প্রেমাতাল
পর্ব ৭
মৌরি মরিয়ম
কতক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর মুগ্ধ তিতিরকে পাহাড়ের কিনার থেকে সরিয়ে আনলো। ওরা ছিল আকাশনীলা কটেজের পেছন দিকটায়। কটেজের পিছন দিকেও একটা বারান্দা ছিল। সেই বারান্দার সামনে ঘাসের উপর তিতির বসে পড়লো। মুগ্ধও বসলো তিতিরের পাশে। অনেকটা সময় কেটে গেল, একটা কথাও বলেনি তিতির। ও এখনো তাকিয়ে আছে সামনের পাহাড় আর আকাশের দিকে। মুগ্ধ বলল,
-“শোনো তিতির, আমাদের দেরি হয়ে যাবে। আমরা মাত্র ৪৮ কিলোমিটার এসেছি। আরো ৪২ কিলোমিটার যেতে হবে অন্ধকার হবার আগেই।”
তিতির উঠে দাঁড়ালো। পাহাড় থেকে নামতে নামতে তিতির কোনো কথা বলল না। ওরা নিলগিরিতেই লাঞ্চ সেড়ে নিয়েছিল। খেতে খেতেও কোন কথা বলেনি তিতির। সিএনজি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর তিতির বলেছিল,
-“থ্যাংকস! আপনি ওভাবে না দেখালে আমি অনেককিছু মিস করে যেতাম। পাহাড়ের উপর ইটের কটেজ দেখে খারাপ লাগা নিয়েই ফিরে যেতাম।”
মুগ্ধ বাম হাতটা নিজের বুকের উপর রেখে বলল,
-“মাই প্লেজার তিতিরপাখি!”
-“বিশ্বাস করেন, আমি আমার জীবনে এত সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখিনি।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তিতির, তোমাকে আমার নিলগিরির আরো অনেক কিছু দেখাতে ইচ্ছে করছে। হয়তোবা তুমি আমার মতই প্রকৃতি প্রেমিক বলেই কিন্তু সবটা আমার সামর্থ্যের মধ্যে নেই।”
-“সবই তো দেখলাম। আরো কি ছিল?”
-“সকালের ম্যাজিক্যাল নিলগিরির মেঘের সমুদ্র দেখাতে খুব ইচ্ছে করছে, সূর্যাস্তের নিলগিরিকে দেখাতে ইচ্ছে করছে। পূর্ণিমা রাতের চাঁদ তারা ভরা নিলগিরিকে দেখাতে ইচ্ছে করছে।”
-“আপনি এই সবগুলো দেখেছেন?”
-“হুম! তবে এর বাইরে একটা জিনিস দেখতে ইচ্ছে করছে।”
-“কি?”
-“উপরের কটেজগুলো বাদে নিচে একটা কাঠের কটেজ দেখেছো না?”
-“হুম!”
-“ওই কটেজে অসংখ্য তক্ষক রাত হলেই হুমরি খেয়ে পড়ে।”
-“তক্ষক দেখতে চাচ্ছেন?”
-“নাহ, তক্ষক তোমার গায়ে এসে পড়লে তুমি কি করবে তা দেখতে ইচ্ছে করছে।”
-“আপনাকে যতটা ভালমানুষ মনে করেছিলাম আপনি আদৌ তা নন।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। বলল,
-“সবাই কেন জানি এই ভুলটা করে ফেলে।”
তিতির মৃদু হেসে বলল,
-“আমরা যদি আজ এখানে থেকে যাই তাহলে কি এগুলো দেখতে পারবো?”
-“কাল ভরা পূর্নিমা। আজই আকাশে এতবড় একটা চাঁদ উঠবে তাই হয়তো সেটা দেখাতে পারবো। সূর্যাস্ত তো ডেইলি হয় তাই সেটাও দেখাতে পারবো। সকালে মেঘের সমুদ্রও পাবো এই সময়ে, কিন্তু আজ আমরা এখানে থাকতে পারবো না। কারন, সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের থানচি পৌঁছতে হবে, তাছাড়া ৩ মাস আগে বুকিং দিতে হয় নিলগিরিতে থাকতে চাইলে।”
তিতির মন খারাপ করে বলল,
-“ওহ!”
-“মন খারাপ করোনা। আরো অনেক সৌন্দর্য তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। যা তুমি কল্পনাও করতে পারছো না। আর এসব নাহয় পরে কোন একসময় এসে দেখে যাবে।”
তিতির এবার পুরো মুগ্ধর দিকে ফিরে বলল,
-“আপনি না যেকোন সাধারণ একটা যায়গা থেকেও সৌন্দর্য খুঁটিয়ে বের করতে পারেন।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“কোন যায়গাই সাধারণ না। সব যায়গার মধ্যেই কোনো না কোনো সৌন্দর্য আছে, কম আর বেশি।”
-“হুম! আচ্ছা, সেন্ট মার্টিনসের সৌন্দর্যের কথা বলুন তো একটু। ওখাকার কি কি আপনার কাছে মনে হয়েছে এক্সট্রা অর্ডিনারি।”
-“তুমি গিয়েছো নাকি যাওনি?”
-“সেটা পরে বলছি, আগে আপনি বলুন না?”
-“সেন্ট মার্টিনসের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ওখানে দুদিন থাকতে হবে। ম্যক্সিমাম মানুষ যে ১২ টায় গিয়ে ৩ টায় ফিরে আসে সেটা করলে হবে না।”
-“আচ্ছা। তারপর?”
-“ওখানকার সমুদ্রের পানিটা তো খুব স্বচ্ছ, সি গ্রিন কালারের। একদম মালদ্বীপের মত তাই রাতে বিচে গেলে দেখা যায় পানির নিচে লাইট জ্বলছে, মুক্তোর মতো। দ্যাটস দ্যা প্রাইসলেস মোমেন্ট হেয়ার! পূর্নিমা থাকলে তো কথাই নেই। আরেকটা সৌন্দর্য হচ্ছে রঙিন মাছ। ছেঁড়া দ্বীপে উপর থেকে দেখা যায় বটে তবে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় পানির নিচ থেকে। ইদানিং ওখানে সি ডাইভিং এর মত একটা সিস্টেম চালু করেছে। তবে অতটা না জাস্ট সমুদ্রের নিচে একটু ঘুরিয়ে রঙিন মাছ, রঙিন প্রবাল দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তবু এটা মাস্ট করা উচিৎ সবার। বিদেশে গিয়ে সি ডাইভিং এর আনন্দের চেয়ে নিজের দেশে এটা কম আনন্দের না। আর কাঁকড়া খাওয়া উচিৎ কারন, বেস্ট কাঁকড়া যে তিন যায়গায় পাওয়া যায় তার মধ্যে সেন্ট মার্টিনস একটা।”
-“কাঁকড়া আমার অনেক পছন্দ। অন্য দুটো যায়গা কোথায়?”
-“কুয়াকাটা সি বীচের লেবু বন, আর চিটাগাং এর নাভাল রোড।”
-“আপনি তো পুরো একটা এনসাইক্লোপিডিয়া!”
-“হা হা হা হা.. ঘুরাঘুরি ছাড়া অন্য কোন নলেজ আমার নেই।”
-“যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি। যেজন্য আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেন্ট মার্টিনসের কথা। আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা সন্ধ্যার পর বীচে নিয়ে যায়নি। তাই ওই সৌন্দর্যটা আমি মিস করেছি। কেউ কখনো বলেওনি এ ব্যাপারে। আর সি ডাইভিং টাইপের কিছু বাংলাদেশে আছে তা তো জানতামই না।”
-“ওহ!”
-“এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের যে প্রান্তেই যাইনা কেন আপনার সাথে না গেলে সব সৌন্দর্য মিস করবো।”
মুগ্ধ মনে মনে ভাবল, ‘আমারও যে তোমাকে আমার দেখা সব সৌন্দর্য আমার মত করে দেখাতে ইচ্ছে করছে তিতিরপাখি। তুমি হয়তো সরল মনে বলেছো কথাটা কিন্তু আমি বলতে পারছিনা তোমার মত করে।’
তিতর উত্তরের জন্য উৎসুক হয়ে চেয়ে ছিল। তাই মুগ্ধ বলল,
-“টিওবির নেক্সট ট্রিপগুলোতে যেয়ো। সব দেখাবো।”
-“ওকে।”
দরজায় আবার টোকা পড়লো.. ভাবীর গলা,
-“তিতির, এই তিতির? আবার ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”
-“আসছি ভাবী।”
তিতির তাড়াতাড়ি চুলটা আঁচড়ে রুম থেকে বের হলো। ওর মা বলল,
-“কিরে, এত দেরী করলি কেন উঠতে? নে তাড়াতাড়ি খেতে বোস।”
-“সময় নেই, ফার্স্ট ক্লাসের পর বাইরে খেয়ে নেব।”
-“না, ক্লাসে লেট হলে হবে। খেয়ে যা।”
-“এখন কি আমার খাওয়া-দাওয়াটাও তোমরাই ঠিক করে দেবে মা?”
তিতিরের মার চোখদুটো বড় হয়ে গেল। মেয়ে কি মিন করতে চাচ্ছে! তিতির কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন আর। সারারাত না ঘুমানো এবং কান্নার জন্য চোখ দুটো বড্ড জলছে। সবকিছুর জন্য মুগ্ধ দায়ী। কেন ফোন করতে গেল এতদিন পর! কেনই বা গান রেকর্ড করে পাঠালো! মুগ্ধকে ও ভুলতে পারেনা কখনোই এটা ঠিক কিন্তু সবকিছুকে চাপা দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোলে তো রাখতে পারে। অথচ সব যখন কন্ট্রোলে তখনই মুগ্ধ ফোন করে বা ভার্সিটির সামনে এসে হাজির হয় আর সব আবার ওলট পালট হয়ে যায় তিতিরের। কোন কাজ ঠিকভাবে করতে পারে না। কোন ব্যাপারে স্থির থাকতে পারে না। একদম অস্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন শুধু একটাই কাজ, মুগ্ধর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোকে পার্ট বাই পার্ট রিভিশন করা। রাস্তার ধার ধরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে হাঁটতে তিতির ভাবনায় ফিরে গেল আবার।
থানচির উদ্দেশ্যে সিএনজি চলছিল। নিলগিরির পর থেকে যত আপহিলস আর ডাউনহিলস আসুক না কেন তিতরের আর ভয় করছিলনা বরং মজা পাচ্ছিল। দুজনে গল্প করতে করতে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পার হওয়ার পর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল। সিএনজি হঠাৎ থেমে গেল। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করল,
-“ও মামা, কি হইলো?”
হাসু কতক্ষণ ঘাটাঘাটি করে বলল,
-“মামা, গাড়ি নষ্ট হইসে। আর যাওন যাবো না।”
-“হায় হায় কও কি মামা! এই মাঝপথ থেকে কিভাবে যাব আমরা?
তিতির বলল,
-“এখন কি হবে?”
হাসু বলল,
-“গাড়িতে ঝামেলা হইলে আমি কি করমু কন? এইডা ঠিক করোন তো আমার কাম না।”
-“তাইলে এখন তুমি কি করবা?”
-“কি আর করমু? গাড়িতে শুইয়া রাইত পার করমু। সকাল হইলে থানচি থিকা কত চান্দের গাড়ী বান্দরবান যাইবো না? কোন একটার সাহায্য নিমু।
মুগ্ধ চিন্তায় পড়ে গেল। আরো ১৭ কিলোমিটার বাকী! তিতিরকে নিয়ে কিভাবে যাবে এতটা পথ! আর এক ঘন্টাও বাকি নেই সন্ধ্যা হওয়ার! সিএনজিতে গেলে হয়তো পৌঁছে যেত সন্ধ্যার আগে। কিন্তু হেঁটে তো অসম্ভব। আর তিতির কতটা হাঁটতে পারবে এই উঁচু নিচু রাস্তায় সেটাও তো চিন্তার বিষয়। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে তিতিরকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো মুগ্ধ। তিতির বেশ হেলেদুলে হাঁটছে। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সিএনজি নষ্ট হবে সেজন্য তুমি প্রস্তুতই ছিলে।”
তিতির হেসে বলল,
-“কি করা যাবে বলুন। যেটা হয়েছে সেটাকে মেনে নেওয়াই ভাল না?”
-“হুম!”
এরপর আর কেউ কোন কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটছিল রাস্তার কিনার দিয়ে। একসময় মুগ্ধ বলল,
-“তোমার কষ্ট হচ্ছে উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে?”
-“না তো।”
-“ব্যাগপ্যাক টার অনেক ওজন না? ওটা আমাকে দাও।”
-“নো নো.. আমার বোঝা আমি টানতে পারি। আমি ছেলেদের ওপর ডিপেন্ডেন্ট না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“বাহ! তাহলে তো ভালই। কিন্তু তিতির আমি চিন্তা করছি অন্য কথা।”
-“কি?”
-“থানচি তো দূরের কথা, আগামী ১ ঘন্টায় নেক্সট যে আর্মি চেকপোস্ট আমরা সে পর্যন্তও যেতে পারবো না হেটে।”
-“এতদূর?”
-“হুম!”
-“তাহলে? অন্ধকার হয়ে গেলেও হাঁটবো?”
-“পাগল হয়েছো? এটা পাহাড়ী রাস্তা। রাত হলে কতরকম বন্যপ্রানী চলে আসে এখানে। তাছাড়া পাশেই কত বড় খাদ দেখেছো? সবচেয়ে বড় কথা হলো রাতে এই রাস্তায় চলার পারমিশন নেই। আর্মিদের নজরে এলে খবর আছে।”
-“তাহলে?”
-“সেটাই ভাবছি।”
-“চলুন আশেপাশের কোনো গ্রামে গিয়ে রাতটা থাকতে দেয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করি।”
-“এটা সিনেমা না তিতির।”
-“মানে?”
-“মানে তোমার কি মনে হয় পাহাড়ে অন্য যায়গার মত একটু পর পর গ্রাম থাকে? কক্ষনো না। এরপর যে গ্রামটা সেটা আর্মি চেক পোস্টেরও পরে।”
-“তাহলে তো আমরা ভুল করলাম। সিএনজিতেই থাকতে পারতাম রাতটা।”
-“সেরকম হলে কি তড়িঘড়ি করে ভাড়া মিটিয়ে চলে আসতাম?”
-“কেন? সিএনজিতে থাকতে কি প্রব্লেম ছিল?”
-“ওই সিএনজি ড্রাইভার যদি ডাকাত দলের কেউ হয়ে থাকে? ডাকাতদের সাহায্য করার জন্য ইচ্ছে করে সিএনজি নষ্টের ভান করে থাকে? কিংবা নিজেই যদি ছুরি ধরে ব্ল্যাকমেইল করে? কি করতে পারবে তুমি?”
বিস্ময়ে তিতিরের চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। বলল,
-“মানে, কি বলছেন এসব?”
-“অসম্ভব কিছু না। এরকমটা এদিকে হয়। তুমি সাথে আছো বলেই ভয়টা বেশি লাগছে।”
-“এখন কি হবে?”
-“ডোন্ট ওরি। তাড়াতাড়ি হাটো। সামনে একটা দ্বিমুখী রাস্তা আছে বোধহয়। থানচির রাস্তায় না গিয়ে আমরা অপজিটে যাব।”
-“কেন আমরা থানচি যাব না?”
-“যদি ওই হাসুটার মধ্যে কোনো ঘাপলা থেকে থাকে তাহলে ওরা ওই থানচির রাস্তায় যাবে আমাদের খুঁজতে। কারন ওরা ভাববে আমরা ওদিকে গিয়েছি।”
To be continued…