#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
১৮.
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। প্রাপ্ত ডাইনিং টেবিলে বসে বসে কাটা চামচে নুডুলস্ প্যাঁচাচ্ছে। স্বেচ্ছায় বানালেও এখন একদমই খেতে ইচ্ছে করছে না ওর। আজ সারাদিন বাসায়ই কেটেছে। সাদিক সাহেব সকালে যখন ফোন করে জানিয়েছেন ফেরার কথা, প্রাপ্ত আর বেরোয়ই নি বাসার বাইরে। বাবা যখনতখন চলে আসবে এমন ভেবে। পিয়ালী নিজেও এতোক্ষন ড্রয়িংরুমে ছিলো। বাবার আগমনী সংবাদ শুনে ইচ্ছেকে সরি থ্যাংকস্ বলা নিয়ে কথা তোলার কথা আর মনেই হয়নি ওর। তবে দুজনের যেনো একপ্রকার নিরব প্রতিযোগীতা ছিলো। কে আগে বাবাকে দেখে, বাবা কার মুখ আগে দেখে। প্রাপ্তর ধমক শুনে সবে গিয়ে পড়তে বসেছে ও। ডোরবেল বাজতেই খুশিমনে উঠে দাড়ালো প্রাপ্ত। কিন্তু ততোক্ষনে ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়েছে পিয়ালী। দরজা খুলে বাইরে সাদিক সাহেবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
-এসেছো? আজকে আমি ফার্স্ট! যাকগে! কেমন আছো বাবা? তোমার থেসিস কমপ্লিট?
বোনের পাগলামী দেখে প্রাপ্ত মুচকি হাসলো। সাদিক সাহেব নিরবে ভেতরে ঢুকলেন। তার নিরবতায় কপাল কুচকে এলো প্রাপ্ত পিয়ালী দুজনেরই। পিয়ালী পাশ ফিরে দরজা লাগাতে যাবে, বাইরে দাড়ানো মেয়েটাকে দেখে বিস্ময়ে বললো,
-ভাবি?
প্রাপ্তর কুচকানো কপাল আরো কুচকে এলো। এ অসময়ে এলাকার কোন ভাবি বাসায় আসবে মাথায় ঢুকলো না ওর। সাদিক সাহেব পেছন ফিরে বললেন,
-ভেতরে এসো।
রোবটের মতো মাথা নিচু রেখে খই ভেতরে ঢুকলো। একধ্যানে সেভাবেই নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো যেভাবে পুরোটা পথ এসেছে ও। জ্ঞান ফেরার পর যখন কোনো মেয়ে শুনবে তার মায়ের দাফন শেষ, আশেপাশে কে আছে, কি আছে কিছুতেই আগ্রহ থাকার কথা না তার। তেমনি খই এখন যেনো যন্ত্রমানবী। শুধু সাদিক সাহেবের কন্ঠনিঃসৃত শব্দে সে যন্ত্রমানবীকে চালনা করা হচ্ছে। যেমনটা ওর মা বলে গেছে। যেমনটা পঞ্চায়েত ওর জন্য নির্ধারন করে দিয়েছে। চারপাশজুড়ে ঘূর্নিঝড় বয়ে গেলেও তা টেরটি পাবে না হয়তো।
প্রাপ্ত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো খইয়ের দিকে। শ্যামবর্নের মেয়েটি অল্পবয়স্ক। পরনে কাপড় প্যাঁচিয়ে কোমড়ে গিট দেওয়া। কোথাওকোথাও কাদাও লেগে আছে। গলায় ধানতাবিজ, নাকে ছোট নথ। চুলগুলো ফিতা দিয়ে বিনুনি করা। কয়েকভাজে ছোট করে ঘাড়ের উপর আটকানো। বেশভুষাতেই পরিচয়, মেয়েটা গ্রামের কেউ। আর যার সবটা ওর কল্পনার সেই প্রতিচ্ছবির সাথে মিলে যায়। সাদিক সাহেব বললেন,
-ও খই। আজ থেকে ও এখানেই থাকবে।
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
প্রাপ্ত থমকে রইলো। পিয়ালী একটুপরই উচ্ছ্বাস নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। সাদিক সাহেব গম্ভীরভাবে বললেন,
-আগে ওকে রুমে নিয়ে যাও পিয়ালী। ওর ফ্রেশ হওয়া জরুরি। বাকি কথা পরে হবে।
পিয়ালী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো। বাবার যেকোনোপ্রকার গম্ভীরতার যথেষ্ট কারন আছে এমনটা ও প্রাপ্ত দুজনেই খুব ভালোমতোই জানে। তবে খইকে বাসায় আনার কারন স্পষ্ট পিয়ালীর কাছে। প্রাপ্তর আগে থেকেই বলতো, ওর শ্যামবর্নের মেয়ে বেশি পছন্দ। যেহেতু ওর মা গ্রামের মেয়ে ছিলো, প্রাপ্ত সবসময় চেয়েছে, ওর জীবনেও ওর মায়ের মতো দুরন্ত, উচ্ছ্বল কোনো গ্রামকন্যাই আসুক। আর ঠিক ওর ভাবনার প্রতিফলন খই। ঘটনাক্রম যাই হোক না কেনো, বাবা যে ছেলেবউ হিসেবেই খইকে বাসায় এনেছে, সেটা যেনো পিয়ালী সুনিশ্চিত। পিয়ালী ভাইয়ের দিকে তাকালো। প্রাপ্তর বিস্ময় তখনো কাটেনি। মুখ দিয়ে কিঞ্চিত শব্দ করে প্রাপ্তকে ডাকলো ও। প্রাপ্ত ধ্যান ছেড়ে ওরদিক ফিরতেই পিয়ালী হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালো, “বাবা তোর পছন্দসই বউ নিয়ে এসেছে দেখ!” প্রাপ্ত বিমুঢ়। পিয়ালী ঠোট টিপে হেসে বাবার দিকে একটু এগুলো। নিচু গলায় বললো,
-তারপর বাবা? ওকে ভাবিপু বলে ডাকি?
সাদিক সাহেবের না সুচক কিঞ্চিত রাগী চাওনি দেখে পিয়ালী থতমত খেয়ে গেলো। গলা ঝেরে খইয়ের কাধে হাত রেখে বললো,
-চ্ চলো আপু। ফ্রেশ হবে চলো।
খই এতোক্ষনে চোখ তুলে তাকালো। গোছানো এতোবড় ঘরটার মাঝের আসবাবগুলোও যেমন ওর পরিচিত না, তেমনি মানুষগুলোও অপরিচিত। পাশেই প্রায় ওর চেয়ে কিছুটা কম বয়সের একটা মেয়ে দাড়িয়ে। পরনে ধুতি, কামিজ। ছোটছোট চুল, চোখে চশমা। চোখ ঘুরিয়ে প্রাপ্তর দিকে তাকালো খই। কালো টিশার্ট ট্রাউজার পরনে উজ্জ্বল শ্যামবর্নের এক সুদর্শন যুবক। উচ্চতা, চেহারায় সাদিক সাহেবের সাথে প্রচুর মিল তার। তার দৃষ্টিও ওরই দিকে নিবদ্ধ। খই চোখ সরিয়ে নিলো। সাদিক সাহেব আবারো বললেন,
-যাও খই। ও তোমার ছোটবোনের মতো।
নির্বাক্যে খই পিয়ালীর সাথে পা বাড়ালো। প্রাপ্ত শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার চলে যাওয়া। বেশ বুঝলো, যা ঘটছে, সবটা বাস্তব। বাবা একদম ওর কল্পকন্যাকেই বাস্তবে নিয়ে এসেছে। এমন কাউকেই ভালোবাসবে বলে এতোদিনের অপেক্ষা, এতো কল্পনাজল্পনা। সবই ঠিক আছে। কিন্তু কোথাও তো একটা হাহাকার। কোথাও তো কোনো কমতি রয়ে গেছে। প্রাপ্ত অনুধাবনের চেষ্টা করলো সে কমতি। খইয়ের চোখে ওর চাওয়া সেই দুরন্তপনার অভাব। নিমীলিত চোখজোড়ায় ওর চাওয়া সেই আনন্দের রেশ নেই। তাই হয়তো সে দৃষ্টিকেও অনুভবে সময় লেগেছে প্রাপ্ত। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসলো প্রাপ্ত। কল্পনায় যাকে ভেবে এতোদিন ভালোবাসা জমিয়েছে, খইয়ের সাথে তার সবটা মিল পেয়েও ওর চাওনিতে খুত ধরছে ও? শুধুমাত্র এজন্য সে চিরচেনা অনুভবে এতোটা ফাঁক রয়ে গেলো? এভাবে মিল খুজে বেরোবে বলে কোনো অনুভূতি কি অবশিষ্ট ছিলো ওর কাছে? নাকি তার আগেই সে অনুভব সম্পুর্ন বিপরীতের অন্যকারো নামে করে দিয়েছে ও? নিজেই দোটানায় পরে গেলো প্রাপ্ত।
•
মোবাইলের স্ক্রিনে মায়ের নম্বর থেকে কল আসতে দেখে একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো রাকীন। তুললো না কলটা। চুপচাপ পকেটে দুহাত গুজে আকাশপানে তাকিয়ে রইলো ও। ভালো লাগছে না কিছুই ওর। সাহেরার দাফনের পর গ্রামপঞ্চায়েত খইকে সাদিক সাহেবের রেফারেন্সে মিষ্টিঘরে পাঠাতে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। খই চলে গেছে এই গ্রাম ছেড়ে। আর এখানে ফাঁকাফাঁকা লাগছে রাকীনের সবটা। ইচ্ছে করছে না আর এই ভাদুলগায়ে থাকতে। মাঠঘাট, প্রকৃতি সবটাই যেনো ফিকে পরে গেছে ওর কাছে। একজন প্লানার হাতে দুটো কাগজ নিয়ে এসে দেখে রাকীনের ফোন বাজছে। সে নিজেই রাকীনের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
-স্যার আপনার ফোন।
চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো রাকীন। পাশ না ফিরে শুধু হাত এগিয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিলো ও। কল রিসিভ করে বললো,
-হ্যাঁ মা বলো।
-কোথায় ছিলো তুই ফোন ছেড়ে? কতোবার কল করেছি দেখেছিস? টেনশন হয়না আমার?
ওপাশ থেকে মায়ের অস্থির আওয়াজ প্রভাব ফেললো না রাকীনের ওপর। শুধু বললো,
-কিছু বলবে? ব্যস্ত ছিলাম।
-কি হয়েছে বাবা? তুই ঠিক আছিস তো? শরীর ঠিক আছে তোর? গলা এমন শোনাচ্ছে কেনো তোর?
-ঠিক আছি মা। বলো কি বলবে।
-কবে আসবি তুই বাবা?
-আরো কিছুদিন সময় লাগবে সবটা গোছাতে।
-কিন্তু…
-মা কাজ আছে আমার। যা বলার একটু জলদি বলো।
কথা থামালেন মিসেস মাহমুদ। রাকীন যখন বলেছে, কাজ আছে, মানে ওর কাজ আছে। স্মিমিত গলায় বললেন,
-ইচ্ছের সাথে কথা হয়েছে তোর রাকীন?
-না। কেনো?
-এ্ এমনি। আসলে…
মায়ের ইতস্তত স্বর শুনেই রাকীন বুঝলো আবারো ওদের বিয়ের কথা নিয়েই কিছু ঘটেছে। ইচ্ছে নির্ঘাত আবারো মন খারাপ করেছে এ নিয়ে। মুখে বললো,
-বুঝেছি। একটু পরে কল করছি তোমাকে মা। রাখছি।
কল কেটে ইচ্ছেকে কল করলো রাকীন। ইচ্ছে গিটারগুলো সাজাচ্ছিলো ওর আরেক রুমে। মন ভালো নেই, সবসময় সেটা প্রকাশ করাটা ওর স্বভাববিরুদ্ধ। রাকীনের কল দেখে একটু আটকে কল রিসিভ করলো ও। ওপাশ থেকে রাকীন বললো,
-কেমন আছিস ইচ্ছে?
-আর কেমন? রাজীব আঙ্কেল প্রতিবার তোর আমার বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে যেমন থাকি, তেমন।
রাকীন কি বলবে, ভেবে পেলো না। তাই চুপই রইলো। ইচ্ছে ওকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বললো,
-তোর কথা বল। তুই কেমন আছিস?
-ভালো নেই।
ইচ্ছে আটকালো। সচারচর রাকীন এতো সোজাভাষায় কথা বলে না ওর সাথে। সবসময় ঠাট্টাছলে হবু বউ হবু বউ বলে বলে ওকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করে। যদিও তাতে লাভ হয়না বললেই চলে। রাকীনের উপস্থিতিতে খেয়াকে আরো বেশি মনে পরে যায় ওর। তাই কোনোদিন প্রানখুলে হাসতে পারেনি ও রাকীনের কথায়। তবুও আজ সেই মেতে থাকা মানুষটাই বলছে ভালো নেই। এটা ইচ্ছের কাছে অদ্ভুতই লাগলো। বললো,
-কি হয়েছে তোর রাকীন?
-কখনো আমার অনুপস্থিততে তোর খুব মন খারাপ করেছে ইচ্ছে?
ইচ্ছে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো রাকীনের এ হেনো প্রশ্নে। হুট করে এমন প্রশ্ন করে বসেছে, যার উত্তরটা ঋনাত্মক বলেইমনে হলো ওর। তাই তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারলো না। রাকীন আবারো বললো,
-কখনো আমার উপস্থিতিতে প্রানখুলে হেসেছিস ইচ্ছে? একবারো?
ইচ্ছে এবারো সত্যিটা বলতে পারলো না। দুজনেরই কয়েকদন্ডের নিরবতা। অনেকটা সময় নিয়ে ইচ্ছে বললো,
-সত্যি করে বলতো রাকীন? কি হয়েছে তোর?
-আমার কিছুই হয়নি ইচ্ছে। তবে তোকে নিয়ে প্রচন্ড ভয় হয়। প্রচন্ড! এই এমন একটা লাইফ তুই ডিসার্ভ করিস না। তোকে একটুখানি হাসাতে পারি না, এই আমার মতো অক্ষম কাউকে তুই ডিসার্ভ করিস না। তুই তো তোর মতো বেপরোয়া কাউকে ডিসার্ভ করিস। যে তার বেপরোয়া কথায় তোকে সামলাবে, বিগড়াবে। পরপরই ছোটখাটো বোকামো করে বসবে। তুই প্রানখুলে হাসবি তার সে বোকামোতে। তার কাজে সে তোকে জানান দেবে, তার ওই বোকামোগুলো একমাত্র তোকে ঘিরে। এই বলয়ে জরিয়ে যাবি তুইও। যে কিনা নিজের চারপাশে জরাবে না বলে বলয় করে রেখেছে। ভয় হয়, তোর এই বেখেয়ালীপনার জন্য সেটা পেয়েও না আবার হারিয়ে ফেলিস তুই। ভয় হয়।
রাকীনের পুরোপুরি কথা শোনেনি ইচ্ছে। মাঝপথে আচমকাই প্রাপ্তর কথা মনে পরে গেছে ওর। মাত্র এই কয়েদিনেই ওই লোকটা কখনো রাগের কারন, কখনো মনে পরার অজুহাত, কখনো মুগ্ধতা, তো কখনো হাসির কারন হয়ে উঠেছে ওর। একজন পুরুষের কাছ থেকে জীবনে প্রথমবারের মতো এতোগুলো অনুভূতি পেয়েছে ও। অকারনে এখনো অবদি তাকে নিয়েই ভাবছে। এ ভাবনার কারন নেই। পরিনতিও নেই। তবে কিসের এতো বিরুদ্ধাচারন? কিসের এতো দোটানা?
#চলবে…
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকমহল,
কেমন আছেন সবাই? গ্যাপের জন্য বিব্রত হচ্ছেন তাইনা? আসলে রোজা, ক্লাস, জার্নি, এক্সামের ব্যস্ততা কাটিয়ে টাইপিংয়ে অপারগ ছিলাম। আজও ক্লান্তিতে গুছিয়ে লিখতে পারিনি সেভাবে। তাই বরাবরের মতো অনুরোধ করবো মানিয়ে নেওয়ার। পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজই। কাল থেকে রেগুলার গল্প পাবেন ইনশাল্লাহ্। ভালোবাসা❤ ]