প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-২৪

0
600

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

২৪.

বাহুডোরে ইচ্ছেকে টলতে দেখে খানিকটা আটকে রইলো প্রাপ্ত। মিষ্টিঘরের স্কুলটা দ্বিতল করতে নতুনকে পুনর্নির্মাণের জন্য ইনিশা বিল্ডার্সে আসতে হয়েছিলো ওকে। দুজন ইন্জিনিয়ারের সাথে কথা শেষ করে বেরিয়ে আসছিলো ও ইনিশা থেকে। লিফটে করে গ্রাউন্ড ফ্লোরের জন্য নামার সময় ইচ্ছেকে লক্ষ্য করেছিলো ও। গাঢ় নীল টপস্, জিনস্, পিঠে ছোট স্কুলব্যাগের মতো ডিজাইনার ব্যাগ, খোলা চুলে স্বাভাবিক সাজই ছিলো ওর। কিন্তু চেহারায় বিদ্ধস্ততা ঠিকই ছিলো। হয়তো সে অস্থিরতার জন্যই মাস্ক নামিয়ে থুতনিতে রেখেছে ইচ্ছে। আচমকাই লিফট আটকে যাওয়াতে জ্ঞানও হারানোর উপক্রম হয়েছিলো ওর।‌ কোনোমতে আগলে নিয়েছে প্রাপ্ত ওকে।

খুব বেশি সময় না নিয়েই ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসে। লিফট নামতে শুরু করেছে। আবছা চোখে প্রাপ্তকে দেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো ইচ্ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে লিফটের দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাড়ালো ও। মাথা ঝারা মেরে প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললো,

-তুমি? এখানে?

প্রাপ্ত কিছু বলতে যাবে, লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌছেছে। ইচ্ছের চারপাশ ঘুরছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলো ও লিফট থেকে। পেছনপেছন প্রাপ্তও বেরিয়ে এসে বললো,

-শুনবে না কেনো এসেছিলাম?

ইচ্ছে দাড়ালো। তবে বুঝলো দাড়ানোর মতো অবস্থায় বেশিক্ষন হয়তো থাকবে না ও। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে ক্রমশ। প্রাপ্তও বুঝলো ওর অবস্থা। বিচলিতভাবে বললো,

-ঠিক আছো তুমি?

জবাবের পরিবর্তে ইচ্ছে একটা শুকনো ঢোক গিললো। তারপর ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে কয়েকঢোকে শেষ করলো ওটা। হাতের পিঠে গলার ঘাম মুছলো ইচ্ছে। প্রাপ্ত আবারো বললো,

-আর ইউ ওকে মিস রকস্টার?

-আম্ আমি ঠিকাছি।

ইচ্ছের অগোছালো উত্তর। হাটা লাগাচ্ছিলো ও। প্রাপ্ত কি বুঝলো, হাতের কাগজগুলো মুড়িয়ে ঠিকঠাকমতো ধরলো ও। এসে সামনে দাড়ালো ইচ্ছের। এগোলো ওর অনেকটা কাছে। মুখে বললো,

-বুঝেছি কতোটা ঠিক আছো।

ইচ্ছে মাথা তুলে ওর চোখের দিকে তাকালো। প্রাপ্ত নিজের চোখের ভাষাটুকো পড়ার সময় দেয়নি ওকে। ওটুকো বলেই হুট করে কোলে তুলে নিলো ইচ্ছেকে। বিস্ফোরিত চোখে ইচ্ছে তাকালো ওর দিকে। সব অসুস্থ্যতা যেনো বিস্ময়ের সাথে প্রতিযোগীতায় হার মানলো। গলা জরিয়ে রাখা মানুষটার কোনো হেলদোল নেই ওর সে চাওনির জন্য। ইচ্ছে শশব্যস্তের মতো আশেপাশে তাকালো। এখনো অবদি করিডোরে কেউ নেই। ঝটপট বললো,

-ক্ কি করছো তুমি মিস্টার গ্…

ওকে বলতে না দিয়ে প্রাপ্ত একদম ঝুকলো ওর মুখের দিকে। ইচ্ছের গলায় কথা আটকে গেলো। চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। প্রাপ্ত ওর ঠোটের নিচ অবদি থাকা মাস্ক নিজের মুখ দিয়ে টেনে উপরে তুলে দিলো। ইচ্ছে যেনো জমে গেলো। প্রাপ্ত এভাবে ওর এতোটা কাছে চলে আসবে, ভাবেনি ও। দু দন্ড ওর প্রসারিত চাওনির দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত। তারপর সরে এসে শীতলস্বরে বললো,

-কিপ কোয়ায়েট মিস রকস্টার। অসুস্থ্য তুমি।

ইচ্ছের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম এবার। মাস্ক কিংবা অসুস্থ্যতার জন্য না। প্রাপ্তের এতোটা কাছে আসার জন্য। পরিস্থিতি সামলাতে প্রাপ্তর গলা ছেড়ে নামার চেষ্টা করে বললো,

-আমি ঠিকাছি। নামাও আমাকে। ছাড়ো।আমি…

প্রাপ্ত আরো শক্তিতে জরিয়ে নিলো ইচ্ছেকে। ওর শক্ত চোয়াল, শান্ত চাওনি যেনো বলছে, “ছাড়ো বললে আরো কাছে টেনে নেবো” তব্দা মেরে নিস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছে প্রাপ্তর দিকে। এই ছেলেটার সবকাজের ধরনটাই অদ্ভুত। আর আশ্চর্যজনকভাবে, সে অদ্ভুত কাজগুলোতে মানা করতে পারে না ও। ডোন্টকেয়ার ভাবে ইচ্ছেকে কোলে নিয়েই হাটা লাগালো প্রাপ্ত। ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ইনিশা থেকে। বাইকের সামনে এসে আরেকবার তাকালো ইচ্ছের দিকে। ওর তখনো সেই বিমুঢ় চাওনি। প্রাপ্ত বললো,

-বাইকে কম্ফোর্টেবল?

-হু?

ইচ্ছের অস্ফুট আওয়াজে বিস্ময় স্পষ্ট। কিন্তু তা যেনো শুনেও না শোনার ভান করলো প্রাপ্ত। যেনো হু বলে অনুমতি দিয়েছে ওকে। দেরি না করে ইচ্ছেকে সামনে নিয়েই বসে গেলো বাইকে। ইচ্ছে তখনো ওর গলা জরিয়ে। সবটা যেনো ওর মাথার উপর দিকে যাচ্ছে। বাইক স্টার্ট দিলো প্রাপ্ত। ইচ্ছে আঁতকে উঠলো। চলন্ত বাইক দেখে আরো শক্তভাবে ও আঁকড়ে ধরলো প্রাপ্তর গলা। প্রাপ্ত বাইক চালাতে মনোযোগ রেখে বললো,

-নাইস সিটবেল্ট হা?

ইচ্ছের মুখ তালাবন্ধ। এমনই পাগলামি শুরু করে দিয়েছে প্রাপ্ত। পুরো রাস্তায় একটা টু শব্দ অবদি করেনি ইচ্ছে। বাইকের সামনে বসে, প্রাপ্তর গলা জরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। রাস্তার লোকজন হাজারটা কথা বলেছে হয়তো ওদের উদ্দেশ্য করেই। কানে যায়নি দুজনের একজনেরও। একটাএকটা মুহুর্তে প্রাপ্তর শ্বাস অনুভব করেছে ইচ্ছে। একটাএকটা মুহুর্তে ইচ্ছের বাহুবন্ধনীকে গলায় স্বয়ংবরের বরমালার মতো অনুভব হয়েছে প্রাপ্তর। সে অনুভূতিতে ইচ্ছে-প্রাপ্ত নিজেরাও গা ভাসিয়েছিলো হয়তো। অন্যকিছুতে মন ছিলো না কারোরই। কাছেরই এক হসপিটালে পৌছে বাইক থামালো প্রাপ্ত। ইচ্ছেকে কোলে করেই হসপিটালে ঢুকলো। রিসেপশনের দিকে এগিয়ে বললো,

-ইমারজেন্সি কোনদিকে?

দৃষ্টি আবারো প্রসারিত হলো ইচ্ছের। ইমার্জেন্সি? লিফটের ওখানেই ও বলেছে, ঠিক আছে ও, কিছুই হয়নি। এই ছেলে তারপরও ওকে হসপিটালে নিয়ে আসলো। এখন আবার বলছে ইমার্জেন্সি। পাগলটাগল হয়ে গেলো নাকি? খানিকটা জোর গলায় বললো,

-ইমার্জেন্সি মানে? আমি ঠিকাছি বললাম তো।

প্রাপ্তর শীতল চাওনি। ইচ্ছে দমলো না। বললো,

-দেখো মিস্টার গ্যাংস্টার, নামাও আমাকে।

প্রাপ্ত ওকে নিয়ে হাটা লাগালো নির্বিকারচিত্ত্বে। ইচ্ছে নির্বাক আগের মতোই। দুর্বলতার জন্য না হলেও প্রাপ্তর কাজকর্মে এবার সত্যিই ও জ্ঞান হারাবে। করিডরে এক নার্সকে দেখে প্রাপ্ত বললো,

-ইমার্জেন্সির পেশেন্টের কেবিন কোনদিকে সিস্টার?

সিস্টার ড্যাবড্যাব করে ওর কোলে মাস্ক পরিহিত ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো,

-পেশেন্ট কে?

-আপনি ডক্টর?

-সরি?

-চেকআপ কি আপনি করবেন? ডক্টরকে ডাকুন এন্ড স্টে আওয়ে ফ্রম মাই ওয়ে!

প্রাপ্তর জোরালো কথায় খানিকটা চমকেই উঠেছে নার্স। আর একটা কথাও বললো না সে। হাত বারিয়ে পাশের কেবিনটা দেখিয়ে বললো,

-দ্ দিস ওয়ে‌ স্যার।

ইচ্ছেকে নিয়ে প্রাপ্ত কেবিনে ঢুকলো। ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে হাত ঝাকি মারলো নিজের। অনেকটা পথ বইতে হয়েছে ইচ্ছেকে। হাত লেগে গেছে। শার্টের হাতা ঠিকঠাকমতো গুটাচ্ছিলো প্রাপ্ত। ইচ্ছে শোয়া থেকে উঠে বসলো। গলা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,

-এটা কি হলো?

প্রাপ্ত হাতা ফোল্ড করা বাদ দিয়ে, নার্সের দিকে তাকালো একপলক। বললো,

-তুমি অসুস্থ্য।

-তোমাকে বলেছিলাম আমি ঠিকাছি।

-তারপরও জ্ঞান হারাতে যাচ্ছিলে!

-তো…

প্রাপ্ত এগিয়ে বেডে হাত রেখে বেশ অনেকটাই ঝুকে দাড়ালো। ইচ্ছে কথা থামালো নিজের। গুটিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে মাস্কটা ঠিকঠাক করে তুলে নিলো। আবারো কিছু বলতে যাবে, প্রাপ্ত বলে উঠলো,

-সেদিন কি বলেছিলে? প্রান বাচিয়েছিলে তুমি আমার? তার বিনিময়ে থ্যাংকস্ দিয়েছিলাম তোমাকে রাইট? অনেক ভেবে দেখলাম, সাদমান ইনাব প্রাপ্ত তো কোনোদিন কারো ঋন রাখে নি। সেখানে তো তুমি প্রানঋনে ঋনী করে‌ দিয়েছো আমাকে। এতোবড় ঋন কিভাবে রাখি বলো? তাই আজকে তোমাকে হসপিটালাইজড্ করে দিয়ে বাচিয়ে দিলাম। হিসাব বরাবর। থ্যাংকস দিতে হবে না। ওয়েলকাম।

প্রাপ্ত বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। দু দন্ড পাথর হয়ে বসে রইলো ইচ্ছে। কপালে হাত রেখে দুম করে শুয়ে পরলো ও। সবটা ভেবে হাসতে লাগলো পরপরই। তেমন অসুস্থ্য না হওয়া সত্ত্বেও, ওকে‌ জোর করেই হসপিটালাইজড্ করে, তার সো কল্ড প্রানঋন নাকি শোধ করে গেলো এই ছেলে। ওর প্রতি সেন্সিটিভিটি না বুঝিয়ে, লজিক ছুড়ে গেলো। একেই হয়তো বলে, ভাঙবে তবু মচকাবে না। পাশে দাড়িয়ে থাকা নার্সটা অবুঝের মতো শুধু সবটা দেখলো। কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছের দিকে। কি বলে গেলো ছেলেটা? হিসাব বরাবর? ওয়েলকাম? এভাবে কোলে করে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে কে ওয়েলকাম জানায়? এটা কোন হিসাববিজ্ঞানের কোন হিসাবের কোন কমার্স? শুধু কি ছেলেটাই পাগল? নাকি সাথে মেয়েটাও? ইমার্জেন্সির পেশেন্ট তো নয়ই এ। আদৌও কি কোনো রোগী? নাকি কোনো পাগল পাগলামীর ভুক্তভোগী?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here