প্রেমানুভূতি #পর্বসংখ্যাঃ ০৭ লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

0
405

গল্পের নামঃ #প্রেমানুভূতি
#পর্বসংখ্যাঃ ০৭
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

রিসেপশনে উদ্দেশ্যে গাড়িতে বসতেই অদ্ভুত এক অস্বস্তি শুরু হয় মহুয়ার। বারবার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে। শিল্পী খাতুনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে মনে মনে দোয়া-দুরুদ পড়ছে সে। ড্রাইভারটা অতি দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। সংকোচে সে বলতে পারছে না গাড়িটা আস্তে চালাতে। এই গাড়িতে সে, শিল্পী খাতুন আর আদনানের খালামনি আছে। রাস্তা ক্রস কাটার সময়টাতেও ড্রাইভার গাড়ির স্পিড কমালো না। অতি দ্রুত গতিতে আসা একটি বাসের সাথে সংঘর্ষ হতে গিয়েও শেষ মূহুর্তে বেঁচে গেলো। মহুয়া নড়েচড়ে বসলো। আদনানের খালামনি ড্রাইভারকে সতর্ক করলেন। গাড়ির দরজা আনলক করে হ্যান্ডেলটা ধরে বসে থাকলো মহুয়া।
ইউ টার্ন নিতে গিয়ে অপর পাশ থেকে আসা দ্রুত গতির ট্রাকটির সাথে গাড়ির বামপাশে প্রচন্ড সংঘর্ষ হলো। বামপাশে থাকা কাচগুলো ঝরঝড়িয়ে ভেঙে পড়লো। মহুয়া বাম পাশে ছিলো, তার হাতে ভাঙা কাঁচের গুড়ো-গুলো পড়লো। চোয়াল শক্ত করে মহুয়া অতিদ্রুত বাম পাশ থেকে শিল্পী খাতুনকে দরজার দিকে ধাক্কিয়ে ডান পাশে দরজার সাথে লাগিয়ে বসালো। হুট করে ধাক্কা খাওয়ায়,গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো ড্রাইভার। যার ফলস্বরূপ ডান দিকে দিকে থাকা বাসটার সাথে প্রচন্ড জোরে বাড়ি খেলো। মহুয়া সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী খাতুন আর তার বোনকে বাম দিকের দরজা খুলে ঠেলে বের করে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
– “আমায় মাফ করে দিয়েন আম্মা!”

ততক্ষণে গাড়ির ডান পাশ ভেঙে পড়ে গেলো। কাঁচের গুড়ো এদিক-ওদিক ছিটিয়ে পড়তে থাকলো। সেই সাথে রাস্তায় গড়িয়ে পড়তে থাকলো তরল রক্ত। মহুয়ার লাল কাচেঁর চুড়ির ভাঙা অংশ রাস্তায় পড়ে আছে। অতি যত্নে লাগানো গাজরাটাও এক পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেলো।
শিল্পী খাতুন জোরে আর্তনাদ করে উঠলেন। আদনানের খালামনি তাড়াতাড়ি আদনানকে ফোন দিয়ে ঘটনাস্হলে আসতে বলেন। মহুয়ার অবস্থার কথা না বলেই ফোন কেটে দেন তিনি। আদনান কোন মতে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে আসার জন্য রওনা দেয়।
আশেপাশের লোকেরা এসে তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে বের করে। তারপর গাড়ির ভাঙা অংশ উঠিয়ে মহুয়াকে বের করার চেষ্টা চালায়। ততক্ষণে আদনান এসে পৌঁছায়। আদনানকে দেখে শিল্পী খাতুন তার কাছে দৌড়ে যান। তাড়াতাড়ি সব ঘটনা বলে মহুয়াকে বের করতে বলেন। মহুয়াকে এমন অবস্হায় দেখে আদনান থমকে দাঁড়ায়। কোনমতে নিজেকে সামলে লোকজনের সাহায্যে মহুয়াকে বের করে আনে। মহুয়ার অবস্হা দেখার মতো না। মাথা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে, হাতগুলোর অবস্হা আরও শোচনীয়। ডান হাতটা মনে হয় ভেঙে গিয়েছে, বেঁকে আছে। কাঁচর চুড়ি ভেঙে চামড়ার সাথে গেঁথে আছে, গাড়ির কাঁচগুলোর হাতের মধ্যে গেঁথে আছে। মহুয়াকে আনতে গিয়ে আদনানের হাতেরও এর খোঁচা লেগেছে। পড়নের শাড়িটারও যাচ্ছেতাই অবস্হা।

মহুয়াকে গাড়িতে বসিয়ে কোনমতে গাড়ি চালাতে শুরু করে আদনান। বারবার লুকিং গ্লাসে মহুয়াকে দেখছে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করলো সে। হসপিটালে পৌঁছাতেই মহুয়াকে কোলে নিয়ে দৌড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো সে। স্ট্রেচারে মহুয়াকে শুয়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের পরিচিত ডাক্তারকে ফোন লাগালো। কিছুসময় পরই ডাক্তার আদনান যে ফ্লোরে ছিল সেখানে এসে উপস্হিত হলো। আদনান অস্হির হয়ে মহুয়ার কথা বলল। আদনানকে শান্ত করে ডাক্তার মহুয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্হা করলো।

ডাক্তার চলে যেতেই আদনান মহুয়ার হাতটা মুঠো করে ধরলো। চোখের সামনে এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে কপালে নিজের উষ্ণ অধরদ্বয় ছোঁয়ালো। মহুয়ার হাতটা নিজের কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
– “সবটা শুরু হবার আগেই কেন শেষ হয়ে যাচ্ছে? একটু সুখের আশার বদলে কেন এক রাশ দুঃখ আর বেদনা জুটলো?”

নার্স এসে জলদি মহুয়াকে নিয়ে চলে গেলো। আদনান পেছন থেকে অসহায় দৃষ্টিতে মহুয়ার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। নিজেকে বারবার দোষী মনে হচ্ছে তার। কেন বারবার মেয়েটাকে এত কষ্টের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, কেন? এর উত্তর তার কাছে নেই।

কিছুসময় পরই মহুয়ার বাবা আর আদনানের মা-বাবা এসে উপস্থিত হলো। মহুয়ার বাবা মেয়ের এই অবস্হার কথা শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শিল্পী খাতুন তো কেঁদেকেটে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। মাহমুদ খান অর্থাৎ আদনানের বাবা কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মনে মনে তিনিও বেশ চিন্তিত মহুয়ার জন্য।
আানান থমথমে মুখে হসপিটালের এক কোণে বসে আছে। সময় যতো গড়াচ্ছে তার চিন্তা তত বেশী বাড়ছে নিজেকে কোনভাবেই শান্ত রাখতে পারছে না।

এর মধ্যেই পাশের ওয়ার্ডের এক জন মারা গেলো। ওয়ার্ডের সবাই ইন্নালিল্লাহ পড়লো। লোকটির স্ত্রী কান্নার আওয়াজের ফলে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে মনটা আরও বিষন্ন হয়ে উঠলো আদনানের। অশান্ত মনে নিয়ে অজু করে হাসপাতালের মসজিদে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতে থাকলো। নামাজ শেষে আকুল আবেদনে সৃষ্টিকর্তার কাছে মহুয়ার সুস্হতার দোয়া করলো।

_________

আদনান হাসপাতালে ফিরলেই খবর পেলো মহুয়ার অপারেশন এখনো শেষ হয় নি। নামাজ পড়ায় মনে অনেকটা শান্তি এসেছে। মাথা ঠান্ডা রেখে চেয়ারে বসে দোয়া পড়তে থাকলো। কিছুসময় পর ডাক্তার বের হতেই আদনান তার কাছে ছুটল গেলো। ডাক্তার আদনানকে বললেন,
– “পেশেন্টের অবস্হা ভালো না। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে কিন্তু পেশেন্ট খুব দুর্বল। তাকে দেখেশুনে রাখতে হবে।”

সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আদনান ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিতে গেলে ডাক্তার তাকে আলাদাভাবে কেবিনে আসতে বললো। আদনান সংকোচ আর ভয় নিয়ে তার কেবিনে গেলো। কেবিনে ঢুকতেই ডাক্তার বলল,
– “আসুন মি. আদনান। আসলে আপনার স্ত্রী সম্পর্কে আরেকটি কথা আছে যেটা আমি বাহিরে বলি নি। তিনি সম্ভবত আগে কোনভাবে মাথায় বাড়ি খেয়েছিলেন যার ফলে আমার মনে হয় তার প্রায়ই মাথা ব্যাথা করতো। এবারও তিনি মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। তাই ওনি মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করতে পারে। ওনাকে মানসিক অশান্তি থেকে দূরে রাখবেন। আর অনেক সাবধানে রাখতে হবে। কিছু ঔষধ দিচ্ছি, সেগুলো নিয়মিত খেতে হবে। ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিলে কিন্তু পরে সমস্যা হতে পারে।

আদনান মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। মহুয়ার কেবিনের সামনে এসে তার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,
– ” আপনি শুধু বেঁচে থাকুন মহুয়া, আমার আর কিছু চাই না!”

প্রায় তিন ঘন্টা পর ডাক্তার মহুয়ার কেবিনে ঢোকার অনুৃমতি দেন। আদনান ছাড়া অন্য কেউ তখন হাসপাতালে নেই। রাত বেড়ে যাওয়ায় আদনান সবাইকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। শিল্পী খাতুন থাকতে চাইলে তাকেও পাঠিয়ে দেয় আদনান। নিজের শরীরটাও একটু দুর্বল লাগছে। সেই দুপুরের পর থেকে না খাওয়া, মহুয়ার অসুস্থতায় তার গলা দিয়ে এক ফোঁটা পানিও নামে নি।
ডাক্তারের পারমিশন পেয়ে ধীর পায়ে মহুয়ার কেবিনে এগিয়ে গেলো। চারপাশে বিকট যন্ত্রপাতির শব্দ। মহুয়ার পেট,হাত,মাথা,পা ব্যান্ডেজ করা। মাথায় ব্যান্ডেজের উপর দিয়েও রক্ত লেগে আছে। মহুয়ার মুখটা পুরো মলিন হয়ে আছে। ঠোঁটগুলো শুকনো। মহুয়াকে এমন অবস্হায় দেখতে পারছে না আদনান। মেয়েটার এখন হাসিমুখে থাকার কথা ছিল। অথচ নিয়তির খেলায় এখন হসপিটালের বিছানায়।
মহুয়ার মাথার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো আদনান। মহুয়া মুখে আঙুল ছুঁয়িয়ে দিলো। মুখটা পুরো ঠান্ডা হয়ে আছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি খসে পড়লো। মহুয়ার হাতে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
– “এই আদনান রহমান-ও শেষ পর্যন্ত আপনার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে মহুয়া। সবার সাথে তাকেও আপনি নিজের মায়ায় বেঁধে ফেলতে সক্ষম হলেন। কনগ্রেচুলেশন আপনাকে!”

চলবে,
বিঃদ্রঃ আমার ফোন নেই, ট্যাবে টাইপ করি। ভাঙা হাত নিয়ে ট্যাবে টাইপ করা অতি দুঃসাধ্য কাজ। তাই দিতে দেড়ি হয়েছে। আমি ক্ষমাপ্রার্থী আপনাদের কাছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here