গল্পের নামঃ #প্রেমানুভূতি
#পর্বসংখ্যা_০৫
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
মহুয়া ঠান্ডা পানিতে হাত ডুবিয়ে রেখেছে আর তাকে সমানে বকে যাচ্ছে আদনান। মহুয়া মুখ ফুলিয়ে বলে,
– “আরে ভাই! আমাকে বকছেন কেন? আপনাকে দেখেই তো চমকে গেলাম, তাই তো গরম পানিটা ছিটকে পড়লো।”
আদনান এবার হতভম্ব হয়ে বলল,
– “এখন এটা আমার দোষ হয়ে গেলো। আর আপনি আমাকে দেখে চমকালেন কেন? এবং হ্যাঁ আমি আপনার ভাই হলাম কবে?”
মহুয়া এবার চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
– “ওহ্,সরি ইটস আ মিস্টেক! ভেরি সরি।”
– “বাট আই উইল নট ফরগিভ ইউ!”
মহুয়া এবার কাঁদাকাঁদো হয়ে বলল,
– “সরি বললাম তো! তাও এমন করছেন কেন?”
আদনানের বোধহয় এবার মন গললো। ধীর কন্ঠে বলল,
– “আচ্ছা মাফ করে দিলান। কিন্তু আপনাকে সাবধানে থাকতে হবে তো। এভাবে প্রতিদিন ব্যাথা পেলে চলবে? প্রতিদিন নিয়ম করে সকালে একবার ব্যাথা পান, আবার দুপুরে ব্যাথা পান। এত ব্যাথা পেলে তো দেখা যাবে আপনাকে সবসময় হসপিটালে থাকা লাগছে, আর তাতে আমি ফকির হয়ে যাবো।”
মহুয়া এবার ধরা পড়া কন্ঠে বলল,
– “কোথায় আমি সকালে ব্যাথা পেলাম। এখনই যা একটু গরম পানি লাগলো।”
আদনান এবার ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “মিথ্যাটা ভালো করে রপ্ত করতে পারেন নি। সকালে আপনার হাত কেটেছে, যার দরুন আপনি সকাল ঠিকমত খেতে পারছিলেন না। দুই আঙুল দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, আমার চোখ এড়াইনি সেটা।”
মহুয়া মুখ ছোট করে বলল,
– “মিথ্যা বলার সরি! বাই দ্যা ওয়ে, আপনার চোখ তো পুরো গোয়েন্দাদের মতো।”
আদনান থতমত খেয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, “গোয়েন্দার চোখ তো গোয়েন্দার মতোই হবে।”
__________
দুপুরে খেতে বসেছে সবাই। মোর্শেদ চৌধুরী নিজের রুমে শুয়ে আছেন, ঔষধের টাইমিং এর কারনে তিনি পরে খাবেন। তাই আদনান আর মহুয়া এখন খেতে বসেছে। মহুয়ার কাটা হাতেই গরম পানি পড়েছিলো ফলে হাত ফুলে লাল হয়ে গেছিলো। মহুয়া তো কেঁদেকেটে নাক-মুখ লাল করে ফেলেছিলো। আদনান তখন বকে ধমকে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। মহুয়া তার ধমক শুনে আবারো কেঁদে ফেলেছিলো।
খাবারের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে মহুয়া। আদনান মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলে মহুয়া অসহায় চোখে তাকায়। হাতের এমন অবস্হা চামচ ধরারও উপায় নেই। আদনান এবার নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে মহুয়াকে মুখের সামনে ধরলো। মহুয়া চমকে তাকালো। মাথা নেড়ে না করতেই আদনান চোখ গরম করে তাকালো। মহুয়া উপায় না পেয়ে তার হাতেই খাওয়া শুরু করে দিলো। এভাবেই পুরো খাবার মহুয়াকে খায়িয়ে তারপর নিজে খাওয়া শুরু করলো সে।
অন্যদিকে মহুয়ার চোখটা কেমন যেন জ্বলছে। ঠিক কত বছর আগে কেউ তাকে এমন যত্ন করে খায়িয়ে দিয়েছে সেটা তার মনে পড়ে না। খুব ছোটবেলায় মাঝে মাঝে বাবা খায়িয়ে দিতো। তারপর তো বাড়ির সার্ভেন্টরা, কিন্তু তারা তো এমন যত্ন করতো না। যেন কোনরকম কাজটা শেষ করলেই পারে। আজ বহুবছর পর তাকে কেউ খায়িয়ে দিলো
চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছতেই কানে এলো আদনানের কন্ঠস্বর,
– “আপনি এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলেন মহুয়া!”
চোখের কোণে জমে থাকা পানি নিয়েই হেসে ফেললো মহুয়া।
__________
সন্ধ্যার দিকেই আকাশে কালো মেঘ জমলো। মহুয়া মেঘ দেখতে ছাদে গিয়েছিল কিন্তু বাতাসে ধুলোবালির উড়োউড়ির কারনে থাকা সম্ভব হয় নি। রাতের দিকেই ঝড়ঝড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির বেগের কারনে বাহিরটা ঠিকমতো দেখাও যাচ্ছে না। আদনান শিল্পী খাতুনকে ফোন করে জানিয়ে দিলো, বৃষ্টির কারনে তারা আসতে পারবে না। আগামীকাল সকালে আসবে। মহুয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টির হালকা ফোঁটা ফোঁটা পানি গায়ে এসে ছিটকে পড়ছে। আজ হাতটা কাটা না থাকলে ঠিকই বৃষ্টিতে ভিজতে চলে যেতো। বাম হাতটা বারান্দা দিয়ে বাহিরে বের করতেই আদনান রুমের ভিতর থেকে দৃঢ় গলায় বলল,
– “বৃষ্টিতে ভিজবেন না কিন্তু মহুয়া, ঠান্ডা লেগে যাবে।”
মহুয়া গাল ফুলিয়ে রুমে এসে বলল,
– “আপনি কিভাবে জানলেন আমার ঠান্ডা লাগবে হু? আমার ঠান্ডা লাগবে না।”
আদনান মহুয়ার গাল টিপে বলল,
– “সকালে গোসল করার পর বারবার যখন হাঁচ্চি দিচ্ছিলেন তখনই বুঝে ফেলেছি। বুঝলেন পিচ্চি!”
মহুয়া এবার রেগে বলল,
– “আমি মোটেও পিচ্চি নই। আমার বয়স ১৮ বছর ২ মাস বুঝেছেন। আই অ্যাম অ্যান অফিশিয়াল এডাল্ট! গট ইট?”
আদনান জোরে হেসে দিলো। মহুয়া ক্ষুব্ধ চোখে গাল ফুলিয়ে তাকালো তার দিকে। লোকটা তাকে উপহাস করছে।
মহুয়া এবার উঠে যেতে নিলে আদনান তার হাত ধরে বসিয়ে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
– “ও মাই গড মহুয়া আপনি এতো পিচ্চি! আমি তো ভেবেছিলাম অন্তত ২০-২২ বছর হবে কিন্তু মাত্র ১৮! আমার বয়স কত জানেন? ২৪ বছর, আপনার থেকে ৬ বছরের বড় আমি।”
মহুয়ার মাথায় এবার দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিলো। মুখ ভার করে বলল,
– “কিহ! চব্বিশ বছর,এত বড়। বাবা শেষ পর্যন্ত একটা বুড়ার সাথে বিয়ে দিলো আমাকে!”
আদনান হতভম্ব হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “আমাকে দেখে বুড়া কোনদিক দিয়ে লাগে হ্যাঁ? ২৪ বছরে কেউ বুড়ো হয়?”
মহুয়া এবার খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। যাক শেষ পর্যন্ত লোকটাকে রাগাতে পেরেছে। উদ্দেশ্যে সফল হলো তার। মহুয়াকে হাসতে দেখে থমকে গেলো আদনান। হাসলে মহুয়ার বাম গালে খুব সুন্দর একটা টোল পড়ে। দেখতে খুব সুন্দর লাগে।
হঠাৎ করে অনেক জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। আদনান চমকে উঠে জানালার দিকে তাকালো। মহুয়া ভাবলেশহীন ভাবে উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। আদনান জিজ্ঞেস করলো,
– “আচ্ছা মহুয়া। আপনি বিদ্যুৎ চমকানোতে ভয় পান না? আম্মু তো প্রচুর ভয় পায়, আমার অথবা হাত ধরে শক্ত করে বসে থাকে।”
মহুয়া মলিন হেসে বলল,
– “পাঁচ বছর বয়স থেকে একা ঘরে শোয়া একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করছেন সে বিদ্যুৎ চমকানো ভয় পায় কিনা?”
আদনান মহুয়ার হাসির দিকে করুণ চোখে তাকালো। মহুয়া স্লান হেসে বলল,
– “আগে প্রচুর ভয় পেতাম। ভয়ে গুটিয়ে যেতাম, কান্নাকাটি করতাম। কিন্তু কান্না থামানোর জন্য, ভয় দূর করার জন্য কেউ ছিলো না। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিলাম। এসব জিনিসের ভয়টা ধীরে ধীরে দূর হয়ে গেলো। যার কেউ নেই তার জন্য তাকেই থাকতে হয়। ”
আদনান মহুয়ার দিকে এক পলক তাকালো। তার সামনে গোলগাল সর্বক্ষণ মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার জীবনে যে এত কষ্ট আছে সেটা কি কেউ জানে?
মহুয়া আদনানের তাকানো দেখে ইতস্তত করে বলল,
– “চলুন শুয়ে পড়ি।”
আদনান সায় দিলো। মহুয়া বিছানার এক কোণে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ক্লান্ত থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। আদনান তখনো অপলক তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। ঠান্ডায় মহুয়া হালকা কাঁপছে। আদনান তার পায়ের নিচে থাকা কম্বলটা মহুয়ার গায়ে দিয়ে দিলো। তারপর ধীর গতিতে তার মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। মহুয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
– “আপনি আর কখনো কষ্ট পাবেন না মহুয়া। মাই প্রমিস! আমি আপনাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দেবো না। আপনি এখন থেকে সুন্দর একটা লাইফ লিড করবেন। সবার মতো আপনারও পরিবার থাকবে,আপনজন থাকবে। আপনার স্বপ্ন, ইচ্ছা-আকাঙ্খা সব পূরণ করার দায়িত্ব আমার। স্বপ্নগুলো হবে আপনার, আর পথ চলার সহযোগী হিসেবে থাকবো আমি। ইটস মাই প্রমিস টু ইউ!”
চলবে,
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।