#প্রেমাচার
কলমে: #অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৬
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
সৈয়দ শামসুল হকের মুখোমুখি বসে আছে মাশরিফ জায়ান। মেহনুভা দাঁড়িয়ে। সে বসার মতো ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না। উসখুস ফুরাচ্ছেই না তার কিছুতেই। সাড়ে আটটা বেজে গেছে প্রায়। দশটা হতে পরীক্ষা শুরু। ছটফট করছে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। এই তো মিনিট খানেক আগে দাদাভাই এর কাছে সবজি দেওয়ার পর পর ই বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলো। মাশরিফ জায়ান নিজের ইজ্জতের কথা তোয়াক্কা না করে কিছুটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে পাঁচ টাকার কয়েন বের করে দিয়েছে সৈয়দ সাহেবকে। রুপালি কয়েনটা দেখে মিটিমিটি হাসছে উপস্থিত সকলে। সানজিদা খানম তো নাতীর পাঁচ টাকা দেখে মশকরা করতে ছাড়েন নি। শাড়ির আঁচলটা টেনে মাথায় দিয়ে বলেন,
“দাদাভাই, এই পাঁচটাকা ফেরত আনার কি দরকার ছিলো? আমার জন্য এক খিলি পান আনতা। খুশি হয়ে তোমার দাদাভাই কে পটিয়ে তোমার পক্ষে আনতাম।”
“পান না আনলেও তুমি পটে গেছো বহু আগেই দাদিমণি। তোমার বর পটবে না। এক বিরা পান আনলেও সে ওই পাঁচ টাকাতেই খুশি। ওই দেখো, কেমন হাসছে।”
সহধর্মিণী এবং নাতীর কথোপকথন শুনে সত্যি মিটিমিটি হাসছিলো সৈয়দ শামসুল হক। মাশরিফ জায়ান এর শেষ কথা শুনে সেই হাসি পরিপূর্ণ রূপে প্রসারিত হলো। উনার দেখা দেখি হাসলো উপস্থিত সকলে। সবাই স্বাভাবিক হাসি হাসলেও বিজয়ীর হাসি হাসছে একজন ই। মেহনুভা। ছটফট করতে থাকা মেয়েটা যখনই দেখেছে তার মাশরিফ ভাই এর হাতে পাঁচ টাকার কয়েন তখনি ছোট্ট তনুমন টা ছলাৎ করে উঠে। ওঠার যথেষ্ট কারণ ও রয়েছে। তুমুলভাবে দর কষাকষি করে এক কেজি আলু, এক কেজি পেঁয়াজ, আর হাফ হেজি বেগুন কেনার পরে পই পই করে বিশ টাকা বাঁচিয়েছিলো সে। মনে মনে যথেষ্ট নিশ্চিত ছিলো মাশরিফ এর মতো মানুষ কখনও বিশ টাকা ফেরত আনতে পারবে না। বাজার শেষে ফুরফুরে মেজাজে ফেরার পথে গরমা গরম চিতই পিঠা দেখে মেহনুভা লোভ সামলাতে পারেনি কিছুতেই। ওই যে, রাতের খাবার খায় নি। সকালে ড্রাই ফুড খেয়েও পেটের এক কোণা ফাঁকা রয়ে গেছে। এখন গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চিতই পিঠা দেখে পেটের ভেতর নাড়িভুড়ির আ’ন্দোলন শুরু হয়েছে। চিতই পিঠা তাদের চাই ই চাই। মেহনুভাও হার মেনে গিয়েছিলো পেটের কাছে। চলার পথে সুযোগ বুঝে মাশরিফ, মেহরুন এবং মুবিন কে ফাঁকি দিয়ে দশ টাকা দিয়ে একটা চিতই পিঠা কিনে ফেলেছে। কেউ যেনো দেখে না ফেলে তাই লুকিয়ে ছিলো গায়ে জড়ানো পঞ্চ’র কোনায়। বরাবর ই হেলেদুলে ধীরগতিতে হাঁটে মেহনুভা। তাই পিছিয়েই থাকে সবসময়। মেহনুভার পিছিয়ে পরাতে মাথা ঘামায় নি কেউ ই। ভাই-বোন দের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরত্ব রেখে ঘপাঘপ কয়েক কামড়ে মেহনুভা গলাধঃকরণ করে সম্পূর্ণ চিতই পিঠা টা। কথায় আছে, পেট শান্তি হলে নাকি দুনিয়া শান্তি হয়। কিন্তু মেহনুভার মনে শুরু হলো অশান্তি। খাওয়ার পর পর ই মাথার জট খুলে গিয়েছিলো। বাড়তি টাকার চিন্তা শুরু হয়েছিলো তাৎক্ষণিক। কাঁধে ঝুলানো কালো রংয়ের ছোট্ট পার্স টা হাতিয়ে উদ্ধার করে একটা দশ টাকার নোট। বেশ হতাশ হয়েছিলো মেহনুভা। নিজের উপর রাগ ও হয়েছিলো প্রচুর। কি বোকামিটাই না সে করল। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসেছিলো মুবিনের কাছে। ফিসফিস করে বলেছিলো,
“এই মুবিন? মাশরিফ ভাই এর কাছে কতো টাকা আছে জানিস?”
“সঠিক জানি না। তবে একটা পাঁচটাকার পয়সা আছে।”
ছোট ভাই এর এমন দায়সারা ভাব দেখে ক্ষেপে গিয়েছিলো মেহনুভা। কন্ঠ কিছুটা উঁচু হতে হতেও সামলে নিয়েছিলো সে। আগের ন্যায় পুনরায় ফিসফিসিয়ে বলেছিলো,
“সঠিক জানি না মানে কি? তুই কি ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার ঘাস কাটছিলি?”
স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলতে থাকা মুবিন তখন মেহনুভার প্রশ্নের উত্তর দিতে বোনের ন্যায় কন্ঠ খাঁদে নামিয়েছিলো। ফিসফিস করে বলেছিলো,
“আরেহ না, ঘোড়া না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাস কাটা যায় নাকি! তাইয়্যেবা কে দেখছিলাম। কোচিং থেকে ফিরছিলো। জানিস আপু, আমার দিকে আজ ও তাকাইছে।”
রাগে নিজের মাথায় নিজে বাড়ি দিতে ইচ্ছা করছে মেহনুভার। তাইয়্যেবা মুবিন এর এক ক্লাস নিচে। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। একই কলেজ। কয়েক মাস হলো তাইয়্যেবার দেখা পেয়েছে মুবিন। নবীন বরণের দিন প্রথম দেখেছিলো তাইয়্যেবাকে একটা বেগুনি ড্রেসে। এক দেখাতেই মুবিনের কি হলো জানে না! তার কোমল হৃদয়টা ঘায়েল হলো। এরপর খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে তাদের বাসার কয়েক বাসা পরেই তাইয়্যেবা দের বাসা। তাইয়্যেবার বাবা চাকুরি স্বত্বে চট্রগ্রাম ছিলো অনেক বছর। এক বছর হলো ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় এসেছে। মেয়েকেও ভর্তি করিয়েছে গুলশান এর সনামধন্য কলেজে। মুবিন সাত -আট মাস যাবত তাইয়্যেবা কে যেখানে যেভাবে পারছে শুধু দেখেই যাচ্ছে, কথা বলার সুযোগ কোনো ভাবেই হচ্ছে না। যতবার ই দেখা হয় ততবার ই কেউ না কেউ সাথে থাকে। কলেজেও ওর বন্ধুবান্ধবদের সামনে অস্বস্তিতে ফেলছে চায় না মুবিন। এই যে ঘুড়ঘুড় করে সুযোগ পেলে শুধু দেখে যায়, মুবিন খুব ভালো করে জানে তাইয়্যেবা বোঝে মুবিনের চাহনি। মাঝে মধ্যে পাশ দিয়ে গেলে মুবিন গলা খাঁকারি কিংবা হাঁচি কাশি দিয়ে মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। সাধারণ পথচারী হলে একবার হলেও ফিরে তাকাতো মুবিনের দিকে। কিন্তু তাইয়্যেবা তাকায় না কখনও। এতেই মুবিন প্রমাণ পেয়েছে, মেয়েটা বোঝে মুবিনের চোখের ভাষা, প্রেমের ভাষা।
ফেরার পথে মেহনুভা মুবিনের উপর প্রচন্ড রকম বিরক্ত হয়েছিলো। যখন বুঝতে পারল ওর সাথে ফুসুরফাসুর করে আর কোনো লাভ নেই তখন সোজা সে চলে গিয়েছিলো জায়ান এর নিকটে। এমনিতে সে যতটুকু পারে জায়ান এর সাথে কম কথা বলে। কিন্তু আজ বলা প্রয়োজন। ভণিতা না করেই তখন প্রশ্ন করেছিলো মেহনুভা,
“মাশরিফ ভাই, কতো টাকার মালিক আপনি?”
“এক কোটি”
“সত্যি!”
“বিশ্বাস না হলে ব্যাংকে গিয়ে দেখে আয়।”
“আরেহ, আমি এখন কার কথা বলছি। আপনার পকেটে কতো টাকা আছে একটু দেখি?
সম্মুখে দৃষ্টি রেখে হাঁটতে থাকা মাশরিফ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়েছিলো মেহনুভার দিকে। পকেটে রাখা ডান হাতের মুঠোয় পাঁচ টাকার কয়েনটা ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিয়েছিলো,
“পাঁচ টাকা আছে। নিবি?”
মাশরিফের মুখে বলা সত্য কথাটা বিশ্বাস হয় নি মেহনুভার। এমন ভঙ্গিমায় বলেছে যে বিশ্বাস করার মতোই না। কেমন যেনো ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বলল।
মাশরিফের কাছে পাত্তা না পেয়ে আবার ও ফিরেছিলো মুবিন এর কাছে। চুপিচুপি ছোট ভাই এর গা ঘেষে হাঁটতে শুরু করেছিলো। মুবিন এর জ্যাকেট টেনে ধরে কিছুটা পিছিয়েও এনেছিলো মাশরিফ-মেহরুন দের থেকে। মেহনুভা জানে মুবিনের পকেটে এক টাকাও নেই তবুও ভাই এর জ্যাকেট এর পকেটে হাত রাখলো যদি কোনো ক্রমে দুই এক টাকা পাওয়া যায় এই আশায়। কিন্তু লাভের লাভ তো কিছু হয় ই নি, উল্টো মুবিনের পকেটে রাখা ইউজ করা ট্যিসুতে হাত রেখে মেহনুভার গা ঘিনঘিন করে উঠেছিলো।
.
মাশরিফের দেওয়া পাঁচ টাকার কয়েন মাশরিফকেই ফেরত দিয়ে সৈয়দ সাহেব মেহনুভাকে ইশারা করলেন। দাদাভাই এর ইশারায় বিজয়ীর হাসি হেসে দশ টাকা ফেরত দিলো মেহনুভা। ছেলেমেয়ের বাজার দেখতে উৎসুক চোখে তাকিয় আছে সৈয়দ সাহেবের দুই পুত্রবধু সহ নিজ অর্ধাঙ্গিনী এবং ছোট্ট নাতনী মায়মুনা। মায়মুনা অবশ্য কোনো ধরনের চিন্তা করছে না আজ। তার আবার লাভ ও নাই, লস ও নাই। দাদাভাই বলে দিয়েছে, মায়মুনা শুধু খাবে। একবার জায়ান এর রান্না তো আরেক বার মেহনুভার। সে স্বাধীন, সে মুক্ত। খাবার খেতে কিংবা কারো পক্ষ নিতে নেই কোনো শর্ত। যখন মন চাবে তখনি যে কারো দলের হয়ে কাজ করতে পারবে সে।
ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে ভীষণ হাসি পাচ্ছে গুলুমুলু মায়মুনার। যখন মেহনুভা দশ টাকার নোট টা বের করে দিলো তখন তার মাশরিফ ভাই এবং মেহরুন আপুর মুখটা দেখার মতো ছিলো।
বাড়ির কাজে সাহায্যকারী ফুলমতি সৈয়দ সাহেবের নির্দেশে দুইটা পাত্র এনে দুই জনের বাজার আলাদা আলাদা ভাবে ঢালল। মাশরিফের কেনা বাজার দেখে সৈয়দ সাহেব সন্তুষ্ট হলেন। নতুন আলু, কোনোটা নষ্ট না। পেঁয়াজ গুলাও বেশ ভালো। সাথে বেগুন। কিন্তু টাকার পরিমাণ হতাশাজনক।
অপরদিকে মেহনুভার ফেরত দেওয়া দশ টাকা হাতে নিয়ে নজর দিলেন বাজারে। আলু ফ্রেশ হলেও পেঁয়াজ কিছু নষ্ট কিংবা পচন ধরেছে এমন। বেগুন দেখতে টাটকা। বড়া বানিয়ে খেতে লাগবে বেশ মজা। কি মনে করে শেষের দিকে দুজনের পাত্র হতে দুইটা বেগুন হাতে নিলেন। সুক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করা মাত্রই দাদাভাই এর চক্ষু চরক গাছ।
দুজনের বেগুনেই ফুটা। নিশ্চিত ভেতরে পোকা।
সৈয়দ সাহেব মেহনুভার কাছ থেকে এমন কিছু পাবেন এটা প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু মাশরিফ তো বাজার সদাই করে। সেও কি বেগুনটা খেয়াল করে আনতে পারলো না! হাফ কেজিতে ওঠা দুইটা বেগুনের মাঝে একটাতেই পোকা। নাতি-নাতনী দুজনেই কি বোকা!
সৈয়দ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ভরাট গলায় অসন্তুষ্ট চিত্তে বললেন,
“দুজনের বেগুনে পোকা। মেহনুভার পেঁয়াজ পঁচা, জায়ানের নায় টাকা। সিদ্ধান্ত আমার ফাঁকা। উঠে গেছে তোমাদের দুজনের উপর থেকে আমার আশা-ভরসা। আমি যাচ্ছি, থাকো তোমরা। ছোট বউমা, আমার জন্য আনো তো কড়া লিকারে এক কাপ চা।”
চলবে……