#প্রেমমানিশা(০২)
‘ কবি সাহেব… ‘
আচমকা সানার ডাকে ওর দিকে ঘুরে তাকালো ফারহান। সানাহ্ বারান্দার স্লাইডের গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে । ফারহান একটু অবাকই হলো সানার এহেন সম্বোধনে। অবাক হয়ে বললো ‘ কে কবি সাহেব ? ‘
‘ এখানে তো আপনি আমি ছাড়া আর কেউ নেই আর একমাত্র আপনিই ছেলে… আমি তো ছেলে নই… ‘
সানার কথায় ফারহানের মুখ লাল হয়ে গেল। সেটা লজ্জায় নাকি অন্য কোনো কারণে বুঝা গেলোনা। ফারহান বুঝলো মেয়েটা সোজাসাপ্টা উত্তরে তাকে খোঁচা মেরে দিয়েছে। ফারহান সহসা বললো ‘ আমার নাম আছে…. এই নামে ডাকার কারণ ? ‘
‘ আমি জানি আপনার নাম আছে কিন্তু আপনি আমার কলেজের প্রফেসর তবে আমার প্রফেসর নন তাই আপনাকে স্যার বলে ডাকবো না তাছাড়া আপনি আমার বড় তাই আপনাকে নাম ধরেও ডাকা যাবে না। তাই কবি সাহেবই বেটার…. আপনি তো অসাধারণ একজন লেখক আর কবি, অন্তত অতসী তো তাই বলে । ‘
সানার কথায় ফারহানের টনক নড়ল । জিজ্ঞেস করলো ‘ অতসী কে যে দেখলাম না… ‘
‘ ভার্সিটি গেছে… আজ আপনারা আসবেন বলে মা আমায় ভার্সিটি যেতে দিল না । রুদ্র তো এবার hsc ক্যান্ডিডেট না ? ‘ সানার সোজাসাপ্টা উত্তর ।
‘ হুম… ‘
‘ কিছু বলবেন ? ‘
‘ হুম… আমি এই বিয়েতে রাজি না । মা আমায় জোর করে বিয়ে দিচ্ছে… আর আমার মনে হয় আপনিও রাজি না । তাই আপনি আঙ্কেল আন্টিকে বলুন আপনার আমাকে পছন্দ না তারপর বিয়ে ভেঙে দিন । ‘
ফারহানের কথায় সানাহ্ অবাক হলো না। সে ধারণা করতে পেরেছিল ফারহান এমনই কিছু একটা বলবে নাহলে ওকে এভাবে বারান্দায় ডাকতো না। তাই সানাহ্ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল ‘ আপনাকে কে বললো আমি এই বিয়েতে রাজি না ? ‘
সানার কথা শুনে ফারহান চমকে উঠলো। ফারহান সানার কথার মানে ঠিক বুঝতে পারল না তাই বললো ‘ মানে ? আপনি এই বিয়েতে রাজি ? ‘
‘ অবশ্যই…. না রাজি হওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না…আপনি হ্যান্ডসাম, ওয়েল ইস্টাবলিশড… একজন বিখ্যাত কবি আর লেখকও। তাছাড়া আপনার তো সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কোনো বাজে অভ্যাসও নেই…আপনি মদও খান না । আপনার মত একটা ছেলেকে বিয়ে করাতো সব মেয়েদের ঘুমন্ত স্বপ্ন…. ‘
সানার কথায় ফারহান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো। খানিক সময় লাগলো নিজেকে সামলে উঠতে। নিজেকে সামলে উঠে তীক্ষ্ণ চোখে সানার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো ‘ আপনি কি করে জানলেন আমার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে আর সব মেয়েদের ঘুমন্ত স্বপ্ন মানে ? আপনারও কি একই সপ্ন ? ‘
সানাহ্ ফারহানের কথায় ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো অতঃপর বললো ‘ আপনার বাড়িতে গেলেই আশা আন্টি আমাকে জোর করে আপনার ঘরে ঢুকিয়ে দেন যেন আপনার সঙ্গে খাতির জমাই। কিন্তু আন্টির দুর্ভাগ্য আমি আসছি শুনলে সবসময়ই আপনি পালিয়ে যান। আপনার বারান্দার সিড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়েন । আর সব মেয়েদের যেহেতু এই স্বপ্ন সেই ক্ষেত্রে আমিও ব্যতিক্রম নই… মেয়েরা সহজাতবশত টল অ্যান্ড হ্যান্ডসাম ছেলেদের পছন্দ করেন তাই আমিও করি। আফটার অল আপনাকে বিয়ে করলে আমার যাবতজীবন সুখে কাটবে । ‘
সানার কথা শুনে ফারহান হতাশ হলো। সে ভালো করেই জানে সানাহ্ মোটেই তাকে টাকার জন্য বিয়ে করছে না কারণ তার বাবার যথেষ্ট টাকা আছে আর তার রেজাল্ট অনুযায়ী সে যেকোনো সময় আর্মি,ডাক্তার দেখে বিয়ে করতে পারবে। শুধু শুধু তার মতো সামান্য কবিকে বিয়ে করে বাকি জীবন বাংলা সাহিত্যের কবিতা শোনার কোনো মানেই হয় না । সানাহ্ বিয়ে কেন করতে চাইছে সেটা ফারহান জানেনা তবুও যে করেই সানাহ্কে বুঝিয়ে শুনিয়ে এই বিয়ে ভাঙতেই হবে নাহলে যে তার আজীবন সন্ন্যাসী থাকার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে।
‘ দেখুন মিস সানাহ্…আপনি বুঝতে চাইছেন না…আমার পক্ষে এই বিয়েটা করা…. ‘
ফারহান তার কথা শেষ করতে পারলনা তার আগেই সেখানে ভেসে এলো এক মিষ্টি গলার তরুণীর কণ্ঠস্বর। সানাহ্কে সেই তরুণী পিছন থেকে জাপটে ধরে সানার ঘাড়ে থুতনি রেখে বললো ‘ দুলা….ভাই…. আমার সহজ সরল আপাকে নির্জনে নিয়ে কি বলা হচ্ছে শুনি ? বিয়ের আগেই কি বিয়ের পরের হানিমুনের প্ল্যান করা হচ্ছে দুলা….ভাই…. । তবে এই অতসী থাকতে আমার আপাইকে কিছুতেই বিয়ের আগে কাছে পাওয়া যাবেনা…নো নেভার…নো হাঙ্কি পাঙ্কী… ‘ ।
অতসীর কথায় ফারহান খানিকটা বিব্রত হলো। তার কথাগুলো অসমাপ্ত হয়েই গলায় রয়ে গেলো। ফারহান কিছুটা বিব্রতকর চাহনি দিল সানার দিকে তবে সানার সেই দিকে চোখ নেই। সানাহ্ ফারহানের দৃষ্টি বুঝতে পেরেও এমনভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো যেন ও ফারহানের অসস্তিকর চাহনি দেখতেই পায়নি।
‘ আমার গম্ভীর মেজাজি বোন আজও চুপ করে আছে কেন ? ‘
অতসীর কথায় অতসীর দিকে অগ্নিদীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো সানাহ্ তবে অতসী সেই দৃষ্টি পাত্তা দিলনা। অতসী বললো ‘ তা তোদের প্রেমালাপ হলে নিচে চল
… মা আর আন্টি ডাকছে তোদের। আন্টি বেরোনোর জন্য রেডি দুলা….ভাই…. ‘।
এখানে থাকলে আবারও অতসীর অসস্তিকর কথাবার্তার মুখে পড়তে হবে এটা ফারহান বেশ ভালই বুঝে গেছে তাই সময় থাকতেই কেটে পড়তে হবে। অসমাপ্ত কথাগুলো নাহয় পরে একসময় বলা যাবে। হাতে সময় তো এখনও এক মাস আছে…. সময় তো আর ট্রেন ফেল করবে না।
সিঁড়ি দিয়ে সানাহ্, অতসী আর ফারহান নেমে আসতেই মিসেস আশা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ফারহানের উদ্দেশ্যে বললেন ‘ কিরে তুই না বললি ভার্সিটি যেতে হবে ? তোর না কাজ আছে ? তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলি ? হাত ধুতে এত সময় লাগে ? ‘
মিসেস কায়নাত তার বান্ধবী মিসেস আশার এরকম বোকামিতে বেজায় বিরক্ত হলেন তবে মুখে কিছু বললেন না কারণ সামনে ছেলে মেয়ে আছে আর তাদের সামনে বান্ধবীকে অসম্মানের মুখে ফেলতে চাননা।
ফারহান তার মায়ের প্রশ্নের জবাব দিলনা বরং কথা ঘুরিয়ে বললো ‘ চলো চলো..…বেরিয়ে পড়তে হবে। তোমাকে বাড়ি নামিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে তারপর আবার আমার ভার্সিটি যেতে হবে…. ‘
মিসেস আশাও আর দ্বিমত করলেন না, এক কথায় বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। মিসেস আশা বেরিয়ে যাওয়ার আগে অবশ্য সানার ললাট ছুঁয়ে আদুরে চুমু খেয়ে সানার জন্য দোয়া করে ‘ মায়ের কথা শুনে চলবে আর মাকে রাগাবে না ‘ বলে বের হলেন।
বাড়ি ফিরেই ফারহান তার ঘরে চলে এলো। ঘরে ঢুকে আওয়াজ করে দরজা লাগিয়ে দিল তারপর ফ্রেশ হয়ে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ফ্যানের বাতাসে সবে চোখে ঘুম ঘুম ভাবটা এসেছিল এমন সময় দরজার বাহিরে থেকে কেউ শশব্দে দরজার কড়া নাড়ল। শব্দে ফারহানের ঘুম উড়ে গেলো। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে টলমল পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাখান খুলে আবারও বিছানায় এসে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল।
খানিকক্ষণ বাদে পিঠে মায়ের আদুরে স্পর্শ পেয়েও কোনো সাড়া শব্দ করলো না ফারহান। মিসেস আশা আলতো হাতে ফারহানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন ‘ সানাহ্কে পছন্দ হলো তোর ? ‘
সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে তড়িৎ গতিতে উঠে মায়ের মুখোমুখি বসলো ফারহান। চঞ্চল দৃষ্টিতে বললো ‘ মা এই বিয়ে কিছুতেই হতে পারেনা… আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না বিয়ে করা… ‘
ছেলের কথায় যেন মিসেস আশা মজা পেলেন এহেন ভঙ্গিতে মুচকি হেসে ফারহানের মাথার এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিয়ে বললেন ‘ সমস্যা কি আজ নাহোক কাল করবি… এখনই তো তোকে কেউ বিয়ে করতে বলছে না । তোদের আকদ তো সামনের মাসে… ‘
‘ সামনের মাস কেন কোনো মাসেই করবো না। স্পেশালি মিসেস সানাহ্কে তো একদমই না। ‘
ফারহানের কথায় হতাশ হলেন না মিসেস আশা। ফারহানের বিয়ে নিয়ে এরূপ ব্যবহার তার কাছে মোটেই আশ্চর্যজনক কিছুনা কারণ এমনটা আগেও হয়েছে। এই নিয়ে ফারহানের জন্য বিশটা মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলে তার বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে পণ করেছে এই বলে যে আদো জীবনে কখনও বিয়ে করবে না সে । কিন্তু তাই বলে তো এমনটা চলতে দেওয়া যায়না। নিজ দায়িত্বে ছেলের জীবন তো তাকেই গুছিয়ে দিতে হবে কারণ সে তো মা ।
‘ কেন সানাহ্ আবার কি দোষ করলো ? ‘ মিসেস আশা অবাক হওয়ার ভান করে বললেন ।
‘ দোষটা তো মিস সানার নয়.. উনি হলেন ইংলিশ লিটারেচারের স্টুডেন্ট আর আমি বাংলা সাহিত্যের প্রফেসর। আমরা দুই মেরুর মানুষ তাই আমাদের মধ্যে কখনই কোনো সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না… তেল আর জলকে যেমন একসঙ্গে রাখলে কখনও এক হয়না তেমনই ইংলিশ লিটারেচারের স্টুডেন্ট আর বাংলা সাহিত্যের প্রফেসরকে একসাথে রাখলেও কোনো লাভ হবে না.. ‘
ছেলের কথায় দমে গেলেন না মিসেস আশা। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বললেন ‘ তুই সানার পড়াশুনাকে বিয়ে করছিস না ওকে ? বিয়ে তো ওকে করছিস তাহলে সেখানে ও কি পড়লো, কি খেলো তাতে কি যায় আসে ? ‘
‘ যায় আসে মা…. যায় আসে। তুমি আমাদের বিয়ে দিতে চাইছো আর দুটো মানুষের মধ্যে যখন একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হয় তখন দুজনের মধ্যে একটু হলেও মিল থাকা উচিত । তুমি উনার চাল চলন দেখেছো ? উনি পুরোই বিদেশিনী…. বড় বিদেশি রাইটারদের বই পড়েন, সবসময় চামচ দিয়ে খান, হাতে সবসময় বই আর চোখে চশমা, বিদেশি গান শুনেন। আর আমাকে দেখেছো ? আমি তো পুরো দস্তর বাঙালি । উনি ব্রাইট স্টুডেন্ট, ইংলিশ নিয়ে পড়ছেন……হয়তো কখনও বিদেশেও চলে যাবেন। সেখানে উনার এত ভালো ক্যারিয়ার রেখে উনার আমাকে বিয়ে করে সারাজীবন বাংলা সাহিত্যের কবিতা শোনার কি কোনো মানে হয় ? এরপরও তোমার মনে হয় আমাদের বিয়েটা সাকসেসফুল হবে ? আমাদের বনিবনা হবে ? ‘
ছেলের কথায় মিসেস আশা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন ‘ তুই যে এত আপত্তি করছিস তা সানাহ্ কি একবারও বলেছে তার তোর সঙ্গে এডজাস্ট করতে প্রবলেম হবে ? ‘
ফারহান তার মায়ের কথায় কিছুই বলতে পারলনা কারণ সত্যি তো এটাই যে সানাহ্ নিজ থেকে আগ্রহ নিয়ে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। সানাহ্কে দেখে মোটেই মনে হয়নি কেউ তাকে বিয়ের ব্যাপারে জোর করে রাজি করিয়েছে । তাহলে এখন মায়ের প্রশ্নের জবাবে কি বলবে ?
‘ ব্যাস তোর নীরবতাই বলে দিচ্ছে সানার কোনো আপত্তি নেই এই বিয়েতে… সুতরাং এত গড়িমসি করে লাভ নেই । বিয়ে তোকে করতেই হবে… আমি বরং ঘরে যাই….একটু ঘুমোনো দরকার। ‘
‘ আরে বাবা কিন্তু বিয়ে তো একজন মানুষের মত নিয়ে হয়… ‘
ফারহান তার কথা শেষই করতে পারলনা কারণ তার আগেই মিসেস আশা তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ফারহান বিরক্তিতে খাটের হেডে হেলান দিয়ে রইল। তার এখন দুঃখে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। সানার ফোন নাম্বারটাও নেই যে তাকে ফোন করে একটু বোঝাবে। যা করতে হবে কালই করতে হবে… অতসীর থেকে সানার ফোন নাম্বার চেয়ে নিতে হবে।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….
গল্পটা কেমন হবে বা কতটুকু ভালো লাগবে তা তো বলতে পারছি না তবে কেন জানি গল্পের নামটা বেশ পছন্দ হইছে