প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-১২

0
801

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১২.

কাধে গিটারের ব্যাগ নিয়ে খোলা চুলগুলো সিড়ি নাড়াচাড়া করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামছিলো ইচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে বসে ওকে দেখেই তিক্ততায় ভরে উঠলো নাফিজা বেগমের ভেতরটা। মেয়েটা তেমন আহামরি সাজগোজ করে না কখনোই। করার ইচ্ছে নেই ওর। টপস্,জিনস্,হাইহিল,খোলাচুল,চোকার সাজগোজ বলতে এ অবদিই। তারপরও এ মেয়ের মতো রুপবতী খুব কম মেয়েই দেখেছেন নাফিজা বেগম । মা মারা যাবার পর থেকে ইচ্ছে কোনোদিন নিজেকে নিয়ে ভেবেছে কিনা সন্দেহ আছে। তারপরও বাইরে থেকে দেখে মনে হবে সে তার দুনিয়াতেই মগ্ন। হয়তো এই কঠোরতাই ওকে টিকিয়ে রেখেছে পৃথিবীতে। নওশাদ সাহেব মেয়েকে বেরোতে দেখে বললেন,

-খেয়ে বেরোও ইচ্ছে?

ইচ্ছে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। তারপর চোখ বুলালো ডাইনিংয়ে থাকা হরেকরকমের খাবারের দিকে। নাফিজা বেগমের দিকে তাকিয়ে ঠোট টিপে হেসে বললো,

-খাবো এস এম?

-আমাকে জিজ্ঞাসা কেনো করছো ইচ্ছে? এটা তো তোমারই বাসা। না খেয়ে কেনো বেরোবে তুমি? এসো? ব্রেকফাস্ট করে বেরোও?

নাকটা ডলে হাসি আটকালো ইচ্ছে। বাবার সামনে এই মহিলার নাটক দেখলে খুব হাসি পায় ওর। নওশাদ সাহেব বললেন,

-ইচ্ছে? এসো? একসাথে ব্রেকফাস্ট করি আজ আমরা?

ইচ্ছে একটা জোরে শ্বাস ছাড়লো। তারপর কাধের সাইডব্যাগটা থেকে ফোন বের করে কাউকে কল‌ লাগিয়ে বললো,

-রেস্ট্রুরেন্টে দেখা করছি। ব্রেকফাস্ট ওখানেই করবো। আই’ল সেন্ড ইউ দ্যা লোকেশন।

নওশাদ সাহেব বিস্ময়ে বললেন,

-তোমাকে খেয়ে যেতে বললাম ইচ্ছে। আর তুমি রেস্ট্রুরেন্টে কারো সাথে মিট করার কথা বলছো?

ইচ্ছে নাফিজা বেগমের দিকে তাকালো। এই মহিলাকে নাটক করার জন্য সুযোগ করে দিতে বেশ মজা পায় ও। বাবার চোখে ঠিক কতোটা নিচ করতে পারে ওকে,সেটা দেখতেও ওর মজা লাগে। তবে এতোসবের মধ্যেও নওশাদ সাহেব উভয়পক্ষকে সামলে কিভাবে চলেন,সেটাও ওর কাছে আশ্চর্যের বিষয়। ও তো মনেপ্রানে চায় এ বাসা থেকে চলে যেতে। শুধু নওশাদ সাহেবের অনুরোধের জন্যই রয়ে গেছে। টমি দৌড়ে এসে ইচ্ছের পা ঘেষতে শুরু করেছে। ওকে কোলে নিয়ে একটু আদর করে দিলো ইচ্ছে। বাবার দিকে ফিরে বললো,

-টমিকে রাতে খাইয়েছো। ও সকালে খেয়েছে কিনা,খাবে কিনা,সেই খোজ নেওয়া তোমাকে মানায় বাবা। আমি রাতে খেলাম কি খেলাম না সে খোজ না নিয়ে,সকালে ব্রেকফাস্ট করার জন্য জোরাজুরি করা তোমাকে মানাচ্ছে না। আসছি।

ইচ্ছে বেরিয়ে গেলো। বিমুঢ় হয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন নওশাদ সাহেব। কিসের সাথে নিজেকে তুলনা করে গেলো ইচ্ছে? অবশ্য ভুল কিছু বলে গেলো কি? সত্যিই তো! নিজের একমাত্র মেয়ের প্রতি কোন দায়িত্বটা পালন করতে পেরেছেন উনি? না ইচ্ছে সুযোগ দিয়েছে,না উনি কখনো সামলাতে পেরেছেন। নাফিজা বেগম পাশ থেকে বলে উঠলেন,

-ইচ্ছে তো কোনোদিনও আমাকে বোঝে নি নওশাদ। জানিনা তোমার প্রতি কিসের এতো অভিযোগ ওর। বাবার আদর পেয়েও তাকে উপেক্ষা করছে। আর ওদিকে আমার মেয়েটা…

নাফিজা বেগম শক্ত হয়ে বসে। টপটপ করে পানি ঝরছে তার চোখ থেকে। নওশাদ সাহেবের অসহায়বোধ বরাবরের মতো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো।
বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলো ইচ্ছে। ড্রাইভ শুরু করে চেয়েছিলো রাকীনকে কল করবে। তার আগেই ফোন বেজে উঠলো ওর। নম্বরটা রাকার। কানে গোজা ব্লুটুথে কল রিসিভ করলো ইচ্ছে। ওপাশ থেকে রাকা বললো,

-ঘুম থেকে এক্সাক্টলি কয়টায় উঠিস তুই ইচ্ছে? এই মোবাইল ফ্লাইট মোড ঠিক কয়টায় নেটওয়ার্ক কভারেজ এরিয়ায় ল্যান্ড করে রে?

ইচ্ছে হাসলো। বললো,

-কি বলবি বল।

-কোথায় তুই?

-সবে বেরিয়েছি বাসা থেকে।

-কোথাও যাচ্ছিস?

-হুম। মিউজিক একাডেমিতে।

-ওখানে কেনো?

-কিছু সার্টিফিকেটস্ কালেক্ট করার আছে। আর একটা ওপেন কনসার্টও আছে। ওখানে পার্টিসিপেট করবো ভাবছি।

রাকা বিরক্তি নিয়ে বললো,

-ওপেন কনসার্ট? তুই ওপেন কনসার্টে গাইবি?

-কেনো? কোনো সমস্যা?

-তোকে হায়ার করবে বলে অর্গানাইজেশনস্ চেকবুক সাইন করে বসে আছে ইচ্ছে। ওরা তো তোকেই এমাউন্ট বসিয়ে নিতে বলে। আর তুই‌ কিনা যাচ্ছিস ওপেন কনসার্টে গাইতে? যেখানে গানের গ না জানা সাধারন জনগন গাইবে,সেখানে? লাইক সিরিয়াসলি?

ইচ্ছে মুচকি হেসে বললো,

-আমি টাকার জন্য গাই না রাকা। আমি মানুষকে আনন্দ দেবো বলে গাই। ওপেন কনসার্টগুলোতে আমজনতা যতোটা গাওয়া নিয়ে এক্সাইটেড থাকে,তেমনি শোনার জন্যও এক্সাইটেড থাকে। এমন শ্রোতাদের সা‌মনে হুট করে স্টেজে উঠে সারপ্রাইজ দেওয়াই যায়।

মুগ্ধতা নিয়ে রাকা চুপ রইলো কিছুক্ষন। ওর আগেই বোঝা উচিত ছিলো,ইচ্ছে সবার চেয়ে আলাদা। মুখে বললো,

-কনসার্টটা কোথায়?

-ড্রাইভ করছি। পৌছে টেক্সট করছি তোকে। কেমন?

হুম বলে ফোন কাটলো রাকা। একটা ছোট শ্বাস ফেলে পাশে দাড়ানো মানুষদুটোর দিকে তাকালো। একপা উচিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুহাত প্যান্টের পকেটে গুজে প্রাপ্ত দাড়িয়ে। আর মাহীম সুন্দরমতো ডাইনিংয়ে বসে আপেল কামড়াচ্ছে। ঘন্টাখানেক আগে ওর বাসায় পৌছে গেছে এরা দুজন। প্রাপ্তকে দেখে রাকা আর ওর মা দুজনেই কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে। প্রাপ্ত কথা না বাড়িয়ে রাকাকে বলে ইচ্ছেকে কল করে ওর আজকের‌ শিডিউল জানতে। ঘন্টাভর তাই ইচ্ছেকে কল করছিলো রাকা। কল রিসিভ করে লাউডে ছিলো ইচ্ছে। পুরো কথা শুনে প্রাপ্ত সোজা হয়ে দাড়ালো। রাকা নড়েচড়ে বসলো। এই মানুষটার এমন আচরন তার আচরনবিরুদ্ধ। তার উপর বিষয়টা ইচ্ছে। যে কিনা তাকে দু দুটো চড় মেরেছিলো। ভয়টা বেড়েছে রাকার। প্রশ্নগুলোও গলায় দলা পাকিয়ে গেছে। প্রাপ্ত বললো,

-কনসার্ট কোথায় হচ্ছে ম্যাসেজ পাওয়া মাত্রই আমাকে জানাবে। ওকে?

রাকা অতিদ্রুত মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বুঝালো। প্রাপ্ত বললো,

-আমি তোমার এখানে এসেছি,এটা কে কে‌ জানবে রাকা?

-এক আল্লাহ্ আর আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ না প্রাপ্ত ভাইয়া!

তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো রাকা। প্রাপ্ত এগিয়ে টি টেবিলে রাখা রাকার মোবাইলটা নিয়ে কিছু একটা করলো। ডাইনিং টেবিলের পাশে থমথমে হয়ে দাড়িয়ে আছে রাকার মা। প্রাপ্ত গিয়ে টেবিলে সাজানো ফলগুলো থেকে একটা আপেল হাতে তুলে নিলো। রাকার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-অসময়ে অজ্ঞাতচরে অনাত্মীয়ের আগমনে বিব্রতবোধ করেছেন নিশ্চয়ই? আত্মরিকভাবে দুঃখিত। পরবর্তীতে সময় করে,জানিয়ে,আত্মীয়বেশে আসার চেষ্টা করবো। গুড ডে আন্টি।

কথা‌ শেষ করে প্রাপ্ত ইশারা করলো মাহীমকে। মাহীম বললো,

-আপনার হাতে কাটা আপেল খুব টেস্টি ছিলো আন্টি। আসছি। ভালো থাকবেন।

দুজনে নির্বিকারচিত্ত্বে বেরিয়ে গেলো। অগ্নিচক্ষু করে রাকার দিকে তাকালো ওর মা। চোখ দিয়েই তার উচ্চস্বর ঝরছে। এরা আবার আসবে এ বাসায়? তারচেয়ে বড় কথা,এই ছেলে আত্মীয়বেশ ধরবে কি করে? একই প্রশ্নে রাকা নিজেও হতভম্ব। প্রাপ্তর আত্মীয়বেশ মানে?

বেলা গরাতে শুরু করেছে। আর তার অনুপাতে গাছপালার ছায়া বাড়তে শুরু করেছে চক্রবৃদ্ধি হারে। বেলাশেষে ভ্যাপসা গরম‌ে ক্লান্তদেহ নিয়ে ধুকতে ব্যস্ত সবাই। সেখানে খই আর পুঁটি উঠোনে দাগ কেটে দমছুট খেলছে অতি আনন্দে। সাহেরা গেছে কাছারীবাড়িতে। রাতের রান্না করে দিতে। খেলতে খেলতে পুঁটি বলে উঠলো,

-ও বুবু? জানো? কাছারিবাড়ির পশ্চিমের পুকুরডার ধারে যে গাব গাছডা আছে না? আয়হায় ওই গাছের গাব তো পাইকা হলুদ হইয়া আছে! তুমি ওহনো দেহো নাই ওইগুলান?

খই ভাঙা পোড়ামাটির টুকরো দিয়ে মাটিতে দাগ কাটছিলো খুশিমনে। পুঁটির পা পরেছিলো দাগে। মানে ওর খেলা কাটা যাবে একবার। ওর সে খুশিটা সইলো না পুঁটির। মনে করিয়ে দিলো বাড়ির বাইরের কথা। ওর কথায় খই গাল ফুলিয়ে তাকালো ওর দিকে। বললো,

-মায়ে আমারে কাছাড়িবাড়ি যাইতে বারন করছে। শুনোছ নাই তুই?

-হ! শুনছি তো! আর বুঝছিও! এল্লাইগাই গাবগুলান ওহনো গাছে আছে। তোমার আঁচলার গোছায় না! ভাবতাছি আইজা আমি পর খুশবু মিল্লা যামুনে। যা স্বাদ একেকটা বিচির! আহ্!

তৃপ্তির স্বর তুললো পুঁটি। খই রাগে উঠে দাড়িয়ে গেলো। বললো,

-যাইবি যা! আমারে শুনাস ক্যান?

-ওমা! তোমারে না কইলে কেমনে চলবো? ওই গাছ কাছাড়িবাড়ির কম,তোমারি তো আগে! তো তোমার অনুমতি নেওন লাগবো না? তয় তুমি অনুমতি না দিলেও আমি যায়ুম। সবগুলা ফল আইনা ঘরে তুলুম। কাচাগুলান গুড়ায় মজায়া হলুদ বানামু। তারপর ওগুলান নিয়া…

-পুঁটি! থাম কইলাম!

খই হাতে থাকা মাটির খোপড়া রাগ নিয়ে ঢিল ছুড়লো মাটিতে। কয়েকটুকরো হয়ে গেলো ওটা।পুঁটি যেনো পৈশাচিক আনন্দ পেলো। খইকে আরো খেপিয়ে দিতে দাত কেলিয়ে বললো,

-ও গাছের গাবগুলান এ বছর বুঝি তোমার জিবে জুটলো না গো বুবু। ইশ্ কি…

খই ধাক্কা মেরে পুঁটিকে মাটিতে ফেলে দিলো। ধুলোতে মাখোমাখো হয়ে গেছে পুঁটির সারা শরীর। রাগে কাপতে কাপতে খই বললো,

-ওই গাছের সব গাব আমার! শুইনা রাখ! তর আর খুশবুর আগে যাইয়া যদি সব ফল পাইড়া না আনি,আমিও খই না!

আঁচল কোমড়ে গুজে দিয়ে হনহনিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো খই। মায়ের ভয়ে সড়কপথে না গিয়ে আলপথ ধরে সোজা পৌছালো কাছাড়িবাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে।
আশপাশ তাকিয়ে দুচারটে গরুচড়ানো রাখাল ছাড়া তেমন কাউকেই দেখতে পেলো না ও। গাছের নিচেরডাল ধরে লাফিয়ে সবে একডালে চড়েছে,নিচ থেকে বিনুনিতে টান পরলো ওর। সবেই তো দেখলো কেউ নেই,হঠাৎ করে ওর বিনুনি টানবে কে? প্রশ্নের উত্তরের খোজে ঘাড় নামিয়ে নিচে তাকাতেই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম খইয়ের। ওর বিনুনি একহাতের আঙুলে পেঁচিয়ে আরেকহাতে মোবাইল স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত মানুষটা অন্য কেউ নয়,আগেররাতে ওর কাছে জ্বী’ন সম্বোধন পাওয়া সে মানুষটা। রাকীন!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here