#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
২৫.
প্রাপ্ত চলে গেছে বেশ অনেকক্ষন। ওর পাগলামোগুলো ভেবে এতোটা সময় শুধু নিশব্দে মিটিমিটিয়ে হেসেছে ইচ্ছে। অনেকটা সময় পর খেয়াল হলো, আবারো শরীর দুর্বল লাগছে ওর। পাশে তখনো সে নার্স থমকে দাড়িয়ে। চুপচাপ উঠে বসলো ইচ্ছে। গলা ঝেড়ে বললো,
-একচুয়ালি…
-উনি আপনাকে নিয়ে অনেক সেন্সিটিভ।
ইচ্ছে কিছু বলার আগেই নার্সটা বলে উঠলো। ইচ্ছে থামলো। সত্যি তো এটাই, জীবনে ওকে নিয়ে চিন্তা করার মানুষ আছে। ওর বাবা, রাকীন, রাকীনের বাবা-মা সবাই ভাবে ওকে নিয়ে। তবে চিন্তা করলেও ওকে সময় দেওয়ার সময় হয়ে ওঠে না কারোরই। তাই প্রাপ্তর মতো এমন করে কারো সেন্সিটিভিটি দেখা হয়ে ওঠেনি ইচ্ছের। ইচ্ছে নখ দেখতে দেখতে মৃদ্যু হেসে বললো,
-মেবি।
নার্স চুপ রইলো। দু দন্ড পরই ইচ্ছে ধ্যান ভাঙলো নিজের। বললো,
-সরি সিস্টার। ও এভাবে আমাকে এখানে নিয়ে আসলো, আ’ম রিয়েলি সরি।
-ইটস্ ওকে। কিছু মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে। অল দ্যা বেস্ট টু বোথ অফ ইউ।
ইচ্ছে নির্বাকচোখে তাকিয়ে রইলো। আর পাঁচটা সাধারন মেয়েকে বুঝি ওদের ভালোবাসার মানুষটা এভাবেই যত্ম নেয়? তাই বুঝি ওকে আর প্রাপ্তকে তুলনা করলো নার্স? তাহলে ওর জীবনটা কেনো এতো সুন্দর না? কি দোষ করেছে ও? সেলেব্রিটি হওয়া তো না। তবে কি নিজেকে খোলকে মুড়িয়ে রাখার জন্য? ও তো চেয়েছিলো কেউ নিজে থেকে এসে বুঝুক ওকে। ভালোবাসুক ওকে। সেই ছোট থেকে রাকীনের সাথে বড় হলো। কই? কখনো তো রাকীনকে নিয়ে এতোকিছু ভাবার সুযোগ হয়নি ওর। তবে কেউই কি নেই ওকে বোঝার জন্য? ওকে চুপ থাকতে দেখে নার্স আবারো বললো,
-জলদি জলদি স্যারের অভিমান ভাঙাবেন কিন্তু ম্যাম! স্যার বেশ অনেকটা অভিযোগ করে বেরিয়ে গেলো বলে মনে হলো।
ইচ্ছে আবারো মাস্কের আড়ালে মুচকি হাসলো। বাবু হয়ে বসে আগ্রহ নিয়ে বললো,
-তাই? তো কিভাবে স্যারের অভিমান ভাঙাতে হবে সিস্টার? এনি টিপস্?
নার্স একটু চিন্তার ভঙিমা করে বললো,
-উম্…শুনেছি ছেলেরা নাকি মেয়েদের শাড়িতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। আপনি শাড়ি পরে স্যারকে ভালোবাসি বলে দেবেন, দেখবেন সব অভিমান গায়েব!
ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো এবার। এইসব ফিল্মি বিষয়গুলো কেনো শুনতে চেয়েছিলো ও, কেনো শুনলো, নিজেও জানে না। তবে এগুলো কোনোদিনও ঘটার নয়। নার্সকে আরো দুবার সরি বলে সৌজন্য হেসে হসপিটাল থেকে বেরোলো ও। ইতিমধ্যইে রাকার কল। রিসিভ করতেই রাকা বললো,
-কোথায় তুই ইচ্ছে?
-লিভ ইট। তুই কোথায়?
-তুই যে হসপিটালে, তার রিসেপশনে দাড়িয়ে আছি। প্রাপ্ত ভাইয়া কল করে বললো তুই নাকি হসপিটালে? নিশ্চয়ই আজও বাসা থেকে না খেয়ে বেরিয়েছিস? তাই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। তাইনা? কতো নম্বর কেবিনে তুই এখন? প্রাপ্ত ভাইয়া বললো…
-প্রাপ্ত?
বিস্ময়ে বললো ইচ্ছে। রাকা বললো,
-হ্যাঁ! ভাইয়া তো…ন্ না মানে, আগে বল তুই কোথায়?
-বেরিয়েছি।
-ও! বেরিয়েও গেছিস? আচ্ছা ঠিকাছে। তুই পাশের রেস্ট্রুরেন্টে বস। আমি আসছি।
নিরবে কল কেটে তাই করলো ইচ্ছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে ওর। প্রাপ্ত রাকাকেও জানিয়েছে ওর বিষয়ে। তারমানে শুধু ঋনপরিশোধ ছিলো না সবটা। চুপচাপ বসে রইলো ও রেস্ট্রুরেন্টের এক কোনে। মিনিটপাঁচেকের মধ্যে রাকা হাজির। ও এসেই আগে জরিয়ে ধরলো ইচ্ছেকে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো,
-শুকরিয়া খোদার। ঠিক আছিস তুই!
-রাকা…
-কোনো কথা না! আগে তুই কিছু খেয়ে নে!
-কিন্তু রাকা…
-ওয়েটার?
রাকা ওয়েটারকে ডাক লাগালো। বলার সুযোগ দেয়নি ইচ্ছেকে। ইচ্ছেও আর তেমন কিছু বললো না। রাকার সাথে বসে খেয়ে নিলো চুপচাপ। খাওয়া শেষে বললো,
-তোকে এখানে প্রাপ্ত আসতে বলেছে?
রাকা মোবাইলে ব্যস্ত ছিলো। ইচ্ছের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ বন্ধ করলো মোবাইল। বললো,
-ম্ মানে, ও্ ওই…আসলে…
ওকে তোতলাতে দেখেই ইচ্ছে বুঝলো, প্রাপ্তই বলেছে ওকে আসতে। ইচ্ছে চুপ রইলো। রাকা ধীর গলায় বললো,
-তুই রাগ করেছিস প্রাপ্ত ভাইয়া আমাকে বলেছে বলে?
-তেমন কিছু না রাকা। তবে আমি ঠিক আছি। এভাবে তোকে বলে…
-ভাইয়া তোকে নিয়ে অনেক ভাবে ইচ্ছে।
-ইয়াহ্! সরি, থ্যাংকস্, ওয়েলকাম করার নিত্যনতুন উপয়াগুলো আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে যে!
-হ্যাঁ! শুধু তোরই ক্ষেত্রে সরি বলেছে সে। থ্যাংকস্ বলেছে। আরো হয়তো অনেককিছু, যা না আমি জানি, নাইবা তুই!
ইচ্ছে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর খানিকটা গুরুগম্ভীরভাবে বললো,
-কি বলতে চাইছিস তুই বলতো রাকা? তুই জানিস, আমার কথা প্যাচানো পছন্দ না। যা বলার স্ট্রেইটলি বল।
রাকা একশ্বাসে বলে দিলো,
-আমার তো মনে হয়, প্রাপ্ত ভাইয়া তোকে ভালোবাসে।
ইচ্ছে থমকে গেলো রাকার কথায়। খানিকক্ষন তাকিয়ে থেকে জোরপুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
-রিল্যাক্স)। আই নো, মিস্টার গ্যাংস্টার ওসব প্রেম ভালোবাসা টাইপের ছেলে না।
-বাবা! ইনায়াত নিক্কন, দ্যা রকস্টার! একটা গ্যাংস্টার কেমন ছেলে, কেমন না, তার সম্পর্কে ভালোই জেনে গেছে দেখছি।
রাকার কথায় ইচ্ছে চুপ করে গেলো আবারো। তবে এটাও বুঝলো, ওকে মৌনতায় মানায় না। মৌনতা মানেই দুর্বলতা। কিন্তু ইচ্ছে তো দুর্বল নয়! রাকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, একটা শ্বাস ছেড়ে ইচ্ছে শক্তভাবে বললো,
-হাজারো ফ্যানফলোয়ার ভালোবাসে ইচ্ছেকে। এদের সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত না রাকা। তবে হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস তুই। না চাইতেও, ঘটনাক্রমে প্রাপ্তকে অনেকটাই চিনে গেছি। তুই যা ভাবছিস, ওর দ্বারা এমন কিছু হতে পারে না।
-তুই চাস না এমন কিছু হোক?
-রাকা!
ইচ্ছের কড়া গলা। রাকা দমলো না। শান্তভাবে বললো,
-কি হতে পারে, কি হতে পারে না, সেটা আমি, তুই, আমরা কেউই ঠিক করে দিতে পারি না ইচ্ছে। কিন্তু আমরা কে কি চাই, সেটা নিতান্তই আমরা জানি। তুই কি চাস, সেটা শুধু তোর মনই জানে। আমার শুধু একটাই অনুরোধ, ওই মনকে বেধে রাখিস না তুই। বাধা দিস না! সে অনুভূতি যার জন্যই হোক, তাকে নিজের করে নিস। প্লিজ ইচ্ছে! প্লিজ!
রাকার অনুনয়। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। সাথে রাকাও। ও বেশ বুঝলো ওর কথাগুলোই ইচ্ছের অস্থিরতার জন্য দায়ী। তবে তার জন্য ওদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না, এ বিষয়েও নিশ্চিত রাকা। ইচ্ছে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেলো কি মনে করে। আবারো রাকার দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যে বললো,
-ভালোবাসা আমার জন্য ধূসর মরুভূমির জলের মতো রাকা। হয় দুর্লভ, নয় মরিচীকা। সত্যিকার প্রেমজোয়ার পেলামই বা কই, প্রেমনোঙরে আটকাবো বলে? দোষটা কি আমার?
রাকা নিরত্তর। ইচ্ছে বললো,
-তবে হ্যাঁ! যদি সত্যিই কোনোদিন অনুভব হয়, এই সেই ভালোবাসার অনুভব, এই সেই প্রেমজোয়ার, কথা দিচ্ছি, সে জোয়ারে আমি সর্বস্ব উজার করে দেবো। সবটা! আর তখন পুরো পৃথিবী দেখবে ইচ্ছের ভালোবাসা। হার ক্রেজিনেস। কজ ইচ্ছে ও’ন্ট ফল ইন লাভ । শি উইল রাইজ ইন লাভ রাকা! শি উইল রাইজ ইন লাভ!
বলা শেষ করে ইচ্ছে রেস্ট্রুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনপেছন ছুটতে ছুটতে এতোক্ষনে মোবাইলে চলা কলটা কাটলো রাকা। সঙ্গেসঙ্গে বাইক ব্রেক করলো প্রাপ্ত। সবে যেনো ভেতর থেকে শ্বাস বেরোলো ওর। কানে গোজা ব্লুটুথটা কান থেকে খুলে, নিচের ঠোট কামড়ে ধরলো ও। ইচ্ছেকে ছেড়ে হসপিটাল থেকে চলে চলে আসলেও ওকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিলো প্রাপ্তর। তাই ওই রাকাকে হসপিটাল যেতে বলেছিলো। ইচ্ছেকে দেখতে যেতে। কিন্তু রেস্ট্রুরেন্টে ঢুকে রাকা কল করেছিলো ওকে। ব্লুটুথে রিসিভ করে, কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলেও প্রতিত্তর পায়নি প্রাপ্ত। ভেবেছিলো রাকা হয়তো ভুলে ডায়াল করেছে। ও নিজেই কল কেটে দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু ইচ্ছের স্বর শুনে আর কলটা কাটতে ইচ্ছে করেনি ওর।
ওদের কথোপকথন শুনতে শুনতেই প্রাপ্ত বাইক চালিয়েছে পুরোটা পথ। কিন্তু ইচ্ছের শেষ কথায় কিছু তো ছিলো! গায়ের সমস্ত জোর যেনো সব হারিয়ে ফেললো ও হঠাৎই। মাঝরাস্তায় নিজের বিমুঢ় সত্ত্বাটা নিয়ে বাইক দাড় করিয়ে রেখেছে। “ইচ্ছে প্রেমে পরবে না, ইচ্ছে তো প্রেমে উত্তল হবে। প্রেমজোয়ারে উত্থানলাভ করবে সে। মাতবে, প্রেমপাগলামিতে।” কানে শুধু এই কথাগুলোই বাজতে লাগলো প্রাপ্তর। পেছনের হাজারো গাড়ির হর্নের শব্দ কানে আসলো না ওর। মনপ্রান জুড়ে বরং এক তীব্র লোভের সঞ্চারন, “ওই ইচ্ছেনদীতে ভরাডুবি হোক শুধু প্রাপ্তর। প্রেমজোয়ার হোক তো হোক,প্রাপ্তর নামে। শুধুই প্রাপ্তর নামে!”
#চলবে…
[ গল্প সম্পর্কিত আড্ডা দিতে জয়েন করুন মিথিমহল। গ্রুপ লিংকঃ
https://www.facebook.com/groups/233416685257163/?ref=share_group_link ]