#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২৬
একটা বিষন্ন বিকেল আর একটা ছবির ফ্রেম অর্ষার মন খারাপের সঙ্গী। কলেজ থেকে ফিরে চেঞ্জ করেনি এখনো। আধ ভেজা চুল গালে লেপ্টে আছে। কোলের উপরে ফ্রেমটা রেখে নিথর হয়ে ফ্লোরে বসে আছে। হঠাৎ কলিং বেল বাজল।
কলিং বেলের বিদঘুটে শব্দটা কান ও মস্তিষ্কে প্রবেশ করতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল অর্ষার।
কোলের উপরে ছবির ফ্রেম রেখেই চিৎকার করে বলল,
“খালা, বাবা ছাড়া অন্য কেউ আসলে দরজা খুলবে না। দিস ইজ মাই অর্ডার।”
কয়েক সেকেন্ড পরে খালা দৌড়ে এল অর্ষার রুমে। অর্ষা নিষ্পলক চোখে ফ্রেমের দিকে চেয়ে আছে। খালা ওকে কিছু বলতেই ইতস্তত বোধ করছে। আঙুলে আঙুল ঘঁষে ভয়ে ভয়ে বলল,
“মামনি, তোমার সেই পোলা বন্ধু আইছে। দরজা খুলুম?”
অর্ষা বুঝতে পারছে পোলা বন্ধুটা দর্শন। সমস্ত রাগ খালার উপর ঝেরে বলল,
“তোমার কানে কি সমস্যা? কি বলছি শুনোনি? বাবা ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিবা না।”
খালা মাথা চুলকে বলল,
“কিন্তু বেল বাজাইতাছে যে?”
অর্ষা দাঁত খিচিয়ে বলল,
“কানে তুলা দেও আর আমার সামনে থেকে দূর হও।”
খালা ওর কথা শুনে বুঝতে পারল ও প্রচন্ড ক্ষেপেছে তাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে না থাকাই শ্রেয়। খালা দরজার দিকে একবার চেয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। দর্শন কখন থেকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এতবার বেল বাজানোর পরেও দরজা খুলছে না। অর্ষার নাম্বার অফ। অর্ষা ওর সাথে কথা তো দূর ওর মুখও দেখতে চায় না। কেনই বা দেখবে? আজ ওর জন্য চরম অপমানিত হতে হয়েছে। ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে অর্ষা জিতে গিয়ে ওকে হারিয়ে দিয়েছে। ওর মাথা ঝিমঝিম করছে। ভালো লাগছে না কিছুই। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পুরো দিনটাই খারাপ গেল ওর। দর্শন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিরুপায় হয়ে বাসায় চলে গেল। আজ অর্ষা দরজা খুলবে না আর কথাও বলবে না। তাছাড়া আগামীকাল পরীক্ষা আছে। রাতে একবার কল করে কথা বলবে অথবা আগামীকাল কলেজে আসলে কথা বলে নিবে।
অর্ষা ওর মায়ের ছবির ফ্রেমটা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
“আম্মু আজ আমাকে একটা মানুষ ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। ওই মানুষটাকে আমি সব সময় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছি। কিন্তু তার বিনিময়ে কি পেয়েছি জানো? ভরা মজলিসে অসম অপমান। এত অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আম্মু। যেদিন আমি বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান আশ্রয়, স্নেহ ভালোবাসার অফুরন্ত ভাণ্ডার মমতাময়ী মা আমার নেই সেদিনও এত কষ্ট পাইনি। যে জিনিস আমার কখনো ছিল না সে জিনিস নিয়ে আমি কেন কষ্ট পাব? নিজেকে বুঝিয়ে এসেছি। কিন্তু যে মানুষটা আমার ছিল, যাকে আমি এত ভালোবেসেছি সে আজ আমাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। তার জীবনে আমার অবস্থান আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ এতদিন আমি তাকে নিয়ে মিথ্যা গর্ব করে এসেছি। সে যাই করুক আমাকে কখনো নিচু করবে না। আমাকে কখনো অবহেলা করবে না। কিন্তু করেছে। আমাকে ওর লাইফে একটা অপশনের মতো রেখেছে। আমি কী করে কলেজে এই মুখ দেখাব? কি করে মানুষের সামনে যাব? এত অপমান যে আমি সহ্য করতে পারছি না।”
অর্ষার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। দুই হাতে মুখ চেপে ধরেছে। নিজের গাল খাঁমচে রক্ত বের করে ফেলেছে।
অর্ষা মুখে মাস্ক পরে কলেজে এসেছে আজ। তিনদিন পরে আজ কলেজে এসেছে বাবার জোড়াজুড়িতে। গালের অনেক জায়গায় কেটে গেছে। ক্ষত মুখ দেখলে অনেকে অনেক প্রশ্ন করতে পারে। তাই মাস্ক পরে এসেছে। বারবার নাক টেনে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে ওর ঠান্ডা লেগেছে। এই তিনদিন দর্শন অনেক চেষ্টা করেছে ওর সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু সম্ভব হয়নি। অনুতাপের তপ্ত আগুন দগ্ধ হচ্ছে নিত্যদিন। এ অনুতপ্তের দগদগে ঘা তখনই শোকাবে যখন অর্ষা ওকে মন থেকে মাফ করবে। অর্ষাকে দেখার জন্য চোখদুটো বেশ তৃষার্ত হয়ে আছে। চাতক পাখির মতো এদিক সেদিক করছে। পরীক্ষা শেষে যখন জানতে পারল অর্ষা কলেজে এসেছে তখন পুরো কলেজ অর্ষাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে এমনকি লেডিস্ ওয়াশরুমেও। কিন্তু কোথাও অর্ষার হদিস মেলেনি। যে নিজেকে নিজ থেকে লুকিয়ে রাখে তাকে কী করে খুঁজে পাওয়া যায়? ওকে না পেয়ে দর্শন ডিপ্রেশনে ভুগছে। নিজের প্রতি প্রচুর রাগ হচ্ছে। অর্ষা কী ওকে কখনো মাফ করবে? কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
পরের দিন দর্শন পেছনে থেকে অর্ষাকে দেখে কালো মেঘের ভেলায় একটুকরো ভাসমান আলো
দেখতে পেল। সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ করে জাগরিত হলো। দৌড়ে ওর সামনে গেল। কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল। অর্ষা ওকে দেখে ইগ্নোর করে চলে যাচ্ছে। ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সে ঝড় এখন ওর হাঁটার মধ্যে বিদ্যমান। দর্শন অনুনয় করতে করতে ওর পেছনে পেছনে গেল।
“অর্ষা, দাঁড়াচ্ছো না কেন?”
“আমার কাজ আছে। তার চেয়ে বড় কথা আমি তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই। সো প্লিজ পেছনে পেছনে ছ্যাচড়ার মতো আসবা না।”
ছ্যাচড়া বলায় দর্শন কিছু মনে করেনি কারণ ও জানে অর্ষা রেগে আছে আর ছ্যাচড়া কেন এর চেয়ে বড় কিছু বলাও এখন অর্ষার জন্য জায়েজ।
“তোমার যা খুশি বলো, যত রাগ আছে সব ঝারো শুধু আমার সাথে একটু কথা বলো। আমি যা করেছি তার জন্য অনুতাপের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি। একটু দয়া করো।”
অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তাচ্ছিল্য করে বলল,
“দয়া! সে তো তুমি করবে আর সেটা আমাকে। আমি তোমাকে দয়া করার কে? আমি সাধারণ একজন মানুষ। তোমার মতো অসাধারণ নই।”
দর্শন ওর মুখের দিকে চেয়ে বিরক্ত হলো। মাস্ক পরে মুখ ঢেকে রেখেছে। একটু দেখতেও পারছে না। দর্শন এক টানে ওর মাস্ক খুলে ফেলে আঁতকে উঠে। মুখ থেকে পারমিশন ছাড়া মাস্ক খোলায় অর্ষা রেগে আগুন। দর্শন ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। গালে আঁচড়ের দাগ। সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে। দর্শন ওর গালে হাত ছোয়াতেই অর্ষা ওর হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“হাও ডেয়ার ইউ টু টাচ মি? কাউকে ছুতে হলে পারমিশন নিতে হয়। আমি তোমার পার্সোনাল প্রপার্টি নই।”
দর্শন হাতটা মুঠ করে নিল অপমানে আর লজ্জায়। থমথমে মুখে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“এমন কেন করেছো?”
অর্ষা কিঞ্চিৎ দূরত্বে গিয়ে বলল,
“আমার ফেস আমি যা খুশি করব। আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করবে না প্লিজ। সে সম্পর্ক আর আমাদের নেই।”
দর্শন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“নেই?”
অর্ষা তাচ্ছিল্য হাসল। তারপর বলল,
“আদৌও আছে কি? সেদিন যা করেছো তারপরেও সবটা ঠিক আছে? আমি তোমার লাইফের কোথাও কি আছি? মনে তো হয় না আছি। যদি থাকতাম….. সূদুর ভবিষ্যতে একদিন তোমার ক্যারিয়ারের জন্য আমাকে ছুড়ে ফেলে দিবে। কারণ তোমার কাছে ভালোবাসা ও মানুষের চেয়ে তোমার পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। এর জন্য সব জায়েজ তোমার কাছে। একদিন বলেছিলাম সব সহ্য করতে পারি কিন্তু অবহেলা নয়। একা থাকব কিন্তু কারো লাইফে অবহেলার পাত্র হয়ে থাকব না। ”
“অর্ষা, এটা ভুল। আমি বুঝতে পারিনি এতকিছু হয়ে যাবে। সত্যিই বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ।”
দর্শন অর্ষার দু’বাহুতে হাত রেখে বলল। অর্ষা ওকে আবারও ঝারা মেরে সরিয়ে বলল,
“ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি। একদম দূরে। তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়।”
দর্শন ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে রইল। অর্ষা ছলছলে চোখে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“তোমাকে পুরো পৃথিবী দিয়েছিলাম তার বিনিময়ে কী দিয়েছো? একাংশও দাওনি। অথচ দেখো আমি কত বোকা সবটা দিয়ে বসে আছি।”
চলবে…..