প্রেমমানিশা(০৫)

#প্রেমমানিশা(০৫)

নিজের দাদুকে হঠাৎ আনমনা হয়ে উঠতে দেখে প্রণয়ের ভ্রু কুচকে এলো। সে দাদুর দিকে এগিয়ে গিয়ে দাদুর কাধে হাত রেখে বলল ‘ কি হয়েছে দাদু ? কি ভাবছো ? ‘

প্রণয়ের ডাকে জালাল সাহেব অতীতের স্মৃতি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। নিজের মন খারাপের মেঘ মনেই লুকিয়ে রেখে মেকি হেসে বললেন ‘ তুমি বাড়ি ফিরছিলে না বলেই টেনশন হচ্ছিল দাদুভাই ? এখন তুমি ফিরে এসেছ তাই এখন আর কোনো টেনশন নেই। ‘

দাদুর কথা শুনে প্রণয় বললো ‘ দাদু আমি এখন বড় হয়েছি……নিজেকে বিপদ আপদে রক্ষা করার ক্ষমতা অর্জন করেছি…… আমাকে নিয়ে খামোখা এত চিন্তা করো না। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে গিয়েই তো বিপিটা বাড়িয়ে নিলে…… কই এশা ? যা গিয়ে প্রেসারের মেশিনটা নিয়ে আয়…… দাদুর বিপি মেপে দেখি। ‘

নাতিকে তাকে নিয়ে এত চিন্তায় পড়ে যেতে দেখে জালাল সাহেব হেসে বললেন ‘ আরে দাদুভাই এত চিন্তা করছো কেন ? এত চিন্তার কিছু নেই….… আমার কিছু হয়নি ‘।

‘ তুমি তো কিছু বলোই না দাদু…… কই এশা গেলি না ? আর চাচীমণি খাবারের ব্যবস্থা করো তো….…জবরদস্ত খিদে পেয়েছে। পেট পুড়ে খেতে হবে ‘

প্রণয়ের কথায় মিসেস ছায়া দৌড়ে গেলেন ভাতিজা ভাতিজির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে আর এশা তার ভাইয়ার আদেশ পেয়ে ছুটে গেলো।

—-

মোবাইল হাতে দাড়িয়ে আছে ফারহান। তার দৃষ্টি মোবাইল পানে স্থির। চোখ জোড়া যেন হাজার বছরের ক্লান্তিতে ঠাসা। আসলে সে ভেবে পারছেনা সানাহ্কে ফোন করবে নাকি করবে না…… মোবাইলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফারহান চোখ দিলো ঘড়ির দিকে । রাত ১ টা বাজতে দশ মিনিট বাকি। অবশেষে অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করলো সানাহ্কে ফোন করবে। তাই যেই ভাবা সেই কাজ।

এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের….

মধ্য রাতে ফোনের মধুর শব্দে বিভোর পুরো ঘর। বিছানার উপর চারদিকে ছিটিয়ে পড়ে আছে বই খাতা, কিছু কিছু বই খাতা আবার স্তূপ আকারেও সাজানো। তাদের মাঝেই গুটিসুটি মেরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঠান্ডায় শুয়ে আছে এক তরুণী। ঠান্ডায় তার জবুথবু অবস্থা তবুও তার চোখের ঘুম হার মানতে নারাজ।

অবশেষে অনেক্ষন ফোন বাজার পর সানাহ্ ঘুমঘুম চোখে আশপাশ হাতড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে ফোন লাউস্পিকারে দিয়ে মাথা আবারও বালিশে এলিয়ে দিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলল ‘ Who’s speaking ? ‘

সানার ঘুমঘুম মোটা গলা ফারহানের বুকে এক তীব্র ঝড়ের সৃষ্টি করলো। ফারহান তার বুকের মধ্যে হওয়া ঢিপঢিপ শব্দের আভাস পেলো। ফারহান দাতে দাত চেপে অনেক চেষ্টা করলো বুকের ভিতর ধড়াম ধড়াম আওয়াজটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার কিন্তু ব্যর্থ হলো। সৃষ্টিকর্তা যদি মানুষকে অন্য মানুষের ভিতর হওয়া আওয়াজ শোনার ক্ষমতা দিতেন তাহলে কত বিপর্যয়টাই না ঘটে যেত। ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা এই ক্ষমতা কাউকে দেননি তাইতো সানাহ্ আজ ফারহানের বুকে হওয়া তীব্র উথাল পাথালের হদিস পেলো না।

ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সানাহ্ কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। ঘুমঘুম বিরক্তিমাখা গলায় আবার বললো ‘ who’s speaking ? ‘

এবার সানার বিরক্তি মিশ্রিত স্বর ফারহানের বোধদয় ঘটালো। ফারহান সচকিত হয়ে বললো ‘ আমি…… ‘
ঘুমে বিভোর থাকায় সানাহ্ ফারহানের গলার স্বর চিনতে পারেনি। বিরক্ত হয়ে বললো ‘ আমি কে ? পরিচয় দিন…… ‘
ফারহান আবছা মৃদু গলায় বললো ‘ আমি….আমি……আমি ফারহান ‘

এবার ‘ ফারহান ‘ নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সানার চোখের ঘুম উড়ে গেলো। সানাহ্ লাফ দিয়ে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু হড়বড় করতে গিয়ে হাতের কাছে থাকা বইয়ে টান লেগে বইগুলো মাথায় পড়ে গেলো। ভারী ভারী বইয়ের জোরে সানাহ্ ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো।

ফোনের ওপাশ থেকে সানার আর্তনাদ মিশ্রিত সুর শুনতে পেয়ে ফারহান ব্যস্ত হয়ে উঠলো। অস্থির গলায় বললো ‘ আপনি কি ঠিক আছেন মিস সানাহ্ ? আপনি কী ব্যথা পেয়েছেন ? ‘
ফারহানের প্রশ্নের জবাবে সানাহ্ কিছুই বললো না বরং সে জিজ্ঞাসু গলায় বললো ‘ আপনি ? ‘

সানার কথার ধরনে ফারহান বুঝলো সানাহ্ তার প্রশ্নের জবাব দিবে না তাই সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো ‘ জি আমি……আসলে আমার আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল ‘ ।

হঠাৎ সানাহ্ গম্ভীর হয়ে গেলো। নিরস গলায় অনাড়ম্বরে বলে ফেললো সেই ভয়ঙ্কর কথা ‘ আপনি কি জানেন মাঝ রাতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকের কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতীর কাছে ফোন দেওয়াটা অভদ্রতার লক্ষণ ? ব্যাপারটা অশোভন…… ‘

সানার কথায় ফারহান হতভম্ব হয়ে গেলো। মিনিট পাঁচেক লাগলো তার ব্যাপারটা বুঝে উঠতে যে সানাহ্ গম্ভীর গলায় একদম স্বাভাবিক ভাবেই তাকে ঠেস মেরে কথা বলেছে। ফারহানের সুন্দর শ্রী সঙ্গে সঙ্গে রক্তিম হয়ে উঠলো তা রাগে নাকি লজ্জায় বোঝা গেলো না। ফারহান অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো । স্বাভাবিক গলায় বললো ‘ আসলে আপনার সঙ্গে আমার অতীব জরুরি কিছু কথা আছে যেগুলো অন্য সময়, অন্য কোথাও বলা যেত না বিধায় এত রাতে এই সময় আপনাকে ফোন করে বলতে হলো। আপনার কি এতে কোনো আপত্তি আছে ? ‘

‘ না…… ‘ সানাহ্ এক কথায় ফারহানের প্রশ্নের উত্তর দিলো।ফারহান সানার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ‘ আপনি কি সত্যিই এই বিয়েতে রাজি ? আপনার কি কোনো আপত্তি নেই এই বিয়েতে ? ‘

‘ অবশ্যই আমি রাজি……আপনার বারবার কেন এটা মনে হচ্ছে যে আমার এই বিয়েতে আপত্তি থাকার কথা ? ‘

‘ কারণ আপনি এই বিয়েতে রাজি হলেও আমি এই বিয়েতে রাজি নই……আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না । ‘

ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ এক অন্য রকমভাবে শান্ত যেন এই শান্তি ঝড়ের পূর্বাভাস। সানাহ্ শান্ত গলায় বললো ‘ আমাকে আপনার বিয়ে না করার কারণ কি জানতে পারি ? আমাকে আপনার পছন্দ নয় ? ‘

‘ আমার আপনাকে পছন্দ নাকি পছন্দ না ব্যাপারটা সেটা নয়…… ব্যাপারটা হলো আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি না…… ‘

‘ আমার আশেপাশে যারা থাকে তারা সবাইই বলে আমি নাকি আগুন সুন্দরী আই মিন ভয়ংকর সুন্দরী। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে কথাটা মিথ্যা। আমি এতটা সুন্দরী হলে আপনাকে আমার রূপে ঘায়েল করার মতো ক্ষমতা আমার থাকার কথা…. আমার মধ্যে কি কোনো খুঁত আছে ? ‘ শেষের কথাগুলো সানাহ্ খানিকটা থেমে বললো।

‘ কথাটা নিঃসন্দেহে সত্য কিন্তু কারোর সৌন্দর্যের ক্ষমতা নেই আমাকে ঘায়েল করার। আমি সৌন্দর্যের প্রেমে নই ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ি তবে এই জীবনে আমি কারোর প্রেমের পড়ব না কারণ আমার মনের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ। আর নিঃসন্দেহে আপনার মধ্যেও খুঁত আছে কারণ সৃষ্টিকর্তা কাউকেই নিখুঁত ভাবে তৈরি করেন নী। সবার মধ্যেই কিছু না কিছু খামতি আছে তবে আপনার ব্যাপারটা এক্সসেপশনাল। আপনি হলেন imperfectly perfect……imperfection আপনার ব্যক্তিত্ব…… ‘

ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ কিছুই বললো না……ফারহান প্রহর গুনছে সানাহ্ তার কথার জবাবে কিছু বলবে এই ভেবে কিন্তু সানাহ্ তাকে নিরাশ করে কিছুই বললো না। ফারহান আর উপায় না পেয়ে নিজে থেকেই বললো ‘ আপনি কি বুঝতে পারছেন যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি না..… ‘

‘ না বোঝার মত তো কিছু বলেন নি আপনি……আপনি আপনার বক্তব্য বাংলা ভাষাতেই বলেছেন যা মোটামুটি আমারও আয়ত্তে আছে। ‘

সানার কথা শুনে ফারহান নিশ্চিন্ত হলো। প্রশান্তির হাসি হেসে বললো ‘ তাহলে আপনি আন্টি আর আঙ্কেলকে বলে দিবেন যে আপনার আমাকে পছন্দ নয় তাই আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান না…… ঠিকাছে ? ‘

সানাহ্ কিছু বললো না। ফারহান ফোনের এপার থেকে শুধু সানার ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। সেকেন্ড কয়েক কেটে যাওয়ার পর ফোন টুট টুট আওয়াজ করে বন্ধ হয়ে গেলো। ফারহান বুঝতে পারলো ফোনের ওপারে থাকা মানুষটা ফোন কেটে দিয়েছে। তবে এই ভেবে শান্তি পেলো যে মানুষটাকে অন্তত বোঝানো গেছে যে সে তার জন্য ঠিক নয়।ফারহান খুশি মনে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে শান্তির এক ঘুম দেবে এই উদ্দেশ্যে কিন্তু তার এটা জানা নেই তার কিছুক্ষণ আগে বলা কথাগুলো একজনের মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে।

–—

পুরো বাড়ি তমসায় ছেয়ে আছে তবে শুধু আলো জ্বলছে অতসীর ঘরে। সে ব্যস্ত রাত জেগে ভার্সিটির পড়া শেষ করাতে। নতুন প্রফেসর আজ সব পুরনো চ্যাপ্টারের কনফিউশন ক্লিয়ার করেছেন বলে আজ আর নতুন চ্যাপ্টার ধরা হয়নি আর এটাই অতসীর জন্য প্লাস পয়েন্ট। নতুন প্রফেসরের পড়া না থাকায় একটা পড়া কমেছে। এই সাবজেক্ট শেষ করতে পারলেই আজ রাতের জন্য পড়া শেষ হয়ে যাবে।

বারান্দার ইজি চেয়ারে অন্ধকারের মাঝে একলা বসে আছে সানাহ্। বাড়ির বাইরের আবছা স্ট্রিট লাইটে সানার টকটকে লাল হয়ে যাওয়া চোঁখ ধরা পড়েছে। সানার চোঁখ লাল, কপালের রগ ফুলে উঠেছে…… মাথার ভিতর ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ হচ্ছে যেন কেউ বারবার আধ ভাঙ্গা দরজা জোর খাটিয়ে লাগানোর চেষ্টা করছে।

সানার রক্তিম চোখ এই মুহূর্তে কেউ দেখলে নির্ঘাত ভয় পেয়ে যাবে। আজ অনেক বড় এক ঝামেলা বেধেছে। এরকম ঝামেলা হলেই সানার শরীর আস্তে আস্তে খারাপ করতে শুরু করে। এই শরীর খারাপ এক সময় এতটাই খারাপ পর্যায় চলে যায় যে সানাহ্ আর দাড়িয়ে থাকতে পারে না। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় সেই সঙ্গে গা জালানো ১০৪° জ্বর।

সানাহ্ আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। তার রক্ত লাল চোখ থেকে পানি পড়ছে। মনে হচ্ছে শরীরের ভিতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে। এমনও মনে হচ্ছে সানাহ্কে এখন কেউ আগুনের চুলার উপর থাকা প্রকান্ড এক পাতিলে বসিয়ে দিয়েছে আর সেই আগুনের তাপে সানার শরীরের ভিতর রক্ত টগবগ করে ফুটছে। সানাহ্ জানে সে এখন আস্তে আস্তে ঘোরে চলে যাচ্ছে, জ্বরের ঘোরে। সানাহ্ যত ঘোরে চলে যাবে ততই সে অবাস্তব কাল্পনিক চরিত্র দেখবে যাদের অস্তিত্ব এক সময় ছিল তবে এখন আর নেই।

‘ মাম্মাম ‘

সানাহ্ জ্বরের ঘোরে অন্ধকার বারান্দার দরজার কাছ থেকে ডেকে ওঠা পরিচিত লোকটার গলার আওয়াজ পেল তবে উত্তর দিলো না। সেই লোকটা এবার সানার দিকে এগিয়ে এসে খানিকটা ঝুঁকে আবারও মৃদু গলায় ফিসফিস করে বললো ‘ মাম্মাম তুমি শুনতে পারছো ? ‘

লোকটার কথা শুনে সানাহ্ অবাক হওয়ার ভান করলো। চেহারায় অবাকের রেশ ধরে দ্বিগুণ উৎসাহে ফিসফিস করে বললো ‘ কি শুনবো বাবাই ? ‘
লোকটা বললো ‘ ওই যে আমার প্রিয় তোমার আমার গান…… ‘
লোকটার কথা শুনে সানাহ্ তার কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো….

এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের

এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনে
এই রাত তোমার আমার

সানাহ্ তার অবচেতন মনে শুনতে পেলো তার বাবাইয়ের প্রিয় গান ‘ এই রাত তোমার আমার ‘। সানাহ্ ফিসফিসিয়ে বললো ‘ হ্যাঁ বাবাই শুনতে পাচ্ছি.. ‘ ।
মেয়ের উত্তর পেয়ে এবার লোকটা নিঃশব্দে সানার পাশে বসে আকাশ পানে তাকালো। আকাশের দিকে তাকিয়েই বললো ‘ মাম্মাম তুমি কার মেয়ে ? তোমার মামনির না আমার ? ‘

সানাহ্ লোকটার কথা শুনে বিভ্রান্তিতে পড়লো না। সহসা অনাড়ম্বরভাবে জবাব দিলো ‘ আমি আফজাল করিমের মেয়েও না আবার আয়াত আমরীনের মেয়েও না। আমি তাদের দুজনের মেয়ে তাই সেই অর্থে আমি তোমাদের কারোরই একার মেয়ে নই। আমি যেমন তোমার মেয়ে তেমনই মামনিরও মেয়ে। ‘

আফজাল সাহেব যেন মেয়ের মুখ থেকে এই কথাই আশা করেছিলেন। উনি এক গাল হেসে মেয়ের গাঁয়ে হাত বুলিয়ে দিতে নিলেন কিন্তু তৎক্ষণাৎ মেয়ের শরীরের আগুন তাপে ছিটকে সরে গেলেন আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মৃদু চেঁচিয়ে বললেন ‘ মাম্মাম তোমার তো অনেক জ্বর…… ‘

সানাহ্ তার বাবাইয়ের কথায় আবারও অবাক হওয়ার চেষ্টা করলো যেন সে জানতোই না তার জ্বর এসেছে। অবাক গলায় বললো ‘ তাই নাকি বাবাই ? ‘

‘ হ্যাঁ মাম্মাম…… মাম্মাম তুমি এখানে বসো..আমি এক্ষুনি তোমার মামনিকে ডেকে আনছি ‘ বলেই আফজাল সাহেব বসার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

সানাহ্ তার বাবাই এখন চলে যাবে এই ভয়ে এই কনকনে শীতেও হালকা ঢোক গিললো। তার বাবাইকে হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। কাতর কন্ঠে বলল ‘ বাবাই ওটা কিছু না…… তুমি যেও না। তুমি এখানেই বসো……আমার কাছে বসো। আমায় ছেড়ে যেও না তুমি ‘

কিন্তু মেয়ের কথা আফজাল সাহেব শুনলেন না। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন ‘ আরে কী মুশকিল আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো কোথায় ? জেদ করে না মাম্মাম..…আমি এই যাবো আর এই আসবো। শুধু তোমার মামনিকে ডাকতে যাচ্ছি। তোমার মামনিকে ডেকে এসেই আমরা হাসপাতালে যাবো। তুমি বসো আমি আসছি তোমার মামনিকে ডেকে ‘ ।

কথাটা বলতে বলতেই আফজাল সাহেব এগিয়ে গেলেন ঘরের দিকে আর সানাহ্ সেই দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে জানে এই যে তার বাবাই গেছে সে আর ফিরবে না। তার আর ফেরা হবে না। সেও ফিরবে না……মামনিও ফিরবে না। দুজনেই মামনির ক্লিনিক থেকে ফিরতে সময় হঠাৎ করে হারিয়ে যাবে….

সকাল হয়েছে….… আজ অতসী ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠেছে। উদ্দেশ্য ভার্সিটি যাওয়ার আগে একবার বিল্টুদের সঙ্গে দেখা করা। তাই অতসী তাড়াতাড়ি করে রেডি হচ্ছে। ভার্সিটির পথে রওনা দিবে স্কুটি নিয়ে। কোনোমতে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে সেটা কাধে তুলে অতসী ছুটলো তার আপাইয়ের ঘরের দিকে। ভাবলো একবার দেখা করে যাওয়া যায় কিন্তু আপাইয়ের ঘরে যেতেই দেখলো তার মা আপাইয়ের মাথায় পানি দিচ্ছে আর আপাই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।

‘ মা আপাইয়ের কি হয়েছে ? এভাবে শুয়ে আছে কেন আর তুমিই বা ওর মাথায় পানি কেন দিচ্ছ ? ওর কি আবার জ্বর হয়েছে ? ‘ অতসী অবাক হয়ে বললো।

‘ সেই পুরোনো রোগ…… ভোরবেলা উঠেছিলাম ভাবলাম তোর আপাকে ডেকে দেই। উঠে দেখি মেয়েটা বারান্দায় বসে আছে……চোঁখ তার টকটকে লাল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কপালের রগ ফুলে উঠেছে আর শরীর প্রচন্ড গরম। বিশ্বাস কর আবছা আলোয় তোর আপার ওই রক্ত লাল চোঁখ দেখে আমি পুরো ঘাবড়ে গেছিলাম। কোনোমতে তোর বাবাকে ডেকে ওকে ঘরে নেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েটার মাথায় দুইবার পানি ঢাললাম কিন্তু জ্বর কমার বদলে আরও হু হু করে বাড়ছে । ‘ মিসেস কায়নাত শঙ্কিত গলায় বললেন।

‘ মা আপার এরকম অবস্থা কি করে হলো ? আপার তো স্ট্রেস নিলেই এরকম হয়। আপাই কি আবারও স্ট্রেস নিতে শুরু করেছে ? ‘ অতসী বললো।

‘ ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। উনি এসে দেখে গেছেন সানাহ্কে। এও বলেছেন সানাহ্ কোনো কারণে অনেক ডিপ্রেসড আর তুই তো জানিস তোর আপাই কেমন । যতই প্রবলেমের মধ্যে থাকুক না কেন কোনদিন মুখ ফুটে বলবে না। তাই ডাক্তার বলেছেন ওর জন্য ওয়েদার চেঞ্জ দরকার। আপাতত ও এই জায়গা ছেড়ে কোথাও গেলে সেটা ওর জন্য ঠিক হবে ‘ মিসেস কায়নাত বললেন।

‘ কোথায় পাঠাবে আপাইকে ? ‘

‘ তোর মামার বাসায় ..… ‘

‘ তাহলে আজ আমার আর কোথাও যেয়ে কাজ নাই..… আমি আপাইয়ের কাছেই থাকি। ‘

‘ না না বাবা দরকার নেই। তোর আপাই যদি জানতে পারে না তার অসুস্থতার জন্য তুই ভার্সিটিতে যাস নি তাহলে তোর তো ক্লাস নিবেই সঙ্গে আমারও নিবে। তুই তো জানিস তোর আপার শরীর খারাপ করলে তার মেজাজ তুঙ্গে উঠে থাকে…… ‘ মিসেস কায়নাত বললেন।

অগত্যা অতসী আর উপায় না পেয়ে বেরিয়ে এলো। অতসীর খুব খারাপ লাগছে তার আপাইকে ওভাবে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে দেখছে, যবে বাবাই আর মামনি মারা গেছে তবে থেকে।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here