#প্রেম_তুমি(দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে সোফায় বসে রইল। প্রিয়া অবাক হয়ে ওকে দেখতে লাগল। কত স্ট্রং মেয়েটা। ওর জীবনে এতকিছু হয়ে গেছে অথচ কেউ জানে না। কাউকে জানায়নি। এতক্ষণ ধরে অর্ষা নিজের জীবনের ঘটনা বলছিল প্রিয়াকে। এক্সিডেন্টের পর ওর জীবনটা কিভাবে পালটে যায় তার নিখুঁত বর্ণনা দিচ্ছিল। সব শুনে প্রিয়া বাকরুদ্ধ। কি বলবে বুঝতে পারছে না। অর্ষা স্বাভাবিকভাবে বসে আছে। প্রিয়া ওর চোখের দিকে তাকাল। “যখন মুখ দেখে কারো ভেতরে কি চলছে বুঝা না যায় তখন তার চোখের দিকে তাকাতে হয়। চোখ সবকিছু বলে দেয়। যদি তা বোঝার ক্ষমতা থাকে।”
অর্ষার ব্যথিত চোখ ভেতরের ব্যথা জানান দিচ্ছে। প্রিয়া ভালো করে অর্ষাকে দেখল। দেই লম্বা পাতলা শরীর , মেয়েটা মনে হচ্ছে আগের মতোই আছে। উহু, মুখশ্রী হালকা বদলেছে, ম্যাচুরিটি এসেছে মুখে। ছোট চুলগুলো বড় হয়েছে। তবে কালো কেশী কন্যা নয়। লালচে চুল। মেক আপ আর ড্রেস আপ সেন্স চেঞ্জ হয়েছে। পায়ে হাই হিল। পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে।
“কিন্তু তোকে তো সবাই ভুল বুঝেছিল। এখনো হয়তো ভেবে বসে আছে।”
অর্ষা প্রিয়ার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
“তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কারো ভাবনা আমাকে খুশি দেবে না। যদি দিত তবে কেয়ার করতাম। আমাকে ভালো রাখবে আমার চিন্তা-ভাবনা, আমার কাজ। আর আমি ভালো থাকতে চাই।”
“অর্পা আপুর সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়। কিছুদিন আগে শপে রুশান ভাইয়ার সাথে দেখা হয়। জানিস উনি আগের মতোই আছে হাসোজ্জল সেই মুখ, সেই কথা বলার ভঙ্গি। তবে শুনে খারাপ লাগল যে অর্পা আপু আর রুশান ভাইয়ার ব্রেক আপ হয়ে গেছে।”
“কোন কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়।”
“তোর একা লাগে না?” প্রিয়া উত্তরের আশায় ওর দিকে অতি আগ্রহের সাথে চেয়ে রইল।
অর্ষা প্রিয়ার আগ্রহ বুঝতে পারল। মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“উহু, যখন তুই একাকীত্বকে উপভোগ্য করে তুলতে পারবি, নিজের আয়ত্তে আনতে পারবি তখন তোর কাছে একাকীত্বের চেয়ে মধুর আর কিছুই লাগবে না।”
প্রিয়া অবাক হয়ে ওকে দেখছে। এই মেয়েটা ছোটখাটো ব্যাপারে কেঁদেকেটে ভাসাত সে এখন কত শক্তপোক্ত কথা বলে। কতটা বদলে গেছে। ওর সাথে প্রাণখুলে কথা বলতে পারছে না প্রিয়া। কেমন সংকোচ লাগছে। মনে হচ্ছে এ যেন অন্য কেউ।
“দর্শন ভাইয়াকে মনে পড়ে না?”
অর্ষা একটু থমকে গেল। প্রিয়ার চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“এই সাত বছরে কতকিছু হয়েছে সব কি মনে রেখেছি? কতজন লাইফে এসেছে কতজন গিয়েছে ক’জনকে মনে পড়বে?”
এর উত্তরে কি বলা উচিত জানা নেই প্রিয়ার। তাই অর্ষাকে আর কোন প্রশ্ন করল না। অর্ষার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে। তবে সেগুলো প্রিয়ার কাছে স্বাভাবিক না। কেন জানি মনে হচ্ছে অর্ষা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না বরং প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছে।
অর্ষা প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“তো কী করিস আজকাল?”
“একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করছি তিন-চার মাস।”
অর্ষা বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
“ওহ ভালো। মন দিয়ে কাজ করিস। আজ আমি আসি।”
প্রিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
“কোথায় যাবি এখন?”
“খালা মনির বাসায়।”
“সে তো সিলেটে থাকে।”
“কিন্তু তার বাসা তো ঢাকাতেই ছিল। খালুর চাকরিসূত্রে সিলেটে থাকত। খালু এখন অবসরপ্রাপ্ত। খালাতো ভাইবোনেরা বড় হয়েছে। তারা জব করছে। এখন তারা ঢাকায়ই থাকেন। এখন তাদের বাসায়ই উঠব। একা কোথাও থাকতে ইচ্ছে করে না। কানাডাতেও চাচা চাচির সাথে থেকেছি।”
“হুম। কানাডা যাওয়ার আগে তাদের কাছে ছিলি নিশ্চয়ই ভালো বুঝাপড়া আছে। আগে তো নিজের বাসা ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারতি না।”
“এখন পারি। বড় হয়েছি না?”
“হ্যা, অনেক বড় হয়ে গেছিস। এতটা বড় হয়ে যাবি কল্পনাও করিনি। যাইহোক এখন কী করার প্ল্যান?”
“উমম,, পরিচিত কয়েকটা কোম্পানি আছে সেখানে কথা বলে দেখব। অলরেডি কয়েক জায়গা থেকে অফার পেয়েছি। আগে দেখি কোনটা পছন্দ হয়। কাজের সাথে আপোষ করব না। পছন্দসই জায়গায় পছন্দমতো কাজ করব।”
প্রিয়ার মনে পড়ল অর্ষা কোন সাবজেক্টে পড়েছে সেটাই জানে না। জানলে হেল্প করতে পারত।
“কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়েছিস অর্ষা?”
“আমি ইঞ্জিনিয়ার। আর্কিটেক্ট।”
প্রিয়া চোখ বড়বড় করে ওর দিকে তাকাল।
“ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিস তুই?”
“হ্যা।”
“মাশাল্লাহ! মাশাল্লাহ।”
প্রিয়া উৎফুল্ল হয়ে বলল।
“আজ তাহলে যাই। আবার দেখা হবে। কল করব তোকে।”
“নাম্বার পাবি কই?”
“আছে তোর নাম্বার। সমস্যা নাই।”
…….
অর্ষা ওর খালার বাসায় যেতেই সবাই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এত দেরি কেন হলো? ও ল্যান্ড করেছে সকালে আর এসেছে এই ভর সন্ধ্যায়। এতক্ষণ কই ছিল এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অর্ষা ক্লান্ত। বড় খালার এক ছেলে এক মেয়ে। দু’জনই ওর বড়। খালাতো বোন বিবাহিত আর খালাতো ভাই জব করছে। আজ ওর আসার খবর শুনে খালাতো বোন আয়েশা ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে এসেছে। বাচ্চা দুটো অর্ষাকে পাগল করে ফেলছে। অর্ষা হাঁপিয়ে গিয়ে বলল,
“আপু এই ক্যাসেট দুটো কী করে সামলাও?”
“সেটা বুঝতে হলে তোকে বিয়ে করতে হবে। শুধু বিয়ে করলেই হবে না। দুটো বাচ্চা পয়দা করতে হবে তাহলেই বুঝতে পারবি কি করে সামলাই।”
“ওহ নো! আমার বোঝার দরকার নেই।”
তখনই আয়াশ অফিস থেকে ফিরেছে। সোফায় বসে অর্ষাকে গল্প করতে দেখে অপলক চেয়ে আছে।
“হেই! অর্ষা! কেমন আছো?”
অর্ষা আয়াশকে দেখে মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আহারে! অফিস করে কি হাল! ঘেমে নেয়ে একাকার।”
আয়াশ অর্ষার ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে বলল,
“ঘাম মোছার জন্য তুমি আছো না? চলে এসেছো আর কীসের টেনশন!”
“ওয়াক! খালা মনি তোমার ছেলেকে কিছু বলো। আমার ওড়না নষ্ট করে ফেলল। ছি! কি গন্ধ! ওয়াক!”
ওর খালা মনি তেড়ে এল ছেলের দিকে।
“তুই সব সময় এমন করিস মেয়েটার সাথে। আসতে না আসতেই জ্বালাতে শুরু করেছিস।”
“মাত্র তো শুরু করেছি আম্মু। আগে আগে দেখো হতা হে কেয়া।”
আয়াশ দৌড়ে উপরে চলে গেল। আয়েশা হাসছে ওদের কাহিনি দেখে। অর্ষাও গাল ফুলিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আয়েশা ফাঁক পেয়ে মা’কে বলল,
“দুটোকে এইবার এক করে দেও। হলো তো অনেক অপেক্ষা।”
“হ্যা, অপেক্ষার অবসান হয়েছে। আমার বোনের মেয়ের দায়িত্ব আমিই নেব।”
চলবে________