প্রেমাচার কলমে: #অপরাজিতা_মুন #পর্ব_৪

0
302

#প্রেমাচার
কলমে: #অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৪

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ফজরের আজান ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গল মেহনুভার। ঘুমকাতুরে আঁখি যুগল টেনে তোলে খুব কষ্টে। রুমে জ্ব’লতে থাকা বৈদ্যুতিক লাইটের উজ্জ্বল আলো চোখে লাগে তার, ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট ভাবে এক পলক দেখে আশপাশ। লম্বা একটা হাই তুলে গায়ের গোলাপি রংয়ের কম্ফোটার টা আরেকটু টেনে ভালোভাবে গয়ে জড়িয়ে নেয় উষ্ণতার খোঁজে। মিনিট খানেক সময় পেরুতেই পুরোপুরি ঘুম কেটে গেলে ভালোভাবে চর্তুদিক লক্ষ্য করে বুঝতে পারে যে সে বর্তমানে ড্রয়িং রুমের সোফায় অবস্থান করছে। গতরাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পরে, মেহনুভার ঘুম আসছিলো না কিছুতেই। এক দিকে পরীক্ষার চিন্তা তো অন্য দিকে দাদাভাই এর হুকুম। দুটোই সমান তালে চাপ সৃষ্টি করছে মেহনুভার মাথায়। রেগুলার স্টুডেন্ট সে। পড়াশোনায় প্রথম থেকেই বেশ ভালো। ঢাকার নামকরা এক পাব্লিক ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথমেটিক্স এ অনার্স ফাইনাল সেমিস্টারে অধ্যায়ন করছে। কিছু দিন পরই অনার্স জীবনের ইতি টানবে।

সৈয়দ শামসুল হক বেশ লম্বা চওড়া মানুষ। তার ই সন্তান হিসেবে উনার দুই পুত্রও বাবার মতো লম্বা চওড়া হয়েছেন এবং সেই সাথে নাতী – নাতনি রাও।
মেহনুভাও বংশগত দিক থেকে মেয়ে হিসেবে উচ্চতায় বেশ লম্বা। গায়ের রংটা দাদী মনোয়ারা খনমের থেকে পাওয়া। উজ্জ্বল বর্ণের। শুধু মেহনুভা বললে ভুল হবে, এই দুই পরিবারের ঔরসজাত প্রতিটা সন্তান ই উজ্জ্বল বর্ণের অধিকারী এবং দৈহিক গঠন লম্বাকৃতি।

রান্না-বান্নার এবং খাওয়া দাওয়ার প্রতি বর্তমানে অনীহা থাকলেও ছোট বেলায় প্রচুর ভাজাপোড়া এবং ফার্স্ট ফুড এর প্রতি ঝোঁক ছিলো মেহনুভার। তাই ছোট বেলায় যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান ছিলো। বড় হতে শুরু করলে বুঝতে পারে শরীরের ওজনটা বেশ বেড়ে গেছে তার। নিজে থেকে বিভিন্ন ডায়েট চার্ট ফলো করে ওজন তো কমিয়েছে তবুও দেখতে বেশ গুলুমুলু লাগে। মেহনুভাকে দেখে না কেউ স্লিম বলতে পারবে আর না কেউ ফ্যাট। ডায়েটের পর মেয়েটা বেশ ব্যালেন্স করে চলছে বোঝা যায়।

চোখ কচলিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে মেহনুভা। ঘাড় বেয়ে পিঠ অব্দি ছড়িয়ে থাকা লেয়ার কাটিং চুলগুলো হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধে। নিজের রুমে পড়তে বসলে সবসময় ঘুম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে। তাই রাত এগারোটার পর পর ই নোটবুক, খাতা, কলমসহ প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে আসে আলিশান ড্রয়িং রুমটাতে। পড়ার ফাঁকে একবার এসে দেখে যায় মেহনুভার মা। ঠান্ডায় মেয়েকে এভাবে বসে পড়তে দেখে দিয়ে গিয়েছিলো একটা কম্ফোর্টার। সোফায় বসে রাত্রি দ্বি প্রহর অব্দি পড়েছিলো মেহনুভা। অনেক ক্ষণ বসে থাকার ফলে যখন তার পিঠে চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয় তখন সোফার কুশন পিঠে রেখে পা জোড়া উপরে তুলে সোজা করে আরামের উদ্দেশ্যে। ব্যাস, আর বেশি রাত জেগে পড়তে হয় নি তাকে। আরাম পেয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছিলো কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে।

বারবার হাই উঠছে মেহনুভার। চোখে মুখে পানি দেওয়া প্রয়োজন। সিঁড়ি বেয়ে দুই তলায় নিজের রুমে আর উঠলো না সে। বাসার কমন ওয়াশরুমটাই ইউজ করলো আপাতত। কিচেনে গিয়ে ড্রাইফুড এর কৌটা টা হাতে নিয়ে আবারও পা তুলে বসে পরল সোফায়। কম্ফোর্টার দিয়ে কোমড় অব্দি ঢেকে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর পর বাম হাতে নোটবুকের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে আর ডান হাতে খাবার খাচ্ছে। রাতে পরীক্ষার চিন্তায় পেট ভরে খেতে পারেনি সে। কিন্তু এখন পেটে হালকা কিছু না দিলে তার চলবে না, পড়ালেখায় মনোযোগ ও আসবে না।

_________

এলার্মের কর্কশ ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গল শুভ্র বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা মানবটির। উন্মুক্ত দেহ। হালকা আকাশী রং এর কম্বল উন্মুক্ত দেহটাকে ঢেকে রেখেছে। শীত হোক কিংবা বৃষ্টি, খালি শরীরে ঘুমানো তার বহু পুরোনো অভ্যাস। এক নাগাড়ে বাজতে থাকা ছোট্ট এলার্ম ঘড়িটা ডান হাতের সাহায্যে বন্ধ করল মাশরিফ জায়ান। প্রতিদিন সকাল আট টা বাজে এলার্ম বাজলেও আজ বেজেছে সকাল সাত টাই। সাধারণত শীতের দিন সকাল বেলা বিছানা ছাড়তে চায় না কেউ ই। ছাড়তে চাচ্ছে না মাশরিফ নিজেও। তবুও বিরক্তি এক দিকে ঠেলে উঠে বসল। বেড সাইডে চার্জে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে সোজা ইমেইল এ ঢুকল। কয়েক মিনিট এর ব্যাবধানে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নিলো খুব দ্রুত। কালো রং এর জ্যাকেট, জুতা পরে বেরিয়ে পরল রুম হতে।

__________

মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকা মেহনুভা হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেলো নিশ্বাসের সহিত ভেতরে প্রবেশ করা পরিচিত ঘ্রাণে। স্বভাবতই মাথা তুলে তাকালো সে। নজরে এলো সুঠাম দেহের অধিকারী মাশরিফ জায়ান কে। পরিপাটি ড্রেসে জায়ানকে এক পলক দেখেই টনক নড়ে মেহনুভার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িতে নজর বুলায়। সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। হায় সর্বনাশ! এখনও তো রেডি হয় নি সে। মেহনুভা বসা থেকে দ্রুত ওঠে। কুঁচকে যাওয়া টপস টা টেনে গলায় ঝুলানো ওড়না ঠিক করে বড় বড় পা ফেলে দৌড় লাগায় দু তালায়। গন্তব্য তার নিজ কক্ষ। কিসের পড়া কিসের কি? এখন যে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরতে হবে নিজের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। নিজ রুমে ঢোকার আগে ঢু মা’রলো ছোটভাই মুবিন এর রুমে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। বেশি কিছু করল না মেহনুভা। শীতের সকালে শুধুমাত্র ফ্যানের সুইচটা অন করে নিজের রুমে চলে এলো ব্যাস্ত পায়ে।

_________

সকাল সকাল নাতী নাতনী সব গুলাই উপস্থিত সৈয়দ সাহেবের কক্ষে। সবার পোশাক বেশ পরিপাটি। শীত নিবারনের উষ্ণ বস্ত্র পরিধান করেছে। দেখেই মনে হচ্ছে কোথাও যাবে তারা। হুম ঠিক ধরেছেন।
সৈয়দ সাহেবের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রথম দিনের কার্য হিসেবে দুই পক্ষকেই বাজার করতে যেতে হবে সকাল সকাল। সৈয়দ সাহেবের মতে, রান্না করার পূর্বে বাচ্চা কাচ্চাদের বাজার নিয়েও ধারণা থাকা উচিত। দরদাম করে উপযুক্ত মূল্যে জিনিস ক্রয় করার দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। টাকার প্রতি মায়া জন্মানো উচিত। একটা প্রিয় জামা কিংবা শখের বস্তু আমরা যেমন দরদাম করে কাঙ্ক্ষিত মূল্যে সম্ভব হলে তবেই কিনি, রান্নার ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। পকেট ভর্তি টাকা আর যা মন চাই তাই কিনে উড়িয়ে দিলাম সেটার পক্ষপাতী বিচক্ষণ সৈয়দ শামসুল হক নয়। তাইতো উনি শুধু বাজার করতে দেন নি, মাশরিফ এবং মেহনুভার হাতে গুজে দিয়েছেন কচকচে নতুন দু’শ টাকার নোট। যা কেনার তা এই দু’শ টাকার ভেতর ই কিনতে হবে। রাতে এমন কথা শুনে এতো অল্প টাকা নিয়ে বেশ হাঙ্গামাও করেছিলো নাতি-নাতনী সকলে। কিন্তু তিনি পকেট থেকে আর এক টাকাও বের করতে নারাজ। অন্যান্য বিষয়ে পুরো ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিবেন কিন্তু বাজারের সময় না। পরীক্ষা তো পরীক্ষা। সেটা হোক পড়াশোনা কিংবা রান্নাবান্না। বোর্ড এক্সামের আগে খাতা, কলম, পেন্সিল গুছিয়ে নিতে হয়, আর রান্নাবান্নার আগে বাজার।
কথা সেটা না, কথা হচ্ছে দু’শ টাকাতে শুধু একটা আইটেম বাজার করে আনতে বললে মানা যেতো, কিন্তু তা না করে সৈয়দ সাহেব নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন কি কি ক্রয় করতে হবে। এক কেজি আলু, এক কেজি পেঁয়াজ, আর হাফ কেজি বেগুন দু’শ টাকার মধ্যে ক্রয় করার পর যদি অতিরিক্ত টাকা থাকে তা ফেরত আনতে হবে। সবজির গুনগত মান যাচাই এবং অতিরিক্ত টাকার পরিমাণ দেখেই বিজয়ী নির্বাচন করবেন সৈয়দ শামসুল হক। দাদাভাই এর এমন সিদ্ধান্ত শুনে স্বল্পভাষী জায়ান খুব একটা তোয়াক্কা না করলেও মেহনুভা বেশ চটে গিয়েছিলো। একে তার পরীক্ষা। এক্সামের দিন সকাল বেলা পড়া ছাড়া কিছুই চোখে দেখে না সে, ইমার্জেন্সি ব্যাতিত টয়লেট ইউজ করতেও নারাজ। সেখানে মাত্র দু’শ টাকা হাতে ধরিয়ে বলছে সকাল সকাল বাজর করে আনতে হবে। পাগল পেয়েছে নাকি মেহনুভাকে! যা মন চাচ্ছে তাই তার কাঁধে চেপে দিচ্ছে। কিন্তু কি আর করার। প্রতিযোগিতা তো প্রতিযোগিতা। সৈয়দ সাহেবের স্পষ্ট জাবাব। তুমি যদি বাজারে না যাও, তবে জায়ান এর কাছে বাজার করার পূর্বেই প্রথম রাউন্ডে হার মেনে নাও। ব্যাস, ফোস্কা’র মতো গায়ে লাগলো কথাটা। এ যাবত বাবা-চাচার একে অপরের স্নায়ুযুদ্ধ দেখলেও অনুভব করতে পারে নি। এখন বেশ পারছে। পারবেই না বা কেনো? মাশরিফ-মেহনুভা একে অপরের সাথে বর্তমানে স্বাভাবিক আচরণ করলেও মেহনুভার মনে সুক্ষ্ণ ক্ষোভ রয়েছে। সাত বছর আগের কথা ভুলেনি সে। ছোট ছিলো তো কি হয়েছে, সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মাশরিফ জায়ান এর একেকটা আচরণ বেশ সম্মানে লেগেছে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here