প্রেমাসুখ #পর্ব_৩৬ (বিষপান) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
464

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_৩৬ (বিষপান)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

রাত বাড়ছে। তবে শীতের প্রকোপ উপলব্ধি হচ্ছে না। পুরো বাড়ি মেহমানে গিজগিজ করছে। সাঁঝ এলোমেলো পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে যাচ্ছে। একটা মেয়ের সামনে দু’টো অপশন রাখা হলে, তন্মধ্যে যে-কোনো একটাকে চুজ করা মোটেও কষ্টসাধ্য না। কিন্তু সেই দু’টো অপশনে যদি হয় বাবা-মা ও প্রিয় মানুষ; মেয়েটা কাকে বেছে নেবে?
সাঁঝের অবস্থা এখন সেরকমই। ভেতর থেকে তার কোন এক সত্তা তাকে বলছে, “এখনও সময় আছে, সাঁঝ। পালিয়ে যা।”
ঠিক সাথে সাথে আরও এক সত্তা বলছে, “তুই না তোর বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস? তুই তার কথা ভাববি না? তুই চলে গেলে লোকটা মরে যাবে।”

সাঁঝ দোটানায় পড়ে গিয়েছে। রুমে প্রবেশ করতেই উপমা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গিয়েছিলি?”

ফোনের ওপাশে হৃদ চুপ থাকল।

সাঁঝ বলল, “বাবা-মাকে সবটা বলতে গিয়েছিলাম।”

আয়াত ভ্রু-কুঁচকে বলল, “তাঁরা মানল?”

সাঁঝ ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল, “না।”

উপমা জিজ্ঞেস করল, “এবার কী করবি?”

সাঁঝ হালকা হেসে বলল, “তাঁরা যা চায় তাই করব।”

প্রণব শুধাল, “মানে?”

সাঁঝ বলল, “বিয়ে করে নেব।”

হৃদ কল কেটে দিল। কিছুক্ষণ আগেই উপমার কাছ থেকে সমস্ত কিছু জেনেছে, প্রহরের নম্বরও নিয়েছে।
হৃদ বুঝতে পেরেছে, এখানে সাঁঝকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। সম্পূর্ণটাই ভুল বোঝাবুঝি ছিল।

উপমা সাঁঝকে বলল, “দ্যাখ, সাঁঝ! আমরা কোনো না কোনো উপায় বের করেই নেব।”

আয়াতও তাড়া দেখিয়ে বলল, “হ্যাঁ, সাঁঝ! তুই একদম টেনশন ফ্রি থাক। বিয়ে হতে দেব না।”

সাঁঝ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। প্রণব বলল, “আমাদের বিশ্বাস করিস তো?”

সাঁঝ উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝাল। প্রণব এতে মুচকি হেসে বলল, “দরকার হলে ঐ মাস্টার ব্যাটারে ধইরা তাল গাছে ঝুলামু। তাও বিয়া করবার দিমু না। আমাদের বেস্টুরে কোন দুক্ষে একটা নিরামিষের গলায় ঝুলামু? স্যার মানুষ আবার কিপটা হয় বেশি। ঐ ব্যাটার লগে বান্ধবী বিয়া দিতাম না।”

আয়াত বলল, “তোকে বলেছিলাম, দেবরহীনা বর আমি মানি নাহ। এই বিয়ে মানি নাহ।”

সাঁঝ আবেগপ্রবণ দৃষ্টিতে সবাইকে দেখে নিল। এটাই কি হওয়ার কথা ছিল! তার হাতে যে কিছুই নেই। আশেপাশে অদিতির অপূর্ণতা দেখতে পেলেই সাঁঝ জিজ্ঞেস করল, “অদিতি কোথায়?”

উপমা বলল, “আন্টি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। তাই ওর চলে যেতে হলো।”

_________________
সকালে হৃদ প্রহরের নম্বর ডায়েল করল। রাতেও কল দিয়েছিল বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই সুইচ অফ ছিল ফোন। তাই সকাল হতে না হতেই আবারও কল দিল। তিনবার রিং হতেই প্রহর রিসিভ করল।

হৃদ সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “প্রহর?”

প্রহর সালামের জবাব দিয়ে বলল, “ইয়েস, স্পিকিং…”

“আমি ড. অনয় আহমেদ।”

“হৃদ ভাইয়া?”

“হুম।”

“ভাইয়া! আপনি! এতদিন পর হঠাৎ!”

হৃদ হাসল। প্রহরকে সে চেনে। নটরডেম কলেজে তার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল প্রহর। খুব মান্য করে তাকে।

প্রহর আবারও বলল, “ভাইয়া, কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?”

প্রহর মিষ্টি হেসে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”

“তা তো থাকবেই! শুনলাম, বিয়ে করতে যাচ্ছ!”

“জি, ভাইয়া। আজ হলুদ।”

“আচ্ছা, মেয়ে পছন্দের?”

“ইয়ে মানে ভাইয়া, হ্যাঁ।”

প্রহর এসব ব্যাপারে খানিকটা লাজুক। প্রসঙ্গ এড়াতে বলল, “আপনার জুনিয়র হয়েও বিয়েটা করতে যাচ্ছি। আপনি আর কতকাল একা থাকবেন?”

“বিবাহিত হবার উপায় যে রাখলে না তুমি!”

“কেন, ভাইয়া? কী করেছি?”

“ভাবিকে বউ বানিয়ে ভাইকে চিরকুমার রাখতে চাচ্ছ।”

“বুঝলাম না!”

“বোঝাচ্ছি! তুমি যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছ, সে আমার প্রেমিকা + বউ।”

“এ্যাহ্!”

“হ্যাঁ। বিয়েটা ভেঙে দাও।”

“কিন্তু, স্যার! সবাইকে জানানো হয়ে গেছে। এখন কীভাবে না করব?”

হৃদ হাই তুলতে তুলতে বলল, “সেটা তোমার ব্যাপার।”

“কিন্তু…”

“কোনো কিন্তু না। আসো, তোমায় একটা ঘটনা বলি। ঘটনাটা সাঁঝের পাগলামির। সেদিন একটা মেয়ের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এটা তোমার ভাবির চোখে পড়েছে। সে সোজা এসে আমার কলার ধরে বলেছে, ‘ঝগড়া-ঝাটি করার জন্য আমি আছি। নেক্সট টাইম যেন না দেখি এসব।’ এরপর আবার হসপিটালে একটা মেয়ে মিট করতে এসেছিল, যদিও মিট হয়নি। তোমার ভাবি সেদিন আমাকে খুন করার হুমকি দিয়েছিল। বোঝো!”

“এটা কী ছিল?”

“এখন তুমিই বলো, যদি বিয়ে করতে চাও; করতেই পারো। পরের দিন সবাই বাসর ঘরে এসে দেখবে বউ পালিয়েছে আর ফ্লোরে বরের লাশ পড়ে আছে।”

“উনি কি পাগল নাকি, ভাইয়া?”

“হ্যাঁ, কিছুটা। আগে সুস্থ ছিল। কিন্তু, কিছুদিন আগে মাথার তার কয়েকটা ছিঁড়ে গিয়েছে।”

“আগে থেকে ইনফর্ম করার জন্য থ্যাংকস ভাইয়া।”

হৃদ মুচকি হেসে বলল, “মেনশন নট, ব্রো।”

____________
রাত বারোটার পর রুমে অর্ণব এলো। উপমা তাকাল একবার। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে অর্ণবকে। উপমাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে অর্ণব জোরপূর্বক হেসে বলল, “অনেক কাজ ছিল, জান।”

উপমা সাঁঝের ব্যাপারে বলতে উদ্যত হতেই অর্ণব বলল, “জানো, খুব খুশি খুশি লাগছে আজ। আমার আদরের ছোট্টো জেরিটা কত্ত বড়ো হয়ে গেল! ভাবতেও অবাক লাগছে। সেদিনই তো হসপিটালের নার্স ওকে বাবার হাতে তুলে দিল। তখন আমিও ছোটো ছিলাম। বাবার হাতের দিকে বিস্মিত নজরে চেয়ে ছিলাম। একদম পুতুলের মতো ছোটো ছিল জেরি। কী জোরে কান্না করে যাচ্ছিল! আমি বাবাকে জোর করলাম ওকে আমার কোলে দিতে। জানো, উপমা? আমার কোলে আসতেই ওর কান্না থেমে গিয়েছিল। ছোট্টো মুখের বড়ো বড়ো চোখে আমার দিকে চেয়েছিল। আমার ভাল্লাগছিল না এভাবে। তাই ওকে জোরে সোরে চিমটি কাটলাম। জেরি আগের চেয়েও উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল। ওর কান্না দেখে আমি খিলখিল করে হেসেছি। বাবার বকুনিও খেয়েছি। তারপর থেকে ওকে না জ্বালালে আমার ভালো লাগে না। আজ আমার সেই পিচ্চি জেরিটা বড়ো হয়ে গিয়েছে। বিয়ে ওর!”

কথা বলতে বলতে অর্ণবের চোখ চিকচিক করছে। উপমা এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। সাঁঝকে নিয়ে কিছু আর বলতে পারল না। অর্ণব ঘুমিয়ে পড়ল। কাল আরও অনেক কাজ থাকবে।
____________
হলুদের সকাল। বাড়িতে সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। আরিফ সাহেব হৃদরোগের কারণে খানিকটা অসুস্থ ছিলেন। তার উপর কালকের ঘটনায় আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলেন। তাই এখনও ঘুমোচ্ছেন।
সুমিতা বেগম বিভিন্ন খাটা-খাটনি করে সাঁঝকে ডাকতে গেলেন। মনে মনে ভাবছেন, “মেয়ের মাথার ভূত নেমেছে কিনা। নেমে যাওয়ারই কথা।”

সুমিতা বেগম সাঁঝের কক্ষের দরজা একবার ধাক্কা দিলেন। দরজা ভেতর থেকে লাগানো। বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পরও সাঁঝ খুলছে না। সুমিতা বেগম এবার ডাকা শুরু করলেন। তাও কোনো লাভ না হওয়ায় অর্ণবকে ডেকে আনলেন। অর্ণব কিছুই বুঝতে পারছে না।

দরজা নক করে বলল, “জেরি! মরার মতো ঘুমোচ্ছিস কেন? আজ তোর গায়ে হলুদ। ওঠ।”

সাঁঝের সাড়া নেই। সুমিতা বেগম দরদর করে ঘামছেন। মাথায় সব উলটা-পালটা চিন্তা। তার মেয়ে বড্ড আবেগপ্রবণ। তার একদম উচিত হয়নি, সাঁঝকে রাতে একা ঘুমোতে দেওয়া।

সুমিতা বেগম অর্ণবকে বললেন, “দরজা ভাঙ।”

অর্ণব হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

সুমিতা বেগম নিজেই ঠেলছেন দরজা। ইতোমধ্যে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে।

প্রণব জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, আন্টি?”

সুমিতা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “দেখো না বাবা! দরজা খুলছে না মেয়েটা!”

উপায়ন্তর না পেয়ে প্রণব আর অর্ণব মিলে দরজা ভাঙল। রুমের ভেতরে ঢুকে দেখতেই শোরগোল বেঁধে গেল। অর্ণব দু’কদম পিছিয়ে গেল। সুমিতা বেগম চিৎকার দিয়ে সেন্সলেস হয়ে গেলেন। সাঁঝ ফ্লোরে শুয়ে, পাশে তার ডায়েরি। সেখানে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা, “আমি তার, নয়তো কারো না।”

অতঃপর সমগ্র বিয়ে বাড়িতে ছড়িয়ে গেল, বিয়ের আগের দিন কনে বিষপান করেছে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here