প্রেমাসুখ #পর্ব_৬ (মোবাইলের মৃত্যু) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
442

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_৬ (মোবাইলের মৃত্যু)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“কী-রে সাঁঝ? রেডি হোসনি এখনো?”

“হচ্ছি আম্মু। আর পাঁচ মিনিট।”

“দুপুর গড়িয়ে গেছে, এখনও তোর পাঁচ মিনিট শেষ হয়নি? যাবি কখন? রাস্তা তো কম না।”

“চিল করো আম্মু। আমার জাস্ট পাঁচ মিনিট লাগবে।”

সুমিতা বেগম সাঁঝের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল,“হ্যাঁ হ্যাঁ। জানি আমি। তোর পাঁচ মিনিট যে কয় ঘণ্টায় হয়, জানা আছে। আমার কী? যাবি তোরা। যা ইচ্ছা কর।”

সাঁঝ মিহি হেসে সুমিতা বেগমকে বলল,“ভাইয়া রেডি হয়েছে?”

“সে তো অনেক আগে থেকেই রেডি। একটু পরপর আমাকে তাগাদা দিচ্ছে তোকে রেডি হতে বলার জন্য। ঐ নবাবকে আরও বুঝি না। এমন ভাব ধরছে, যেন ঢাকায় তার বউ রেখে আসছে।”

“হ্যাঁ, আছে হয়ত কোনো ভাবি। এবার গিয়ে খোঁজ লাগাব।”

সুমিতা বেগম ব্যাগ গোছানো শেষ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে সাঁঝকে বললেন,“এখন বাজে দুইটা আটত্রিশ। পোনে তিনটার মধ্যে বেরোবি।”

সাঁঝ জলদি তৈরি হওয়ায় মন দিল। আজ এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। সময় তো হাওয়ার চেয়েও দ্রুত চলে। এই ক’দিন রোজ হৃদ-সাঁঝ-এর মেসেজ আলাপন চলেছে। অবশ্য সারাদিন নয়। হৃদের ফ্রী টাইমেই হয়েছে। সাঁঝ তার মন ভালো করার ঔষধ পেয়ে গিয়েছে। তার ‘ভাল্লাগেনা’ রোগের ঔষধ। ওদিকে হৃদও একজন মানুষ পেয়েছে, যার সাথে কথা বলে হাসতে পারে। পরিচয়টা খুবই স্বল্প সময়ের এবং সম্পূর্ণ ভুল পরিচয়। তবুও আজ তারা একে অপরের ভীষণ প্রিয়।

কেউ হয়ত বলেছিল, ভার্চুয়াল জগৎটা ফেইক এবং ফেইক জগতে কোনো আপন মানুষ হয় না। কিন্তু এটা ভুল কথা! তাদের পরিচয়টা নকল থাকুক! মানুষটা তো আসল!
অনেক সময় আমাদের সামনে থাকা মানুষগুলোকে যা বলতে পারি না, তা নির্দ্বিধায় ভার্চুয়ালে তৈরি হওয়া কাউকে বলে ফেলি। কারণ একটাই, তার সাথে আমাদের দেখা হচ্ছে না। সে এসব নিয়ে পরে কথা বলতেও আসবে না।
হ্যাঁ! এটাই ভার্চুয়াল থেকে সবচেয়ে বড় পাওয়া। হৃদ পেয়েছে সাঁঝকে, সাঁঝ পেয়েছে হৃদকে। তারা একে অপরের মন খারাপের মেডিসিন হয়ে এসেছে।

আজ সাঁঝ ও অর্ণব ঢাকা যাবে,বেশ কিছুটা সময় পর সাঁঝ পুরোপুরি তৈরি।ফুপির বাসায়। সে উদ্দেশ্যেই তৈরি হাওয়া। বেশ কিছুটা সময় সাঁঝ পুরোপুরি তৈরি। আয়নায় নিজেকে দেখে নিল। কাঁচা হলুদ রঙের একটা গোল জামা, প্লাজু ও হালকা গোলাপি রং-এর ওড়না। চুলগুলো বেনুনী গাঁথা। এক হাতে কয়েকটা আলাদা আলাদা রং-এর কাঁচের চুড়ি। আর পায়ে নূপুর। সাঁঝ বরাবরই ভীষণ সৌখীন। মুখে প্রসাধনী না মাখলেও, এসব ছাড়া তার চলেই না।

রুম থেকে বেরোনোর সময় দেখল, তিনটা বেজে গেছে। জিভে কামড় দিয়ে বলল,“এখন আম্মুর বকুনি খেতে হবে।”

জলদি রুম থেকে বের হলো। ড্রইং রুমে আরিফ সাহেব ও অর্ণব বসে আছে। সুমিতা বেগম খাবার প্যাক করছে। পথ সামান্য হলেও, মায়েরা তো এমনই। এখান থেকে টাঙ্গাইল শহরে যাবে। ওখান থেকে ঢাকার বাসে উঠবে।

__________
সন্ধ্যা ছয়টা। বিগত এক ঘন্টা ধরে জ্যামে বসে আছে সাঁঝ ও অর্ণব। সাঁঝ একবার অর্ণবের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল। অর্ণব ভ্রু উঁচু করে বলল, “কী?”

সাঁঝ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,“বাড়ি যাব।”

অর্ণব হেসে দিল।
“ভাইয়া! তুই হাসছিস? এদিকে তোর বোনের এই অবস্থা!”

“তো হাসি পেলে হাসব না?”

“না, হাসবি না। সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগে এই জ্যাম! ধ্যাৎ! অসহ্যকর!”

অর্ণব কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই তার ফোন বেজে উঠল। সে কল রিসিভ করে কানে তুলে বলল,“এইতো, জ্যামে আছি।”

“এখনো?”

“হুম, জানোই তো তোমার শহরের অবস্থা!”

ওপাশ থেকে বলল,“কীঃ! বারবার শহর নিয়ে খোটা দাও কেন? একমাত্র এখানকার বাসিন্দারাই জানে, এই শহরে ঠিক কতটা সুখ আছে!”

“এই কথা আর কতবার বলবা? বুঝি তো, নিজের শহরের খানিকটা সুনাম করার ধান্দা। এই-ই তো!”

“দ্যাখো! বেশি বলছো! আমার শহর এভাবেই সুন্দর। সুনামের যোগ্য। প্রশংসা করার জন্য ধান্দা-ফান্দার প্রয়োজন নেই।”

অর্ণব হেসে বলল,“তাহলে তো থেকেই যেতে হয়!”

“হ্যাঁ, তা থাকবে। না করেছে কে?”

“কেউ যদি রেখে দিত!”

ওপাশ থেকে মেয়েটি হাসল। কবির ভাষায়, সে হাসিতে মুক্তো ঝরল। রিনিঝিনি আওয়াজ।হাসি মাখা ঠোঁটে সে বলল,“তবে তাই হোক! আসুন আপনি।”

“এবার থেকে যাব। নয়ত তোমাকে নিয়ে আসব। পার্মানেন্টলি।”

তখনই অর্ণবের খেয়াল হলো তার পাশে সাঁঝ বসে আছে। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল সাঁঝের দিকে। দেখল, সাঁঝ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অর্ণব ফোন রাখতে গেল।

তখন সাঁঝ বলল,“ক্যারি অন ভাই, তোরই দিন।”

অর্ণব অতি সন্তর্পণে কল কেটে দিল। সাঁঝের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,“ঐযে! কলিগ ফোন দিয়েছিল। অন্য কিছু না।”

“হুম, বুঝি।”

অর্ণব আর কথা বাড়াল না। আজ সারাদিনে হৃদের রিপ্লাই পায়নি সাঁঝ। সেই সকালে মেসেজ দিয়ে রেখেছে। বরাবরই হৃদ সারাদিনের ব্যস্ততার জন্য অফলাইন থাকে। অনলাইনে এলেও, চ্যাটিং করতে পারে না। এজন্য অপেক্ষাও করল না।

সাঁঝ ও অর্ণব ফুপির বাসায় পৌঁছল সন্ধ্যার পর। সাতটার পরপরই। অর্ণব সিএনজির ভাড়া দিতে দিতে বলল,“তুই ভেতরে যা।”

সাঁঝ সে উদ্দেশ্যে গেল। তখনই তার ফোনে হৃদের মেসেজ এলো। হৃদ লিখেছে, “কী ব্যাপার? আজ মন খারাপ কেন?”

এক সপ্তাহ জুড়ে তারা অনলাইনে সংসার পেতেছে ঠিকই, তবে বাস্তব অর্থে একে অপরের ভীষণ ভালো বন্ধু হয়েছে। মন ভালো করার বন্ধু। যেই বন্ধুত্বে একে অপরকে চেনা কিংবা জানা লাগে না, পাশে পেলেই হয়।

সাঁঝের মতে সম্পর্কটা এরকম,“না ছিল পরিচয়, না ছিল জানা-শোনা; তবুও আজ আপনি আমার ভীষন প্রিয়।”
উক্তিটি সাঁঝ হয়ত ফেসবুকেই পেয়েছিল। আসলেই, এরকমই তো হলো।
আজ সকালে সাঁঝের ভীষণ মন খারাপ ছিল। কারণ একটাই। সে হচ্ছে উড়নচণ্ডী। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে অভ্যস্ত। কিন্তু শহর! অজানা কারণবশত সে শহুরে আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। সেজন্য মন ভার ছিল সকালে।
তাই হৃদকে মেসেজ করেছিল,“একটা পাখির আসল জায়গা কোনটা? মুক্ত আকাশ না-কি ছোট্ট বন্দী খাঁচা?”
শহরের ইট সিমেন্টের বাড়িগুলো সাঁঝের কাছে বন্দী খাঁচা বৈ কিছুই মনে হয় না।

হৃদের রিপ্লাই পেয়ে বলল, “জামাইহীনা বউ আমি। ওরে কেউ মোর দুঃখ বুঝল না।”

“এই যে, আমি ইনভিজিবল হয়ে গেছি না কি?”

“না, না। আপনি আছেন বলেই তো এখন হ্যাপি হ্যাপি লাগছে।”

“আচ্ছা! কী করছেন?”

“জামাইয়ের সাথে যুদ্ধ করে, ফাইনালি জয়ী হয়ে বাড়ি এলাম।”

“জামাই!”

“উফফস স্যরি! জ্যামের সাথে। অটো-কারেকশন হয়ে গেছে!” —এটুকু লিখে, শেষে ‘সেন্টি’ ইমোজি দিল।

“আপনার মতো আপনার কী-বোর্ডও এবার জামাই চাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে এটা।”

“হেহে! ঐ আর কী! বেচারা এতকাল আমার মতো সিঙ্গেল ছিল, এখন আমি বিয়াইত্তা হওয়ার পর থেকে ওরও হতে ইচ্ছে করছে।”

“হায় বেচারা! ওটাকেও বিয়ে দিয়ে দিন।”

“দিয়ে দেব। কিন্তু আমি ভাই বহুত কিপটা মানুষ। টাকা পয়সা খরচ করতে পারব না। ইনভিজিবল কোনো কীবোর্ডের সাথে মনে মনে বিয়ে দিয়ে দেব। আফটার অল, মনের বিয়েই বড়ো বিয়ে।”

হৃদ কিছুটা সময় নিয়ে রিপ্লাই দিল,“আচ্ছা, বউটা এখনই কী হিসেবী! ভবিষ্যৎ-এ তার জামাইয়ের খালি ফায়দা আর ফায়দা!”

“হয়, তার টাকা তো আমার শাড়ি-চুড়ি কেনার জন্যই।”

“একদম! তা কোথায় গিয়েছিলেন?”

“আরে, যাইনি তো। এলাম।”

“কোথায়?”

“এভাবে তো ফুপির বাসায় এসেছি। কেউ চাইলে, শ্বশুর বাড়িতেও যেতে পারি।”

হৃদ হাসির ইমোজি দিয়ে বলল,“যদি কেউ সত্যি সত্যি চায়?”

সাঁঝ ব্লিংকিং ইমোজি দিয়ে বলল,“তাহলে আজকে আমাকে শ্বশুরবাড়ি আসা থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। ডিয়ার শাশু মা অ্যান্ড শ্বশু আব্বা! আপনাদের ভার্চুয়াল বৌমা আসছে।”

এদের মিষ্টি কথোপকথন চলছেই। দুজনে দৃষ্টি ফোনের দিকে আবদ্ধ। চারিদিকে কোনো খেয়াল নেই হৃদের। এদিকে খেয়াল নেই সাঁঝেরও। হুট করেই একটা খাম্বার সাথে বাড়ি খেয়ে সাঁঝের ফোন নিচে পড়ে গেল।

সাঁঝ চিৎকার দিয়ে বলে ওঠল,“ও মা গো মা! আমার কলিজার কী হইয়া গেল রে! এখন আমার কী হইব? অ্যা অ্যা! সব গেল রে আমার। সব গেল।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here