#প্রেমাচার
কলমে: #অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৭
(কপি করা কঠিন নিষিদ্ধ)
দুপুরের মিঠে রোদে বারান্দায় বেতের তৈরি ইজি চেয়ারে বেশ আরাম করে বসে আছেন সৈয়দ আলাউদ্দিন হক এবং তার সহধর্মিণী আয়েশা সিদ্দিকা। আজকের খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন দুজনেই। সম্পাদকীয় পাতায় আলাউদ্দিন হক খুব মনোযোগ এর সহিত একটা কলাম পড়ছিলেন এমন সময় সহধর্মিণীর ডাকে মনোযোগে বিঘ্ন হয়। মাথা তুলেন, তাকান প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে। আয়েশা সিদ্দিকা বেশ আত্নমর্যাদা সম্পন্ন শিক্ষিত মহিলা। নিজের মতামত টা সবার সামনে প্রকাশ করেন বেশ জোড়ালো ভাবে। আজকেও স্বামীর সামনে একটা নিজস্ব মতামত পেশ করতে চান। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা তার ধাতে নায়। সোজা-সাপ্টা কথাতে তিনি অভ্যস্ত। আজও সেটার ব্যাতিক্রম হলো না। বাহিরের পরিবেশে এক পলক তাকিয়ে স্বামীর আদলে পূর্ণদৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন,
“ছেলে-মেয়ে দুইটা তো বড় হইছে। বিয়ের বয়স হইছে। কিছু ভাবছো ওদের নিয়ে?”
স্ত্রীর প্রশ্নে উপর নিচে মাথা ঝাঁকালেন আলাউদ্দিন হক। বিজ্ঞ মানুষের ন্যায় ভাবুক ও হলেন কিছুটা। মনে মনে যা ভাবার ভেবে বললেন,
“হুম। সমন্ধ আসছে কয়েকটা। ব্যাস্ততার জন্য তো আগাতে পারছি না।”
“তোমার ব্যাস্ততা শেষ হবে না কখনও। বলছিলাম জায়ান এর আগে নেহার ব্যাবস্থা টা করো। অনার্স শেষ হইছে। মাস্টার্স্ট না হয় স্বামীর ঘরে গিয়ে শেষ করবে।”
“যে সমন্ধ গুলো আসছে আয়েশা, ওগুলা সব দেশের বাহিরে থাকে। তুমি তো জানো, আমার ছেলে মেয়ে দুইটাকে আমি বিদেশ পাঠাতে পারবো না। বিয়ে হবে, দেশে থাকবে, চোখের সামনে সংসার করবে। নাতি-নাতনীর মুখ দেখবো যখন মন চাবে তখন।”
স্বামীর কথায় মৃদ্যু ভাবে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন আয়েশা সিদ্দিকা। বললেন,
“দেশের বাহিরে থাকা আমারও পছন্দ না জায়ানের বাবা। তুমি ঢাকার ভেতরেই পাত্র দেখো। মফিজ ভাই নাকি দুইটা ভালো সমন্ধ পাইছে নেহার জন্য। মেহনুভার মা বলল। তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমি কি খবর নিতে বলব?”
মফিজউদ্দিনের সাথে সম্পর্কটা এখন ভালো না হলেও ছোট ভাইকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় আলাউদ্দিন হক। ছোট ভাই যে বেশ বিচক্ষণ তা আলাউদ্দিন হকের চেয়ে বেশি আর কে জানে। তবুও পারিবারিক কলহ এবং রেষারেষির জের ধরে বললেন,
“দরকার নেই। ওকে ওতো ওস্তাদি করতে হবে না।”
স্বামীর কথা মনঃপুত হলো না আয়েশা সিদ্দিকার। সময় না নিয়েই কাঠকাঠ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“মেহনুভার জন্য সমন্ধ যদি তুমি ঠিক করো তাহলেও কি ওস্তাদি হবে? ”
জবাব দিলেন না আলাউদ্দিন। উত্তর তার জানা আছে তবুও বলতে পারলেন না। বলবেন কি করে? ভাতিজা ভাতিজি দের কে যে সন্তানের মতোই ভালোবাসেন ছোট থেকে। যেখানে ভালোবাসা থাকে সেখানে আপনা-আপনি অধিকারবোধ ও উঁকি দেয়। মেহরুন এর বিয়ের কথা এতোদিন চিন্তা না করলেও এখন ভাবাচ্ছে উনাকে। নিজের মেয়ের সাথে সাথে একমাত্র জ্যাঠা হিসেবে ভাতিজির জন্য দ্বায়িত্ববোধ টাও জেগে উঠছে। চোখে দেওয়া চশমার কালো মোটা ফ্রেমটা ঠিক করতে করতে বললেন,
“মফিজ এর সমন্ধ যদি তোমার ভালো লাগে তো আমাকে জানিয়ো। তার আগে মেয়ের কাছে খোঁজ নিও ওর কোনো পছন্দ আছে কি না। আর মফিজকে বলে দিও, মেহনুভার কথাও যেনো ভাবে।”
স্বামীর কথায় মুচকি হাসলেন আয়েশা সিদ্দিকা। সন্তুষ্ট মূলক হাসি। হাজারো মা’রামা’রি কা’টাকা’টি, দ্বন্দ্ব সং’ঘাত সৃষ্টি হলেও শেকড় কে যে কেউ ভুলতে পারে না, মায়া-মহব্বত ছাড়তে পারে না। সেখানে এই সামান্য ব্যাবসা নিয়ে রেষারেষির সূত্র ধরে আলাউদ্দিন হক কি করে ভুলে যাবে সাত বছর আগেও একই পাতে দুই ভাই এর খানা খাওয়ার কথা। জীবনের কতোগুলা বসন্ত পার করেছেন তিনি, সেখানে মাত্র সাতটা বসন্তর জন্য তো ওতোগুলো বসন্ত মিথ্যে হতে পারে না। সে সময়ের ভালোবাসা তো এতো দ্রুত ফিকে হতে পারে না।
_________
পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে সেই যে একটা ঘুম দিয়েছিলো মেহনুভা, সজাগ পেয়েছে সন্ধ্যার ও পরে।
সারাদিনের চিরচিরে মেজাজটা অবশ্য ঘুমানোর পর ঠান্ডা হয়েছে অনেকটা। পরীক্ষা ও অনেক ভালো হয়েছে। শুধু বাবার বকা টুকু কপালে না জুটলে ভালোই যেতো তার দিন। পরীক্ষা দিয়ে আসার পর পর ই মেহনুভার দেখা হয়েছিলো বাবার সাথে। মফিজউদ্দিন মেয়েকে কাছে ডেকে বাজারের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে অন্যকিছু না বলে বলেছে মাশরিফ ভাই এর চেয়ে টাকা বেশি ফেরত এনেছে মেহনুভা। পঁচা পেঁয়াজ আর ফুটা বেগুনের কথা লুকিয়ে যায় কৌশলে। কিন্তু মফিজউদ্দিন তো ঘটনার কিছু অংশ জানেন, সকালেই শুনেছেন স্ত্রীর কাছে। এতো বড় মেয়ের কাছ থেকে তো টাকা বাঁচানো টা আশা করেন নি তিনি। খাবার দাবারের ব্যাপার, আশা করেছিলেন তরতাজা ভালো জিনিস ই ক্রয় করে আনবে। কিন্তু হলো তার উল্টো, শেষমেশ কপালে পঁচা পেঁয়াজ ই জুটলো। দুরন্তপনা মেয়েকে সে সময় কাছে ডেকে বুঝিয়েছেন ও, “সঠিক মূল্যে ভালো জিনিস কিনতে হয়। স্বস্তা পেয়ে খারাপ জিনিস নয়।” কিন্তু মেহনুভা তো মেহনুভা। নিজের পক্ষে যুক্তি খন্ডন করতে একটু ও ছাড়ে না। মফিজউদ্দিনের সাথেও শুরু করল। নিজের পক্ষে অতিরিক্ত সাফাই গাইতে গিয়ে ধমক খেলো বড়সড়। বকা জুটলো কপালে। তার উপর হুট করে কোথা থেকে উদয় হয়েছিলো মাশরিফ জায়ান। চলার পথে চাচার কানে ঘি ঢালতে ভুলেনি সে। বলে দিয়েছিলো পোকা ওয়ালা বেগুনের কথা। মাশরিফ ভাই এর কথা শুনে মেহনুভা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো অনেক ক্ষণ। মেহনুভার বেগুনে শুধু পোকা ছিলো না, তার টাতেও ছিলো। তাহলে দোষ শুধু মেহনুভার ঘাড়ে কেনো?
অনেক প্রশ্নই তো উঁকি দিয়েছিলো মনে কিন্তু বাবার রক্তচক্ষুর ভয়ে টু শব্দটাও করতে পারে নি। পাছে পিঠের উপর উদুম কেলানি না পরে। এতো বড় হয়েছে, ছোট ভাই বোন দের সামনে মান-ইজ্জতের ভয় তো আছে।
আগামী দুই দিন পরীক্ষা নেই মেহনুভার। কিছুটা অবসর সময় আছে হাতে। ঘরের বদ্ধ হাওয়া ভালো লাগছে না কিছুতেই। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো খোলা সুবিশাল ছাদটাতে। মেহনুভা দের চিলেকোঠার ঘর টা মুবিনের দখলে। যদিও মুবিন দু’তলায় ঘুমায়, তবুও দিনের অধিকাংশ সময় কাটে এই ছোট্ট চিলেকোঠায়। কক্ষে লাইট জ্বলছে। তার মানে মুবিন আছে ভেতরে। সে আর প্রবেশ করল না, জানালা দিয়ে উঁকি দিলো মেহনুভা। মুবিন এর সাথে মায়মুনাও আছে দেখা যায়। গেমস খেলছে দু জনে মিলে। মুখ ফিরালো। ওদিকে পা না বাড়িয়ে সৈয়দ পরিবারের দুই ছাদের মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি কারী সরু ব্রিজ টাতে পা ঝুলিয়ে বসল। সামনের জায়গাটা ফাঁকা। বড় বড় কোনো দালান নেই। তাই নিজের শহর টা যতদূর চোখ যায়, মন ভরিয়ে দেখতে পায়।
“পেত্নির মতো বসে আছিস কেনো?”
হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনে ভয়ে চমকে ওঠে মেহনুভা। কেঁপে উঠলো কিছুটা। পিছু ফিয়ে তাকিয়ে দেখল মাশরিফ জায়ান দাঁড়ানো। পরনে এখনও বাহিরের পোশাক। ফরমাল ড্রেস। শুধু সাদা রংয়ের শার্টের ফুল স্লিভ কুনুই পর্যন্ত গোটানো।
ভয় দূর করতে বুকে থুথু দেওয়ার ভঙ্গিমায় মেহনুভা উঁচু কন্ঠে শুধালো,
“ভূতের মতো ভয় দেখাচ্ছেন কেনো?”
“আমাকে কোন দিক থেকে ভূত মনে হচ্ছে?”
“আমাকে কোন দিক থেকে পেত্নি মনে হচ্ছে?”
“মুখে মুখে তর্ক করবি?
“করবো।”
“এখান থেকে ধাক্কা দিয়ে ফালায়ে দিবো।”
চুপসে গেলো মেহনুভা। সে জানে ধাক্কা দিবে না জায়ান, তবুও বাই এনি চান্স যদি দিয়েই ফেলে তাহলে অক্কা না পেলেও হাড্ডি গুড্ডি গুড়ো গুড়ো হয়ে যাবে। শয্যাশায়ী হয়ে বিছানায় পরে থাকতে হবে। না বাবা, এমনটা সে কিছুতেই চায় না। ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। কালারফুল ওড়নাটা ভালোভাবে গলায় পেঁচিয়ে মাশরিফের থেকে কয়েক হাত দূরে সরে আসল। মাশরিফ আগাগোড়া পরখ করলো মেহনুভার। এই মেয়েটার এমন রং চিটচিটে জামা কাপড় পড়ার স্বভাব জীবনেও যাবে না। পুরো বাসাটাতে তো লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, কমলা রং এ ভরপুর করে রাখছে সাথে নিজেকেও। এসব কড়া রংয়ের জিনিস খুবই বিরক্ত লাগে জায়ানের। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। চোখের সামনে এতো বড় বাড়িটাকে সয়ে যাচ্ছে এটা আর এমন কি। কয়েক দিন পর বিয়ে হয়ে গেলে আর দেখতে হবে না। মেহনুভার থেকে চোখ সরিয়ে মুবিনের চিলেকোঠায় তাকালো জায়ান। কন্ঠ কিছুটা উঁচু করে ডাকলোও, কিন্তু শুনলো না। নিশ্চয়ই ভিডিও গেমস খেলছে কানে হেডফোন গুজে। বাধ্য হয়ে মেহনুভাকেই বলল,
“ফাইলটা চাচ্চু কে দিয়ে আয়।”
“কিসের ফাইল?”
“সব কথাতেই তোর এতো প্রশ্ন কেনো?”
“আমার কোন কথাতে আপনি প্রশ্ন পাইলেন?”
দাঁত কটমট করে রেগে এমন গালি দিতে ইচ্ছা করল জায়ান এর কিন্তু থামলো খুব কষ্টে। এখন নিচে যাওয়া তার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব না। দাদাভাই এর সামনে যাওয়া মানেই রেস্টুরেন্টের আলাপ সাথে অন্যকোনো টাস্ক দিয়ে বসে কি না কে জানে। অন্য দিকে চাচার কাছে নিজে গিয়ে ফাইল দেওয়া মানে নিজের বিপদ নিযে ডেকে আনা। সব বুঝিয়ে দিতে দিতে রাত পার করে ফেলবে। তবুও চাচার ব্যাবসায়িক আলাপ শেষ হবে না। হাত ঘড়িতে নজর বুলাল। বন্ধু মহল অপেক্ষা করছে। আজ ছোট্ট খাটো একটা আড্ডার পসরা বসবে প্রায় এক সপ্তাহ পর। আজাইরা তর্ক করার সময় জায়ান এর নায়। তাইতো শান্ত কন্ঠে মেহনুভাকে বলল,
“ফাইলটা নিয়ে সোজা চাচার রুমে যাবি। বলবি আমি পাঠাইছি। লাস্টের পৃষ্টায়….”
” আমি পারবো না। আপনার ফাইল আপনি…”
“শীষষষ… একটা বাড়তি কথা বলবি তো সকালে লুকিয়ে চিতই পিঠা খাওয়ার কথা আমি নিজে গিয়ে চাচ্চু কে বলে আসবো। এবার বল, ফাইল নিয়ে যাবি নাকি চাচ্চুর ধাতানি খাবি?
বিস্মিত হলো মেহনুভা। চোখ বড় বড় করে শুধালো,
“আপনি কি করে জানলেন আমি চিতই পিঠা খাইছি?”
“আমি তো অন্ধ, চোখে দেখিনা। দোকানদার এসে বলে গেছে আমাকে। আরো কিছু?
কঠিন গলায় রাগান্বিত স্বরে বলল মাশরিফ জায়ান।
ভাবনায় মশগুল মেহনুভা। সে তো সব দিক খেয়াল রেখে তবেই চিতই পিঠা খাওয়ার মিশন সাকসেসফুল করেছে। তাহলে জানলো কি ভাবে। আরেহ ধুরু, দেখলো কি ভাবে? অতিরিক্ত ভাবনায় মাথাটা আউলা বাউলা হলো মূহুর্তেই। বেশি ঘাটলো না। হীতে বিপরীত না হয়ে যায় আবার। হাত বাড়িয়ে মাশরিফের কাছ থেকে ফাইল টা হাতে নিলো। তবুও খচখচানি স্বভাবটা দমাতে পারলো না।
বলেই ফেলল,
“মাশরিফ ভাই, আমি বাবার বড় মেয়ে। আপনার কমপিটিটর। আমার জানার হক আছে এটা কিসের ফাইল।”
চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত মাশরিফ এর পা থামে মেহনুভার কথায়। পিছু ফিরে তাকায়। বড় বড় দু কদম এগিয়ে মুখোমুখি হয় মেহনুভার। ডান হাতের সাহায্যে মেহনুভার মাথায় হালকা একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,
“তোর বিয়ের ফাইল। এই বাড়ি থেকে পেত্নি দূর করার ফাইল এটা।”
জায়ানের থাপ্পড় দেওয়া যায়গায় মেহনুভা হাত বুলায়।
মাশরিফের চোখে চোখ রেখে বলে,
“ওসব ফন্দি করে লাভ নায়। চাইলেও পারবেন না। পেত্নিকে বেশি জ্বালিয়েন না, সুযোগ পেলে আপনার ঘাড় মটকাতে ছাড়বে না। ”
চলবে….
(একটু এলোমেলো পর্ব। রিচেক করা হয় নি। আমি একটু দৌড়ের উপর আছি। মানে খুব ই ব্যাস্ত। মানিয়ে নিবেন দয়া করে।
ভালোবাসা সবাইকে💛)