প্রেমাসুখ #পর্ব_৩ (ভার্চুয়াল সংসার) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
591

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_৩ (ভার্চুয়াল সংসার)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

সাঁঝ চটজলদি নিজের ফোন অন করল। অর্ণব অফিসে যাওয়ার সময় সাঁঝের রুমে এসে তার ফোন নিয়ে গিয়েছে। ফোন অন করতেই নোটিফিকেশন এলো বেশ কতগুলো। তন্মধ্যে নজর কাড়ল সেই হৃৎপিণ্ডের প্রোফাইলটি। ইনবক্সে গিয়ে দেখল কাল রাতের মেসেজ।
প্রথমটা হচ্ছেঃ’আপনি কি সবসময় এভাবেই কথা বলেন? নাকি ফেইক আইডি?”

পরের মেসেজটা হচ্ছে,“কেন যেন আপনাকে ফেইক মনে হচ্ছে! যাই হোক,আপনি তো কবুল করে নিলেন, আমার ভার্চুয়াল বউ হবেন?”

দুটো মেসেজ-ই কাল রাতের। সাঁঝ শয়তানি হাসি হেসে রিপ্লাই দিল,“এমা! কী বলেন? আমি ফেইক হতে যাব কেন? আর ভার্চুয়াল বউ হব না কেন? অবশ্যই অবশ্যই।”

___________________
ঘড়িতে এখন বেলা বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট। নিজের চেম্বারে বসে আছে হৃদ। পরনে হোয়াইট শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। ফর্সা ও সুঠাম দেহের সাথে শুভ্র রং-এ তাকে সুদর্শন এক পুরুষ লাগছে। বর্তমানে সে ভালো মানের একজন ডাক্তার। ঢাকা মেডিকেলের স্টুডেন্ট ছিল আর বর্তমানে সেখানকার-ই ডাক্তার। শুরু থেকেই পড়াশোনায় ভীষণ ভালো। দেখতে শুনতে তার মতো ছেলে খুব কম।
বিয়ের প্রতি অনীহা তার অনেক আগে থেকেই। বাবা-মা কম মেয়ে খোঁজেনি। কিন্তু হৃদ প্রতিবার-ই নাকচ করে দেয়। কেননা তার মা পছন্দ করেছে শুধু মাত্র সাদা চামড়ার মেয়েদেরকে। কিছু মানুষ সৌন্দর্য বলতে সাদাকেই বোঝে। বরাবরই হৃদ তার মায়ের এমন পছন্দ দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে না করে দেয়। শুরু থেকে তো এটাই হচ্ছে। রূপের সাথে ক্যারিয়ারের বিয়ে হচ্ছে, মনের সাথে মনের না।

টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে, সেই হাতেই কিছু রিপোর্ট তুলে দেখছে হৃদ। অন্য হাতে একটা কলম ঘুরাচ্ছে। মুখটা একদম গম্ভীর। পেশেন্টদের ব্যাপারে সে ভীষণ সিরিয়াস। সিরিয়াস মুডটা যেন তারই জন্য তৈরি হয়েছে। সর্বদা একই ভঙ্গিতে থাকে। দেখতে অবশ্য ভালোই লাগে।

তখনই তার ফোনে কল এলো। টেবিলের উপর থেকে ফোনটা তুলে দেখল আকাশ কল দিয়েছে। রিসিভ করে কানে তুলল।

ওপাশ থেকে আকাশ বলল,“কই তুই?”

“কেবিনেই। তুই?”

“টাঙ্গাইলে, শ্বশুরবাড়িতে। আমি আর পুষ্প ছুটিতে আছি।”

“সকালে না এখানে ছিলি?”

“হ্যাঁ, আসলে পুষ্পর দাদী মারা গেছে, সেজন্য আসতে হলো।”

“ওহ্! কল দিলি যে!”

“হ্যাঁ, কিছু দরকার ছিল।”

“হুম, বল।”

“মেইল চেক দে। কিছু ফাইল’স অ্যান্ড ফটো’স পাঠিয়েছি।”

“ওকে।”—বলেই ফোনটা রেখে দিল হৃদ। ডাটা অন করতেই সাঁঝের মেসেজ এলো। হৃদ সেগুলো এড়িয়ে গেল। আকাশের কাজগুলো চেক দিচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে একটা সার্জারি আছে। এরপরই লাঞ্চ আওয়ার, লাঞ্চ করে আজকের শিডিউলে আরও অনেক কাজ আছে। সব মিলিয়ে এখন তার কাছে ওসবের সময় নেই।

___________
সন্ধ্যার শেষভাগ। যান্ত্রিক শহরে সন্ধ্যা বলতে নীলচে আকাশ ও আযানের ধ্বনি ছাড়া কিছুই বোঝায় না। পাখির কলকাকলি,শীতল বাতাস মোট কথা গ্রাম্য আবহাওয়ার ছিটে ফোঁটা এই শহুরে পরিবেশে পাওয়া যায় না। কাজ শেষে মাত্রই ফ্রি হলো হৃদ। ছুটি হয়ে গিয়েছে। হসপিটাল থেকে বাসার দূরত্ব খুব একটা না; হেঁটে যেতে দশ মিনিট। নীলচে সন্ধ্যে এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। ল্যাম্পপোস্টের নিভু নিভু আলোতে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। হৃদ হসপিটাল থেকে বেরোতে পারল না। বৃষ্টি নেমে গিয়েছে।আকাশ পানে একবার তাকিয়ে পুনরায় নিজের হাতঘড়িতে দেখল। এখন সন্ধ্যে সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। সময়ের অপচয় পছন্দ নয় তার। কিন্তু এখন না চাইতেও অপেক্ষা করতে হবে।

দেয়ালের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। চোখ দুটো বুজতেই মনের ক্যানভাসে একটা দৃশ্য চলে এলো।
বছর দুয়েক আগের কথা। প্রিয় বন্ধুদের বিয়ে উপলক্ষ্যে বেশ কিছুদিন ছিল সেখানে। একদিন ভোর সকালে হৃদ জানালা দিয়ে দেখতে পেল এক অপ্সরীকে। গ্রামের রাস্তায় শাড়ি পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে এক কিশোরী। কিছুটা দূরে একটা বিল আছে। হৃদের রুম থেকে তা স্পষ্ট দেখা যায়। হৃদ দেখতে পেল, সেই মোহময়ী মেয়েটি বিলের দিকে এগোচ্ছে। কয়েকটা পদ্ম তুলে নিয়ে পুনরায় নিজ রাস্তায় চলে যাচ্ছে। বাচ্চা এই মেয়েটার ছেলে মানুষী দেখতে হৃদের ভালোই লাগছে। প্রতিটি কাজ যে ভেবেচিন্তে করে, এমন কি নিঃশ্বাস অবধি পরিকল্পনা করে ফেলে, সে সেদিন আনমনে হেসে ছিল। এই জিনিসটা এখনও ভাবায়। চোখ দুটো খুলতেই সে বুঝতে পারল, তার অধর কোণে ছোট্ট একটা হাসির রেখা।

কিছু মনে পড়তেই হৃদ নিজের ফোনটা হাতে নিল। মেসেঞ্জারে প্রবেশ করতেই সাঁঝের মেসেজ দেখল। আশেপাশে চোখ ঘুরাল। হালকা করে শ্বাস ফেলে রিপ্লাই দিল,“আচ্ছা এরপর?”

______________
ড্রয়িং রুমে সোফার উপর উলটা হয়ে শুয়ে কার্টুন দেখছিল সাঁঝ। টিভিতে এখন ডোরেমন চলছে। প্রিয় কার্টুন তার। বয়স আঠার পেরিয়েছে তবে অভ্যেসগুলো এখনও সেই বাচ্চাদের মতোই। দেখছে, হাসছে আর একটু পরপর চিপস মুখে দিচ্ছে। তখন সেখানে সুমিতা বেগম এলো।
তেজি কন্ঠে বলল,“এতো বড়ো মেয়ে হয়েও কেমনে কার্টুন দেখিস? সর তুই। আমি সিরিয়াল দেখব।”

চিপস চিবোতে চিবোতে বলল, “এহ! এমন ভাবে বলছ যেন বড়ো হলে কার্টুন দেখা যায় না?”

“যায় না-ই তো। সর এখন। রিমোট দে।”

সাঁঝ উঠে বসল। রিমোটটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, “দেব না। এই সিরিয়ালে কী পাও বলতে পারো?”

সুমিতা বেগম রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করল। স্টার জলসায় গিয়ে থামল। টিভির দিকে উদ্দেশ্য করে বলল,’দ্যাখ! কত ভালো মেয়ে! সবসময় মা-বাবার কথা মতো চলে, তুই কী করিস? কিছু শেখ।’

সাঁঝ মুখ ভেংচিয়ে বলল,“আর ঐযে বিয়ের পর পরকীয়া করে! ঐটা শিখতে বলবা না?”

“সাআআআআঁঝ!”

“কী হয়েছে? ধমক দাও কেন?”

“তর্ক করা শিখেছিস? উঠব আমি?”

সাঁঝ আলগোছে সোফা থেকে উঠে ধীরকন্ঠে বলল,“আহারে আমার বেচারা আব্বু! কষ্ট লাগে। এতগুলো বছর কী অত্যাচারই না হয়েছে তার উপর! ইশ!”

কথাটা শেষ করেই সাঁঝ দৌড়িয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করল। সুমিতা বেগমের মিনিট সময় লেগেছে কথাটা বুঝতে। বুঝতে পেরে পুনরায় সাঁঝকে ধমক লাগাল। কিন্তু সাঁঝ এখন বিপদসীমানার বাইরে।

রুমে গিয়ে হাসতে হাসতে বিছানার উপর বসে পড়ল। তখনই হৃদের মেসেজ এলো। ফোন হাতে নিয়ে হৃদের মেসেজ দেখে সাঁঝ ভাবল, কী লিখবে।

কিছুক্ষণ ভেবেই লিখল,“এরপর বলুন, কী করছেন?”

এখনও বৃষ্টির জন্য আটকে আছে হৃদ। ফোন হাতেই ছিল। মেসেজ পেয়েই রিপ্লাই করল,“বৃষ্টি দেখি, আপনি?”

“আপনাকে কল্পনা করি জানেমন!”

হৃদ মেসেজটা দেখেই কেশে উঠল। এ কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে কে জানে! কিন্তু ডেয়ার ইজ ডেয়ার। সে হিসেবে কথা এগোতে হবে। প্রশ্ন এখানেই, কী বলবে?

হৃদ লিখল,“কল্পনায় কী করছেন?”

খানিকক্ষণ ভাবল সাঁঝ। অতঃপর লিখল,“কোনো এক বর্ষায়, আমি আর আপনি মিলে ঘুরব। বৃষ্টিতে ভিজব। কোনো এক পদ্ম বিলে যাব। আমার প্রিয় ফুল এটা। আর কী!এখন কিছু মনে আসছে না। পরে বলব আবার।”

অজান্তেই হৃদ সাঁঝের কল্পনাতে সেই মেয়েকে দেখতে পেল। ঝড়ো হাওয়া বৃষ্টির ছিটের দিক পরিবর্তন করল। কিছু ফোঁটা এসে মাখল হৃদের ফর্সাজ্বল মুখশ্রীতে। রিপ্লাই করল হৃদ,“আচ্ছা অনামিকা নামটা কি সত্যিই আপনার?”

“হ্যাঁ, আমারই নাম। এই! আপনি কি এখনও আমাকে ফেইক ভাবছেন? না জান, আমি সত্যিই ফেইক না। আমি তো আপনার রিয়েল লাভ।”

“না, ফেইক ভাবব কেন? হাজার হোক, একমাত্র বউ। ভার্চুয়াল বউ।”

“ওরে আমার ভার্চুয়াল জামাইটারেহ!”

হৃদ এই মেয়ের ব্যবহারে অবাক হচ্ছে। দুনিয়াতে এমন মেয়েও আছে? আজকাল যেভাবে মেয়ের আইডি ছেলেরা ব্যবহার করে, তাতে হৃদের একটু আধটু সন্দেহ হওয়াটা ভিত্তিহীন নয়।

মেয়েটার বয়স অনুমান করার জন্য জিজ্ঞেস করল, “কীসে পড়েন আপনি?”

কিছুক্ষণ ভাবল। সত্যিটা বলবে? নাহ্। লিখল, “পড়ালেখাকে তো অনেক আগেই আলবিদা করে দিয়েছি। এখন আপনার মনের স্কুলে পড়ব। পড়াবেন?”

“যদি না বলি?”

“তবে আর কী? আমার আর পড়ালেখা হবে না। আপনি কী করেন?”

“আমি কষাই।”

হৃদের উত্তর শুনে সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
বৃষ্টির তেজ একটু কমলো। চারিপাশে দেখল। এখন রাত হয়ে গেছে। হাঁটা দিল বাসার উদ্দেশ্যে। আর চলছে সাঁঝের সাথে চ্যাটিং। দু’টো ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের এমন বাচ্চামো স্বভাব কেবল মাত্র ভার্চুয়ালের মতো এই নকল দুনিয়াতেই পাওয়া যায়। এখানে কেউ কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করতে আসে না। ব্যাপারটা অনেকটা যার যার তার তার মতো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here