#প্রেমাচার
কলমে: #অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
মা এবং ছোট ভাই এর মাঝে বসে শুরু থেকেই উসখুস করছে সৈয়দ মফিজউদ্দিন এর জ্যেষ্ঠ কন্যা সৈয়দ মেহনুভা হক। টানাটানা ভ্রু জোড়ার মাঝে তার বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। ছটফট করছে অনেক ক্ষণ হলো। দাদাভাই এখনও পরিষ্কার করে কিছু বলছেন না কেনো! দুই পরিবারকে ডেকে এতো বড় একটা ঘোষণা দিচ্ছে তবুও তার কাছে বিরক্তিকর লাগছে। সৈয়দ সাহেবের থেমে থেমে বুঝিয়ে বলা কথাও এ মূহুর্তে ভণিতা লাগছে। সরাসরি এক নিঃশ্বাসে বলে দিলেই তো ফুরিয়ে যায়। এতো প্যাচ ভালো লাগছে না মোটেও। মন চাচ্ছে এক ছুটে এখান থেকে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। রেস্টুরেন্ট যাকে মন চায় তাকে দেক, তাতে মেহনুভার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কাল যে সবচেয়ে কঠিন এক্সাম তার জন্য অপেক্ষা করছে এটা কেউ বুঝতেছে না কেনো! পরিবারের সবাই তো জানে, মেহনুভার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু কাল থেকে। তাবুও তারা কি ভাবে পারে এতো গুরুত্বপূর্ণ সময় গুলা তাকে অযথা এভাবে বসিয়ে রেখে নষ্ট করাতে। আচ্ছা, মেহনুভার বাবার না হয় রেস্টুরেন্টের জন্য ভীষণ রকমের চিন্তা হচ্ছে, কেননা তিনি রেস্টুরেন্ট নিয়ে অনেক সিরিয়াস কিন্তু দাদাভাই এর কি একটুও মায়া দয়া হচ্ছে না। এই যে কখন থেকে মেহনুভা গা ছাড়া ভাব করে বসে আছে এটাও কি উনি দেখছেন না! উনি কি বুঝতেছেন না, এসব পারিবারিক ব্যাপার স্যাপার এ মেহনুভা আগ্রহী নয়। উনি তো জানেন, কাল তার পরীক্ষা। তবুও! নিজের চুল নিজে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে তার। রাগ হচ্ছে ভীষণ রকমের।
মেহনুভার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্তের চুম্বুকাংশ টুকু অবশেষে ঘোষণা দিয়েই ফেললেন সৈয়দ শামসুল হক। ফুরফুরে মেহেদী রাঙা লাল দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
-“আমি জানি তোমারা দুই ভাই আমার যোগ্য উত্তরসূরী। রেস্টুরেন্টের দ্বায়িত্ব দিলে তোমদের দিলে খুব সুন্দর ভাবে পরিচালনা করতে পারবে। কিন্তু এটা তোমাদের যে কোনো একজনের হাতে আমি তখনি তুলে দিবো যখন তোমাদের উত্তরসূরীরা রান্না বান্নায় পারদর্শিতা দেখিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে।”
কথার অর্থ অনুধাবন করে কিছুটা চেতে গেলেন মফিজউদ্দিন। বাবার সিদ্ধান্তে বিরুদ্ধাচারণ করতে উঠে দাঁড়াতেই সৈয়দ সাহেবের যোগ্য স্ত্রী মনোয়ারা খানম গর্জে ওঠলেন। রাগান্বিত কন্ঠস্বরে থমক দিয়ে ছেলেকে বসিয়ে দিলেন। বললেন,
-“খবরদার মফিজ, বেয়াদবি করবা না। বেয়াদবি আমার পছন্দ না। উনি তোমার আব্বা, আমার স্বামী। আমার সন্তানের ঔদ্ধত্য পূর্ণ আচরন আমি বেঁচে থাকতে মেনে নিবো না। কথা শেষ করতে দাও উনাকে। বয়স হয়েছে আমার এজন্য কিছু বলি না বলে সাহস বেড়ে গেছে। বসো।”
শেষ শব্দটা বেশ জোর গলায় ধমকের স্বরে বললেন উনি। মায়ের ধমকে দমে গেল পুত্র। সৈয়দ সাহেব বিবির কড়া কন্ঠস্বরে মুখে হাত রেখে প্রশান্তি মূলক হাসি হাসলেন। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী’র সাথে সেই প্রথম দেখা হওয়ার দিনে যেমন তেজ ছিলো গলায়, এখনও ঠিক তেমনি আছে। বদলায় নি একটুও। পার্থক্য একটাই, প্রথম দিন সৈয়দ সাহেবের বিপক্ষে গর্জে উঠেছিলেন, আর আজ পক্ষে।
রাশভারি কন্ঠে আবারও বলতে শুরু করলেন সৈয়দ শামসুল হক।
-“আমি যা বলবো, মনে রেখো আমার সিদ্ধান্তই শেষ সিন্ধান্ত। তোমাদের ছেলে মেয়ে দের কে প্রস্তুত করো। আমকে জ্ঞান দিতে না এসে কিভাবে এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে হবে সেই জ্ঞান দাও। কেউ আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করার ইচ্ছা থাকলে বলে দাও এখনি। আমি অন্য ব্যাবস্থা নিবো।”
আলাউদ্দিন এবং মফিজউদ্দিন পিতা-মাতার কড়া নির্দেশে দমে তো গেলো সাথে পড়ে গেলো মহাচিন্তায়। ছেলে মেয়ে যে তাদের রান্নাবান্নায় একেবারে আনাড়ি। পারে না যে তা না। রান্নাবান্নার বেসিক নলেজ টুকু তাদের মাঝে আছে কিন্তু ভাত টুকুও তাদের খুব বেশি রান্না করে খাওয়ার প্রয়োজন হয়নি কখনও। আর তারা কিনা রান্না করবে! আর সেই রান্নায় বিজয়ীও হবে! আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর লাগলেও এখন আর কিছুই করার নেই দুই ভাই এর। পিতার নির্দেশ অমান্য করার দুঃসাহস দুই ভাই এর এক জনের ও নেই।
সৈয়দ সাহেব সবার উপর দৃষ্টি রাখলেন। এতোক্ষণ নাতী-নাতনী গুলো অমনোযোগী হয়ে থাকলেও এখন কেমন গোলগোল উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে তার ই দিকে। কোলে-ঘাড়ে তুলে বড় করা নাতী-নাতনীর চোখের ভাষা তিনি বুঝলেন। নিশ্চয়ই ছেলে মেয়ে গুলো অমনোযোগী থাকায় এতোক্ষণ বলা কথা গুলোর অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় নি। যেহেতু তারা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেহেতু তাদের মাঝে বিষয়টি পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘আমি চাই, আলাউদ্দিন এর কোনো সন্তান আর মফিজউদ্দিন এর কোনো সন্তানের মাঝে একটা প্রতিযোগিতা হোক। রান্নার প্রতিযোগিতা। বাকি সন্তানরা তাদের সাহায্যকারী হিসেবে থাকবে। প্রতিদিন ডিনারের জন্য আমার সিলেক্ট করা একটা ম্যানু রান্না করে আমার আর তোমাদের দাদুমনির সামনে পরিবেশন করতে হবে। তোমাদের রান্নাবান্না করা খাবার আমাদের সঠিক স্বাদ না দেওয়া পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে। আমি আবারও বলছি, এখানে শুধু মাত্র তোমাদের সন্তান রাই অংশ নিতে পারবে। তোমরা কেউ না। তবে পরামর্শ অবশ্যই দিতে পারবা। এই প্রতিযোগিতায় যার সন্তান সবচেয়ে ভালো রান্না করতে পারবে তার উপরেই আমি দ্বায়িত্ব তুলে দিবো। এখন আমাকে বলো, কার হয়ে কে এই কাজ করবে।”
সৈয়দ সাহেবের বিস্তারিত বক্তব্য শুনে সবার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পরলো। গুঞ্জন ওঠে গেলো সবার মুখে। আলাউদ্দিন এবং মফিজউদ্দিন দুই ভাই ভাবনায় মশগুল। তাদের ছেলে মেয়ে কেউ ই এই প্রতিযোগিতার জন্য যথোপযুক্ত না। বেসিক জানলেও রান্নাবান্না একটা শিল্প। শুধু জানলেই হয় না, কঠোর পরিশ্রম এবং বেশি বেশি অনুশীলন কিংবা চর্চা করতে হয়। রান্না কার্য প্রনালী কে অনেকেই ‘এ আর এমন কি’ বলে উড়িয়ে দিতে চায়। আসলেই কেই তাই?
পরিবারের প্রধান সদস্য সৈয়দ মফিজউদ্দিন হক ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে আছে কন্যা মেহনুভার দিকে। বাবার চাহনি উপলব্ধি করে মেহনুভা ডানে বামে মাথা নাড়াচ্ছে তুলকালাম বেগে। এ কোন ফাঁ’সাদে পরল সে। টুকটাক রান্নাবান্না সে পারে কিন্তু সেটাও খুব একটা ভালো না। কখনও লবন বেশি তো কখনো ঝাল। আর দাদাভাই যে মানুষ, উনার রুচিমাফিক খাবার রান্না করা অসম্ভব। মফিজউদ্দিন তার একমাত্র ছেলে মুবিন কে সরিয়ে মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মেয়েকে মানিয়ে নিতে নরম গলায় বললেন,
-“মেহনুভা, মা আমার। তুই কি চাস রেস্টুরেন্টে ওদের দ্বায়িত্বে যাক?”
মেহনুভার পুনরায় ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে
-“না।”
-“তাহলে দ্বায়িত্ব টা তুই নিয়ে নে মা।”
-“বাবা আমার এক্সাম কাল থেকে। তুমিও কি চাও আমি ফেইল করি।”
বাম পাশ থেকে মা সানজিদা খানম ঝটপট প্রশ্ন ছুড়লো,
-“ফেইল কেনো করবি? সারাবছর পড়িস নি নাকি! রান্না তো তুই এক বেলা করবি, সারাদিন তো করবি না।”
মায়ের কথা শুনে অবাক হলো মেহনুভা। বলে কি এসব! যেখানে সে এক্সামের সময় টয়লেট ইউজ করাও সময় অপচয় হিসেবে বিবচনা করে সেখানে এতো সহজে মামণি এমন কথা বলতে পারলো। মামণি কি জানে না, সে ছোট থেকেই পড়ালেখা নিয়ে কতো সিরিয়াস। মায়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁসে ওঠে বলল,
-“বললেই হলো। এমন ভাবে বলছো যেনো বললাম আর হলো। আমি কি ওতো কিছু রান্না করতে জানি?”
মেয়ের বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে মফিজউদ্দিন বললেন,
-“জানবি, সব জানতে আর শিখতে পারবি। আমি আর তোর মা শিখিয়ে দিবো।”
এতোক্ষণ আগ্রহের সহিত দেখতে থাকা মেহনুভার ছোট ভাই মুবিন পাশ থেকে বলে উঠল,
-“বাবা, আপুকে এতো তোষামোদ করার দরকার কি! ও রাজি না হলে আমাকে দ্বায়িত্ব দাও। আমি ঠিক পারব।”
-“তুমি যে কতো পারবা জানা আছে আমার। আ/গুন লাগাবা কিচেনে গেলে।”
এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মফিজউদ্দিন এর কথা শুনে ঠোঁট চেপে হেসে উঠলো সকলে। নাদুসনুদুস মায়মুনা জানে দ্বায়িত্ব তার আপুর ঘাড়েই পরবে। তাই এদিকের সব বাদ দিয়ে চলে গেছে ওই পরিবারের কাহিনি দেখতে।
আপনারাও আসুন।
আলাউদ্দিন হক ছেলেকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছেন না। মনে মনে খুব রেগে যাচ্ছেন, কিন্তু ছেলে তার এক রোখা। সারাদিন বিজনেস ডিল করতে করতে জীবন তার তেজপাতা সেখানে নাকি এখন খুন্তি-কড়াই ধরবে, রান্না করবে। রান্না করার মতো এতো ধৈর্য সৈয়দ পরিবারের বড় নাতি সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মাশরিফ জায়ান এর নেই। ছেলেকে মানাতে না পেরে রাগে তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠে র’ক্তিম চোখে স্ত্রী’র দিকে তাকালেন আলাউদ্দিন হক। আয়েশা সিদ্দিকা চোখ টিপে ঘাড় বাঁকিয়ে স্বামীকে শান্ত হতে ইশারা করলেন। ছেলের হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললেন,
-“বাবা জায়ান, লক্ষী বাবা আমার। তোর বাবার অবস্থাটা বোঝ বাবা।”
-“বাবার অবস্থা বাবাকে বুঝতে দাও, দ্বায়িত্ব নেহাকে দাও। লাস্ট বার বলছি আম্মা, আমি পারবো না মানে না। এক কথা বার বার বলতে ইচ্ছা করে না। চলে যাচ্ছি আমি।”
কথা শেষ করে ঝট করে ওঠে দাঁড়ানো মাশরিফ কে দু হাতে টেনে ধরলো তার মা এবং বোন। শক্তপোক্ত ছেলেটাকে বসালো খুব কষ্ট করে।
ছেলের প্রতি আলাউদ্দিন হকের রাগ তিরতির করে বাড়ছে। কখন না জানি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। শুধু মাত্র অন্য কোনো উপায় নেই এবং এক রোখা ছেলে বলে নিজেকে শান্ত রাখছেন। ঠোঁট গোলাকৃতি করে দম ছেড়ে নিজেকে যতটুকু সম্ভব আরো শান্ত করে মাশরিফের দিকের তাকিয়ে বললেন,
-“তুমি কি আমার কথা অমান্য করতে চাচ্ছো জায়ান?
তুমি চাচ্ছো আমি এখানেই মফিজের কাছে হার মেনে নেই?”
-“না বাবা। বুঝতেছো না কেনো? আমার সময় কোথায়? আর আমি রান্নার কি পারি? নেহা আছে তো। নেহাকে দাও।”
ভাই এর উপর দায়িত্ব পড়বে এটা শতভাগ নিশ্চিত জেনে বেশ আরাম করেই বসে বসে এতোক্ষণ বাপ-ভাই এর কার্যকলাপ দেখতে থাকা নেহা তার একমাত্র ভাই এর কথা শোনামাত্রই চমকে উঠল। কন্ঠ কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলল,
-“তুমি নিজে পারবা না, পারবা না। আমাকে দেখিয়ে দাও কেনো ভাইয়া? আমি ভাত রান্না করতে পারি বলেই কি সব পারি। আমিও পারবো না। আম্মু, আমি কিন্তু পারবো না বলে দিলাম।”
আলাউদ্দিন আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না। কখন না জানি এতো বড় ছেলের গাঁয়ে মা-বাবার সামনে হাত তুলে বসেন। এমমিতেই তার মেজাজ গ/রম, তার উপর রাজি না হয়ে ঘি ঢালছে এই ছেলে। কটমট দৃষ্টিতে চিবিয়ে চিবিয়ে শেষ বারের মতো বললেন আলাউদ্দিন,
-“তুমি কি আমার কথা শুনবাই না?”
বাবার রাগ যে সপ্তকাশ ছাড়িয়েছে তা বুঝতে পেরে কন্ঠে অসহায়ত্ব মিশিয়ে বলল আব্দুল্লাহ আল মাশরিফ জায়ান,
-“বাবা, সারাদিন এতো কিছু করে আমি সত্যি পারবো না।”
-“পারবি। বিজনেস সামলানোর আগেও তো বলেছিলি পারবি না। এব্রড যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছিলি। এখন ও পারবি। না পারলে এমনি এমনি ফ্রেন্ড দের সাথে ট্যুরে গিয়ে বারবিকিউ পার্টি, ভুনা খিচুড়ি করে খাস না। সব জানি আমি। তোর উপর ভরসা আছে আমার।”
-“এই ভরসা ভরসা করে আমার মন গলাচ্ছো প্রথম থেকে। ভালো লাগে না। আমার রান্না তোমার বাবা গিলতে না পারলে দোষ দিতে পারবা না খবরদার। তোমার আব্বাকে বইলো এমোডিস আর স্যালাইন হাতে নিয়ে আমার রান্না করা খাবার খাইতে।”
-“সে দেখা যাবে। আব্বার পেটের চিন্তা আব্বা করবে। তুই তোর বাবার কথা চিন্তা কর।”
চলবে……
(দাদাভাই এর সিদ্ধান্ত কেমন লাগলো বলে যাবেন। শুনতে ইচ্ছুক।)