#প্রেমাসুখ
#পর্ব_৩২ (বিয়ের প্রপোজাল)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে সাঁঝের ঘুম ভেঙে গেল। পুরনো সকল ইচ্ছেগুলো আবারও তাকে জাপটে ধরল। ভোরের স্নিগ্ধ রোদে নিজের মহিমান্বিত রূপকে ফুটিয়ে তুলতে, হাঁটতে বের হওয়ার ইচ্ছে তাকে জেঁকে ধরল। প্লাজু ও টিশার্টের উপরে একটা মোটা শাল জড়িয়ে নিল। চুলগুলো উপরে খোপা বাঁধা। ছোটো ছোটো ক’গাছি চুল সেই খোপার বাঁধন থেকে বেরিয়ে মুখের সামনে দোল খাচ্ছে।
সুমিতা বেগম কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠে পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিচ্ছে। উঠোনের এক কোনা থেকে সুমিতা বেগম খেয়াল করল সাঁঝ বাড়ি ছেড়ে বেরোচ্ছে। সুমিতা বেগম ওকে ডাকল না। জানা কথা, মেয়ে এরকম মৌসুমে বের হয়। শীত ও বর্ষণ তাকে ঘুমোতে দেয় না। সুমিতা বেগম আবারও ঝাড়ু দেওয়ায় মনোযোগী হলো।
সাঁঝ আজ কতগুলো মাস বাদে এই শহরের গন্ধ পাচ্ছে! বুকটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। মফস্বল শহর হওয়ার সুবাদে এই ভোরের তীব্র শীত উপলব্ধি করা যাচ্ছে। সাঁঝ শীতে থরথর করে কাঁপছে। তবুও যেন তা ভালো লাগছে। কোনো কৃত্রিমতা নেই। যা আছে, সবটা আপন আপন লাগছে।
সাঁঝ অদিতির বাড়ির রাস্তায় এলো। কতদিন হয়ে গেল, দেখা হয় না! মাঝে মাঝেই কথা হয়। তবে আগেকার অনুভূতি পায় না। মনে হয়, অদিতি প্রাণ খুলে কথা বলছে না।
একটা চাপা শ্বাস বের হলো সাঁঝের বুক চিরে।
অদিতির বাসার সামনে এসেই তার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। এভাবেই তো চলে আসত! অদিতি ছিল ঘুম কাতুরে। এই সময়ে ওকে ওঠানোর জন্য সাঁঝ কী-ই না করত! মিহি হাসল সাঁঝ। অতঃপর ফোন হাতে তুলে কল দিল। কয়েকটা রিং হতেই রিসিভ করল অদিতি। জাগ্রত ছিল সে।
সাঁঝ বলল, “কেমন আছিস?”
অদিতি বিছানা গোছাতে গোছাতে জবাব দিল, “আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি, তুই?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কী করছিস?”
“বিছানা গোছাচ্ছি।”
“ও! এত আগে উঠেছিস? এই শীতে?”
“হুম। আগের সব পছন্দ-অপছন্দ পরিবর্তন করেছি তো! এজন্য।”
সাঁঝ বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করল, “আবার প্রেমে পড়েছিস?”
অদিতি হালকা হেসে বলল, “হুম। কী করিস তুই?”
“দাঁড়িয়ে আছি।”
“দাঁড়িয়ে! কোথায়?”
“তোর বাড়ির সামনে।”
“মানে?”
“কাম ফাস্ট, অদি। এখানে ভীষণ মশা। খেয়ে দিচ্ছে আমায়।”
অদিতি ফোন রেখে দিল। অস্থির চিত্তে দৌড়িয়ে বাইরে চলে এলো। রাস্তার পাশে সাঁঝ দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। অদিতি আবেগী হয়ে জলদি গিয়ে সাঁঝকে জড়িয়ে ধরল।
সাঁঝ অদিতির পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “অনেকদিন পর শান্তি শান্তি লাগছে, অদি বেবি।”
অদিতি কাঁদতে কাঁদতে হাসল। সাঁঝকে ছেড়ে দাঁড়াতেই সাঁঝ বলে উঠল, “ওরে বাবা! আমার ন্যাকারাণী কাঁদছে!”
অদিতি ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, “মার খাবি, সাঁঝ।”
“একটু মার। তবুও ভুল বুঝিস না।”
অদিতি কান্না থামাল। অনেক কষ্টেই কান্না থামাল। জিজ্ঞেস করল, “তোকে ভুল বুঝব কেন?”
“বুঝছিস।”
“না। একদম না।”
“তোকে তোর চেয়ে ভালো বুঝি। মিথ্যে বলিস না।”
অদিতি চুপ রইল। সাঁঝ হালকা হেসে বলল, “ওড়না নিয়ে আয়। হাঁটতে বের হই।”
অদিতি পরনের সোয়েটারের উপর ওড়না জড়াল। হাঁটতে লাগল সাঁঝের সাথে। কিছু মাস আগেও তো হেঁটেছে সাঁঝের সাথে। এই একই রাস্তা ছিল। সময়টাও এমনই ছিল।
বেশ কিছুদূর যেতেই সাঁঝ বলল, “অদি!”
অদিতি বেশ সাবলীল ভাবেই জবাব দিল, “হুম।”
“ভুল বুঝিস না।”
“আরে বাবা! বুঝি না তো।”
“আমি যদি তোকে সেদিন জোর করতাম, তবে তুই অ্যাডমিশন টেস্ট দিতিস। আর হয়েও যেত।”
অদিতি চুপ রইল। সাঁঝ নিজের তালে বলে গেল, “আমি ইচ্ছে করেই জোর করিনি।”
অদিতি সাঁঝের দিকে তাকাল। সাঁঝ বলল, “তুই যেদিন চলে এলি, তার আগের দিন কোচিং-এ উপমার সাথে ভাইয়া গিয়েছিল। হয়তো কোনো মোমেন্টে তুই দেখে ফেলেছিলি, আমি ভুল?”
“না। রিকশাতে দেখে ফেলেছিলাম। তোর ভাইয়ের কাঁধে উপমার মাথা।”
“তুই বুকে খানিকটা যন্ত্রণা অনুভব করেছিলি?”
“খানিকটা না, নিদারুণ যন্ত্রণা।”
“রিকশায়, এই সামান্যতেই এই অবস্থা হয়েছিল! এটা বুঝেও কী করে আমি তোকে সেই শহরে থাকতে বলতাম? যেই শহর প্রতি পদে পদে তোকে যন্ত্রণার সাক্ষাৎ দেবে; এর চেয়েও বেশি।”
অদিতি চুপ রইল। সাঁঝ বলল, “শুভ ভাইয়া কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ না।”
অদিতি মিহি হেসে বলল, “তোর ভাইয়ের প্রতি আমার আর ভালোবাসা নেই। কিছুটা দূর্বলতা আছে। আর আছে অগাধ সম্মান। বাকিটা জীবন ওঁকে সম্মান করেই যাব। আর শুভ! আমি জানি ও ভীষণ ভালো ছেলে। ধীরে ধীরে আমার মনে নিজের জন্য অনূভুতি ও নিজেই তৈরি করে নিচ্ছে। আমি ওকে মেনে নিয়েছি। আমাদের ফ্যামিলিকে ক’দিন আগেই জানালাম। ওর প্রমোশন হওয়ার পরপরই বিয়ে করব।”
সাঁঝ অবাক স্বরে প্রশ্ন, “এত কাহিনি হলো! আর আমি আজ জানলাম! এই তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড! মনে মায়া-দয়া নেই তোমার?”
অদিতি হাসল। সাঁঝ রেগে থাকলে ওকে তুমি সম্বোধন করে। অদিতি বলল, “জানিসই তো…”
“কী?”
“অভিমান ছিল।”
“ওরে আমার অভিমানিনী!”
“এলি কবে?”
“কাল এসেছি।”
“একা?”
“না। উপমাও এসেছে। ”
“সকালে ও এলোনা…”
কথাটা বলেই অদিতি চুপ হয়ে গেল। সাঁঝও কিছু বলল না। দু’জনই এই ব্যাপারে ইতস্তত বোধ করছে।
অদিতি বলল, “ভুলে গেছিলাম, ও বিবাহিতা। স্যরি।”
সাঁঝ মিহি কন্ঠে বলল, “ইট’স ওকে।”
__________________
পোনে আটটা নাগাদ সাঁঝ বাড়ি ফিরল। সুমিতা বেগম রান্না করছে। সাঁঝ রান্না ঘরে ঢুকল। মায়ের হাত থেকে খুন্তিটা নিয়ে রান্না শুরু করল। সুমিতা বেগম মুচকি হাসল। মেয়ে আসলেই বড়ো হয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে উপমা এলো। একটা মেরুন কালার শাড়ি, হাত ভর্তি স্বর্ণের চুড়ি, নাকফুল, মাথায় ঘোমটা। সব মিলিয়ে পাক্কা গিন্নি লাগছে।
সুমিতা বেগম জিজ্ঞেস করল, “এই শীতে শাড়ি পরতে গেলি কেন?”
“বিয়ের পর প্রথম এবাড়িতে এলাম তো! এজন্য ইচ্ছে হচ্ছিল।”
“হ্যাঁ রে! অর্ণব উঠেছে? ”
“না, মামি।”
“মার খাবি, উপমা।”
“কেন? কী করলাম?”
“এখনও মামি ডাকবি? ‘মি’-টা বাদ দে না রে, মা।”
উপমা লাজুক হেসে বলল, “আচ্ছা, মা।”
সুমিতা বেগম প্রসন্ন হাসল। সাঁঝ সুমিতা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল, “বাকিটা আমি আর উপমা করছি। তুমি যাও তো। ”
সুমিতা বেগম মুচকি হেসে প্রস্থান ঘটাল। সাঁঝ ও উপমা গল্প করতে করতে রান্নায় মনোযোগী হলো। সাঁঝ হঠাৎ উপমার ঘোমটার আড়ালের ভেজা চুল দেখে ভ্রু-কু়ঁচকে ফেলল।
উপমাকে জিজ্ঞেস করল, “এই শীতের সকালে গোসল করেছিস কেন? শরীর ঠিক আছে?”
উপমা অদ্ভুত ভঙ্গিতে কেশে উঠল। নিজেকে রান্নার কাজে ব্যাস্ত দেখানোতে লেগে পড়ল।
সাঁজ আবারও জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? ঠিক আছিস তুই?’”
উপমা সাঁজের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছি। কিছু হয়নি।”
“তুই তো সকালে গোসল করার মতো মেয়ে না।”
উপমা কড়া চোখে তাকাল। অবুঝ সাঁজ বুঝল। ব্যাপারটা দেরিতে হলেও বুঝল। বোঝার পরপরই স্থান ত্যাগ করল। সে বুঝতে দেরি করল কেন! এই ব্যাপারে সাঁঝের অদ্ভুত লাগছে।
আর এদিকে বেচারি উপমা! তার তো রাগে, লজ্জায় কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে, অর্ণবকে শীতের পুরো রাত পুকুরে চুবাতে। এমন কেউ করে!
_______________
রুমে এসে দেখল, সাড়ে আটটা বাজে। অনুমান করল, হৃদ কোথায় হবে; আজ তো সরকারি ছুটি। হৃদ হসপিটালে না কি বাসায়? ভেবে পেল না।
কল দিতে ইচ্ছে হলো তার। তবে কল দিল না। ছোট্ট করে একটা মেসেজ করল।
হৃদ আজ বাসায় আছে। মাত্র খাওয়া শেষ করল। এমন সময়ে সাঁজের মেসেজ পেল। মেসেজটি ওপেন করে দেখল, সেখানে লেখা, “মি. হৃৎপিণ্ড! সন্ধ্যাবতীর হৃৎপিণ্ড চুরির দায়ে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হলো।”
হৃদ রিপ্লাই লিখল, “শাস্তি হিসেবে কি আপনাকেই পাব?”
সাঁজ মুচকি হাসল। হৃদ তৎক্ষণাৎ ভিডিয়ো কল দিল। সাঁজকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার ভীষণ। সাঁজ ভড়কে গেল। রিসিভ না করে উলটো কেটে দিল। ভিডিয়ো কলে সে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ভিডিয়ো কলটা কেটে দিয়ে সাঁঝ অডিয়ো কল দিল।
হৃদ চাপা স্বরে বলল, “কলটা কেটে দিলে কেন?”
সাঁঝ আমতা আমতা করল। লজ্জাবতী সাঁঝ এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরকণ্ঠে বলল, ”এভাবেই।”
“এভাবেই না। ভিডিয়ো কলে এসো। দেখব তোমায়।”
“এ্যাই না!”
“কেন?”
“কিছু না। খেয়েছেন সকালে?”
হৃদ ‘হু’ বলেই কল কেটে দিল। সাথে সাথে আবারও ভিডিয়ো কল এলো। সাঁঝ রিসিভ করবে না করবে না করেও করল। হৃদ সাঁঝের লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া গাল দুটো দেখে হাসল। সাঁঝের মাত্রাতিরিক্ত লজ্জায় এবার যেন নিজেরও হাসি পেল। ফট করে ক্যামেরা অফ করে ফেলল।
হৃদ তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল, “আরে আরে! কী করছ কী?”
সাঁঝ এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচল। হৃদের দিকে এবার যেন চোখ মেলে তাকাতে পারল। খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এর আগে কখনো এভাবে তাকানোর সাধ্য হয়নি। ফরসা লম্বাটে মুখশ্রী। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। থুতনিতে টোল। লালচে ঠোঁট। মোটা ভ্রু, গভীর চোখ, ঘন পল্লব বিশিষ্ট অক্ষি জোড়া। কপালের বা পাশে একটা কালো তিল। ইশ! সাঁঝের আকুলিবিকুলি করা মনটা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলছে, এই সুদর্শন পুরুষের চোখে সেরা সুন্দরী সে! এই পুরুষ তার প্রেমানলে জ্বলছে! এই সেই পুরুষ, যে তার অসুখে মরছে।
হৃদ ঠোঁট চেপে হাসল, সাঁঝের এরূপ কান্ড দেখে। সাঁঝের বলতে ইচ্ছে হলো, ‘আর কতো রূপ দেখিয়ে ঘায়েল করবেন আমায়?’ তবে একথা বলল না।
হৃদ ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দেখা দেবে না, সন্ধ্যাবতী?”
সাঁঝ কেঁপে উঠল। চোখ দুটো বুজে ফেলে বলল, “উঁহু।”
“কেন?”
“আপনার চোখের এই ভয়ংকর দৃষ্টিতে আমার মরণ নিশ্চিত। দৃষ্টি মেলাতে ভয় পাচ্ছি।”
“আমার যে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ!”
“পরে দেখবেন।”
“নাহ্! চোখ বন্ধ করে ক্যামেরা অন করে ফেলুন তো!”
“লজ্জা লাগছে।”
হৃদ আবারও তার ভয়ংকর সুন্দর হাসি দিয়ে সাঁঝের মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকর্ষণ করল। সাঁঝ তৎক্ষণাৎ কল কেটে দিয়ে একটা মেসেজ করল, “খেয়ে আসি।”
সাঁঝ এবার বলল, “এই লোকটা আমার জান নিয়ে নেবে!”
______________________
একসাথে খেতে বসেছে সবাই। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। আরিফ সাহেব সাঁঝকে ডাকলেন। সাঁঝ খেতে খেতে বলল, “হুম, বল।”
আরিফ সাহেব মিহি হেসে বললেন, “আমাদের ভরসা করো তো?”
সাঁঝ মুচকি হেসে বলল, “তোমাদের ভরসা করব না তো কাদের করব?”
আরিফ সাহেব সুমিতা বেগমের দিকে তাকালেন। সুমিতা বেগম চোখের পাপড়ি ফেলে আরিফ সাহেবকে ইশারা করল, কথাটা বলতে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে একদমে বললেন, “আমরা তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। তোমার আপত্তি আছে? দ্যাখো, যদি অন্য কোথাও পছন্দ থাকে, জানিয়ে দাও।”
সাঁঝ অবাক হলো। তার তো এখন বিয়ের কথা ছিল না! তার অবাক মুখখানাকে ছাপিয়ে খুশি উপচে বের হলো, একটা কথা ভেবে। তার ডাক্তার সাহেব বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে! সে তো সেদিন বলেছিলই!
সুমিতা বেগম জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে না?”
সাঁঝ মুচকি হেসে বলল, “তোমরা যা বলবে, তাই হবে।”
চলবে…..!