প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-২৭

0
572

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

২৭.

মুষুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে আজ। মিষ্টিঘরের ছাদে হাটু জড়িয়ে বসে আছে খই। ছাড়া চুলগুলো ঘাড় থেকে মেঝেতে পরে আছে বিস্তৃতভাবে। বৃষ্টির পানির সাথে খইয়ের চোখের পানিও মিলেমিশে একাকার। এ কয়দিনে অনেক কষ্টে নিজেকে পাথর করে রেখেছিলো ও। আজ হঠাৎই মেঘলা আকাশ দুর্বল করে দিয়েছে ওকে। ভাদুলগায়ে কালবৈশাখীর সেই ঝড়ের দিনগুলোতে আম কুড়োনো, পুটিদের সাথে শুকমরায় ঝাপাঝাপি,রাতে বর্জ্রপাতের আওয়াজে প্রতিবার মায়ের বুকে মুখ গোজা সবকিছুই মনে পরছে ওর। নিচে মিষ্টিঘরের বাচ্চারা ভিজছে, আনন্দ করছে। কিন্তু ওর তো আনন্দ নেই। তাই লুকিয়ে‌চুরিয়ে ছাদে চলে এসে ও। হঠাৎই ও
আওয়াজ এলো,

-এভাবে ভিজলে অসুখ করবে কিন্তু!

পুরুষালী গলায় খানিকটা চমকে উঠে পেছন ফিরলো খই। বক্তাকে দেখেই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম ওর। ঠোটে অমায়িক একটা হাসি ঝুলিয়ে রাকীন দাড়িয়ে। ওর খয়েরী রঙের শার্টটা ভিজে একাকার। ভেজা চুলগুলো থেকে পানি গরাচ্ছে। খইয়ের মনে হলো, হয়তো ভুল দেখছে ও। অস্ফুটস্বরে বললো,

-নকশাদার…

-কেমন আছো?

রাকীনের সুস্পষ্ট কথায় খই‌ টের পেলো, এটা কোনো ভ্রম নয়। রাকীন সত্যিই এসেছে। তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো ও। বললো,

-ন্ নকশাদার? তুমি?

রাকীন মুচকি হেসে চুলগুলো উল্টে ধরলো। খইয়ের দিকে এগিয়ে বললো,

-হ্যাঁ আমি। কোনো জ্বী’ন না।

-ত্ তুমি এ…

-আশ্রমের স্কুলের দ্বিতীয়তলা আর নতুন বিল্ডিংয়ের নকশা আমাদের কোম্পানি থেকেই করার প্লান করেছিলেন সাদিক স্যার। এজ এন আর্কিটেক্ট, কোম্পানি আমাকেই পাঠিয়েছে এখানে। তাই এখানে আসা। সামনের বিল্ডিংয়ে বসেই নকশা আকছিলাম। বাবা! ম্যাডাম দেখি এমন তুমুল‌ বৃষ্টিতে এই বিল্ডিংয়ের ছাদে বসে। এমনিতেও এসেছিই যখন, দেখা করতামই তোমার সাথে। এদিকে বৃষ্টিতে ভিজছো, কেউ বারণও করছে না। তাই ভাবলাম এখনই এসে একটু বকে যাই তোমাকে।

খই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো রাকীনের দিকে। একশ্বাসে কথাগুলো বলে রাকীন আবারো বললো,

-বললে না কেমন আছো? পড়শোনা করছো তো ঠিকমতো?

সাথেসাথে বাজ পরার শব্দ। খই চমকে উঠেছে। রাকীন ওর হাত টেনে এনে ছাদের সিড়ির দিকটায় দাড় করালো এবার। হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল এলোমেলো করতে করতে বললো,

-গ্রামে তো আমাকে জ্বীনই বানিয়ে দিয়েছিলে। আজ তোমার নতুন বাড়িতে এলাম, এবারো সেই ভুত দেখা মোডে আছো। নাকি কথা বলাই ভুলেটুলে গেছো শহরে এসে? কোনটা?

খই অবাকচোখে শুধু দেখছে ওকে। কি বলবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। উত্তর না পেয়ে রাকীন হতাশচোখে তাকালো খইয়ের দিকে। মিষ্টিঘরের প্রজেক্টটা লিখনই সামলাচ্ছিলো। আজ হঠাৎ এটার ফাইল চোখ পরতেই থমকে গিয়েছিলো ও। একপ্রকার বাহানা করে চলে এসেছে ও এখানে। মুল উদ্দেশ্য ছিলো খইয়ের খবর নেওয়া। আত এ মেয়ে তো সেই পুরোনো শকিং এক্সপ্রেশনেই সময়পার করে দিচ্ছে। রাকীন এদিকওদিক তাকালো। ওদের ঠিক পাশেই পুরোনো এক কাঠের তাক। তাতে আধভেজা একটা খবরকাগজ। রাকীন মুচকি হেসে কাগজটা তুললো। কিছু একটা পড়ে‌ বললো,

-বাহ্! খইয়ের নাম দেখি খবরকাগজে ছেপেছে!

বড়বড় চোখ করে‌ তাকালো খই। উকি দিলো‌ খবরকাগজটায়। রাকীন মুচকি হাসলো। ইশারায় খইকে জিজ্ঞাসা করলো, দেখবে? খই মাথা নাড়লো তাড়াতাড়ি। রাকীন পেপার উল্টিয়ে তাতে থাকা একটা ছবি বের করে খইকে দেখিয়ে বললো,

-বাচ্চাটাকে‌ দেখেছো? ওর‌ বয়স মাত্র আট বছর বয়স। এরমাঝেই সে চাঁদ-সুর্য মহাকাশের এমনসব তথ্য আবিষ্কার করেছে যে, অনেক বড়বড় বিজ্ঞানীরাও তা আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই ওর নাম খবরকাগজে।

খই অবুঝের‌ মতো তাকিয়ে রইলো শুধু। রাকীন পেপারটা মুড়িয়ে ধরে বললো,

-তো ম্যাডাম! ছবিটা আপনারো হতে পারতো! কিন্তু আপনি তো কথা বলা, পড়াশোনা সব ছেড়ে দুঃখবিলাস আর বৃষ্টিবিলাস করছেন। তাই এই ছবিটা আপনার না! দুঃখিত!

খই চোখ নামিয়ে নিলো। ভেজা ওড়না মুঠো করে‌ দাড়িয়ে রইলো‌ শক্তভাবে। রাকীন বুঝলো, এখনো পুরোপুরিভাবে মা হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি খই। ও পেপারটা সরিয়ে রেখে খইয়ের হাত মুঠো‌ করে‌ নিলো। ‌মাথা তুলে তাকালো খই। রাকীন কিঞ্চিত ঝুকে দাড়িয়ে বললো,

-শিক্ষার কোনো বয়স হয়না খই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যতোটুকো দরকার,যে কেউ সেটা যেকোনো জায়গা থেকেই‌ পেতে পারে। কিন্তু নিজেকে গড়ার দায়িত্ব সবসময় নিজেকেই‌ নিতে হয়। নিজের স্বপ্নকে ছুতে চাইলে নিজেকে তৈরী করতে হয় সেভাবে। যদি এই মেয়ে এতো অল্পবয়সে হাজারটা ডিগ্রি ছাড়াই এতোকিছু করতে পারে, তবে ওর মতো যে কেউই পারবে চেষ্টা আর অধ্যবসায় দিয়ে পৃথিবীজয় করতে। যে কেউ! তুমিও খই…

খই জলভরা চোখে‌ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। রাকীন এবার ওর গালে একহাত রেখে বললো,

-পারবে না?

গালে থাকা রাকীনের হাতের দিকে তাকালো খই। আকস্মাৎ ঠোটে হাসি ফুটলো‌ ওর। রাকীনের হাতের ওপর হাত রেখে বললো,

-আমি পারবো নকশাদার! পারবো আমি! তুমি এভাবে আমার পাশে থাকলে, আমি সব পারবো! ঠিক পারবো!

তুমি পাশে থাকলে কথাটা শুনে রাকীন আটকে গেলো। হাত সরিয়ে নিলো খইয়ের গাল, হাত থেকে। অসম্ভব তৃপ্ত এক হাসি উপহার দিয়ে, উচ্ছ্বাস নিয়ে একছুটে নিচে চলে আসলো খই। ওর কথার ভঙিমা, আনন্দে কিছু তো আলাদাই ছিলো। আর তা হয়তো রাকীনের ভয় বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো। হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো রাকীন। কাকে দোষারোপ করবে ও? বারবার খইয়ের প্রতি দুর্বল করে দেওয়া পারিপার্শ্বিককে? নাকি দুর্বল হয়ে পরার জন্য দায়ী ওই মায়াবিনীকে? নাকি অতীতকে ভুলতে চলা অসহায় নিজেকে? কাকে?

ক্ষুদে গায়েন একাডেমি। বাচ্চাকাচ্চা আর সংগীতযন্ত্রের কলরবে মুখরিত এক পরিবেশ। গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতে দাড়ালো ইচ্ছে। পরনে থাকা সাদা-নীলের সংমিশ্রিত শাড়ীটার শুভ্র আঁচল সামনে হাতে ধরলো। আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো একাডেমির নেমপ্লেটটায়। ওর আবেগ। এখান থেকেই গান নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো ও। ওর মা গানের শিক্ষিকা ছিলেন এই একাডেমিতে। মায়ের সাথে, খেয়াকে নিয়ে কতো এসেছে ও এই একাডেমিতে, হিসেবছাড়া। আর এজন্য নাফিজা বেগমের কম ধমকিধামকিও শুনতে হয়নি খেয়াকে। তবুও লুকিয়ে চুরিয়ে আসতো দুজনে এখানে। অতীত মনে করে মৃদ্যু হাসলো ইচ্ছে। সময়ের সাথে যে বদলে গেছে সবটা। সবটাই!

ইচ্ছে একাডেমির ভেতরে ঢুকলো। আজ পুরো দিনটাই এখানে বাচ্চাগুলোর সাথে কাটাবে ও। ওকে ঢুকতে দেখেই একাডেমির অন্য দুজন শিক্ষিকা এগিয়ে এসে স্বাগতম জানালো ওকে। দেশে থাকলে প্রতিবছর এ দিনটায় ইচ্ছে এখানে আসবে, এমনটা জানে তারা। ইচ্ছে সবার সাথে কথা বললো। কয়েকটা গার্ডিয়ানও এসে কথাবার্তা বললো বেশ অনেকক্ষন। হারমোনিয়ামে বেশ কিছু বাচ্চাকে সুরও‌ শেখালো ইচ্ছে। তারপর চলে এলো একামেডির পেছনদিকটার গার্ডেনে। ওর মা, খেয়ার অনেক স্মৃতি জরিয়ে আছে এ জায়গাটায়। একাডেমির বাকিসব বাচ্চাদের কেউ দোলনায়, কেউ রাইডে, কেউ সাইকেল নিয়ে ব্যস্ত। ইচ্ছে ওদের সাথেও সময় কাটালো। বেশ অনেকক্ষন থাকার পর সবে চলে আসবে বলে পাশ ফিরতে যাচ্ছিলো ও। আচমকাই কেউ দ্রুতগতিতে এসে একহাতে ওর হাত, আরেকহাতে কোমড় জরিয়ে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসলো আগের দাড়ানো জায়গা থেকে।

শার্ট খামচে ধরে দু সেকেন্ডের জন্য হলেও সে পুরুষ অবয়বটার বুকে মুখ গুজে রইলো ইচ্ছে। খিচে বন্ধ করে নিলো‌ চোখজোড়া। আকস্মিক এমন ঘটনায় এটুকো ভয় না হওয়া নারীস্বভাব বিরুদ্ধ। সে বিরুদ্ধাচারনে ব্যর্থ কঠোর মানবীর থেকে চোখ ফেরাতে ব্যর্থ হলো প্রাপ্ত নিজেও। নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছের দিকে। মিষ্টিঘরের কিছু ছেলেমেয়ে এই একাডেমিতে আসে গান শিখতে। কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে ওদেরই দেখতে এসেছিলো ও। কিন্তু আসার পর শুভ্রনীল শাড়িতে ইচ্ছেকে দেখে আর কিছুই চোখে পরেনি ওর। একধ্যানে শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই এগিয়েছে বাগানে। হঠাৎই খেয়াল হলো, ইচ্ছের ঠিক পাশ দিয়ে একটা বাচ্চা সাইকেল নিয়ে এগোচ্ছে। বৃষ্টির জন্য পানি জমে কাদা হয়ে গেছে জায়গাটায়। সাইকেল কাদার মধ্যে দিয়ে গেলে শাড়ি নষ্ট হবে ইচ্ছের। তাই ওভাবে ছুটে এসে সরিয়ে নিলো ও ইচ্ছেকে। ঘটনা বুঝে উঠতেই মাথা তুলে তাকালো ইচ্ছে। প্রাপ্তকে দেখে বিস্ময়ে দৃষ্টি প্রসারিত হলো ওর। অবাককন্ঠে বললো,

-তুমি?

প্রাপ্তর ধ্যান ভাঙলো। ইচ্ছেকে না ছেড়ে ইশারায় ওর আগের দাড়ানোর জায়গার পাশের খাঁদটার দেখালো। তারপর গম্ভীরভাব দেখিয়ে বললো,

-ওখানে দাড়িয়ে ছিলে, বাচ্চাটা সাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় কাদা ছিটিয়ে দিয়ে যেতো শাড়িতে।

-হ্যাঁ তো?

ইচ্ছের স্পষ্ট প্রশ্নবাণে প্রাপ্ত হচকিয়ে গেলো। কোনোমতে বললো,

-ত্ তো তোমার শাড়ি নষ্ট হয়ে যেতো না? ত্ তাই সরিয়ে এনেছি।

-ও। তাই বুঝি? তো এখানে আমি সেইফ। বাট তুমি সেইফ তো? মিস্টার গ্যাংস্টার?

ইচ্ছে ঠোট টিপে হাসি আটকে বললো। ওর বলার ভঙিমায় সন্দিহান দৃষ্টি ছুড়লো প্রাপ্ত। কিছু বলে উঠতে যাবে, ঠিক ওর পেছন দিয়ে আরেকটা বাচ্চা সাইকেল নিয়ে যাওয়ায় কদর্মাক্ত পানি ছিটে এসে একদম পায়ে লাগলো ওর। ইচ্ছে নিজেকে ছাড়িয়ে পিছিয়ে দাড়ালো তৎক্ষনাৎ। শাড়ির কুচি খানিকটা উচিয়ে ধরে দেখে নিলো কোথাও‌ কাদা লেগেছে কি-না। সবটা ঠিক আছে দেখে শ্বাস ছাড়লো ইচ্ছে। তারপর চোখ তুলে তাকালো প্রাপ্তর দিকে। তার নিষ্পলক চাওনি। ইচ্ছে ভ্রু নাচিয়ে আগে প্রাপ্তর পায়ের দিকে ইশারা করলো। তারপর মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, কাদা লেগে গেছে। মুখে একটা কথা না বলে, শব্দ করে হেসে দিলো ইচ্ছে। ওর ইশারা বুঝে উঠে রোবটের মতো নিজের পায়ের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। প্যান্টের নিচের দিকে সত্যিই কাদা লেগেছে। একজনের সাজ ঠিক রাখতে নিজের কাপড়ে নিজেই কাদা লাগিয়ে নিলো। তৎক্ষনাৎ তীক্ষ্মদৃষ্টিতে ইচ্ছের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। ইচ্ছে তখনও হাসছে। প্রাপ্তর চাওনি পরিবর্তন হলো এবার। ইচ্ছের হাসিতে ওর মনপ্রানে শীতল বাতাস ছুয়ে দিয়ে গেলো যেনো। ইচ্ছে একটু এগিয়ে এসে হাসতে হাসতেই বললো,

-এটা কি ছিলো জনাব? আমার শাড়িতে কাদা লাগতে দিলে না ঠিক আছে, কিন্তু তোমার নিজের ড্রেসআপই তো নষ্ট হয়ে গেলো।

প্রাপ্তের চাওনিতে তখনো মুগ্ধতা। ইচ্ছে দুহাত পেছনে গুজে আরো খানিকটা এগিয়ে মাথা উচু করে বললো,

-এখন যদি বলি তবুও তোমাকে থ্যাংকস দেবো না, তো?

-যদি বলি তোমার হাসিতে ষোলোআনাই উশুল, তো?

আনমনে বলে দিয়ে প্রাপ্ত নিজেই থমকে গেলো। হাসি থেমে গেলো ইচ্ছেরও। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে প্রাপ্তর কথার মানে খুজতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলকভাবে। কিন্তু বুঝে ওঠার সুযোগ, সময় কোনোটাই প্রাপ্ত ওকে দেয়নি। একমুহুর্ত না দাড়িয়ে বেরিয়ে এলো গার্ডেন থেকে।

#চলবে…

[ রিচেইক হয়নি। এলোমেলো‌ লাগলে সরি🙁
গল্প সম্পর্কিত আড্ডা দিতে জয়েন করুন মিথিমহল। গ্রুপ লিংকঃ
https://www.facebook.com/groups/233416685257163/?ref=share_group_link ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here