প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-২১

0
653

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২১.

প্রায় দশমিনিট খইয়ের কান্না নিরবে সয়ে নিলো রাকীন। ওর পিঠে লেপ্টে থেকে মেয়েটা অঝোরে কেদে চলেছে এতোক্ষন হলো। বাধা দেয়নি ও। বাধা দেওয়াটা উচিত বলে মনে হয়নি ওর। এভাবে কাদাটা জরুরি ছিলো খইয়ের জন্য। ওকে নিয়ে সাদিক সাহেব শহরে চলে আসার পর ভাদুলগায়ে একটা একটা মুহুর্ত অস্থিরতায় কেটেছে রাকীনের। পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুরটা আজ যখন আরেকদফায় শুকমরার তীরকে বিদায় জানাচ্ছিলো, সে অস্থিরতাকে বাস্তবে রুপ দিতে বাধ্য হলো রাকীন। নির্মানাধীন ব্রীজটার কাগজপত্র ব্যাগে তুলে উঠে পরে ঢাকার ফিরতি ট্রেনে। আসার আগে গ্রামপঞ্চায়েতের কাছ থেকে সাদিক সাহেব আর মিষ্টিঘরের ঠিকানা নিয়ে এসেছে ও। বাসায় ফিরে দু দন্ডও দেরি করেনি। গাড়ি নিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পরেছে মিষ্টিঘরের উদ্দেশ্যে। তবে ঠিক কেনো, কোন টানে ছুটে এসেছে এখানে, সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বলে মিষ্টিঘরে যাওয়ার সাহস হয়ে ওঠেনি রাকীনের। ঝিলের দিকটায় গাড়ি থামিয়ে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুজছিলো ও। শুনশান রাতের একলা মানবসত্ত্বা জাগ্রত হয়ে শুধু এটুকো জানান দিয়েছে, খইকে ছাড়া ভাদুলগাঁয়ে ভালো ছিলো না ও। একদমই ভালো ছিলোনা। একসুরে বাধা পরতে সেই মেয়েটিই কি করে ওর বুকে এসে মুখ গুজবে, তা কি করে জানবে ও? খইকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছন ফিরলো রাকীন। ঝাপসা চোখ তুলে তাকালো খই। রাকীন ওর দুগালের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-কেদেকেদে এ-কি হাল করেছো নিজের?

খই নিজেকে ছাড়িয়ে একপা পেছোলো। কিঞ্চিত অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইলো রাকীনের দিকে। একটু চুপ থেকে আবারো ফুপিয়ে কেদে দিয়ে বললো,

-আমার মা আর নাই নকশাদার! আ্ আমি অন্…

আর কিছু বলার আগেই ওর হাত ধরে একটানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো রাকীন। শক্ত করে জরিয়ে রাখলো খইকে। খই আরো শব্দ করে কেদে দিলো এবার। রাকীন বললো,

-হুশ! কাদে না! আর কেদো না! কাদলে মা আরো কষ্ট পাবে খই! এভাবে কাদতে নেই।

-কান্না থামাও খই। অনেক কেদেছো।

খইয়ের থামার নাম নেই। রাকীন ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

-কান্না না থামালে জ্বী’ন ঘাড় ম’ট’কে দেবে কিন্তু এবার!

মাথা তুলে তাকালো খই। এতোক্ষনে ওর মাথায় আসলো, এই লোকটার এখানে থাকা কতোটা অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রশ্নসমেত নিজেকে সামলাবে বলে আগে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো খই। আর তার জন্য ওর এবার হিচকি উঠেছে। রাকীনের বুকে মৃদ্যু শক্তি দিয়ে সরে যাবে বলে উদ্যত হলে ওর হাত ধরে ফেললো রাকীন। খানিকটা গম্ভীরভাবে বললো,

-এইডা তো ভাদুলগাঁওয়ের শুকমরার তীর না। তো এতো রাইতে এইহানে কি? হুম?

রাকীনের কথা বলার ভঙিমা শুনে দৃষ্টি প্রসারিত হলো খইয়ের। ঠোট টিপে হাসি আটকে প্রশ্নের উত্তরের জন্য ইশারা করলো রাকীন। খই দৃষ্টিনত করে ধরা গলায় বললো,

-ওই ইটপাথরের ঘরে দম বন্ধ হইয়া আইতাছিলো আমার। শ্বাস নেওনের লাইগা বাইর হইছি।

উত্তর দিয়ে রাকীনের কপালে সুক্ষ্ম ভাজের রেখা লক্ষ্য করলো খই। ওটা বিরক্তিপ্রকাশকের সাথে চিন্তার প্রকাশও বটে। বাসা থেকে একটা মেয়ে এভাবে বেরিয়ে আসলো, কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা আদৌও আছে কি সেখানে? রাকীন এমন ভাবনায় মত্ত্ব হওয়ার আগেই খই হাত মুচড়ালো নিজের। রাকীন ওর হাত না ছেড়ে বললো,

-ভাদুলগাঁয়ে তো প্রতিবার ঝাঁ’সির রাণী সেজে দর্শন দিতে। তা শহরে এসে নকশাদারকে ভয় পাচ্ছো নাকি?

-আমার কান্দোনে ভয় আছিলো নকশাদার?

হাত আলগা হয়ে আসলো রাকীনের। খই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। রাকীন জোরপুর্বক হেসে বললো,

-অচেনা একটা জায়গায় এতো রাতে বেরিয়েছো, কিভাবে বেরোলে?

-তুমি এইহানে ক্যান নকশাদার?

উত্তরের পরিবর্তে প্রশ্ন শুনে আটকে‌ গেলো‌ রাকীন। কেনো যেনো ওর মনে হলো, মায়ের মৃত্যুতে আরেক নতুন খইয়ের জন্ম হয়েছে। যে দস্যি বটে, কিন্তু আগের মতো আর গা ছাড়া নেই। কথাতে কারন খুজতে শিখে গেছে সে। যেটা ওর জন্য ভালো। রাকীন মৃদ্যু হাসলো।‌ একপা এগিয়ে বললো,

-আমি এই শহরেরই কেউ‌ খই।

খই‌ চোখ‌ নামিয়ে নিলো। রাকীন বললো,

-আশ্রমের কেউ‌ দেখেনি তোমায় বেরোতে?

-বাড়ির হক্কলে ঘুমায়।

আবারো কপাল কুচকে এলো রাকীনের। বাড়ি বাড়ি কেনো বলছে খই? মিষ্টিঘর যে অনাথআশ্রম, তা কি জানেনা ও? নাকি মিষ্টিঘরকে অনাথআশ্রম বলে সম্বোধন করা হয়না? একটু ঝুকে বললো,

-আর এই সুযোগে রায়বাঘিনী বেরিয়ে পরেছে শহরভ্রমনে। তাইতো? তা কোথায় যাচ্ছিলেন শুনি? এই ঝিল অবদি শুকমরার ফিল নেবেন বলে? নাকি আরো দুরে কোথাও‌ যাওয়ার প্লান ছিলো আপনার? হুম?

-কোনহানে যাওন উচিত আমার নকশাদার?

আকস্মাৎ খইয়ের কাতর আবেদন শুনে রাকীন নিজেই এলোমেলো হয়ে গেলো যেনো। হাসিটা উবে গেলো ওর ঠোট থেকে। খই বললো,

-তুমিই কওনা? এইহানে সাদিক কাকা ছাড়া তো আর কাউরে তো চিনি না। হেয় তো আমারে ওই ঘরটাই চেনাইছে ওহনো অবদি। আর তাতে শুধু আমার দম ফুরাইছে নকশাদার। ওহন তুমি যহন আছোই, এইবার না হয় তোমার কথাডাই শুনি। আমার দম বাচানোর লাগি, আমারে বাচানোর লাগি জবাব দিও একটু? কোনহানে যাওন উচিত আমার নকশাদার? যাওনের জায়গা আছে আমার?

খইয়ের চোখে জল টলমল করছে। যখনতখন বেরিয়ে আসবে সে প্রবাহ। দুহাত মুঠো করে নিলো রাকীন। মনে দোটানা তান্ডব শুরু করেছে। যে প্রবাহের টানে এতোদুর অবদি এসেছে ও, সে প্রবাহকে আগলে রাখার দায়িত্বটা কি ওরই নয়? কি করে অস্বীকার করবে ও নিজেকে নিজের বিবেকের কাছে আবদ্ধ করে দেওয়া সে দায়িত্বকে? উচিত হবে অস্বীকার করা? পারবে ও?

ইচ্ছে উপুর হয়ে শুয়েশুয়ে পা দোলাচ্ছে। ল্যাপটপে নিজেরই কিছু গান দেখতে দেখতে গুনগুন করে গান গাইছে আর মাঝেমধ্যে কাঠবাদাম মুখে পুরছে। টমি এতোক্ষন অবদি মেঝেতে শুয়েশুয়ে বল নিয়ে এদিকওদিক করছিলো। ব্যালকনি দিয়ে আসা দমকা বাতাসে গিটারের হাতলে রাখা ইচ্ছের স্কার্ফটা এসে মেঝেতে পরলো। টমি মেঝে শুকতে শুকতে স্কার্ফের কাছে গেলো। আচমকাই শব্দ করে উঠলো ও। চোখ সরিয়ে টমির দিকে তাকালো ইচ্ছে। অকারনে শব্দ করার অভ্যেস নেই টমির। ইচ্ছে একবার বললো,

-টমি সাইলেন্স।

টমির ভায়োলেন্স বাড়লো বই কমলো না। ইচ্ছে ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে বসলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড ডুড? স্কার্ফ মেঝেতে পরেছে। আমি নই!

টমি তখনো থামেনি। মুখ দিয়ে উল্টেপাল্টে দিলো স্কার্ফটা। স্কার্ফের ছেড়া অংশ দৃশ্যমান হলো ইচ্ছের কাছে। ইচ্ছের মনে পরে গেলো, এটা সেই স্কার্ফ যেটা আগেরদিন ছিড়ে নিয়েছে প্রাপ্ত। মনে পরতেই হাসি পাচ্ছিলো ইচ্ছের। হাসিটা আটকে বাবু হয়ে বসে টমিকে বললো,

-টমি? ওটা বাইকে লেগে ছিড়ে গেছে।

টমি থামলো। লেজ গুটিয়ে বেডের দিকে এগোচ্ছিলো শান্তিতে বসবে বলে। ইচ্ছে ঠোট টিপে হেসে বললো,

-আরে না না! টমি? ওটা তো বাইকে লেগে ছেড়ে নি! ওটা তো…

টমি আবারো শব্দ করতে লাগলো। ইচ্ছে আগের মতোই হাসি সংবরনের‌ চেষ্টা করে‌বললো,

-টমিইইই? ওটা মেবি রাকাদের‌ বাসার দরজার কোনায় বেঝে ছিড়ে‌ গিয়েছিলো।

টমি আবারো নিশ্চুপ। আগের মতো এবারো ইচ্ছের কাছে যাবে বলে এগোচ্ছিলো ও। ইচ্ছে ফট করে‌ বলে দিলো,

-স্কার্ফটা প্রাপ্ত ছিড়েছে।

শব্দের সাথে নিজের তীব্র প্রতিশোধস্পৃহাকে এবার প্রদর্শন করাতে লাগলো টমি। একপ্রকার ফুসে ওঠা‌ যাকে বলে। ইচ্ছে আর পারলো না নিজের হাসি ধরে রাখতে। শব্দ করে হাসতে লাগলো ও। ওর হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো বাসা। অনেকগুলো বছর পর আবারো এ বাসার চারদেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগলো ইনায়াত নিক্কনের বিলুপ্তপ্রায় সে হাসির ঝংকার। টমি প্রথমকেই স্কার্ফ শুকে‌ বুঝে গিয়েছিলো ওতে ইচ্ছের গায়ের সাথে প্রাপ্তরও স্পর্শ আছে। তাই শুরু থেকেই অপছন্দের লোকটার উপস্থিতি অনুভব করে চেচাচ্ছিলো ও। ইচ্ছে করেই ইচ্ছে দুবার ভুলভাল বলেছে ওকে। তখন সেটাকে সত্য মেনে শান্ত হয়ে গিয়েছিলো টমি। শেষবারে ইচ্ছে যেই প্রাপ্তর নাম‌ নিয়েছে, সত্যিসত্যিই টমির সেই অপছন্দের প্রাপ্ত স্কার্ফটা ছিড়েছে প্রমান পেয়ে ওইভাবে শব্দ করতে শুরু করেছে ও। সবটা বুঝে হাসতে হাসতে বিছানায় গরিয়ে পরলো ইচ্ছে। অনেকক্ষন পর হাসি থামিয়ে হাপাতে হাপাতে বললো,

-এই লোকটাকে তোর এতো অপছন্দ কেনো টমি? আমার স্কার্ফে তার স্পর্শ আছে এইটুকো বুঝেই এতো আক্রোশ তোর? হোয়াই ডুড?

টমির শান্তশিষ্ট ভাবখানায় যেনো স্পষ্ট জবাব, “হু! অপছন্দের লোকই‌ বটে। তোমার গিটার ভেঙেছে, ঝাল খাইয়েছে, দেয়াল টপকেছে, সরি বলেনি, থ্যাংকস্ দেয়নি। এখন শুনি তোমার স্কার্ফও‌ ছিড়েছে। তো তাকে অপছন্দ করবো না তো তোমার মতো তার নামে আকাশ কাপিয়ে হাসবো? তুমিই বা কেনো উল্টোপথে চলছো? হোয়াই ডুড? হোয়াই?”
ইচ্ছে কি বুঝলো, কতোটুকো বুঝলো ওর ভঙিমায়, উঠে বসলো চুপচাপ। হাসোজ্জ্বল চেহারায় আবারো বিষন্নতার মেঘ জমলো যেনো। তা দেখে‌ ভাব পাল্টালো টমি। চাঁদমুখে অমাবশ্য এনে দিলো বুঝি ও নিজেই। লেজ নেড়ে‌ এগিয়ে গিয়ে ইচ্ছের পায়ে গা ঘেষলো ও। ইচ্ছে মৃদ্যু হেসে কোলে তুলে‌ নিলো ওকে। গায়ে হাত বুলিয়ে চোখ স্থির করলো ব্যালকনির বাইরের আকাশের দিকে। চাঁদ লুকিয়েছে কালোমেঘের আড়ালে। ইচ্ছে একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিহিস্বরে বললো,

-আই উইশ তোর প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকতো আমার কাছে। আই উইশ! কিন্তু এই উত্তরহীনতার এই কালোমেঘ ঘোচানোর আগে যে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর জানা চাই আমার টমি। উত্তরগুলো কি সত্যিই‌ নেই আমার কাছে? নাকি আমিই‌ মানতে নারাজ? কোনটা?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here