#প্রেমাচার
কলমে: #অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৫
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
শীতের সকালে পিচ ঢালা রাস্তায় ফুটপাতের উপর দিয়ে হাঁটছে মাশরিফ জায়ান। গায়ে জড়ানো ধূসর রংয়ের জ্যাকেট টার পকেটে হাত গুজে মাথায় হুডি তুলে দাম্ভিকতার সহিত একেকটা কদম রেখে অগ্রসর হচ্ছে। তার পাশাপাশি হাঁটছে মুবিন। ভাই এর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটলেও একবার এদিক তাকাচ্ছে তো আরেকবার ওদিক। মাশরিফ এবং মুবিন এর কয়েক হাত পেছনেই তাদেরকে অনুসরণ করে হাঁটছে মাশরিফ জায়ান এর একমাত্র বোন মেহরুন হক নেহা এবং মেহনুভা। চর্তুদিকে ঘন কুয়াশা। আজ কুহেলিকার উপস্থিতি যেনো একটু বেশি। তার উপর সকাল সাড়ে সাতটা। সাধারণত অন্যান্য ঋতুতে সকাল সাড়ে সাতটা অনেক বেলা হলেও শীতের সময় তেমন টা নয়। সূর্যের দেখে পাওয়া তো দূরের কথা, কয়েক গজ সামনের কিছুও দেখা যায় না ঘোলাটে কুয়াশার কারণে। আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি। ঘন কুয়াশার সাথে শিরিশিরে শীতল হাওয়া শরীরে কম্পন তুলছে। উষ্ণতার নিমিত্তে ভারী শীতবস্ত্র পরিধান করে শীত নিবারনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে মেহনুভা। মোটা একটা লং কোর্ট, তার উপর সুন্দর একটা ঘিয়ে রংয়ের পঞ্চ, গলায় লাল মাফলার, মাথায় টুপি। নিজেকে শীত হতে রক্ষা করার সব রকম উপায় অবলম্বন করলেও হাত দুটো তার বরফ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর দুই হাতের তালু একত্রিত করে ঘষছে উষ্ণতার জন্য। যখন ব্যার্থ হচ্ছে তখন টুপ করে ঠান্ডা শীতল হাত দুটো মাস সাতেক বড় মেহরুন হক নেহার গালে চেপে ধরছে। মেহনুভার এমন কার্যে রেগে যাচ্ছে নেহা। চেঁচিয়ে উঠছে বিরক্তিতে। দুষ্ট মেহনুভা বোন কে রাগিয়ে দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসছে। আ’গুনে ঘি ঢালল মেহনুভার হাসি। আগের তুলনায় বেশ ক্ষেপে গেলো নেহা। চলার পথে ফট করে সুযোগ বুঝে নিজের হিমশীতল হাত জোড়া গুজে দিলো মেহনুভার গলায়।
ছ্যাত করে উঠলো মেহনুভা। রাগ এবং বিরক্তির রেখা একত্রে ফুটিয়ে উঠলো তার মুখে। নেহা বোনের এমন মুখাবয়ব দেখে চেপে রাখা হাসি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। উচ্চশব্দে হেসে দিলো খিলখিল করে। হাসির মাঝেই নেহা বলল,
“দেখ কেমন লাগে। আমারও এমন লেগেছে। সোধবোধ।”
মেহনুভা গোমড়া মুখ করে ভেংচি কাটল মনে মনে। সোধ হলেও বোধ হয়নি। বোধ তো মেহনুভা করবে। গালে না, গলাতেও না, মাথার উপর ঠান্ডা পানি ঢেলে দিবে বাসার ফিরলে। দেখাবে মজা।
রাস্তায় দুই একটা রিক্সা যাতায়াত করছে। মাঝে মাঝে সিএনজি। সৈয়দ সাহেবের বাসার পাশের কলোনিতে বাজার বসে প্রতিদিন। গন্তব্য তাদের সেখানেই। যেহেতু মাছ, গোস্ত না কিনে শুধুমাত্র সবজি কিনতে হবে, মূল বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই তাদের। কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। ওইতো দেখা যায় সবজির দোকান। অল্প কিছু দোকান, আর অল্প কিছু ভ্যানের উপর হরেক রকমের সবজি সাজানো। শীতের সবজি সকাল সকাল কুয়াশায় ভিজে উঠেছে, শিশিরকণা জমেছে উপরে। দেখতে একদম ফ্রেশ লাগছে। দোকানের কাছাকাছি এসে পিছু ফিরল জায়ান। পেছন হতে নেহা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু মেহনুভা অদূরে একটা গাছের তলায় বসে। কুয়াশাজড়ানো প্রকৃতিতে মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না জায়ান। নেহার নজর গেলো ভাই এর নজর অনুসরণ করে। সে অবাক হলো কিছুটা। মেহনুভা এতোটা পিছিয়ে গেলো কি করে! এতোক্ষণ যে বকবক করল, তাহলে কার সাথে বকবক করলো? একা একা করেছে! ইয়া আল্লাহ! কেউ দেখে ফেললে নিশ্চিত পাগল ভাবত।
নেহা মনে মনে নিজেকে হাজারো গালমন্দ করে কন্ঠস্বর কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে ডেকে ওঠলো মেহনুভাকে। শুনলো না মেয়েটা। পুনরায় ডাকল, কিন্তু না। কর্ণকুহরে প্রবেশ ই করাতে পারল না। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল, কিছু সবজি বিক্রেতা তাকিয়ে আছে তার দিকে উৎসুক চোখে। নেহা অস্বস্তিতে পরল।
মুবিন এগিয়ে যেতে চাইলে হাতের সাহায্যে থামিয়ে দিলো জায়ান। ইশারায় দুজনকে এক পাশ হয়ে দাঁড়াতে বলল। হাতে রাখা ফোনটা পকেটে পুরে বড় বড় পা ফেলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধানে এগিয়ে এলো মেহনুভার কাছে। শিশির ভেজা নাম না জানা ছোট্ট ছোট্ট বাসন্তী রঙ্গা ফুল কুড়াচ্ছে মেয়েটা। পিচঢালা সরু রাস্তায় বাসন্তী রঙ্গা ফুলের মাঝে লাল মাফলার পেঁচানো মেয়েটাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে। এক হাতে ফুল নিয়ে অন্য হাতের তালু ভর্তি করছে। মেহনুভার কাছাকাছি এলো না জায়ান। কয়েক কদম দূর হতেই ডাকলো ছোট্ট করে, “নোভা?”
মেহনুভার কোনো হেলদোল নেয়। এক ধ্যানে সেই যে ফুল কুড়াচ্ছে তো কুড়াচ্ছে। জায়ান গলা খানিক উঁচিয়ে পুনরায় ডাকলো। উহু, কাজ হলো না। শুনলো না মেহনুভা। দুইবার ডাকার পরেও ফিরে তাকালো না একবারও। কিঞ্চিৎ রাগ হলো জায়ানের। চোয়াল শক্ত হলো। এ কেমন অসভ্যতা! ডাকার পরেও সাড়া দিচ্ছে না! লম্বা চওড়া মানুষটা পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাত উপরে তুলে মাঝারি আকৃতির গাছটার একটা ডাল ধরলো। ধীরে ধীরে নিচের দিকে টেনে আনলো ডালটা। অনেকটা নিচে। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল মেহনুভার সাড়া পাওয়ার জন্য। যখন পেলো না, তখন আর ডালটা ধরে রাখার প্রয়োজন মনে করলো না। আলগোছে সুন্দর করে ছেড়ে দিলো ডালটা। সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝর করে ঝরে পরলো অনেক অনেক নাম না জানা ছোট ছোট ফুল। এতোক্ষণে ধ্যান ভাঙ্গলো, উর্ধ্বে মুখ তুলল মেহনুভা। চমকিত হলো। এতো ফুল! ঝরঝর করে ঝড়ে পরছে মেয়েটার দিকে। চমকিত মেহনুভার আনন্দ সেকেন্ড পাঁচেক ও স্থায়ী হলো না। ফুলের সহিত গাছের পাতায় জমা বিন্দু বিন্দু শীতল শিশির কণা টুপ টুপ করে পরল মেহনুভার সুন্দর মুখাবয়বে। টুপটুপ জলে তার শরীরের জামা কাপড়ের সাথে চোখ মুখ ভিজিয়ে দিলো অনেকটা। ঘটনার আকস্মিকতায় ফট করে দাঁড়িয়ে পরল মেহনুভা। ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকাল, জায়ান কে দেখে দ্বিগুণ বিস্মিত হলো। বিরক্তিতে ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুখ মুছে নিলো। হনহন করে সামনে এগিয়ে জায়ান এর মুখোমুখি হয়ে রাগ প্রকাশ করতে মুখ খুলবে এমন সময় মেহনুভাকে তোয়াক্কা না করে হাঁটা ধরলো জায়ান। দ্বিগুণ থেকে আরো দ্বিগুণ, চারগুণ রেগে ভস্ম হলো মেহনুভা। ধপাধপ বড়বড় পা ফেলে জায়ান এর কাছাকাছি এসে গরগর করে শুধালো,
“মাশরিফ ভাই, এটা কেমন বিহেভ আপনার? মুখে কি আপনার তালা ঝুলানো? নাকি আমার নাম জানেন না? না ডেকে সাত সকালে ভিজিয়ে দিলেন। পানি কি রকম ঠান্ডা আপনি জানেন?”
মাশরিফ ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন ই মনে করছে না। কিন্তু বকবক থামছে না মেহনুভার। শেষমেশ বিরক্তি আকাশ ছুলো তার। মন চাচ্ছে এই মেয়েটার উপর এক বালতি পানি ঢেলে দিতে। তখন বুঝবে ঠান্ডা কি জিনিস। গতিশীল পা জোড়া হুট করে স্থির করল জায়ান। পিছুপিছু আসতে থাকা মেহনুভা থমকে দাঁড়ালো জায়ান থামতেই। পিছু ফিরে মেহনুভার সম্মুখে এগিয়ে এলো। উলের নরম তুলতুলে টুপিটা মেহনুভার মাথা থেকে এক টানে সড়িয়ে কানে গুঁজে রাখা ব্লু-টুথ হেডফোন খুলে মেহনুভার হাতে ধরিয়ে দিলো। রেগে গিয়ে পরপর করা প্রশ্নসমূহের জবাব নিমিষেই পেয়ে গেলো মেহনুভা। মুখে তালা ঝুলিয়ে থাকে নাকি নাম জানে না তার উত্তম জবাব কোনোরকম বাক্য ব্যায় না করেই দিয়ে দিলো জায়ান।
_______________
জায়ানকে দেখে এক গাল হেসে মামা বলে নিজের দোকান থেকে কেনার জন্য হাঁক ছাড়ল কয়েক বিক্রেতা। মাঝেমধ্যেই বাজার করে জায়ান। সকালে হাঁটতে রেরুলে এখান থেকে টুকটাক সবজি কিনে নিজ পরিবারের জন্য। সেই খাতিরে এখানকার প্রায় প্রতিটা বিক্রেতা তার বেশ পরিচিত। সে নিজেও বিক্রেতাদের কাছে পরিচিত মুখ। সাধারণত অন্যান্য দিনে যখন জায়ান সবজি কিনে তখন দর কষাকষি করে না। কেজি প্রতি যা দাম চায় তা দিয়েই নিয়ে নেয়। কিন্তু আজ বাঁধলো বিপত্তি। নির্দিষ্ট করা অর্থে কোনো ভাবেই দর কষাকষি ব্যাতিত সেই দামে নেওয়া উচিত হবে না। এদিকে দামাদামি ও করতে ভীষণ সংকোচ হচ্ছে তার। বাড়তি টাকা সঙ্গে নেই যে আলু, পেঁয়াজ, বেগুন ব্যাতিত অন্য কোনো সবজি ক্রয় করে পুষিয়ে নিবে। এখানে আসার পূর্বে সৈয়দ শামসুল হক সুন্দর করে মাশরিফের পকেট থেকে ওয়ালেট টা রেখে দিয়েছেন নিজের কাছে। কেউ যেনো এদিক সেদিক না করতে পারে সেজন্য তদারকি করতে জায়ান এর সাথে দিয়েছেন মুবিন কে আর মেহনুভার সাথে দিয়েছেন মেহরুন কে। দুই নম্বরি করার কোনো সুযোগ নেই কারোরই।
জায়ান জোরপূর্বক মুচকি হাসে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে। বিক্রেতা এটা সেটা অনেক সবজি মাশরিফ কে দিতে উদ্যত হয়। জায়ান হাতের ইশারায় বাঁধা দেয়। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলে,
“মামা, আজ এই সবজি লাগবে না। শুধু এক কেজি আলু, এক কেজি পেঁয়াজ আর বেগুন দেন। কোনটা কতো করে বলেন।”
“আপনারে আর কি দাম কইমু মামা। যা দাম তাই দিবেন। কচি লাউ আনছি মামা কালকেই, লইয়া যান। গইলা যাবো, খায়া স্বাদ পাইবেন।”
সত্যি দেশি লাউ সাজিয়ে রাখা। দেখতে একেবারে টাটকা। ইচ্ছা তো জায়ান এর ও করছে কিন্তু সে নিরুপায়। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, কিন্তু পাশে মুবিন থাকার ফলে ইচ্ছা থাকলেও উপায় করা সম্ভব হচ্ছে না। দুদিকে ঘাড় নাড়ালো জায়ান। বলল,
“না মামা। লাউ অন্য দিন নিবো। আজ আলু পেঁয়াজ আর বেগুন ই দেন।”
বিক্রেতা দোকানের সবচেয়ে ভালো নতুন আলু, পেঁয়াজ পলিথিন এ প্যাকেট করল। যখন এক কেজি বেগুন মাপতে শুরু করল তখন ই জায়ান তড়িঘড়ি করে নিষেধ করে বলল,
“মামা, হাফ কেজি বেগুন দেন। এতো না”
“মাত্র হাফ কেজি লইবেন মামা। ওই সপ্তাহে তো দুই কেজি লইয়া গেলেন। হাফ কেজিতে মাত্র দুইটা বেগুন পাইবেন। কারে রাইখা কারে খাওয়াবেন?”
বিক্রেতার কন্ঠে বিস্ময়। মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো জায়ান কে।
“মামা, এলার্জি বেড়ে গেছে। বেগুন খাওয়া কমিয়ে দিছি। আপনি হাফ কেজি দিন তো। আমার হাফ কেজি লাগবে।”
বিক্রেতা হাফ কেজি বেগুন তো দিলো কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না এই জায়ান কে। এর আগে যখন ই আসছে, যে সবজিটাই কিনুক না কেনো, দুই তিন কেজি করে নিয়ে ব্যাগ ভরে বাজার করে নিয়ে গেছে। আর আজ কিনা হাফ কেজি বেগুন! কেমন ওলোট পালোট লাগছে সবকিছু। জায়ান জ্যাকেটের পকেটে হাত রাখে। চকচকে দু’শ টাকার নোট টা বের করতে করতে শুধায়,
“কতো হলো মামা?”
“আলু ষাট, পেঁয়াজ একশ, আর বেগুন মামা ৭০ টাকা কেজি। হাফ কেজি পয়ত্রিশ। ১৯৫ টাকা হইছে মামা। ”
স্বস্তির শ্বাস ফেলে জায়ান। অল্পের জন্য দুইশ টাকার বেশি হয় নি। নিজের তো হয়ে গেলো। দু’শ টাকার নোট টা দিতে দিতে পিছু ফিরে তাকালো জায়ান। মেহনুভার দিকে নজর যেতেই ঢের বিস্মিত হলো। বেশ দর কষাকষি করছে মেয়েটা। এক দোকানে যখন কাঙ্ক্ষিত মূল্যে পন্য পাচ্ছে না তখন অন্য দোকানে যাচ্ছে। টনক নড়ল জায়ান এর। চলে আসতে উদ্যত হয়েছিলো সে। কিন্তু আসলো না। সংকোচ সাইডে রেখে দোকানদার কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পাঁচ টাকা ফেরত দেন মামা। এক্সামে পাস করতে হেল্প করেন। দেন আমার টাকা আমাকে দেন।”
দোকানদার এবার বিস্ময়ের সপ্তপর্যায়ে পোঁছে গেলো। যে লোক বিশ, ত্রিশ চল্লিশ টাকা পর্যন্ত এমনি এমনি দিয়ে যায় সে আজ পাঁচ টাকা ফেরত চাচ্ছে। এমন দিন ও দেখতে হলো। পরিচিত ক্রেতাকে আজ তার অপরিচিত লাগলো। পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে মাশরিফের হাতে ধরিয়ে দিলো। মাশরিফ কয়েনটা নিয়ে ঠোঁটে জোরপূর্বক একটা হাসি হেসে, হাসি মুখ উপহার দিলো।
চলবে…..
নাকি দৌড়াবে? বলুন দেখি, পর্ব কেমন লাগলো।
জানতে ইচ্ছুক।