প্রেমাচার কলমে: #অপরাজিতা_মুন #পর্ব_৯

0
224

#প্রেমাচার
কলমে: #অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৯
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ]

“ভোজনরসিক এর ভোজনালয়”রেস্তোরাঁর কুক রা বড়সড় কিচেনের এক দিক ফাঁকা করে দিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হকের নির্দেশে। সেখানে এখন সৈয়দ পরিবারের নাতী-নাতনীতের আনাগোনা। দুই পরিবারের সন্তানদের মাঝে হচ্ছে চা-কফির জমজমাট প্রতিযোগিতা। মেহনুভা তো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে কিন্তু জায়ান এখনও এদিক সেদিক ঘুরছে। তার আচরণে কেমন যেনো হেলাফেলা।
গোমড়া মুখে একটা পাত্রে মাত্র হাত দিয়েছে মেহনুভা, তখনি কোথায় থেকে হুট করে হাজির হলো মেহরুন এবং মায়মুনা। মুখে হাসি লেপ্টে দুজনের ই। এমন হাসি মেহনুভার খুব একটা পছন্দ হলো না, মাথায় আ’গুন ধরিয়ে দিলো। কেনোনা, চালাকি করে আগে ভাগে কুপন নিয়ে কফিটাই যে তার ভাগ্যে জুটেছে। মেহনুভার কাছে পাত্তা না পেয়ে মেহরুন চলে গেলো ভাই এর কাছে, তাগদা দিচ্ছে চা বানানোর উদ্দেশ্যে। মাশরিফ জায়ান বুঝতে পারছে না কি চা সে বানাবে। দুধ চা নাকি রং চা?
দাদাভাই এর একটু ঠান্ডা লেগেছে, বানাবে কি সে আদা চা? পাশ থেকে মেহরুন বলে, ” ভাইয়া, চলো বানাই এক কাপ মালাই চা।”

মাশরিফ জায়ান বোনের দিকে আশার চোখে তাকায়। কিন্তু ভরসা পায় না। মালাই চা যে বানাবে, দাদাভাই এর রুচি মাফিক কি হবে?

“তুই পারিস?”

জায়ানের প্রশ্নে মেহরুন উপর নিচে ঘাড় দুলায়। বলে,

“হ্যাঁ পারি তো। আমি বলি তুমি করো।”

এক টুকরো আশার আলো দেখতে থাকা মাশরিফ আশাহত হলো ছোট বোনের জবাব শুনে। চিন্তায় আর কিচেনের চুলার আঁচে গরম লাগছে ভীষণ। একটু স্বস্তির নিমিত্তে শরীরে পরিহিত ধূসর রং এর শার্টের টপ দু বোতাম খুলতে খুলতে শুধালো,

“তুই যে সব বলবি ওসব আমি আগে থেকেই জানি। নিজে কি কিছু করতে পারবি?

মেহরুন খেয়ালি দৃষ্টিতে মেহনুভার দিকে এক পলক তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,

“না ভাইয়া। আমি তো করতে পারবো না। মেহনুভা আমাকে করতে দিবে না। যা করার তোমাকেই করতে হবে।”

“তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমার মাথাটা আর গরম করিস না। যা, ওদিকে যা। হাফ লিটার গরম দুধ আন যা”

এতোক্ষণ মাশরিফ এবং মেহরুনের আশে পাশে ঘুরঘুর করছিলো সৈয়দ বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য স্কুল পড়ুয়া গুলুমুলু মায়মুনা। অমনোযোগী শ্রোতা হয়ে মাশরিফের কন্ঠে ভুলভাল কথা শুনে নাক কুঁচকে বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,

“ইয়্যু ভাইয়া! তুমি চা তে ডিম দিবা?”

মাশরিফ জায়ান তাকায় মায়মুনার দিকে। এই মেয়েটাকে সবার থেকে একটু বেশি স্নেহ করে সে। ছোট বোনের অভিব্যাক্তি দেখে হাসলো কিছুটা। বলল দুধ আনতে, মায়মুনা শুনে ফেলেছে ডিম আনতে।
ভুল যখন শুনেছে, সেই ভুল টাকে আর শুধরালো না। মায়মুনার মতো করেই জবাব দিলো,

“দিবো তো। খাবি?”

বড় ভাই এর প্রস্তাবে ডানে বায়ে মাথা নাড়ায় মায়মুনা। হাত নাড়াতে নাড়াতে নাক ছিটকিয়ে বলে,

“না। চা দিয়ে আমি ডিম ডুম খাই না। তোমার চা খেয়ে দাদাভাই এর যে কি অবস্থা হবে তা ভেবেই আমি দিশেহারা।”

“তোকে বুঝতেও হবে না। যা এখান থেকে, বোনের মতোই হয়েছে।”

মাশরিফ ভাই এর মুখে নিজের দিকে খোঁটা দিয়ে বলা কথা শুনেও আমলে নিলো না মেহনুভা। কফি যে বানাতে হবে তাকে, তাও আবার পারফেক্ট ভাবে। কথার প্যাচে কথা বলার মতো এতো সময় কোথায় তার? ভীষণ ব্যাস্ত সে।

.
পাশাপাশি দুটো গ্যাসের চুলা। একটাতে মেহনুভা কফি বানানোর উদ্দেশ্যে গরুর খাঁটি দুধ জ্বা’ল দিতে শুরু করেছে। মাশরিফ আর বেশি সময় নিলো না। নিজেও একটা পাত্রে আগে থেকে গরম করা দুধ মিডিয়াম আঁচে জ্বা’ল দিতে শুরু করল। বলক ওঠার কিছুক্ষণ পর চুলার আঁচ কমিয়ে দিলো। যখন দুধের উপর সর জমতে শুরু করলো তখন একটা চামচ এর সাহায্যে উপর থেকে স্বর গুলো আলতো করে তুলে নিয়ে একটা পাত্রে রেখে দিলো। এভাবে একদিকে দুধ ঘন হতে থাকল অন্য দিকে মালাই চা বানানোর উপাদান হিসেবে সর ও জমাতে থাকলো।

অপরদিকে মুবিন একটা উঁচু মোড়া নিয়ে মেহনুভার পাশে বসে পরেছে। এতো কাছাকাছি বসাতে মেহনুভা বেশ রেগে গেছে। কিচেনে এমনিতেই অনেক গরম, তার উপর মুবিন এতো কাছে বসেছে যে মাথার উপর বসে আছে বলে মেহনুভার মনে হচ্ছে। রেগেমেগে মুবিন কে ঠেলে দূরে বসতে বলে একটা বড় কাপে এক চা চামচ কফি পাউডার, স্বাদ মতো চিনি এবং এক চা চামচ গরম দুধ মিশিয়ে হ্যান্ড বিটারে বিট করতে থাকলো। কিছুক্ষণের মাঝেই কফি, চিনি আর দুধের সংমিশ্রণে ঘন এসপ্রেসো তৈরি হলো। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকল সবাই।

আশেপাশে কাউকে না পেয়ে এই ফাঁকে জায়ান মনোযোগ দিয়ে চা তৈরি করতে শুরু করল। এতোক্ষণে বেশ অনেকটা সর জমিয়ে ফেলেছে সে। যেহেতু আগে থেকেই দুধ টা গরম ছিলো তাই বেশি সময় লাগে নি সড় জমাতে। দুধ টাও ঘন হয়ে হয়ে গিয়েছে। হাফ লিটার দুধ কমতে কমতে প্রায় অর্ধেক হয়েছে। ঘন হয়ে আসা দুধে দুই চা চামচ চা পাতা, স্বাদ মতো চিনি এবং কয়েকটা এলাচ দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বা’ল করে নিলো। চা পাতার সঠিক রং যখন চলে আসলো তখন ছাকনি দিয়ে ছেঁকে একটা সুন্দর কাপে চা টুকু ঢেলে নিলো। চায়ের উপর দিয়ে দিলো আগে থেকে উঠিয়ে রাখা সর। চামচ দিয়ে হালকা একটু নেড়ে নিলো। তৈরি হয়ে গেলো সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মাশরিফ জায়ান এর হাতে তৈরি ধোঁয়া ওঠা সুস্বাদু মালাই চা।
নিজের জন্যও এক কাপ করে ফেলল মাশরিফ। সরু পাতলা ঠোঁটে চুমুক দিয়ে নিজের হাতে তৈরি চায়ের স্বাদ গ্রহন করে মেহনুভার দিকে তাকাল। সামনের পরিস্থিতি দেখে এক লহমায় চোখ জোড়া হলো ছানাবড়া। মেহনুভা শুধু কফি বানায় নি, কফির উপরে বিশেষ কায়দায় ল্যাটে আর্ট করে পাতার কম্বিনেশনে হার্ট শেপ দিয়েছে যা তার তৈরিকৃত কফিটাকে অতিরিক্ত লোভনীয় করে তুলেছে।

মন মানলো না কিছুতেই। সামনে থেকে মুবিন কে সরিয়ে দিলো মাশরিফ। মেহনুভার কাছাকাছি এসে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে পরখ করলো, নয়ন জোড়া বন্ধ করে শ্বাস টেনে কফির কড়া ঘ্রাণ নিলো। সর্ব/নাশ কাজ করবার! এই মেয়েটা কফি বানাতে পারে না বলে বলে ঠিক বানিয়ে ফেলছে। বানিয়েছে তো বানিয়েছে, একেবারে ছক্কা মে’রেছে। ল্যাটে কফি বানিয়ে চমকে দিয়েছে সকলকে।
মাশরিফ দেড়ি করল না। নিজের হাতের কাপ টা চুলার পাশে রাখলো। উপরের কেবিনেট থেকে একটা সাদা রং এর কাপ নিয়ে মেহনুভার সামনে ধরলো। নরম গলায় বলল,

“দেখতে হেব্বি টেস্টি লাগছে রে নোভা। আমাকেও এক কাপ বানিয়ে দে।”

মেহনুভা মাথা তুলে তাকাল। গোলগাল মুখ টা ঘেমে উঠেছে। সামনের কিছু অলস চুল কপালে লেপ্টে আছে। ঘর্মাক্ত মেহনুভার মুখটা দেখতে খুবই স্নিগ্ধ লাগছে। মাথা খাটিয়ে এতোক্ষণ ধরে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে কফি বানানো শেষে মাশরিফ ভাই এর প্রসংশা সহজ ভাবে নিতে পারলো না। ভ্রু কুঞ্চিত করে সন্দেহের নজরে তাকিয়ে বলল,

“কফি খেতে চাচ্ছেন কেনো? আর এতো তারিফ বা করছেন কেনো? দেখি তো আপনার চা?”

মাশরিফ পাশ থেকে নিজের কাপ টা হাতে নিয়ে মেহনুভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“খাবি? এই নে খা।”

“আপনার এঁটো করা চা আমি খাবো না।”

“খাবি না?”

“না।”

“কফিও দিবি না?”

“না।”

মেহনুভার কন্ঠে “না” বাচক শব্দ শুনে শান্ত এবং স্থির চোখে মাশরিফ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ডান হাতে ধরে রাখা চায়ের কাপ টাতে একটা তৃপ্তিদায়ক চুমুক দিলো। দাদাভাই এর জন্য বানানো চায়ের কাপটা মেহনুভার থেকে একটু দূরত্বে রেখে দিলো। সৈয়দ সাহেবের উদ্দেশ্যে পরিবেশন করতে ট্রে তে রাখা কফি মগ টা তে পূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করল। ঠোঁটের কোণে সবার অগোচরে মৃদু হাসলো। বাম হাতটা বাড়িয়ে ট্রে’র এক কোণা ধরলো। মেহনুভার মুখবয়বে দৃষ্টি স্থির করে শুধালো,

“আমি যদি তোর ট্রে’টা এখন হালকার উপর ঝাপসা নেড়ে দেই কেমন হবে?

শীতল হুম/কি তে কেঁপে উঠলো মেহনুভার অন্তরাত্না।
চেতে গিয়ে বলল মেহনুভা,

“খুব বাজে হবে। এমন কাজ ভুলেও করবেন না। ইয়া আল্লাহ! ট্রে ছাড়েন মাশরিফ ভাই। আমার মতো খারাপ কিন্তু কেউ হবে না।”

“তোকে খারাপ হতে কেউ বলছে না। কষ্ট করে এক কাপ কফি বানা।”

ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে থাকা মেহরুন, মুবিন, মায়মুনা হা করে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কোথায় থেকে কোথায় যাচ্ছে? ট্রে টা যদি মাশরিফ ভাই হালকা একটু নেড়ে দেয় তাহলে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে। লেগে যদি যায়, তবে মুবিন ও অংশগ্রহণ করতে চায়। ফট করে মাশরিফের ন্যায় ট্রে’র আরেক কোণা ধরে ফেলে। ঠোঁট বাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মেহরুন-মায়মুনাও বাদ গেলো না। মুবিনের ট্রে ধরার কারণ উপলব্ধি করে তারাও ছাড়লো না। ধরে ফেলল দুজনেই। মেহনোভা হতভম্ব নয়নে তাকিয়ে। কি হচ্ছে এসব তার সাথে! মেহরুন মনের কথা আর চেপে রাখতে পারল না। বলল,

“জায়ান ভাই এর জন্য বানালে বানা, না বানালে না বানা। আমাদের জন্য বানা। জায়ান ভাই ছাড়লেও, আমরা কিন্তু ছাড়ছি না।”

চলবে……

[টুক করে একটা মন্তব্য করবেন। আর যারা নেক্সট লিখেন, তারা নেক্সট না লিখে নাইস ও তো লিখতে পারেন। নেক্সট লিখে কি হয়? আল্লাহ যদি হায়াতে বেঁচে রাখে, পরের পর্ব তো আমি দিবোই।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here