প্রেমাসুখ #পর্ব_২৮ (তোমাকেই চাই) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
321

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_২৮ (তোমাকেই চাই)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

স্নিগ্ধ, শীতল, থমথমে এই পরিবেশে এক প্রেমিকযুগলের অস্থিরতা দৃশ্যায়ন হচ্ছে খুবই গভীর ভাবে। হৃদ ছাদের দরজা থেকে একটু এগিয়ে এসে, মাঝ বরাবর দাঁড়াল। সাঁঝ তো রেলিং ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। জোরে জোরে শ্বাস টানছে।

হৃদ দূরের কোনো এক ল্যাম্পপোস্টের আলোতে লক্ষ করল, তার সামনের এই শ্যামমোহিনী নারীটির গায়ে কালো রঙের শাড়ি। চুলগুলো বাতাসে ঢেউ খাচ্ছে। আরো গভীর ভাবে লক্ষ করল, সাঁঝ তার হাতদুটো শক্ত করে মুঠোবন্দী করে রেখেছে। বড্ড অশান্ত সে। যার দরুন সমগ্র শরীর ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। হাতের কাঁচের চুড়িগুলো একটার সাথে আরেকটা বেজে মোহময়ী শব্দ তৈরি করছে। হৃদ চমৎকার ভাবে হেসে উঠল। সেই হাসির শব্দ তীরের ন্যায় গিয়ে গাঁথল সাঁঝের হৃদয়ে।

সাঁঝ আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে পারল না। ছুঁটে চলে গেল ছাদের বাইরে। হৃদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাঁঝের যাওয়া দেখল। নেশালো আওয়াজে বলে উঠল, “তুমি আমায় কী বানিয়ে দিলে! তোমাকে পাওয়ার লোভ আমার অন্তর আত্মাকে কাঁপিয়ে তুলছে। এই পাওয়াটা কিন্তু তোমার হৃদয়।”

বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। ব্যাপারটা দারুণ। হৃদের কাছে মনে হচ্ছে, সে তার জীবনের সবটা পেয়ে গেল। তার আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। শুধু সাঁঝ হলেই হবে। সে ঠিক করে নিল, বিয়েটা জলদিই করে ফেলবে।

___________________
নিজের বাড়িতে অদিতিকে দেখতে পেয়ে শুভ ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। কল্পনাতেও আশা করেনি, অদিতি তার বাড়িতে আসবে। পরপর দু’বার নিজের হাতে চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো, এটা সত্যি। এতে যেন তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। কীভাবে কী!

শুভকে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাহানা বেগম বলে উঠল, “বিয়ে করেছিস আমাদের না বলে?”

শুভ বিষম খেল। কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। অদিতি শুভকে এই অবস্থায় দ্বিতীয়বার দেখার জন্য তার দিকে তাকায়নি। চোখ সরিয়েই রেখেছে। শুভ জলদি গিয়ে একটা টিশার্ট পরে এলো।
মাকে জিজ্ঞেস করল, “কী হচ্ছে এখানে?”

শাহানা বেগম থমথমে গলায় বলল, “তোকে তো বার বার বলছি বিয়ে করতে। আমরা কি জানতাম? তুই বাইরে বউ রেখে এসেছিস।”

“মানে?”

শাহানা বেগম অদিতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এটা তোর বউ না?”

শুভ আরেক দফায় বিষম খেল। অদিতি মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। এসব তার কাছে ভালোই লাগছে। সে ভেবে এসেছে, শুভকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। যেই কষ্ট সে পাচ্ছে, সেই কষ্ট যেন শুভ না পায়, সেজন্যই সুযোগ দেবে। শুনেছে, দ্বিতীয়বারও ভালোবাসা যায় না। সে প্রমাণ করবে, দ্বিতীয়বারও কারো প্রেমে গভীরভাবে তলিয়ে যাওয়া যায়। তার কষ্টে যার বিন্দুমাত্র বুক কাঁপেনি, তাকে দেখিয়ে দিতে চায়, সেও দিব্যি আছে।

শুভ অদিতিকে হাসতে দেখে কিছুই বুঝল না। তবে শাহানা বেগমকে বলল, “এখনও বিয়ে করিনি, আম্মু। কিন্তু তোমার বউমা যদি রাজি হয়, তবে আমিও আলহামদুলিল্লাহ।”

শাহানা বেগম বুঝল, অদিতি তার ছেলের প্রেমিকা। এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ফেলে অদিতিকে বসতে বলে রান্না ঘরে চলে গেল, চা বানানোর উদ্দেশ্যে।
অদিতি বসল। পাশেই বসল শুভ। অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে অদিতির দিকে।

অদিতি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “আমার ফেইসে কিছু লেগে আছে?”

শুভ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “না তো!”

“তবে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

“তুমি অদিতিই তো?”

“তোমার কী মনে হচ্ছে?”

“মনে হচ্ছে তুমি অন্য কেউ।”

অদিতি মুখের সামনে হাত রেখে হেসে উঠল। অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসল। শুভ তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবল, ‘এই হাসির জন্য মরতে রাজি।’

শুভ কিছুক্ষণ বাদে জিজ্ঞেস করল, “আমার না সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।”

অদিতি হাসি থামিয়ে বলল, “বিগত মাসগুলো আমি বড্ড অশান্তিতে ছিলাম। আমি তো ক’মাসই সহ্য করতে পারছি না, তুমি কী করে এতগুলো বছর সহ্য করলে? তোমার জন্য বুকটা কেঁপে উঠল। তাই ভাবলাম, একটা সুযোগ চেয়েছিলে তুমি; দেওয়াই যায়।”

“সত্যি দেবে?”

“হু, তবে একটা শর্ত আছে।”

“কী শর্ত?”

“আমাকে পেতে হলে তোমায় আমার হয়েই থাকতে হবে। পরনারীর ছায়াও যদি মাড়াও, তবে সেই মুহূর্তে তুমি আমায় হারাবে, চিরতরে।”

শুভ মুচকি হেসে বলল, “যে পুরুষ একনারীতে সন্তুষ্ট, সে অন্য নারীতে সুখ খুঁজতে যাবে না কোনোকালেই।”

এতে অদিতিও হেসে উঠল। তার মনের কষ্ট খানিকটা লাঘব হলো। না পেল সে তাকে, যাকে কৈশোরে ভালোবেসে এ জীবন তার তরেই করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে তো পেয়েছে এমন একজনকে, যে তাকে ভালোবেসে পৃথিবীর ধরাবাঁধা সব নিয়মকে তুচ্ছ করে, সে নিতে না চাওয়া সত্ত্বেও কেবল তারই হয়েছিল।

______________
রাতে ঘুমনোর আগ মুহূর্তে সাঁঝের ফোনে কল এলো। ভাইব্রেট মুডে থাকায় বালিশের নিচে থেকে ফোন কেঁপে উঠল। রুমে কেউ নেই। ইদানিং একাই ঘুমোয় সাঁঝ। উপমা গেস্ট রুমে থাকে প্রতি রাতেই। অর্ণবের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলতে গিয়ে সাঁঝের ঘুমে সমস্যা হতে পারে বিধায়ই সে আলাদা থাকে। এতে অবশ্য সাঁঝেরও সুবিধে।
বালিশের নিচে থেকে ফোন বের করল। স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে ‘অসুখ’ নামটা। সাঁঝের অধর কোণে এক চিলতে হাসির রেখার দেখা মিলল। এই নামের সব রহস্য তার সামনে আজ। উফফ! কী যে ভালো লাগছে! তার হৃদয়হরণকারী ব্যক্তিত্ব সব এর মধ্যেই আছে। ভার্চুয়াল জামাই! যে তার হাসির কারণ হয়েছিল। অসুখ! যে তার অসুস্থ হওয়ার কারণ হয়েছিল। আর ডাক্তার সাহেব! জলজ্যান্ত এক অসুখ সে নিজেই।

কল রিসিভ করে কানে তুলল। ওপাশে হৃদ শুয়ে আছে। ঘুম নেই চোখে। ঘড়িতে বাজে একটা, কিন্তু ঘুমনোর নাম নেই। ব্যস্ত শহরের রাস্তা থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দটা উচ্চস্বরে বেজে উঠছে। দু’পাশ থেকে উভয়েরই কেবল শ্বাস-প্রশ্বাস শোনা যাচ্ছে।

হৃদ হাসল। সাঁঝ অনুভব করে চোখ বুজে ফেলল, আরও গভীর ভাবে অনুভব করার জন্য। হৃদ মিষ্টি কন্ঠে বলল, “মেয়ে! তুমি কি আমায় বোঝো?”

সাঁঝের বন্ধরত চোখের পাতা থরথর করে কাঁপছে। বলতে ইচ্ছে হলো, ‘বুঝি তো, ডাক্তার সাহেব। ভীষণ ভাবে বুঝি।’
তবে একথা বলতে পারল না। সে শুধু বলল, “জানি না।”

এত লজ্জা লাগছে কেন তার! সাঁঝকে তো হৃদের সন্ধ্যাবতী ডাকা উচিত নয়, লজ্জাবতী ডাকা উচিত।

হৃদ আরও লজ্জা দেওয়ার জন্য বলে উঠল, “বোঝো! আমার চেয়েও ভালোভাবেই বোঝো!”

সাঁঝ কিছু বলল না। দুপাশে খানিকক্ষণ নীরবতার পর হৃদ আবারও বলল, “তোমাকে দেওয়া আমার প্রথম উপহার কী জানো?”

“কী?”

“আমার হৃৎপিণ্ড।”

সাঁঝ মিহি হাসল। হৃদ একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমার আড়াই বছর আগের ভালোবাসা তুমি।”

সাঁঝ চমকে উঠল। বিস্মিত কন্ঠে বলল, “আড়াই বছর!”

“হু।”

“কীভাবে? আপনার সাথে তো আমার কথা হলো কয়েক মাস আগে।”

“তোমার সাথে আমার কথা হয়েছে ক’মাস আগে, তুমি আমাকে দেখেছ সেদিন। কিন্তু আমিতো নিজেকে তোমার নামে লিখে দিয়েছিলাম বর্ষ আগে।”

“আপনি কেন বলেননি আমাকে, যে আপনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন? ভার্চুয়ালে তো সোজা প্রপোজ করে দিলেন, তাও বিয়ের।”

“আগে জানতাম না তুমিই সে। প্রপোজ করেছিলাম ডেয়ার নিয়ে।”

পরে সবটা খুলে বলল। সাঁঝ ধীর কণ্ঠে বলে উঠল, “এক্কেবারে চান্দির কপাল আপনার। না হলে কি আমাকে পেতেন?”

হৃদ হাসল। সত্যিই তো, তার ভাগ্য ভীষণ ভালো। না হলে কীভাবে সাঁঝকে পেয়ে গেল!

আবারও নীরবতা তাদের নামে লিখে দিল বেশ কিছু সময়। হৃদ তার সেই ফিসফিসানো আওয়াজে বলল, “সুখ-সমুদ্রে তলিয়ে আমি নামহীন এক অসুখ বাঁধালাম, প্রেম কিনারায় ভেসে এসে প্রেমাসুখের এই কাহিনি গড়ালাম।”

ওপাশ থেকে সাড়া মিলল না। গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হৃদও আর কল কাটল না। সেভাবেই শুয়ে রইল। কিছু মুহূর্ত বাদে বুকটা শূন্য শূন্য লাগল। মনের মাঝে আফসোসের জন্ম নিল। ইশ! এই বুকে যদি তার সন্ধ্যাবতী ঘুমত! তবে তার এক বীনিদ্র রজনী সাঁঝকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে কাটত।

_________________
সকালে সাঁঝের ঘুম ভাঙল আটটায়। সাঁঝ উঠে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। কাল রাতের কথা মনে করল। হৃদের সাথে কথা বলছিল! তখনই মনে এলো, সাঁঝ তো কল কাটেনি। জলদি ফোন খুঁজল। অনেক খোঁজার পর কম্বলের নিচে পেল। হাতে নিয়ে দেখল হৃদ কল কেটেছে পাঁচটার দিকে। এতক্ষণ লাইনে ছিল সে! আর সাঁঝ কি না ঘুমিয়ে পড়েছিল! বড্ড অনুশোচনা হতে লাগল।

নোটিফিকেশন দেখল, মেসেজ এসেছে, “এমন মধুর রাত্রির জন্য পৃথিবীর সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে রাজি; পুরষ্কার হিসেবে যে আমার কেবল তোমাকেই চাই।”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here