#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
২৯.
-আমি বিয়েটাতে রাজী রাকীন। সত্যিই হয়তো তোর চেয়ে বেশি আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাউকে পাবো না। তাই জীবনসঙ্গী হিসেবে তোকেই মেনে নেবো। আমি রাজী বিয়েতে।
ফোনে ইচ্ছের বলা কথাটা শুনে কান থেকে ফোন নামিয়ে কলটা কেটে দিলো রাকীন। ও জানতো, ইচ্ছে মানা করবে না এই বিয়েতে। ইচ্ছের মনে এখনো অবদি যদি কোনো দুর্বলতা থেকে থাকে, সেটা শুধু ওকে নিয়েই। যদিও তা ভালোবাসার না। বন্ধুত্বের। তবুও! ওর সারা রুমের অবস্থা দেখার মতো না। ড্রেসিংটেবিলের আয়না চুর্নবিচুর্ন হয়ে মেঝেতে পরে আছে। সাথে পরে আছে রাকীনের শিক্ষাজীবনের গোটাবিশেক ক্রেস্ট, মেডেল আর অনেকগুলো স্কেচের কাগজ। তাতে এক বাচ্চা মেয়ের মুখশ্রী। মোবাইলটা ছুড়ে মেরে, চিৎকার করে মাথার চুলগুলো উল্টে ধরলো রাকীন। দেয়ালে ঘুষি ছুড়লো কয়েকবার। ওর আওয়াজ শুনে ছুটে এলেন রাজীব মাহমুদ আর তার মিসেস। ভেতরে ঢুকে চারপাশ দেখে শব্দ করে কেদে দিলেন মিসেস মাহমুদ। ছুটে এসে বিছানায় বসা রাকীনের কাটা হাত আচলে চেপে ধরলেন। এতোগুলো বছরের সংসারে, স্বামীর দিকে প্রথমবারের মতো ঘৃনাদৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বললেন,
-এটা কেমন বিয়ে বলতে পারো? তুমি না আমাদের ছেলের ভালোর জন্য ওকে বিয়ে দিতে চাইছো? আমার ছেলেটা তো…
-আমি ঠিক আছি মা।
শান্তস্বরে বললো রাকীন। মিসেস মাহমুদ আরো জোরে কেদে দিয়ে বলতে যাচ্ছিলেন কিছু। রাকীন নিজেকে ছাড়িয়ে বাবার মুখোমুখি এসে দাড়ালো। শক্ত গলায় বললো,
-ইচ্ছে রাজী হয়ে গেছে বাবা। ও রাজি এই বিয়েতে।
-এ মাসের পনেরো তারিখ তোমাদের বিয়ে রাকীন।
রাকীন চোখ সরিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো। বললো,
-আর খেয়া হাউজিং?
-আমি কথা বলেছি লয়ারের সাথে। ঝামেলা মিটে গেলে আমিই ইনস্টলমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবো। ওটা নিয়ে আর ভাবতে হবে না তোমাকে। নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নাও রাকীন। আমার বিশ্বাস, ইচ্ছেকে কোনোদিনও কষ্ট দেবে না তুমি। আর সে দায়িত্ববোধ থেকেই তোমাদের সম্পর্কটা আরো গাঢ়তর হবে দেখো। তাইতো এই বিয়ে…
আবারো রাকীন তাচ্ছিল্যে হাসলো। বললো,
-ইচ্ছেকে যেমন কোনোদিনও কষ্ট দিতে পারবো না, তেমন খেয়াকেও কোনোদিনও ভুলতে পারবো না আমি বাবা। তাই বলে তুমি ভুলেও ভেবো না, হাউজিং নিয়ে তোমার শর্তের জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছি আমি। মোটেও তা নয়। ইচ্ছের বন্ধুত্বের জন্য ওকে খুশি রাখার দায়িত্বটা আমি নিচ্ছি। মাঝখান থেকে এই শর্ত জুড়ে দিয়ে নিজেকে ছোট না করলেও পারতে।
ছেলের সামনে দাড়িয়ে থাকার আর সাহস হলো না রাজীব মাহমুদের। চলেআসলেন রাকীনের সামনে থেকে। জীবনে এই প্রথমবার এতোটা নিচকাজ করেছেন তিনি। ছেলেকে ভালো দেখবেন বলে তার ভালোলাগার, ভালোবাসার সাথেই বেআইনি সংশ্লিষ্টতা প্রমান করে তাতে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন রাজীব মাহমুৃদ। উপায় ছিলো না তার। অবশ্য তাতে যদি ভবিষ্যতে রাকীন, ইচ্ছে দুজনেই ভালো থাকে, এ কাজ নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই তার। একটুও না।
•
সন্ধ্যে নেমেছে শহরে। বাইকের চাবিটা নিয়ে বেরোচ্ছিলো প্রাপ্ত। পরনে সাদা টিশার্টের উপর ডার্কচেইক শার্ট। শার্টের হাতা কনুই অবদি গুটানো। ইচ্ছের দেখা সেই প্রথমদিনের প্রাপ্তর মতো। ভালোবাসি বলবে বলে, চেনাপরিচয়ের সেই শুরুর বেশেই বাসা থেকে বেরোনের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রাপ্ত। দরজা দিয়ে বেরোনের সময় সাদিক সাহেব ডাক লাগালেন ওকে। প্রাপ্ত দাড়ালো। সাদিক সাহেব বললেন,
-ইমারজেন্সি?
মুচকি হেসে মাথা নেড়ে না বুঝালো প্রাপ্ত। মুখে বললো,
-কিছু বলবে বাবা?
ছেলের কাধে হাত রাখলেন সাদিক সাহেব। মুখে হাসি রেখে করিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে বললেন,
-তোমার মা মারা যাওয়ার পর থেকে এখনো অবদি, আমি সবসময়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি তোমাকে আর পিয়ালীকে সবরকম অভাব থেকে আগলে রাখার। বাবা হিসেবে কতোটুকো পেরেছি, তা তোমরাই জানো প্রাপ্ত। কিন্তু আমি সবসময় চেয়েছি তোমাদের বন্ধু হতে। আর হয়েও উঠেছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই হয়তো কোনো আড়াল সেভাবে ছিলোই না আমাদের মাঝে। আজও আমি তার ব্যতিক্রম চাইনা প্রাপ্ত। তাই সরাসরিই বলতে চাইছি তোমাকে।
প্রাপ্ত দাড়িয়ে গেলো। স্বতন্ত্রস্বরে বললো,
-এভাবে কেনো বলছো? কি হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা?
-সমস্যা না প্রাপ্ত। সমাধান। আমার হাজারো ব্যাকুলতার সমাধান তুমি।
-মানে? কি হয়েছে বলোতো বাবা!
সাদিক সাহেব আবারো মুচকি হাসে বলতে লাগলেন,
-আমি জানি, তুমি খইকে পছন্দ করো। আর খইও এ কয়দিনে যথেষ্ট সাচ্ছন্দ্য হতে শুরু করেছে তোমার সাথে। তাই তোমাদের দুজনের বিয়েটা এবার সেরে ফেলতে চাইছি আমি প্রাপ্ত। এ বিষয়ে তুমি কি বলো?
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
বাবার কথা শুনে খুব বেশি চকিত হলো না প্রাপ্ত। এমন ভাবনা যে সাদিক সাহেবের আগে থেকেই ছিলো, তা ও জানতো। কিন্তু কথাটা আজ বলছে বলেই যা। ও ভেবেছিলো ইচ্ছেকে বলার পরই বাবাকে বলবে, ও ইচ্ছেকেই ভালোবাসে। কিন্তু সাদিক সাহেব আগেই বলে বসলেন কথাটা। প্রাপ্ত এটা খুব ভালোমতোই জানে, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনোই ওকে জোর করবে না ওর বাবা। আজ যখন কথাটা উঠেছেই, ও ঠিক করলো, পরিস্কারভাবে বলবে বাবাকে, ইচ্ছেকে ভালোবাসে ও। খইকে নয়। এটা জানলেই মিটে যাবে সবটা। মুচকি হেসে প্রাপ্ত বললো,
-আসলে বাবা, তুমি যেমনটা ভাবছো, তেমনটা নয়। কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তোমার।
সাদিক সাহেব একটু থেমে বললেন,
-ভুল বোঝাবুঝি মানে?
-সত্যি বলতে, আমিও ধারনা করেছিলাম, তুমি যা ভেবেছিলে সেভাবেই হওয়ার কথা ছিলো সবটা। কিন্তু হয়নি। বরং তার বিপরীতে ঘটে গেছে সবকিছু। বিশ্বাস করো বাবা, আমার অগোচরেই হয়েছে এসবের রদবদল। তোমাকে, আমাকে ভুল প্রমানিত করে আমার মন আজ বিপরীতে আটকেছে। আসলে আমি খইকে ভ্…
-প্রাপ্ত?
ভালোবাসি না বাবা- বলার আগেই মাহীমের গলা শুনে প্রাপ্ত থামলো। দরজায় ঝুকে দাড়িয়ে হাটুতে দুহাত রেখে সমানে হাপাচ্ছে ও। ও যে ছুটতে ছুটতে এ বাসা অবদি পৌছেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাপ্ত বললো,
-কি হয়েছে? এভাবে হাপাচ্ছিস কেনো?
মাহীম সোজা হয়ে দাড়িয়ে, জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে ভেতরে ঢুকলো। কিছুক্ষন সাদিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে থেকে কি ঘটেছে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো হয়তো। আগের মতোই হাপিয়ে ওঠা কন্ঠে বললো,
-তোর সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।
প্রাপ্ত ওর কথাকে উপেক্ষার স্বরে বললো,
-পরে। বাবার সাথে কথা আছে আমার।
-কিন্তু প্রাপ্ত এটা তারচেয়েও বেশি জরুরি। তোর…
-তোকে বললাম না? এখন বাবার সাথে কথা বলছি আমি। পরে দেখছি তোর বিষয়টা। সোফায় গিয়ে বস কিছুক্ষন।
কড়া গলায় মাহীমকে থামিয়ে দিয়ে বাবার দিকে ফিরলো প্রাপ্ত। মাহীম অস্থিরভাবে কপাল চেপে ধরে এদিকওদিক পায়চারী করতে লাগলো। সাদিক সাহেব মৃদ্যু হেসে বললেন,
-আগে মাহীম কি বলে, সেটা শুনে এসো প্রাপ্ত। আমরা নিজেদের কথা একটু পরে আলোচনা করলেও কোনো সমস্যা নেই তো।
-কিন্তু বাবা…
-কোনো কিন্তু নেই। শুনে এসো তুমি। মনে হচ্ছে খুব জরুরি কিছু বলবে ও। ছুটে এসেছে ওভাবে।
শীতল দৃষ্টিতে মাহীমের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। মাহীম অসহায়ভাবে ইশারায় বুঝালো, আমার কথাটা শোন ভাই। বাবার সামনেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে ওর শার্ট ধরে টেনে নিজের সামনে নিয়ে পিঠে ধাক্কা লাগালো প্রাপ্ত। এক ধাক্কাতেই দরজা ঠেলে ভেতরের রুমে ঢুকেছে মাহীম। প্রাপ্ত শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে, ওর দিকে এগোতে এগোতে বললো,
-সমস্যা কি তোর? তোর জন্য কি বাবার সাথে নিজের বিয়ের আলাপও করতে পারবো না ঠিকমতো? বল তোর জরুরি আলাপ। আমি তো শুনি। তবে যদি তোর আলাপে জরুরি কিছু না থাকে, আমি নিজ দায়িত্বে তোকে জরুরি খাতিরের মাধ্যমে হসপিটালের জরুরি বিভাগে পাঠিয়ে দেবো। বল এবার।
-বিয়ের আলাপ মানে? কার সাথে? খই?
মাহীমের বিস্ময়ের সুর। প্রাপ্ত বললো,
-না। যাকে ভালোবাসি তার সাথে। তুই বল কি বলবি।
-তুই কি সাদিক আঙ্কলেকে রকস্টার ইচ্ছের বিষয়ে বলতে যাচ্ছিলি?
প্রাপ্ত থামলো। মাহীমের সাথে ওর ওঠাবসা বেশি। ইচ্ছেকে নিয়ে ওর অনুভূতিগুলোও ও টের পেয়ে যাবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। শান্তভাবে বললো,
-হেয়ালী না করে আগে বল কি বলতে এসেছিলি। তাড়া আছে আমার।
-তুই রকস্টার ইচ্ছেকে ভালোবাসিস।
চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো প্রাপ্ত। অস্বীকার করার উপায় নেই। অস্বীকার করতে ইচ্ছে করছে না ওর। শুধু মাহীম কেনো, চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে বলতে ইচ্ছে করছে ওর, ও ইচ্ছেকে ভালোবাসে। ঠোটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে একধ্যানে কিছুক্ষন মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। তারপর মাথা তুলে মাহীমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-হ্যাঁ ভালোবাসি। ভালোবেসে ফেলেছি ওই রকস্টারকে। প্রচন্ড! ওকে ছাড়া থাকা দায় হয়ে গেছে আমার মাহীম। খুব বেশি ভালোবাসা আর তার থেকে দুরুত্ব, এতো বেশি ভয়ানক হয় বুঝি? পাগল করে দিয়েছে আমাকে সে। লিটরেলি পাগল করে দিয়েছে। তাকে ছাড়া মনমস্তিষ্কে আর কোনো কিছুই আসছে না। কি করি বলতো?
ওর কথা শুনে মাহীম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো। প্রাপ্ত হেসে বললো,
-থাক। তোকে বলতে হবে না। বাবার সাথে ওকে নিয়েই কথা আছে আমার। বাবাকে বলে, তারপর ওকে প্রোপোজ করতে যাবো ভাবছি। সময় নষ্ট করিস না আমার। কিছু বলার থাকলে বল, নইলে আমি আসছি।
নিরবে ওর দিকে চেয়ে রইলো মাহীম। রাগ নিয়ে তেড়ে এগোতে গিয়েও নিজেকে সামলালো প্রাপ্ত। ওকে জ্বালাতেই মাহীম এসময় এসেছে এমনটা ভেবে পেছন ফিরলো বেরিয়ে আসবে বলে। মাহীম ডাক লাগিয়ে বললো,
-যাস না প্রাপ্ত।
-শা’লা! কুসংস্কার বলেও একটা কথা আছে! এই কাজেও পিছনডাক দিলি? ফিরবো না আমি।
চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংবরন করতে গিয়ে বিরক্তি বাড়লো। মাহীমের দিকে ফিরে না ফিরে হাটতে হাটতেই বললো ও কথাটা। মাহীম ধরা গলায় বললো,
-ইচ্ছের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে প্রাপ্ত। সামনের পনেরো তারিখ ওর বিয়ে।
#চলবে…
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকমহল,
আজকে গল্প নিয়ে কিছু কথা বলি। আসলে এ গল্পটাতে চার চারটে মুল চরিত্র দিয়ে আমি মানুষের মন, বর্তমান পারিপার্শ্বিক, স্মৃতি, বাস্তবতা সবকিছু মিলিয়ে ভালোবাসাগুলো যেসব পরিস্থিতি ফেইস করে, তাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। লক্ষ্য করলে দেখবেন, পার্শ্বচরিত্র মিষ্টি-সাফোয়ান, মাহীম-রাকা জুটিদুটোও এই চেষ্টার বহির্ভূত না। এগোচ্ছি কাহিনীবিস্তৃতির মৃদ্যুছন্দে। যদি ঘটনাপ্রবাহ কারো কাছে কোথাও বোধগম্য হয়ে না ওঠে, আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে গল্পের জুটিগুলো নিয়ে আমি সেভাবেই এগোবো, যেভাবে শুরুতেই প্লট সাজিয়েছি। ভালোবাসা সবার জন্য❤ ]