#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|চতুর্থ পর্ব|
সকালের হেলানো বাতাসে শরীর হিম শীতল করে তুলে। প্রভাতের প্রথমাংশের বাতাস কিছু মানুষের জন্য আনন্দ বয়ে আনে ঠিক তেমন দুঃখও বয়ে আনে।
ছাদের উপর যেন এক প্রকার ঝড় বইছে। রুপের কাছে এখন মনে হচ্ছে ঝড়ের সাথে সাথে ভূমিকম্পও হচ্ছে। ঝড়ের কারণে রুপের শরীর হিম শীতল হয়ে আসছে। ভূমিকম্পের ফলে রুপের বক্ষঃস্থলের ঠিক বাপ প্বার্শ ধুকপুক করে লাফাচ্ছে।
নাদিফের এখন ইচ্ছে করছে নাদিফের সম্মুখের মেয়েটিকে আচ্ছা মত থাপ্পড়াতে। নাদিফ কিছু একটা ভেবে বুকের উপরে রাখা এক টুকরো রুমাল সরিয়ে নিলো। এক পা দুই পা এগিয়ে এসে রুপের সামনে দাঁড়ালো। নাদিফের ফর্সা বক্ষঃস্থল এখন পুরোপুরি উন্মুক্ত। নাদিফ রুপের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। নাদিফের কাছে আসাতেও রুপের কোন পরিবর্তন হয়নি, আগের ন্যায় হা করে তাকিয়ে নাদিফকে গিলছে।
” কাছে চলে এসেছি। এবার গেলো।”
অতি নিকটে রাগী লোকটার কন্ঠস্বর রুপের কর্ণধারে চলে আসায় রুপের হুঁশ ফিরে আসে। রুপ নাদিফের একদম বক্ষঃস্থলের সমান। রুপের মাথা যদি আরো একটু হেলানো হয় তো নাদিফের ফর্সা বুকে মাথা ঠেকবে। চোখের সামনে ফর্সা বক্ষঃস্থল দেখে রুপ অজ্ঞান হবার উপক্রম। গোলাপি ফ্রেমের চশমার অভ্যন্তরে থাকা মার্বেলের ন্যায় গোল চোখ রুপ এবার শরীরের সমস্ত শক্তি খরচ করে বুজে নেয়। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে নাদিফকে ধাক্কা দিয়ে এক চিৎকার দেয়।
এদিকে নাদিফ যেন রুপের এহেন কান্ডের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ছাদে টবে রাখা ক্যাকটাস গাছের উপর নাদিফের হাত গিয়ে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য নাদিফের কাছে মনে হচ্ছিলো কোন ধারালো অ’স্ত্র হাতে ঢুকেছে। নাদিফ হাতের দিকে খেয়াল না করে ক্ষুব্ধ হয়ে রুপের নিকট আসে। রুপ চোখ খিচে বন্ধ করে রাখে যেন রুপ প্রস্তুত নাদিফের শক্ত হাতে আরো দু’ চারটে থাপ্পড় খাবে।
সকালের রোদের সোনালি কিরণ রুপের মুখের উপর আছড়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে রুপ কি যেন বিড়বিড় করে যাচ্ছে। হলদে ফর্সা রংয়ের রুপ সেই রোদের কিরণে গোলাপি হয়ে যাচ্ছে। রুপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে ঠোঁট। শুষ্ক গোলাপি ঠোঁটে যেন কত বছর হয় কৃত্রিম সাজসজ্জা ছোঁয়া লাগে না। নাদিফ এই প্রথম কোন মেয়েকে খুঁটিয়ে দেখছে। নাদিফ এসেছিলো রুপকে সত্যি সত্যি’ই আরো একটা থাপ্পড় দিতে কিন্তু এখানে এসে রুপের মায়াময়ী রুপে নিজেই বিলীন হয়ে গিয়েছে। নাদিফ অনুভব করছে সকালের এই অল্প রোদে নাদিফ ঘামছে। নাদিফ নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি কোথাও নাদিফ মেয়েদের সংস্পর্শে আসেনি। মেয়েদের দেখলেই বিরক্তি চলে আসে নাদিফের কাছে। নাদিফ ভাবে, মেয়েরা হয় ইমোশনালে ভরপুর। কথায় কথায় নাকে মুখে কান্না করে দেয়। যা নাদিফের একদম অপছন্দ। নাদিফ মাথা হালকা ঝাকিয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয়। রুপের নিকট থেকে কিছুটা দূরে সরে চেয়ারে বসে। আড়চোখে রুপের চেহারা আবারও পর্যবেক্ষণ করে নেয়। রুপ এখনও চোখ বন্ধ করা অবস্থায়। নাদিফ মুখে গাম্ভীর্যভাব টেনে এনে বলে,
” আমার হাত কেঁ’টে সেখানে দাঁড়িয়ে কি করছো মেয়ে?”
রাগী লোকটার কন্ঠস্বর দূর থেকে শোনা যাওয়ায় রুপ চোখ খুলে। নাদিফের হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা র’ক্ত পড়ছে। রুপ আল্লাহ্ বলে চাপা আর্তনাদ করে উঠে।
নাদিফ এবার চরম বিরক্ত। এমন বোকা মেয়ে নাদিফ এই জন্মে দেখেনি। একজন মানুষ ব্যাথা পেলে যে এগিয়ে আসতে হয় তা হয়তো এই মেয়ের অজানা।
” এখনও চোখ দ্বারা আমাকে ধ’র্ষ’ণ করেই যাচ্ছো? কাছে এসো।”
কাছে এসো শুনে রুপ আরো দুই কদম পিছিয়ে গেলো। ছাদের এদিক সেদিক তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো। নাদিফের এখন বিরক্ত, চরম বিরক্ত। রুপকে ধমকে দেয় নাদিফ।
” আমার সাথে প্রেমলীলা করতে ডাকছি না। হাতের ক্ষ’তটায় কাঁটা বিধেছে তা উঠিয়ে দিতে বলেছি।”
রুপ যেন আজ বোবা প্রাণী হয়ে গিয়েছে। কন্ঠনালী হতে কোন স্বর বের হচ্ছে না। এরুপ হয়ে থাকে নাদিফের সামনে রুপের। কাঁপা কাঁপা পায়ে রুপ নাদিফের নিকট আসে। হাত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
” কাঁটা আছে দুইটা।”
এই প্রথম নাদিফ রুপের স্বর শুনে। রুপের কন্ঠস্বর ভাঙা কন্ঠস্বর। হয়তো কথা কম বলে তাই! নাদিফের কানে এই দুইটা শব্দ বারবার বেজে চলছে।
” জমিনে যে রুমাল পড়ে আছে সেটা দিয়ে কাঁটা দুটো উঠিয়ে দাও।”
রুপ ভদ্র বাচ্চার ন্যায় তাই করলো। রুমাল নিয়ে এসে নাদিফের সামনে দাঁড়ালো। চেয়ারে বসা অবস্থায় নিদিফ স্পষ্ট করে রুপকে দেখতে পাচ্ছে। ভয়,লজ্জায় মেয়েটার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চার চোখ দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কাঁটা তুলছে। পরপর দুইটা কাঁটা উঠিয়ে আনায় নাদিফ ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে। এদিকে রুপ নাদিফের আর্তনাদ শুনে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। ভয়ে রুমাল হাতে নিয়ে’ই ভোঁ দৌড়। রুপের চলে যাওয়া দেখে নাদিফ চিৎকার করে বলে উঠে,
” থাপ্পড়ের জন্য প্রতিশোধ নিলে মেয়ে তাই না! আরেকবার তোমাকে হাতের কাছে পাই, আমাকে ব্যাথা দেয়ার জন্য দ্বিগুণ পরিমাণে ফেরত দিবো তোমাকে।”
————–
প্রতিশোধ নেয় কীভাবে তা রুপের জানা নেই। কিন্তু বর্তমানে মনে মনে রুপ বেজায় খুশি রাগী লোকটাকে আঘাত করতে পেরে। সিঁড়ি বেয়ে মুচকি হেসে নামছিলো রুপ। গন্তব্য নতুন বাড়ির নতুন ঘর।
আয়েশা আজাদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন উপরে সিঁড়ি বেয়ে। ছেলের আর্তনাদ যে কানে এসেছে আয়েশা বেগমের।
রুপকে দূর থেকে কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন। ছেলের হবু বুউ হিসেবে বেশ পছন্দ করেছেন। রুপকে ছাঁদ থেকে হাসিমুখে নিচে নামতে দেখে আয়েশা আজাদেরর মনে লাড্ডু ফুঁটে উঠে। বাড়ির মালকিনকে দেখে রুপ বিনম্রতার সহিত সালাম দিলো।
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
রুপকে আয়েশা আজাদের এতটা’ই পছন্দ হয়েছে যে সালমান খানের সিনেমা কিক্ সিনেমার সালমান খানের মায়ের চরিত্রের ড্রামা শাশুড়ির মত রুপকে বউ সাজে কল্পনা করছেন। এদিকে রুপ পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। আয়েশা আজাদ পুরো সিঁড়ি আটকে রুপকে দেখে যাচ্ছে। যার দরুন রুপ নিচে আগাতে পারছে না।
” আন্টি আপনার ঘরে মশা ঢুকেছে।”
রুপ মশা মুখে বলেছে না ঘরে বলেছে তা না শুনে আয়েশা আজাদ ওয়াক ওয়াক করা শুরু করে দেয়। আয়েশা আজাদ ভেবেছে মশা হয়তো মুখে ঢুকেছে। এদিকে আজাদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী যে একই প্রকৃতির মানুষ তা বুঝে এসেছে রুপের। তাইতো এই কথা বলা! আয়েশা আজাদ রুপের মুখে এত হাত রেখে বলে,
” মাশাআল্লাহ! কি নাম তোমার?”
রুপের মিষ্টি উওর,
” রিনিঝিনি রুপ।”
আয়েশা আজাদ আরো কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু রুপকে উনার এত’ই পছন্দ হয়েছে যে ইমোশনাল হয়ে কন্ঠনালী থেকে স্বর বের হচ্ছে না। এক প্রকার লাজুক হেসে রুপের সামনে থেকে প্রস্থান নিলেন।
——–
সময় এখন মধ্যাহ্নভোজের। প্রেম নীড়ে আজ বাহারি খাবারে ভরপুর। আজাদ সাহেব কিছুক্ষণ পর পর রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন খাবারের সুগন্ধি পেয়ে। পরপর আয়েশা আজাদের চোখ রাঙানি দেখে ভয়ে আবার চলেও যাচ্ছেন আজাদ সাহেব। নাদিফ, নাবিল আজ বাসায়। ফাহিমা মুখ ফুলিয়ে কাজ করছে। অন্য সময় হলে দেখা যেতো কথা বলে বলে শাশুড়ির মাথা খাচ্ছে কিন্তু আজ নীরব। ফাহিমার নীরবতাটা আয়েশা আজাদকে ভীষণ ভাবাচ্ছে।
” ঐ বেটি, মুখে কি আজ আঠা দিয়ে রেখেছিস? কথা বলছিস না কেন?”
ফাহিমা যেন শাশুড়ির আগে বাড়িয়ে কথা বলার জন্য অপেক্ষায় ছিলো। আয়েশা আজাদের কথা শেষ হতেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে দেয়।
” কান্না করছিস কেন? নাবিল কি বকেছে? আমাকে একবার বল নাবিলের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবো।”
ফাহিমার কান্না শুনে আজাদ সাহেবও দৌঁড়ে আসেন। আদরের বউমার চোখে পানি দেখে আয়েশা আজাদকে বকে দেন,
” ললিতা, কেন বকছো মেয়েটাকে। প্রেম নীড়ে শুধু ভালোবাসা থাকবে কান্না নয়। তুমি কি জল্লাদ শাশুড়ি সাজতে শুরু করেছো? সোনা ময়না জাদুর পাখি! ঐসব চিন্তা বাদ দাও। ভালো শাশুড়ি হয়ে যাও।”
আয়েশা আজাদ হতভম্ব। তাঁর স্বামী কোন কথাকে কোথায় নিয়ে গেলেন তা ভাবছে।
” কি বললে! আমি কখন বকলাম? পারো তো শুধু আমার পিছনে লাগতে। তুমি মনে হয় সাধু!”
এদিকে ফাহিমার কান্নার কথা যেন দুজন ভুলে গিয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। শ্বশুর শাশুড়ির ঝগড়া দেখে ফাহিমা আরো জোরে কান্না করতে থাকে।
” আমি কান্না করছি, আমাকে দেখো। ঝগড়া করো না তোমরা।”
ফাহিমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো দুজন। আজাদ সাহেব এবার নরম স্বরে প্রশ্ন করলেন,
” কেন কাঁদছো মা! কেউ কিছু বলেছে? বলো আমাকে একবার! তাঁর মাথা আজ’ই টাক করে ফেলবো।”
শ্বশুরের কথায় ফাহিমা পিটপিট চোখ করে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে শ্বশুরের উদ্দেশ্যে বলল,
” আগে টাক হয়ে আসো বাবা। তারপর বলবো।”
আজাদ সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। বিস্ময়করদৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের বউয়ের পানে।
” আমি টাক হয়ে আসবো। মানে আমি তোমাকে কিছু বলেছি? কিন্তু কখন? কোথায়?”
ফাহিমা এবার ছলছল চোখে শ্বশুরকে বলল,
” তুমি না গতকাল রাতে বললে, আমি পোয়াতি। কিন্তু আমি তো পোয়াতি না! তারমানে তোমাদের ছেলে আরো একটা বিয়ে করেছে আমার আড়ালে আর তা তোমাদের জানা। আমি এই কষ্টে কান্না করছি।”
আয়েশা বেগম খুন্তি হাতে ফাহিমার দিকে তেড়ে আসলেন। কিন্তু মারলেন না বরঞ্চ মাথায় গাট্টি ভিরে বললেন,
” ওরে গাঁধী রে! তোর শ্বশুরের মাথায় যে পোকা ধরেছে তা তুই জানিস না? ফোনে নিজেকে বাচানোর জন্য কাকে না কাকে মিথ্যা বলেছে। আর তুই সেটা ভেবেই! ইয়া আল্লাহ! আমি কোথায় আছি!”
আজাদ সাহেব বিড়ালের ন্যায় চুপসে গেলো। মিনমিন করে বলল,
” খিদে পেয়েছে। খাবার আনো বউমা।”
———
খাবার টেবিলে রুপ মলিন মুখ করে বসে আছে। এদিকে রাইসার মুখে আনন্দের হাসি। চোখের সামনে এত এত সুস্বাদু খাবার দেখে গাপুস গুপুস করে এক নিমিষে সব খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রুপ এবং রাইসাকে এক প্রকার জোর করে আয়েশা আজাদ খাবার টেবিলে নিয়ে আসেন। স্বল্প পয়সায় এই বাড়িতে থাকছে এই ব্যাপারটা রুপের অন্তরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এখন আবার খাবার! রুপ বিনা পয়সায় বিলাসিতা করতে ইচ্ছুক না।
নাবিল, ফাহিমা একসাথে নিচে নেমে আসে। ফাহিমার মুখ থেকে নতুন দুই মেয়ের কথা শুনেছে নাবিল। নাবিলের মেয়েদের নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। খাবারের টেবিলে এসে বসে পড়েন।
আজাদ সাহেব রুপকে খাবারের টেবিলে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। হবু ছেলের বউয়ের পাশে বসে খোশ গল্প করবেন বলে ইচ্ছে পোষণ করলেন। খাবারের টেবিলের চেয়ার টেনে হাসিমুখে রুপকে কিছু বলবেন তাঁর আগেই ঝড়ের বেগে কোথায় থেকে নাদিফ চেয়ারে বসে পড়লো।
ছেলের কান্ডে আজাদ সাহেবের মুণ্ডু আক্কেল গুরুম। মুখ ফসকে আজাদ সাহেব বলে ফেলল,
” এটা কি হলো?”
নাদিফ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
” তোমার বউ ঐখানে বসেছে, এখানে না। যাও নিজের বউয়ের পাশে গিয়ে বসো।”
চলবে………..
ছবিটি আমার প্রাণ প্রিয় প্রকাশক ভাই Fahim Mahmud Adi উপহার দিয়েছেন।