাথা ও গায়ের ওপর পা উঠিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। সেসব কথা ভাবতেই লজ্জায় অনুজার সাত আসমান নিচে ধ্বসে পড়তে মন চাইছে। কি ভাবল ইজহান!
অনুজার লজ্জা রাঙা মুখখানা দেখে ইজহান দুষ্টু হেসে পুনরায় বলল, “কি খাস তুই? প্রতিদিন সকালে কয়টা পরোটা খাস? দুপুরে কয় পট ভাত খাস বল তো? আমাকেও তো খেতে হবে। হাতির মত শরীর সহ্য করতে হলে নিজেকেও তো হাতি বানাতে হবে। তাই না? নাহলে তো আমি গুড় গুড় হয়ে যাব তোর ভাড়ে।”
ইশ! কি লজ্জাজনক কথা। ইজহান ভাই এত লাগাম ছাড়া কেন! অনুজা বলে উঠল, “মোটেও আমি হাতি না। পঞ্চম কেজি ওজনে নিশ্চয় কেউ হাতি হয়ে যায় না।”
“মোটেই হ্যাঁ। নিজের ওজন বুঝবি কিভাবে। বুঝব তো আমি! বাই দা মেঠোপথ ঘুম ভালো হয়েছে?”
অনুজা মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। ইজহান লোকটা সাংঘাতিক। সে আগেই জানতো। কিন্তু তার জানা অজানায় আরও নতুন তথ্য যোগ হচ্ছে।
অনুজা ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে শাড়িতে পা বেধে পড়তে নিলে ইজহান পিছন থেকে তড়িঘড়ি করে অনুজার কোমর পেচিয়ে ধরলো। পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলেও হঠাৎ পুরুষালি হাতের স্পর্শে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল অনুজা। ইজহান হয়তো অনুজার অস্বস্তি বুঝতে পেরেছিল। হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “একটু দেখে চলতে পারিস না। পরে গেলে বেড টেবিলের কোণায় লেগে রক্তরক্তি অবস্থা হত।”
অনুজা ইজহানের কথায় কিছুটা স্বাভাবিক হল। কিন্তু পা বাড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করল তার শাড়িটা খুলে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। এবার সে অসহায় দৃষ্টিতে ইজহানের দিকে তাকাল। তা দেখে ইজহান মাথায় হাত রেখে বলল, “নিজেই দেখ মেয়ে মানুষ কত প্যারা দেয়। এজন্যই বিয়ে করতে চাইছিলাম না। শাড়ি কিভাবে খুলল? শাড়িটাও ঠিকভাবে সামলাতে পারিস না। আমার এক ডজন বাচ্চাকাচ্চাকে কে সামলাবে বল তো? আমি তো ভেবেই কোমায় চলে যাচ্ছি।”
অনুজা হতাশ। সে জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়ল সে? মোটে বিয়ে করবে না আবার এখন এক ডজন বাচ্চার স্বপ্ন দেখে।
চিন্তায় ইজহানের কপালে দুটো ভাজ পড়ল। যেন শাড়ি খুলে যাওয়া নিয়ে সে বড়ই চিন্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভাবাভাবির শেষে শুধালো,
“শাড়ি পড়তে পারিস?”
“না।”
ইজহান ইউটিউব ঘেটে শাড়ি পড়ার ভিডিও অন করে অনুজার হাতে দিল। তারপর নিজে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্য পা বাড়াল।
ভিডিও বেশ কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে দেখলেও শাড়িটা পূর্বের ন্যায় ঠিকঠাক পড়তে পারল না অনুজা। হাটতে গিয়ে পায়ে বেধে যাচ্ছে। পা বাড়িয়ে সামনে আগাতে পারছেনা। অনুজা নিজের ভুল বুঝতে পারল না। অতঃপর হতাশ হয়ে বসে রইল। তার জীবন হতাশায় ছেয়ে গিয়েছে। যেখানে যাচ্ছে, যেটাই করছে সবেতেই হতাশা!
ইজহান ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে অনুজাকে বিষণ্ণ বদনে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কি হয়েছে? শাড়ি ঠিকঠাক পড়তে পেরেছিস?”
প্রতিত্তোরে অনুজা বলল, “নাহ্। কোথায় যেন ভুল হচ্ছে। পায়ে বেধে যাচ্ছে হাটতে গেলে।”
ইজহান টাওয়েল দিয়ে ভেজা মুখ মুছে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, “দেখি আম্মাকে পাঠাচ্ছি।”
ফাতিমা বেগম রান্না করছেন। তার পাশে বড় মেয়ে মুশফিকা বসে বকবক করে যাচ্ছে। তার কথার বিষয়বস্তু হলো, একমাত্র মেয়েকে রেখে কিভাবে তারা ছেলের বিয়ে দিতে পারলো? কত শখ ছিল ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে। ফাতিমা বেগম বারবার বুঝিয়েও মুশফিকা’কে থামাতে পারলেন না। তাই হতাশ হয়ে রান্নাবান্নার কাজে মনোযোগ দিলেন।
কিচেনে ইজহানের উপস্থিতি চোখে পড়া মাত্রই হৈ হৈ করে উঠল মুশফিকা। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “এভাবে আমাকে পর করে দিলি তোরা? কত ইচ্ছে ছিল ভাইয়ের বিয়েতে কত সাজগোজ করব। আনন্দ মজা করব। সেসব কিছু তো হলোই না। আরও বিয়ের কথাটা পর্যন্ত আজ সকালে জানলাম। তোরা আমার সাথে প্রতারণা করেছিস। আমার ইচ্ছেতে বালি ঢেলে দিয়েছিস।” মুশফিকার চোখ ভিজে উঠল। সে সত্যি দুঃখ পেয়েছে তার ভাইয়ের অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ বিয়েতে।
ইজহান মুশফিকা’কে কিছুই বোঝাতে গেল না। ফাতিমা বেগমের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল। ফাতিমা বেগম ছেলের অসহায়ত্ত্ব বুঝলেন। মেয়েকে দ্বিতীয়বারের মত সবটা বুঝিয়ে বললেন।
ইজহান ইতস্তত করে বলে উঠল, “আসলে পায়ে বেধে অনুজার শাড়িটা খুলে গিয়েছে। যদি একটু পড়িয়ে দিয়ে আসতে।”
মুশফিকা মুচকি হাসছে। ইজহান যেন আরও লজ্জায় পড়ে গেল।
মুশফিকা বলল, “সে কি রে। আগে বলবি না। দেখি সর। আমি যাচ্ছি। ভাইয়ের বউ দেখব না নাকি? তোদের মত নিষ্ঠুর না। ওর জন্য আসার সময় একটা ছোট্ট চেইন নিয়ে এসেছি।”
বলতে সময় নিলেও উৎফুল্ল চিত্তে অনুজার কাছে যেতে সময় নিল না মুশফিকা। সে একটু আবেগী। কিন্তু মনটা বড্ড সরল। কোন প্যাজগোছ নেই।
মুশফিকা চলে যেতেই ইজহান মন খারাপ করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, “বুবু খুব দুঃখ পেয়েছে তাই না? বাবা কাজটা মোটেও ঠিক করেননি। ভাবার জন্য একটু সময়ও দেননি। লোকের কথায় বাবা কবে থেকে এত কান দিতে শিখলেন আম্মা?”
“আমি নিজেও জানিনা বাবা। এত বুদ্ধিমান একজন মানুষ অবুঝের মত কাজ কিভাবে করলেন আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু বাবা, জীবন হচ্ছে স্রোতের মত। যখন যেদিকে বয়ে চলবে সেদিকেই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। নাহলে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। আমি জানি বিয়ে করার মত মানসিকতা তোদের কারো ই ছিল না। কিন্তু যেটা হয়ে গিয়েছে সেটা তো মেনে নিয়ে মানিয়ে চলতে হবে তাই না?”
ইজহান শুকনো কন্ঠে প্রতিত্তোরে বলল, “জি আম্মা।”
______________________________
“অনুজা?”
মুশফিকার উপস্থিতি এবং কন্ঠস্বরে অনুজা আরেকটু গুটিয়ে নিল নিজেকে। মুশফিকা ধপ করে অনুজার পাশে বসে পড়ল। শুধালো, “তারপর, কেমন আছো বলো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। আপনি?”
“এইতো চলছে আলহামদুলিল্লাহ্। তা এভাবে জড়সড় হয়ে বসে কেন? শাড়ি খুলে গিয়েছে বুঝি! এসো আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
মুশফিকা অনুজাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে বলল, “যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। বেশ বেলা হয়ে গেছে।”
অনুজা নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে গেল। অনুজা যেতেই মুশফিকা বসে রইল না। স্বভাবসুলভ ভাইয়ের অগোছালো বিছানা গুছিয়ে রাখল। ইজহানের এলোমেলো করে করা ড্রেসিং টেবিল সুন্দর করে গুছিয়ে দিল। বেড টেবিলের ওপর রাখা ফুলিদানিটা বেঁকে ছিল। সেটাও সঠিক জায়গায় রেখে দিল। জানালার গ্লাস সরিয়ে পর্দা টানিয়ে দিল। ফ্রেশনার দিয়ে পুরো রুমে স্প্রে করে নিল। ব্যালকনির দরজা খুলে দিতেই আটকে থাকা সকালের তরতাজা রোদ রুমে ঢুকে পড়ল। আলোকিত হয়ে উঠল পুরো রুম।অনুজা ওয়াশরুমে থেকে এস দেখল মুশফিকা একটু একটু করে সব গুছিয়ে রাখছে। অনুজার একটু খারাপ লাগল। তার গুছানো উচিত ছিল। সে এমনিতে খুব গোছানো এবং পরিপাটি স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু নতুন জায়গায় এসে নিজের করণীয় সবকিছু এলোমেলো করে ফেলছে। মুশফিকা’কে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সবে এসে নিশ্চয়ই ননাসকে বলা উচিত হবে না, “আপনি কেন গোছালেন? আমি নিজেই ঠিক করে নিতাম।”
অনুজার অস্বস্তি হয়তো মুশফিকার নজরে পড়ল। মিষ্টি হেসে বলল, “তুমিই তো করবে। আজ আমি করে দিলাম। আস্ত গরু আমার ভাই। পুরো রুমটা অগোছালো, এলোমেলো করে রেখেছে। আমি এলে গুছিয়ে দিয়ে যায়। নাহলে আম্মা অথবা জামিলার মা গুছিয়ে যান। এতবড় ছেলে তার রুম নাকি অন্য কারো গুছিয়ে দিয়ে হয়। কোন কথা হলো?”
মুশফিকা একা একাই কথা বলে যাচ্ছে। অনুজা চুপচাপ শুনছে। মুশফিকার সাথে অনুজার যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল হঠাৎ করে ফাতিমা বেগম মেয়ে এবং নাতনি কে নিয়ে ওদের ফ্লাটে এসে পড়েছিলেন। অনুজা তখন সবে স্কুল থেকে এসে কোনরকম গোসল করে ড্রয়িং রুমে টিভিতে কার্টুন ছেড়ে ভাত নিয়ে বসেছিল। কলিং বেল শব্দে অনুজার ছোটবোন অনিশা গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। ফলে অপ্রত্যাশিত ভাবে অনুজা সেদিন বড্ড লজ্জাজনক অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। আইরিন রহমান বাড়িওয়ালি ও তার মেয়ের আগমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আপ্যায়নে। আর অনুজা লজ্জা ঢাকতে। লজ্জা পাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সে বাসায় পড়া ঢোলা টিশার্ট, প্ল্যাজু পড়া ছিল। সদ্য গোসাল করার কারণে তার কোমর সমান লম্বা চুলগুলো থেকে টুপটাপ পানি পড়ে সোফার কভার ভিজে যাচ্ছিল। সবমিলিয়ে সেদিন সে বাইরের মানুষের সামনে দারুণ লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু মুশফিকা অনুজার অস্বস্তি বুঝে হেসে দিয়ে বলেছিল, “এত অস্বস্তি, লজ্জার কিছু নেই। তোমার বয়সে এমন কত হয়েছে। লজ্জা পেতে হবে না। তুমি আরাম করে খাও। কেমন!”
অপরিচিত মুশফিকার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিল অনুজা। এরপর থেকে মুশফিকা অনুজার মধ্যে ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। মুশফিকা শশুর বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি আসলেই অনুজাকে খুজতো। আর অনুজাও মুশফিকার সঙ্গ উপভোগ করতো। মুশফিকার ছোট মেয়েটাও অনুজাকে খুব পছন্দ করতো।
___________
মুশফিকা লকেটসহ একটা চিকন স্বর্ণের চেইন অনুজার গলায় পড়িয়ে দিয়ে বলল, “বাহ্ সুন্দর লাগছে তো! চল এবার সকালের ব্রেকফাস্ট করে নিই। বেশ বেলা হল তো। ক্ষুদা লেগেছে নিশ্চয়ই!”
অনুজা নিঃশব্দে মুশফিকা’কে অনুসরণ করে চলল।
অনুজার মাথায় বড় করে আচল তুলে দিয়েছে মুশফিকা। হালকা গোলাপি রঙা জামদানি শাড়ি আর গলার চিকন চেইনে অনুজাকে আরেকটু বড় করে তুলেছে ইজহানের চোখে। অনুজার সকালের নতুন রূপে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। অস্বীকার করতে পারল না, তার ষোড়শী দারুণ সুন্দর। কি সুন্দর গলুমলু বার্বি ডলের মত লাগছে। মন চাইছে টপাটপ দু গা’লে দুটো চুমু একে দিই। ইজহান মনের কথায় নিজেই অবাক হয়ে গেল। কি ভাবছিল সে। যাহ্! অনুভূতি গুলোতে লাগাম টানতে হবে। নাহলে যে ঘোর বিপদ!
ইনশাআল্লাহ চলবে…
লেখায়~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
আপনাদের রেসপন্সে আমি হতাশ!
এক মৃগ নয়নার প্রেমে নামের যে গল্পটা দিতে চেয়েছিলেন এটা সেটাই। শুধু নাম পরিবর্তন করে দিয়েছি।💚