#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
২৩.
অনেকক্ষন যাবত ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কাজে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছে রাকীন। কিছুতেই পারছে না। বারবার ভুল করে বসছে ছোটছোট বিষয়েই। পাশেই বিছানার উপর রাখা স্কেচের কাগজপত্র ফ্যানের বাতাসে খচখচ শব্দ তুলেছে। রাগ নিয়ে ল্যাপটপ কোল থেকে সেই কাগজের উপরই রাখলো রাকীন। দাতে দাত চেপে, চোখ বন্ধ করে জোরেজোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার। বন্ধ চোখের পাতায় সেই চেনা মুখ। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে, একদম কাছে এসে যে ঠোটজোড়া ওর ঠোট ছুইয়ে দিয়েছিলো, সেই ঠোঁট। সেই শ্যামবর্নের মুখশ্রীর টানাটানা চোখজোড়া। খই! রাকীন চোখ মেললো। উঠে দাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিটালো কয়েকবার। খইকে ভুলতে চায় ও, এমনটা নয়। তবে খই ওর ভাবনা এতো গাঢ়ভাবে জরিয়ে যাক, এমনটাও চায়না ও। আপাতত কাজে মনোযোগ ধরে রাখাটা বেশি জরুরি। রুমে মাকে কফি নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো রাকীন। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে এগোলো টেবিলের দিকে। বললো,
-কফি চাইনি মা।
-মা হই তোর! তুই কখন চাইবি, সে অপেক্ষায় থাকতে পারি না আমি রাকীন! আমি জানি তোর কখন কি প্রয়োজন!
মিসেস মাহমুদের অভিযোগের স্বর। রাকীন থামলো। মায়ের দিকে ফিরে তাকানোটা শ্রেয় বলে মনে হলো না ওর। মিসেস মাহমুদ কফি রাখলেন টেবিলের উপরে। রাকীনের কাধে হাত রেখে বললেন,
-তোর খেয়াল রাখবে, এমন কাউকে তোর প্রয়োজন রাকীন।
…
-এভাবে চলে এলি গ্রাম থেকে? ওদিকের সব ঠিক আছে তো বাবা?
-বেঠিক হবে এমনটা কেনো ভাবছো মা? ডোন্ট ওয়ারী। এখান থেকেই বাকিটা সামলে নেওয়া যাবে। সব ঠিক আছে।
-শুধু তুই ঠিক নেই। তাইনা রাকীন?
কফিমগ হাতে নিতে গিয়েও থেমে গেলো রাকীন। পুরোটাই লক্ষ্য করলেন মিসেস মাহমুদ। ছেলেকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,
-তুই জানিস রাকীন, তোর বাবা কোনোদিনও মুখ ফুটে তুই কেমন আছিস জানতে চাইবে না। কিন্তু তুই তো এটাও জানিস, তোকে কতো ভালোবাসে সে। তোর ভালো চায়। তোকে ভালো দেখতে চায়। এভাবে আর কতোদিন বাবা? আর পারছি না তোকে অতীত আঁকড়ে এভাবে দেখতে! পারছি না!
কাদতে লাগলেন মিসেস মাহমুদ। রাকীন জরিয়ে ধরলো মাকে। ওর বলার কিছুই নেই এখানে। সন্তানকে সুখী দেখতে চাওয়া প্রতিটা বাবা মায়ের অধিকার। সে অধিকার থেকে ও বঞ্চিত করেছে ওর বাবা,মাকে। তাই এই অভিযোগ ওকে শুনতেই হবে। মিনিটদুয়েক পর কানে আসলো,
-কাল ইনিশাতে খেয়া হাউজিং নিয়ে মিটিং ডেকেছি। চায়না থেকে কিছু বিল্ডার্স আসছে।
রাকীন তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরলো। রাজীব মাহমুদ দরজায় দাড়িয়ে বলেছেন কথাগুলো। রাকীন বিস্ময়ে বললো,
-কাল মিটিং মানে? হাউজিংয়ের মিটিং তো আরো দুমাস পর হওয়ার কথা!
-সেটা তো তোমার আরআইপি’র পরে হওয়ার কথা ছিলো। এখন তুমি যখন এসেই গেছো, আর দেরি করতে চাইছি না।
-কিন্তু বাবা…
-কিসের কিন্তু রাকীন?
রাকীন চুপ রইলো। রাজীব মাহমুদ বললেন,
-আমি ভাবছিলাম কাল হাউজিং প্রজেক্টের পুরোটার দায়িত্ব আমি নেবো।
এটুকো শুনেই রাকীন কি বলবে, বুঝে উঠতে পারলো না। এই প্রজেক্ট ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন প্রজেক্টের একটি। তা যদি রাজীব মাহমুদ নিজে লিড দিতে চান, তারমানে সে প্রজেক্ট সুন্দরতম রুপ নেবে। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। ও নিজে লিড করবে না, এই খারাপ লাগার চেয়ে, ওর বাবা লিড করছে,এটাই ওর কাছে সবচেয়ে খুশির। রাকীন কিছু বলার আগেই রাজীব মাহমুদ বললেন,
-খেয়া হাউজিংয়ে ইনিশা থাকছে। তবে ইনিশা বিল্ডার্সের তরফ থেকে তুমি এই প্রজেক্টের লিডে থাকছো না রাকীন। ইচ্ছেকে বলে দিও কাল ও যেনো ইনিশায় পৌছে যায়। মিটিংয়ে ওকেও এটেন্ড করতে হবে।
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
রাকীন মাকে ছেড়ে ছুটে এসে শক্তকরে জরিয়ে ধরলো ওর বাবাকে। আলতোভাবে ছেলের গায়ে হাত রাখলেন রাজীব মাহমুদ। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। যেখানে ছেলের ভালো করার সুখের চেয়ে, সে ছেলেকে ঠকানোর গ্লানি সুস্পষ্ট। দেরি না করে বেরিয়ে গেলেন রাজীব মাহমুদ। মিসেস মাহমুদও ঠোটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে। খুশিমনে ইচ্ছেকে কল করলো রাকীন। কল রিসিভ হতেই বললো,
-কাল হাউজিং প্রজেক্ট নিয়ে মিটিং আছে ইচ্ছে!
আচমকাই রাকীনের কল পেয়ে ইচ্ছে যতোটা না অবাক হয়েছিলো, হাউজিংয়ের কথা শুনে আরো অবাক হলো ও। বিস্ময় নিয়েই বললো,
-কি বলছিস কি তুই রাকীন?
-হ্যাঁ! ঠিকই বলছি! বাবা নিজে কনফার্ম করেছে আমাকে! এইমাত্র!
শ্বাস ছেড়ে দাড়ানো থেকে বিছানায় বসে গেলো ইচ্ছে। রাকীনের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকটা খুশি ও। ইচ্ছে বললো,
-তোকে ছাড়াই মিটিং?
-হ্যাঁ! কাল একটু কাজ পরে গেছে আমার। বাট নো নিড টু ওয়ারি! গেইস হোয়াট? বাবা নিজে লিড করবে প্রজেক্টটা!
আরেকদফায় অবাক ইচ্ছে। চোখ ভরে উঠলো ওর। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়! রাকীনের লালন করা খেয়ার স্বপ্ন। খেয়া হাউজিং! নিম্নবিত্তদের মাথার উপর তাদের নিজস্ব ছাদ। ইচ্ছেকে চুপ থাকতে দেখে রাকীন বললো,
-কিরে? চুপ করে গেলি যে?
-হুম? ক্ কিছুনা! এটা বল, তুই গ্রাম থেকে কবে আসছিস? ওদিকের কাজ কতোদুর?
রাকীন এবার চুপ করে গেলো। যেখানে খইয়ের জন্য ভাদুলগাও ছেড়ে ঢাকায় চলে আসলো ও, সেখানে এই মেয়েটাকে বলাও হয়নি ও ঢাকায় এসেছে। ইচ্ছে আবারো বললো,
-কিরে? এবার তুই চুপ কেনো?
-মিস করছিস আমায়?
ইচ্ছে আবারো নিরত্তর। সত্যিই কি এতোটুকোও মিস করেছে ও রাকীনকে? এতোগুলো দিনে একবারও মনে পরেছে ওর রাকীনের কথা? রাকীন উত্তরের অপেক্ষা করলো না। কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
-কাল সময়মতো ইনিশায় চলে আসিস। মিটিংয়ে তোর থাকাকে বাবা আবশ্যক বললো।
হুম বলে কল কাটলো ইচ্ছে। টমি আগেই ঘুমিয়ে গেছে বিছানায়। শুন্যদৃষ্টিতে ব্যালকনিতে তাকালো ইচ্ছে। বাইরে শীতল হাওয়া বইছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এ বাতাস কি মনকে শীতল করতে এসেছে? নাকি কোনো তান্ডবের পুর্বাভাস? স্বস্তি নাকি দীর্ঘশ্বাস, তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ!
•
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে ছিলেন নওশাদ সাহেব। নাফিজা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। ইচ্ছে রেডি হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখে টমি ডাইনিংয়ের মেঝেতে বসে নিজের খাবার খাচ্ছে। আজ ওর আগেই নিচে নেমে গেছে টমি। নওশাদ সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু। প্রতিদিন বলা সত্ত্বেও বাসায় ব্রেকফাস্ট করে না ইচ্ছে। আর প্রতিবারই মনে করিয়ে দিয়ে যায়, ওকে খেতে বলার অধিকারও তার নেই। ইচ্ছে বেরিয়ে না গিয়ে সোজা ডায়নিংয়ে বসে গেলো। বড়বড় চোখে তাকালেন নওশাদ সাহেব। উৎফুল্লভাবে বললেন,
-ইচ্ছে তুমি…নাফিজা? ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসো। আজ ইচ্ছে আমাদের সাথে খাবে।
নওশাদ সাহেবের কথাটা শুনে মোটেও খুশি হননি নাফিজা বেগম। অবশ্য অবাক হয়েছেন। এ মেয়ে আজ কেনো বাসায় খেতে বসলো? কিছু না বলে চুপচাপ খাবার বাড়ছিলেন উনি। ইচ্ছে মোবাইলে দৃষ্টি রেখে উচুস্বরে বললো,
-খাবার এনো না এস এম। ব্রেকফাস্ট করবো না আমি।
নাফিজা বেগম থামলেন। বিরবিরিয়ে নাটক শব্দটা উচ্চারন করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন উনি। নওশাদ সাহেব আশাহতের মতো করে বলতে যাচ্ছিলেন কিছু। ইচ্ছে ফোন ছেড়ে একপলক রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বললো,
-রাকীন বলছিলো খেয়া হাউজিং প্রজেক্টটা নিয়ে আজ ইনিশায় বোর্ড মিটিং আছে। তুমি যাবে এস এম?
হাত থেমে গেলো নাফিজা বেগমের। তার ছোট্ট মেয়েটার ছোটছোট ইচ্ছেগুলোকে ছোট করে দেখেনি রাকীন। রাকীনের কাছে কখনোই ইচ্ছে-রাকীনের মাঝের সম্পর্ক খেয়া-রাকীনের সম্পর্কের উর্ধ্বে ছিলো না। তারপরও তার মেয়েটাই সবকিছু থেকে আজ বঞ্চিত। কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌও আছে কি না…দাতে দাত চেপে নিজেকে সামলালেন নাফিজা বেগম। আজ খেয়া নেই বলেই ইচ্ছের কাছে হাউজিংয়ের কথা শুনতে হচ্ছে। খেয়াকে প্রাধান্য দেখিয়ে মহান সাজতে চাইছে ইচ্ছে। নাফিজা বেগম শান্তস্বরে বললেন,
-যাবো না।
ইচ্ছে ক্ষুদ্রশ্বাস ছাড়লো। ও জানতো নাফিজা বেগম কখনোই রাজি হবেন না। উঠে দাড়িয়ে বললো,
-ফাইন। আসছি।
এই বলে ইচ্ছে বেরিয়ে আসলো। ইনিশায় পৌছে রাকীনকে দেখতে পেলো না কোথাও। রাজীব মাহমুদ নিজেই হাউজিংয়ের মিটিংয়ে সবটা সামলেছেন। সবটা দেখে মনেমনে অনেকটা শান্তি মিলেছে ইচ্ছের। মিটিং শেষে বেরিয়ে রাজীব মাহমুদের সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেকটা দেরি হয়ে যায় ওর। রাকীন অন্য প্রজেক্টে আছে বলেই নাকি এটাতে লিড দিচ্ছে না, এমনটাই বললেন রাজীব মাহমুদ। ইচ্ছে বুঝলো, পুরোটাই ওকে বোঝানোর চেষ্টা, রাকীন খেয়াকে ভুলে মুভ অন করতে চাইছে। কিছু না বলে শুধু সৌজন্য হাসিতে পাশ কাটিয়েছে ও রাজীব মাহমুদকে।
বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেলো ইচ্ছের বেরোতে। ইনিশার কর্মদিবস ততোক্ষনে শেষ। লিফটে এসে কোনোদিক না তাকিয়ে গ্রাউন্ডফ্লোরের জন্য বোতাম চাপলো ইচ্ছে। চোখ মোবাইলে থাকলেও প্রচন্ড ক্ষুধায় মাথা ঘুরতে শুরু করেছে ওর। লিফট নামতে শুরু করার কয়েকসেকেন্ড পরেই আচমকা অন্ধকার হয়ে আসলো ওর চারপাশ। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ইচ্ছের অন্ধকারে ফোবিয়া আছে। এমনিতেও ক্ষুধা, তার উপর অন্ধকার, এরপর ভেন্টিলেশনে সমস্যা। দুবার চেচিয়ে,দরজায় হাত দিয়ে বারি লাগালো ইচ্ছে। পেছন থেকে কেউ হয়তো কিছু বললো। কিন্তু নিজের ওপর আয়ত্ব রাখতে পারলো না ইচ্ছে। পরে যেতেই অনুভব হলো, কারো বাহুডোর আগলে নিয়েছে ওকে। গালে কারো স্পর্শের সাথে কানে বাজলো,
-হেই মিস রকস্টার? আর ইউ ওকে? মিস রকস্টার?
#চলবে