#প্রেমাসুখ
#পর্ব_১২+১৩ (প্রেয়সীর হৃৎপিণ্ড অসুস্থ)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“আপনি হয়ত ভুলে আমাকে মেসেজ করেছেন।”
সাঁঝের করা এই মেসেজটি দেখে হৃদ হাসল। ওষ্ঠের কার্নিশ সামান্য বাঁকিয়ে কিছু ভাবল। এই তো! এই তো সেই সন্ধ্যেতেই তো সাঁঝকে দেখল! সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলল। এই দুটো বছর মস্তিষ্কে কেবল যার বিচরণ ছিল, সে হঠাৎ সামনে চলে এলে না চিনে থাকবেই বা কী করে? চিনেছিল। সেই ধাক্কাটা যেই সেই ধাক্কা ছিল না, মনের দরজায় অসুখের সজোরে করা একটা করাঘাত ছিল। শুধু খানিকটা সময়ের জন্য বুদ্ধি লোপ পেয়ে বসেছিল। তার উপর সাঁঝের ওমন ঝগড়াটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। এটুকুই।
সেদিন সাঁঝের ঝগড়া মেশানো প্রতিটি বাক্য হৃদের কানে প্রেম কাব্যের মতো বেজেছিল। যখন কথার ছলে সাঁঝ নিজের নামটা বলল, তার অগোচরে হৃদের ঠোঁটের কার্নিশে হাসির রেখা বেড়েছিল; খুবই সামান্য। মনে মনে নিজের মনকে বলেছিল,“হায়! এই লঙ্কাবতীর নাম সাঁঝ! মানে সন্ধ্যা! আমার সন্ধ্যাবতী!”
ভাবনা ফুরোল। ডাক্তার হওয়ার দরুন তার নিকট দুটো ফোন ছিল। একটা প্রফেশনাল কাজে ব্যবহার করত আর অন্যটা পার্সোনাল।
হাসি কমিয়ে সাঁঝের মেসেজের রিপ্লাই দিল,“মানুষ জীবনভর সুখ খুঁজে বেড়ায়, খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যায় অসুখের যাঁতাকলে। মা বলতেন, আমি ব্যতিক্রম; সকলের চেয়ে ব্যতিক্রম! তাই তো আমি ভিন্নধর্মী পথ বেছে নিলাম। জীবনের বেশ কিছুটা সময় এই অসুখের পিছে ব্যয় করলাম। অবশেষে! পেয়েও গেলাম। নিজের এত সাধনার অসুখকে চিনতে ভুল করব? মোটেও না।”
ফোন টিপছিল সাঁঝ। অপরিচিত নম্বরটা থেকে মেসেজ পেল তখনই। না চাইতেও নোটিফিকেশন থেকেই দেখে ফেলল। সুখ-অসুখের বোঝাটা সাঁঝের মস্তিষ্ককে বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছিল। অনেক অনেক প্রশ্ন তার মনে, যেখানে উত্তরের কোঠায় রয়েছে এক বিশালাকৃতির শূন্য। বরাবরের মতোই অজস্র প্রশ্ন মিশ্রিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সাঁঝ।
মেসেজের রিপ্লাই দিল,“আমি সত্যিই আপনাকে চিনতে পারছি না।”
হৃদের হাতেই ফোনটা ছিল। দেখতে পেয়ে মুচকি হাসল, টেবিলের উপর রেখে দিল ফোনটা।
খানিকটা নেশালো কণ্ঠে বলল,“আমি তোমার কাছে মহামূল্যবান কিছু একটা হতে চাই, যার সান্নিধ্য পেতে তুমি অপেক্ষা করো! অস্থির হও! নিজ থেকে বারবার মেসেজ দাও। সহজলভ্য জিনিসের কদর কম তো! প্রিয় সন্ধ্যাবতী, আমি তোমার ছটফটানো দেখতে চাই।”
___________________
কিছু প্রয়োজনে অদিতি শহরে এসেছে। প্রয়োজনটা অবশ্য কিছু কেনাকাটা। টাঙ্গাইলের ক্যাপসুল মার্কেটের পাশেই একটা ফুচকার স্টলের সামনে দাঁড়াল। এখানকার ফুচকাটা অকারণেই তার ভীষণ ভালো লাগে।
উৎসাহিত কদমে এগিয়ে যায় সেই স্টলে।মুচকি হেসে বলল,“মামা ঝাল বেশি দিয়ে এক প্লেট ফুচকা বানাও তো,জলদি।”
ফুচকার দোকানী অদিতির দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পেরে হাসল। লালচে দাঁত বের করে বলল, “বানাইতাছি।”
অদিতি আরও কিছুটা হেসেই পাশের এক দোকানটাতে চলে গেল, কিছু কিনবে না এভেবেই। কেননা ফুচকার দোকানীর সিরিয়ালে আরও অনেক কাস্টমার আছে।
পাশ্ববর্তী দোকানে পা বাড়াতেই দোকানী সৌজন্য মূলক হেসে বলল,“কী লাগবে আপা?”
অদিতি বাহ্যিক ভাবে বড্ড গম্ভীর দৃষ্টিতে দোকানের প্রতিটা পণ্যে নজর বুলিয়ে নিল।
অনেক্ষণ বাদে কাস্টমারের দেখা পাওয়ায় দোকানীর চেহারায় একটি খুশির ঝলক দেখা গেল। সেই সাথে তার চালু মস্তিস্ক ভেবে নিল, একটা পণ্য কিনতে ঢুকেছে তো কী? অনেকগুলো বিক্রি করেই ছাড়বে। বাঁকা হেসে পুনরায় অদিতিকে বলল,“আপা!”
অদিতি তার দিকে তাকাল। জুতার দোকান হওয়ায় এটা ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যাবে না। ওপাশ থেকে কালো রঙের একটা ফ্ল্যাট জুতা নামিয়ে পায়ে পরে নিল।সঙ্গে সঙ্গে দোকানী বলে উঠল,“আরে আপা! কী যে লাগতেছে না! উফফ!”
অদিতি জোরপূর্বক হেসে এটা খুলে অন্য জুতা তুলে নিল। পরার আগেই দোকানী বলল,“আপা! এটা আরও সুন্দর। চমৎকার লাগতেছে কিন্তু আপনার পায়ে! এটা নেন। বলি কী, দুইটাই নেন।”
এভাবে আরও কয়েকটা দেখার পর দোকানের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল ফুচকার দোকানে ভীড় নেই। এর মানে, যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। জলদি জলদি সব মেটাতে হবে।
অদিতি খানিকটা হাসল। কলেজ লাইফের কথা মনে পড়ে গিয়েছে তার। সাঁঝ আর সে প্রায়শই কোনো দোকানে ঢুকে সময় অপচয় করে চলে আসত। আর আসার আগে দোকানীর সাথে ছোটো-খাটো একটা প্র্যাংক হয়ে যেত।
হাসি থামিয়ে দোকানীকে তার হাতের জুতাজোড়ার দাম জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, এটার প্রাইস কত?”
দোকানী তার চিরচেনা ও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কথাটি বলল,“জি আপা, এটার প্রাইস একদাম ২১০০ টাকা। শুধু আপনার জন্য ১৭০০।”
কথাটি শুনে অদিতির হাসি পেল। কিন্তু হাসি দমিয়ে বলল,“কী বলেন?এত কেন?৭০০ তে দিবেন?”
মূলত ইচ্ছে করেই বলেছে। সে তো কিনবে না। তাই ইচ্ছে করেই এত কমিয়ে বলল। দোকানী ব্যাথিত কন্ঠে বলল,“আপা লস হয়া যায়। আচ্ছা, ১৪০০ তে নেন।”
“না ভাইয়া,৭০০ হলে বলেন।”
“আপা, আরেকটু বাড়ান, ১০০০ এই দিয়ে দিব, লস হয়া যাইব তাও।”
অদিতি জুতাজোড়া রেখে বলল,“ভাইয়া, তাহলে আসি।”
সে জলদি কেটে পড়তে চেয়েছিল। যেই হারে দামের অর্ধগতি হচ্ছে! কখন না আবার বলে দেয়, আপা নিয়ে যান।
হুট করেই যেন মনে হলো, নিজের মনের কথাটা শ্রবণ করেছে।
দোকানের বাইরে চলে এসেছে।আবারও শুনতে পেল,“আপা ৭০০ ই দিয়েন।নিয়া যান।”
অদিতি পিছু মুড়ল না। যেতে যেতেই জিহ্বাতে কামড় দিয়ে বলল,“নেক্সট টাইম থেকে আরও কমিয়ে বলতে হবে।”
ফুচকার স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এক প্লেট বানানো ফুচকা অদিতির হাতে তুলে দিল। তখনই সাঁঝের কল এলো। রিসিভ করে বলল,“কী খবর?”
“ভালো। তোর?”
“ভালোই।”
“এতো শব্দ কেন? কই তুই?”
অদিতি ফুচকা মুখে তুলে চিবাতে চিবাতে বলল,“ক্যাপস্যুলের সামনে।”
সাঁঝ চিৎকার দিয়ে বলল,“কীঃ!আর তুই ফুচকা খাচ্ছিস?”
“হু।”
“আমাকে রেখে?”
“হু।”
“পারলি কেমনে বইন?”
অদিতি ফুচকা আরও একটা মুখে পুরে বলল,“আহ! দারুণ! দারুণ!”
এরপর হেসে দিল। বিল মিটিয়ে আবারও সাঁঝকে বলল,“এবার বল।”
“কী?”
“তোর ভার্চুয়াল সংসার কেমন চলে?”
“যেমন তেমন।”
“ক্যান?”
“অনয় সাহেব দ্যা ভার্চুয়্যাল জামাই মেসেজ সিন করে না।”
অদিতি হেসে দিল এটা শুনে। এরপর বলল,“ভার্চুয়্যালেই তোর সংসার টিকল না। বাস্তব জীবনে তো আরও টিকবে না রে!”
“মজা নিস না।”
“আহারে!”
“আমার জন্য?”
“না, তোর জামাইয়ের জন্য।”
“চুপ!”
অদিতি আরও জোরে হেসে দিল। এরপর বলল,“আচ্ছা শোন!”
“ বল, শুনছি।”
“কিছু না। কী করছিস?”
“বল বলছি।”
“ইয়ে মানে, তোর ভাইয়ের কী খবর?”
সাঁঝ ছোটো করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ভালোই আছে।”
“ওও আচ্ছা!”
সাঁঝ প্রসঙ্গ এড়াতে বলে উঠল,“আসবি কবে?”
“মঙ্গলবারই আসব।”
“আঙ্কেল আসবে না কি আন্টি?”
“কেউ আসবে না রে। আব্বু একটু ব্যাস্ত।”
সাঁঝ একটু ভাবল। কিছু মনে পড়তেই বলল,“আচ্ছা, সোমবার আয়।”
“কেন?”
“ভাইয়া আসবে। ওর সাথেই আয়।”
অদিতি কোনো আওয়াজ করতে পারল না। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।মানুষ অতি শোকে পাগল হয়। কিন্তু অদিতি অতি উল্লাসে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
সাঁঝ অদিতির সাড়া না পেয়ে বলল,“হ্যালো,অদি!আছিস?”
খুশিতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,“হ..হ্যাঁ! আ..ছি আছি।”
সাঁঝ বুঝল এই পাগল মেয়েটির কাণ্ড। এক হাতে ফোন কানে নেওয়া, অপর হাত কপালে চালিয়ে বলল,“বাড়ি গিয়ে খুশি হ বইন। এখন রাস্তা সাবধানে যা।”
অদিতির বিস্মিত মুখশ্রীতে লম্বা হাসির চিহ্ন পাওয়া গেল। অনেক সাধনার কোন কিছু নিজের করে না পেলেও, নিজের সাথে কয়েক মুহূর্ত রাখতে পারার প্রশান্তিই অন্যরকম। তার শব্দগুলো এখন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
সাঁঝ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“আচ্ছা রাখি। বাড়ি গিয়ে কল দিস।”
অদিতি এখন কথা বলল, পরম আনন্দের সাথে বলল,“আচ্ছা।”
কল কেটে ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। সামনে থেকে একটা রিকশা ডাক দিল,“মামা যাবেন?”
রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসতেই অদিতি উঠে পড়ল। তাড়া দিয়ে বলল,“চলুন।”
রিকশা চলতে শুরু করার আগেই রিকশায় কারো বসার অস্তিত্ব পেল এবং সে ওপাশে চেপে বসল। অদিতি বুঝতে পারল না, এটা কে?
পাশ থেকে একটা ভরাট কন্ঠ বলে উঠল,“এবার চলেন মামা।”
————————-
উপমার বারান্দায় একটা দোলনা রয়েছে। বারান্দার এপাশে কোন বিল্ডিং নেই দেখে ভালোই আলো-বাতাস আসা-যাওয়া করে। সাঁঝ এখানে বসেই দোল খাচ্ছে। উপমা তার একটা ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছে। সাঁঝকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আজকে তার মন ভালো না একটুও, এজন্য যায়নি। এত কৌতুহল নিয়ে কার মন ঠিক-ঠাক থাকে?
বড়ো অস্থির! চিন্তা-চেতনা চলছে বড়োই দ্রুত গতিতে। ইশ সাঁঝ! আর পারল না।দোলনা থাকে উঠে দাঁড়াল। বারান্দার এপাশ থেকে ওপাশ দুইবার পাইচারি করে রুমের ভেতরেই চলে গেল। বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, কোন রিপ্লাই আসেনি। সকাল থেকে এ পর্যন্ত যে কয়বার ফোন চেক করল!
এবার আর অপেক্ষা করতে পারল না। বড্ড অস্থির চিত্তে চলল তার হাত। এভাবে কেউ মেসেজ টাইপ করে? বানান ভুল হচ্ছে বারবার। শান্ত হতেই পারছে না। পরপর দু’বার দু’টো বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলল।
খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,“ধুর! এত এক্সাইটেড তো এক্সের প্রপোজালেও ছিলাম না।”
এরপর মেসেজে লিখল,“আপনার পরিচয়টা দিন প্লিজ। কে আপনি?”
চেম্বারে বসে রোগী দেখছিল হৃদ। নিজের ফোনে মেসেজ আসতে দেখেই বাঁকা হাসল।
পেশেন্ট যেতেই রিপ্লাই দিল,“তুমিময় অসুখে আক্রান্ত এক রোগী আমি।”
“অসুখ!”
“হুম। প্রেমাসূখ। বাইরে থেকে সুখ সুখ লাগছে। কিন্তু ভেতরটা ঝেঁকে দ্যাখো, অসুখ করেছে। প্রেম ও অসুখের সন্ধি হয়েছে। আর প্রেমময়ী এই অসুখে আক্রান্ত আমি, বড্ড গভীর ভাবে।”
সাঁঝ থমকে গেল। কাঁপা কাঁপা হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল বিছানায়। সে নিজেও বসে পড়ল।তার মস্তিষ্কে এখন একটা প্রশ্ন,‘প্রেম ও অসুখের সন্ধি হয় কী করে!’
______________________
অদিতি চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,“তুমি? তুমি এখানে কী করছ? আর আমার পাশে এসে বসলেই বা কেন?”
শুভ মিটমিটিয়ে হাসছে। রিকশাকে থেমে থাকতে দেখে বলল,“মামা, চলেন তো।”
এরপর পাশ ফিরে হতবাক হয়ে বসে থাকা অদিতির দিকে তাকাল। ওষ্ঠদ্বয় অধিকতর প্রসারিত করে বলল,“আসতে পারি না?”
অদিতির কড়া জবাব,“না, একদম না।”
শুভর বুকটা দুমড়ে উঠল। তবুও ঠোঁট থেকে হাসি সরাল না। এক মুহূর্তের জন্য অবশ্য এই হাসি কমে গিয়েছিল।
অদিতির কথার পরিপ্রেক্ষিতে শুভ বলল,“এজন্যই এসেছি।”
অদিতি তপ্ত শ্বাস ফেলে রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“মামা, রিকশা থামান।”
“না, প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন।”
শুভ তৎক্ষনাৎ এটা বলল। অদিতি আরও জোরে থামতে বলতেই, রিকশা থেমে যায়। রিকশাওয়ালা পেছনে তাকাল। শুভ বলল,“ম্যাম একটু রেগে আছে মামা।”
রিকশাওয়ালা দাঁত কেলিয়ে বলল,“গোছা করবেন না আম্মা। এইডা ভালা না। কামের কাম তো করেই না, উলটা নষ্ট কইরা দেয় সব।”
কথাটা বলেই আবারও সামনে ঘুরে রিকশা চালানোতে মন দিল। কিন্তু কথা বলেই যাচ্ছে।
“বুঝলেন আম্মা! আফনেরে আমগো কিছু কাহিনি কই। আমাগোর দাদা হেই কালে জমিদার আছিল। একদিন আমাগোর দাদিবুবুর ওপরে গোছা কইরা ব্যাক জমি হ্যার ভাইয়ের নামেত্তে লিখা দিছিল।”
রিক্সাওয়ালার এটুকু কথা শুনে শুভ ধীর কণ্ঠে বলল,“পুরুষ মানুষের ধ্বংসের মূল কারণ এই নারী;হয় প্রতক্ষ্যভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে।”
অদিতি চোখ রাঙাল। তা দেখে শুভ মিটমিটিয়ে হাসল।
রিকশাওয়ালা আরও কিছু কথা বলে গেল যা শ্রবণ ইন্দ্রীয় পর্যন্ত পৌঁছাল না কারো।অদিতি আবারও রিকশা থামাতে গেলেই শুভ তার হাত ধরে ফেলল। বিস্মিত-রাগান্বিত অদিতি শুভর এহেন কাণ্ডে মিইয়ে গেল।
শুভ বড়ো কাতুরে কণ্ঠে বলল,“সিনক্রিয়েট কোরো না,শান্তি দাও!তুমি আমার এজীবনের প্রাপ্তি হলে না। ক্ষণিক সময়ের তৃপ্তি হয়ে যাও!’’
অদিতি শীতল চাহনিতে তাকাল।শুভ মাথা চুলকে বলে উঠল, “ইশ!এভাবে যদি সেদিনও আমার কথা মানতে আমাকে মেনে নিতে!’’
অদিতি দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
চলন্ত রিকশায় এই শহরের গলিতে হয়ত শেষ বারের মতো না হওয়া প্রেমিকার সাথে ঘুরছে শুভ। অদিতি এই গতিশীল প্রকৃতির দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। সেদিকে তাকিয়েই শুভকে প্রশ্ন করল,“এভাবে পিছু নিচ্ছ কেন? কী চাই?”
’’তোমাকে চাই!’’
অদিতি ফট করে শুভর দিকে তাকাল। পর্যবেক্ষণ করল শুভর নয়নজোড়া।গভীর, থমথমে, নিশ্চল। সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ল ঐ দু’চোখের অসহায়ত্ব।
অদিতিকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে শুভ গম্ভীর মুখে হাসল। অদ্ভুত দেখাল খুব। অদিতির চোখে নিজের চাহনি স্থির রেখে বলল,“দিলে না তো!’’
হুড খোলা রিকশায় ওই দূর নিলচে আকাশে এদিক-সেদিন চোখ বুলিয়ে নিল।
ছোটো ছোটো কয়েকটা শ্বাস ফেলে বলল,“আফসোস!পেলাম না তোমাকে!’’
__________________________
ঘড়িতে এখন নয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট। নিস্তব্ধ ছাদে একাকী দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ।প্রকৃতিতে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব; অথচ সেই কখন থেকে অস্থিরতা ছেঁয়ে আছে।বর্ষণের নাম নেই! সাঁঝ একমাত্র কেউ যে এই অবেলায় বর্ষণের অপেক্ষায় আছে।সেই খবর কি ওই মেঘগুচ্ছ রেখেছে!
প্রচন্ড বাতাসে খোলা চুলগুলো নেচে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। না চাইতেও ভাবনাতে সেই মেসেজগুলো বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। দমকা হাওয়ার সাথে একগুচ্ছ শব্দ সাঁঝের কানে বেজে উঠল,“সন্ধ্যাবতী!’’
সাঁঝের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ছেঁয়ে গেল আরও একটি শব্দ,“অসুখ!’’
সাঁঝের হাত-পা অসাড় হয়ে এলো। প্রকৃতির অশান্ত ভাবটা এখন সাঁঝের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে চলমান। দু’টো কথাই বড্ড শ্রুতিমধুর ঠেকল।
সাঁঝকে আরও বেশি অস্থির বানিয়ে দিল আরেকটা কথা,“সন্ধ্যাবতী! তুমি আমার ব্যক্তিগত অসুখ!’’
ইশ! কী নেশালো আওয়াজ! কারো আওয়াজেও বুঝি এতটা প্রেম থাকে!
সাঁঝ নিজের ডান হাতটা বুকের বা পাশে রাখল, অবশ ঠোঁট অনেক কষ্টে নাড়িয়ে উচ্চারণ করল,“ইশ! হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেল কেন!”
সেই সাথে অনুভব করল একটা মিষ্টি সুঘ্রাণ। হুট করেই বুঝতে পারল এই ঘ্রাণ তার খুব চেনা! দু’চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টানল। মুহূর্তেই বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। হালকা করে মিষ্টি হাসল সাঁঝ।
মনে মনে ভাবল,“সে যদি আরেকটু হালকা হতো নিশ্চয়ই এই বাতাসের সাথে উড়ে যেত!’’
বাতাসের বেগের সাথে সাথে আগমন ঘটল বর্ষণের। দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি তার মুখে মাখল। দু’হাত ছড়িয়ে খুব ধীর গতিতে ঘুরতে লাগল। বন্ধ চক্ষুজোড়া খুলতেই দরজার পাশে হৃদকে দেখেই কপাল কুঁচকে ফেলল।অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হৃদ বলল,“তাই-তো বলি বাতাসের আজ এত তেজ কেন! এমন রগচটা-মেজাজী মেয়ে মানুষ যেখানে থাকবে সেখানকার আবহাওয়া শান্ত থাকবেই বা কী করে! প্রকৃতি অস্থির থাকবে শুধু থেমে যাবে কারো…..”
মুহূর্তেই সাঁঝ চিৎকার করে বলে উঠল,“খাটাশ হৃৎপিণ্ড।”
“হ্যাঁ,হ্যাঁ, হৃৎপিণ্ড। তবে খাটাশ নই।”
হৃদের কথা শুনে সাঁঝের মেজাজ আরও বিগড়ে গেল সঙ্গে বাড়ল বৃষ্টির ফোঁটার তেজ!
সাঁঝ রাগে জোরে জোরে বলল,“আমি আপনাকেই বলেছি!”
বৃষ্টি ও হাওয়ার তেজের জন্য এত জোরে কথাও আস্তে শোনাচ্ছে।
হৃদ আরও আস্তে বলল,“হ্যাঁ তোমার হৃৎপিণ্ড।”
কিন্তু সেটা আর সাঁঝের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল না। সাঁঝ জোরে বলল,“কী?’’
“আপনি।”
“আমি কী?”
“রগচটা-মেজাজী মেয়ে মানুষ!”
হৃদের এই বাক্যের প্রতিটি শব্দ সাঁঝের কাছে অপমানজনক মনে হলো। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে যাওয়ার কারণে দু’জনেই ভিঝে একাকার হয়ে গেল।
সাঁঝের সামনের চুলগুলো কপালে লেপ্টে গিয়েছে। বৃষ্টির পানি কপাল বেয়ে নাকের উপর দিয়ে পড়ছে। এই জন্য ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না। মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। আর থেমে থেমে বলছে, ‘’আপনি.. আমার সাথে.. ঝগড়া.. করতে এসেছেন? সেই মুডে নেই আমি।”
হঠাৎ-ই বজ্রপাতের আলোতে সাঁঝ হৃদের ভাব-ভঙ্গি দেখতে পেল। সাদা শার্টটি ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। হাতা কনুই অবধি গোটানো, চুলগুলো কপালের সাথে লেপ্টে আছে। ফর্সা মুখশ্রী এই বৃষ্টির শীতল স্পর্শে গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। ওষ্ঠদ্বয় লালচে হয়ে আছে। সাঁঝের জায়গায় অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই বড়ো-সড়ো ক্রাশ নামক বাঁশ খেয়ে ফেলত। সাঁঝ অনিমেষ তাকিয়ে আছে ভিজে চিপচিপে হওয়া হৃদের নেত্র পানে। কথা বলতে পারছে না। উঁহু, পারছে না বললে ভুল হবে, চাইছে না।
হৃদ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। কী স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তার সন্ধ্যাবতীকে!
হৃদ সাঁঝের পাতলা অধরযুগলের দিকে তাকাল। ঠান্ডায় কাঁপছে। হৃদ শুকনো ঢোক গিলল। দৃষ্টি সরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। সাঁঝ হৃদের দিকে দু’কদম এগিয়ে এলো। মাঝে দূরত্ব খুবই কম। হৃদ যেন শ্বাস নিতেই ভুলে গিয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সাঁঝ হৃদকে ক্রস করে ছাদের দরজার দিকে এগোনোর জন্য পা বাড়াল। তার আগে সাঁঝ আড়চোখে হৃদকে দেখে নিল। চাহনি বড়ো গভীর! পাশাপাশি দু’জন দু’দিকে মুখ করে দাঁড়াল।
সাঁঝ হৃদকে উদ্দেশ্য করে, অনেক হালকা আওয়াজে বলল, “এভাবে কোনো মেয়ের সামনে আসবেন না, ডাক্তার সাহেব। সেই মেয়ের শ্বাস নিতে সমস্যা হয়ে যাবে।”
হৃদ চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকাল সাঁঝের দিকে। চোখে চোখ রইল সেকেন্ডে দুয়েক। তৎক্ষনাৎ সাঁঝ প্রস্থান করল।
চলবে…
[দুঃখিত! আমার আগের গল্পের পাঠকরা জানেন, আমি কেমন নিয়মিত। কিন্তু সমস্যা তো বলে কয়ে আসে না!]