#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৮
অর্ষা দর্শনের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে গিয়েছে। ওর আসার একটাই উদ্দেশ্য সেটা হচ্ছে দর্শন কি বলে সেটা জানার। সেদিনের পর আর দর্শনের সাথে দেখা হয়নি। দর্শন হসপিটাল থেকে সরাসরি আসবে। অর্ষা আগে আগে এসে বসে আছে। বুঝতে পারছে না দর্শন কেন ডেকেছে। কিছু বলার থাকলে মোবাইলে বলতে পারত, এভাবে ডাকার কি আছে। এসব ভাবতে ভাবতে দেখল ডাক্তার সাহেব চলে এসেছে। চোখের চশমাটা খুলে অর্ষার দিকে এগিয়ে এল। অনেক দিন পর আবার দর্শনের চোখে চশমা দেখতে পেল। দর্শন অর্ষাকে দেখে এগিয়ে এল। চেয়ার টেনে বসে ওকে এক পলক দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“কেমন আছো?”
অর্ষা দর্শনকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“ভালো।”
দর্শন মৃদু হাসল। তারপর অর্ষার চোখের দিকে চেয়ে বলল,
“তুমি কি সত্যিই অর্ষা?”
“মানে?”
“এই যে ভালো আছো তাই। আমাকে ছাড়া এত ভালো কি করে থাকো? আগে তো একটা দিন ভালো কাটতো না আমাকে ছাড়া। ভালোবাসা বদলে গেলো কী করে?”
অর্ষা ওর প্রশ্নে নির্বাক। বলতে ইচ্ছে করছে সব কিছুই বদলে গেছে। না চাইলেও পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে ভালো থাকতে হয়। ভালো না থেকে উপায় নেই। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না।
দর্শন ওর কাছ থেকে উত্তর আশাও করেনি।
পকেটে থেকে ছোট একটা বক্স বের করল। বক্সটা টেবিলের উপরে রাখল। অর্ষা আড়চোখে ওর কাজ দেখছে। বক্সটা দেখে এর ভেতরে কি আছে কিংবা কেন বের করেছে এর কারণ উদঘাটন করতে পারল না। তাই চুপ করে দেখেও না দেখার ভান করে রইল। দর্শন বক্সটা টেবিলের উপরে রেখে চুপচাপ বসে আছে।
অর্ষার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই প্রশ্ন করল,
“আমাকে ডেকেছো কেন?”
দর্শন বাকা হাসল। তারপর মাথা চুলকে বলল,
“গুড কোশ্চেন। এতক্ষণে একটা কাজের কথা বলেছো।”
দর্শনের এমন রহস্য কিংবা ভনিতা করে কথা বলা অর্ষার মোটেও ভালো ঠেকছে না।
দর্শন বক্সটা খুলে অর্ষার সামনে ধরল। অর্ষা বক্সের ভেতরে একটা রিং জ্বলজ্বল করতে দেখে দর্শনের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। ওর চোখেমুখে বিস্ময়, প্রশ্ন দেখে দর্শন আর ভনিতা করল না। সরাসরি বলল,
“উইল ইউ মেরি মি?”
ওর প্রস্তাবে অর্ষার ভেতরে তোলপাড় হতে লাগল। ইচ্ছে করছে বলতে ইয়েস কিন্তু ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে না। বারবার কে যেন বলছে আবেগে ভেসে যাস না। অর্ষার চোখের কোণে পানি জমেছে। নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
“তোমার মাথা ঠিক আছে? সব জেনেও কি করে এমন প্রস্তাব দিচ্ছো?”
“সব জেনে মানে কি? যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে দু সেকেন্ডর মাথায় মরে যাচ্ছো। জীবন অনিশ্চিত আর খুব ছোট। এই জীবনে সুখী হতে বড় কিছু প্রয়োজন হয় না আর না ভেবেচিন্তে, ঘেটে-ঘুটে সব হয়। আর হ্যা আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আমি সুস্থ, স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।”
“দেখো দর্শন, বয়সটা পাগলামির না। তুমি আগে থেকেই যথেষ্ট ম্যাচুউর। আশা করি এখন আরো ম্যাচুউর হয়েছো। তাই আবেগে ভেসে যেও না প্লিজ। তুমি অপরাধবোধে ভুগছো তাই তো? এখানে তোমার কোন অপরাধ নেই আমি বলছি। আমার সাথে যা হয়েছে সেটা আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে দ্যাটস ইট। এসবে আর নিজেকে জড়িও না। যদি আমার কথা বলো তো বলব আমি ভালো আছি৷ আমি আমার লাইফ নিজের পছন্দ মতো গুছিয়ে রেখেছি। কোন কিছুর প্রয়োজন নেই আমার। আর না কমতি আছে। বিয়ে, সংসার এসবে আমার কোন আসক্তি নেই। আমি যে লাইফ লিড করছি সেটা আমার জন্য একদম পারফেক্ট। তাই প্লিজ আমার জন্য চিন্তা করো না। নিজের লাইফে ফোকাস করো। আর ভালো থাকো। আর হ্যা কখনো, কোনদিন আবেগের বশে কোন সিদ্ধান্ত নিও না।”
দর্শনের কান জ্বলে যাচ্ছিল। রাগে গা রি রি করছে।
“হয়েছে তোমার? তোমার লেকচার শুনতে আমি আসিনি৷ এমন দু’চার লাইনের লেকচার আমিও দিতে জানি। বড় লায়েক হয়ে গেছো? ভালো জব, ভালো স্যালারি ব্যাস মাথায় উঠে গেছো? বড় ম্যাচুউর হয়ে গেছো? আবেগ আর বাস্তবতা আমাকে শেখাচ্ছো? এসব ড্রামা আমার সামনে একদম করবে না। মাথায় রক্ত উঠে যায়। সব সময় তোমার এই লেকচার শুনতে আমার ভালো লাগে না। আমি আজ এসেছি তোমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করতে আর তুমি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছো? আচ্ছা অর্ষা তোমার কি মনে হয় আমার জ্ঞান বুদ্ধি কিছুই নেই?”
“আমি সেটা বলছি না। বলছি আমার নিজের কথা। আমি বিয়েতে ইন্টারেস্টেড নই।”
“কেন নও?”
“কারণ আমি অপারগ। আমি মা হতে পারব না। তাই আমি বিয়ে করতে চাই না।”
অর্ষা দু হাত জোড় করল দর্শনের সামনে। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি পড়ল।
“প্লিজ আমার পিছু ছেড়ে দেও। ভালো লাগে না আমার।”
দর্শন চেঁচিয়ে উঠল,
“কীসের অপারগতা? এত না লায়েক হয়েছো? এত না পড়াশোনা করেছো? তুমি না আধুনিকা? তাহলে তোমার চিন্তাভাবনা এত চিপ কেন? কোন মানুষই পারফেক্ট হয় না। এর মানে এই না সে জীবনের কাছ থেকে কিছুই পাবে না। এর মানে এই না সে সারাজীবন কেঁদে যাবে। সুখী হওয়ার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে। তোমার আছে, আমারও আছে।”
রেস্টুরেন্টে আশেপাশের সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। অর্ষা দর্শনের নাম উচ্চারণ করে আশেপাশে তাকাল৷ দর্শন দেখে অনেকেই ওদের দিকে চেয়ে আছে।
তাই তাড়া দেখিয়ে বলল,
“উঠ, আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”
দর্শন জোর করে অর্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে।
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
দর্শন কিছু না বলে ওকে নিয়ে বের হয়ে গেল। লিফটে চড়ে ছাদে গেল। ছাদে গিয়ে অর্ষার হাত ছেড়ে দিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাদটা আলো করে রেখেছে গুটি কয়েক আলোক বাতি।
“দর্শন, আমাকে এখানে কেন আনলে?”
দর্শনের এমন ব্যবহারে অর্ষা আতংকিত হয়ে আছে। দর্শনের চোখে-মুখে রাগ, জেদ খেলা করছে।
দর্শন পাইচারি করে নিজেকে কন্ট্রোল করছে।
তারপর ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
“দেখো, সুখী হওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য দুটো মানুষের ভালোবাসাই যথেষ্ট। ভালোবাসা থাকলে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।”
দর্শন ওর দু গালে হাত রাখল। ওর হাত নিয়ে নিজের গালে বুলালো। অর্ষার অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে।
“কোন কিছু ফিল করতে পারছো অর্ষা?”
দর্শন ওর আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে ওর হাতের পাতায় ঠোঁট ছুয়ালো। দমবন্ধ হয়ে আসছে অর্ষার। তাই দ্রুত হাত সরিয়ে নিল।
দর্শন কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে ফের প্রশ্ন করল,
“না-কি এখন আর ভালোবাসো না?”
অর্ষা ওর প্রশ্নে চমকে ওর দিকে তাকাল। দর্শন জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু কোন জবাব দিতে পারছে না। ওর কাছে কোন জবাব না পেয়ে মলিন হাসল। তারপর ধীর গলায় বলল,
“ফাইন!”
দর্শন ফাইন বলে পেছাতে লাগল। ওর চোখ অর্ষার চোখেই আঁটকে আছে। এভাবে কেন পিছিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। ছাদের কিনারা ঘেঁষে যেতেই অর্ষার হুশ হয়। ওর বুক কেঁপে উঠল। দর্শন ছাদের কর্ণারে কেন যাচ্ছে। কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে না তো?
“দর্শন, স্টপ! থামো বলছি।”
অর্ষা ওর দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছে। দর্শন থামছেই না। ওর চোখে মুখে কিছু খেলা করছে। ম্লান মুখটায় কিঞ্চিৎ হাসি খেলা করছে। অদ্ভুত সে হাসি।
দর্শন রেলিঙ ধরে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকায়। পুরো দুনিয়া তুচ্ছ লাগছে ঠিক সেদিনের মতো। সেই সকালটার মতো। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। এতগুলো বছর কম কষ্ট পায়নি। আজও পেল আর বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতেও পাবে। দর্শন রেলিঙ ধরে এক পা রেলিঙে তুলে। অর্ষা পেছনে থেকে ওকে ধরে ফেলে।
“কী করছো তুমি? পাগল হয়ে গেছো? আবার একই ভুল কেন করছো?”
অর্ষা ওকে টেনে রেলিঙের কাছ থেকে সরিয়ে আনে।
দর্শন চিৎকার করে বলল,
“কী করব আমি? এভাবে আমি বাঁচতে পারব না। পারব না আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে।”
অর্ষা মেঝেতে বসে পড়ল। বসে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
“নিজেকে অনেক কষ্টে শক্ত করেছি। কেন বারবার দূর্বল করে দেও?”
অর্ষা কেঁদেই চলেছে। ওর কান্না থামছেই না। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। মনের সমস্ত কষ্টকে বৃষ্টি হয়ে ঝড়াবে। দর্শন হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসল। ওর মাথাটা নিজের প্রশস্ত বুকে চেপে ধরল।
“কেন গোপনে কষ্ট পাও? কেন আমাকে কষ্ট দেও? তুমি আমার হলে আমার আর কিচ্ছু চাই না।”
অর্ষা ঘর্মাক্ত মুখটা তুলে বলল,
“কিন্তু তুমি যদি কখনো বদলে যাও?”
“আমি কখনো বদলাব না। প্রমিস। আমি শীঘ্রই দুই পরিবারের সাথে কথা বলব। যত দ্রুত সম্ভব আমি তোমাকে আমার করে নিতে চাই।”
~~~~
অর্ষার ঘুম হচ্ছে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে শুধু ছটফট করছে। দর্শনকে তো ধরা দিয়ে এসেছে। কিন্তু দর্শনের পরিবার? তারা কি বলবে? তারা কি ওকে মেনে নিবে? যদি মেনে না নেয়? যদি সময়, পরিস্থিতি আর বাবা-মায়ের প্ররোচনায় দর্শন বদলে যায়? তাহলে কি সহ্য করতে পারবে?
এসব প্রশ্ন অর্ষার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
সকাল সকাল দর্শন ওকে কল করেছে। তখনও বিছানা ছাড়েনি। ঘুম ভাঙতেই ওর কথা মনে পড়ল। ওর মনটা বেশ ফুরফুরে। কল দিয়েই জিজ্ঞেস করল,
“হ্যালো, অর্ষা কি করো?”
অর্ষা গম্ভীরমুখে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“এত সকালে?”
এই প্রশ্নে দর্শন চুপসে গেল।
“কেন সকাল সকাল কল দিতে পারি না? ”
অর্ষার মনটা অশান্ত হয়ে আছে। রাতে ঘুম হয়নি। তাই মন মেজাজ দুটোই খারাপ। তবুও নিজেকে সামলে বলল,
“না মানে পারো তো। কিন্তু তোমাকে হসপিটালে যেতে হবে তাই বললাম আর কি।”
দর্শনের কাছে অর্ষার কন্ঠস্বর অন্য রকম লাগছে। নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে ভাবছে। মনের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলছে। দর্শন এসব আঁচ করতে পেরে কিছুটা ডিস্টার্ব হলো। অর্ষা কি নিয়ে ভাবছে? সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাবে না তো? আবার দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে না তো? বহু বছর আগে যেভাবে পালিয়েছিল সেভাবে আবার পালাবে না তো?
দর্শন কোন রকমে কল কেটে দিল। সিদ্ধান্ত নিল অর্ষা কিছু করার আগেই ওকে নিজের করে নিবে। ওকে কোন সুযোগ দেবে না।
অর্ষার অফিস শেষে দর্শন ওর জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অর্ষা ওকে দেখে অবাক হলো। কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে এল যে।
অর্ষাকে গাড়িতে বসতে বলল। অর্ষা গাড়িতে ওঠে
বসতেই দর্শন সরাসরি বলল,
“আজকে আমরা বিয়ে করব।”
চলবে…….